#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৬
#ফারহানা ইয়াসমিন
“এসব তুমি কি বলছো? এতো বড় একটা অন্যয় হয়ে গেলো মেয়েটার সাথে তারপরও তুমি আবার ওকে ওই দঙ্গলে পাঠাতে চাইছো? না না এবার আমি আমার মেয়ের সাথে এতোবড় অন্যায় কিছুতেই হতে দেবোনা। রুহি কিছুতেই ও বাড়ি ফিরে যাবে না।”
দিলারা দরজা থেকে প্রায় ছুটে এলেন ঘরের ভেতর। রুহি অবাক হয়ে ওর বাবাকে দেখছে। বাবা যেন পাল্টে গেছে একরাতে। যে বাবা ওর বিয়ে দিয়ে অনুতপ্ত ছিলো, বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছেদ করলো ওর কারণে সেই বাবা হঠাৎ করে পাল্টে গেলো কি করে? ইয়াকুব বিরক্ত হয়ে স্ত্রীকে দেখলো-
“দিলারা,,ওটা দঙ্গল নয় রুহির শশুর বাড়ি। ও বাড়িতে ওর পুরো অধিকার আছে। আর তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন আমি ওর বাবা নয় শত্রু।”
দিলারা আগের চাইতে দ্বিগুণ মেজাজ নিয়ে তেড়ে এলো ইয়াকুবের দিকে-
“দেখো, একবার মেয়েকে নিয়ে যা খুশি করেছো কিছু বলিনি। অনেক কষ্টে আমার মেয়ে সব ভুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এখন আবার তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবোনা কিছুতেই।”
ইয়াকুব আলী এমনিতে ঠান্ডা ধাতের মানুষ কিন্তু কেউ তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে তার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। কারন তিনি মনে করেন, তিনি সবসময় যৌক্তিক কাজটাই করেন। অযাচিত কোন কিছুই কারো উপর চাপিয়ে দেন না। সেখানে তার কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধচারন করা মানেই তাকে ভুল ভাবা যেটা তিনি সহ্য করতে পারেন না। এই মুহূর্তে দিলারার উপর তার ভীষণ রাগ হলেও নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করলেন-
“শোন দিলারা যা বলেছ বলেছ আর বোলো না। আমি আমার মেয়ের ভালো চাইবোনা তো কে চাইবে? নিজের মেয়ের জন্য নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এই শহরে এসে পড়ে আছি কি শখ করে? এরপরেও তুমি বলছো আমি মেয়ের ভালো ভাবি না?”
“হ্যা ভাবোনা। ভাবলে এমন কথা বলো কি করে? যে মানুষটার পাঁচ বছর কোন খোঁজ ছিলো সে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে আমার মেয়ের জীবনের দখল নিতে চায়? মেয়ে বলে কি মানুষ না? তোমার মেয়ের মুল্য এই তোমার কাছে?”
দিলারা ফুঁসে উঠলো। ইয়াকুব আলী স্ত্রীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন না। রুহি শুন্য দৃষ্টি মেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা মায়ের ঝগড়ার কোন কিছু তার মাথায় ঢুকছে না। তার কেবল মনেহচ্ছে শুভর কি হবে? যদি তার বাধ্য হতে হয় কোন কারনে তবে শুভর কি হবে? এই ছেলেটা একনিষ্ঠ ভাবে তাকে ছায়া দিয়ে গেছে এতোগুলো দিন। রুহিকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস জুগিয়ে গেছে। একটু একটু করে রুহির মনের শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে পানি দিয়ে দিয়ে নরম কাঁদামাটি বানিয়েছে। ভঙ্গুর নড়বড়ে রুহিকে প্রতিনিয়ত মোটিভেট করতে করতে রুহির মনে নিজের নামের চারাগাছ রোপণ করেছে। এই এতোদিন পর এসে রুহির মনটাও যেন একটু চাষাবাদের উপযোগী হয়ে উঠেছে। উর্বর মনের মধ্যে শুভ নামক উদ্ভিদের বীজ রোপণ হচ্ছে। রুহি আর কিছু ভাবতে পারছে না। তীব্র উদ্বেগের একটা ঢেউ আঘাত হানছে শরীর মনে। হঠাৎ শরীরে ঝাঁকি খেয়ে সম্বিৎ ফিরে সামনে বাবাকে দেখতে পেলো রুহি। ঠোঁট নড়ছে বাবার, মানে কিছু একটা বলছেন অথচ রুহির কানে কিছুই ঢুকছে না। কেবল ট্রেনের হুইশেলের শব্দ যেন গন্তব্যে আসার আগেই ক্রসিং পড়া। তারপর আধাঘন্টার যাত্রা বিরতি। রুহির চোখে আঁধার নেমে আসলো।
★★★
“মারে, আমার কথাগুলো কি তুই মন দিয়ে শুনবি? তারপর তোর যা ভালো মনেহয় তাই না হয় করিস?”
জ্ঞান ফেরার পরে নিজের শিওরের কাছে বাবাকে বসে থাকতে দেখে রুহি তড়িঘড়ি উঠে বসতে চায়। ইয়াকুব আলী মেয়েকে শুয়ে থাকতে বলেন। রুহি সে কথা কানে না তুলে উঠে বসতেই ইয়াকুব আলী রুহির হাত ধরে কথাগুলো বললেন।
“বাবা, এভাবে বলছো কেন? কি বলতে চাও বলো না। তোমার সব কথা আমি শুনবো।”
কথা বলতে যেয়ে রুহির গলা ধরে আসে। মাঝে মাঝে পরিবেশ পরিস্থিতি এতোটা অসহায় হয়ে যায় যে মনের বিরুদ্ধচারন করতে হয়। এই মুহূর্তটা সেরকম। বাবার কোন কথাই শুনতে মন চাইছে না তার। রুহি অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। দিলারা মুখচোখ শক্ত করে বসে আছে। রুহির জ্ঞান ফেরার পরে একটা কথাও বলেনি নিজ থেকে। ইয়াকুব আলী গলা পরিস্কার করে নেন-
“মারে, অল্প বয়সে তোকে বিয়ে দিয়েছি বলে হয়তো সারাজীবন তোর কাছে দোষী হয়ে থাকবো কিন্তু আমি কি খুব ভুল কিছু করেছি? আমার তিন মেয়ে, বাবা হিসেবে মেয়েদের ভালো পাত্রস্থ করা আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকে আমি কিছু ভেবেছিলাম। ভেবেছি বড় মেয়ের জামাই ভালো বংশ, ভালো পরিবারের হলে বাকীদের পথ পরিস্কার হয়। তাই তোর আশরাফ চাচার সাথে দেখা হওয়ার পর যখন তার ছেলের জন্য তোর প্রস্তাব দিলো আমি সানন্দে লুফে নিলাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে জানতাম ওরা বনেদী ব্যবসায়ী বংশের। এরকম পরিবার থেকে তোর বিয়ের প্রস্তাব আসাতে বাকী কিছু ভাবিনি আমি। আশরাফ ভালো ছেলে, ওর সন্তান ভালো হবে এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ওর ছেলে এমন কাজ করার পরে আমার ভুল ভাঙলো। আমি তোকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম পরেরদিনই। আশরাফকেও বলে দিলাম তুই আর ফিরে যাবি না। তালাকের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে বললাম। আশরাফ সেদিন আমাকে কিছু না বললেও আমার অফিসে এসেছিলো দিন দুয়েক পর। আমার হাত ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করলো। প্রায় তিনঘণ্টা ধরে আমাকে বুঝিয়ে হাতে পায়ে ধর আমার থেকে কথা নিলো।”
ইয়াকুব আলী থামতেই রুহির চোখে কৌতুহল ফুটে উঠলো, ভেতর ভেতর ঘামছে সে। বাবা আসলে কি কথা দিয়েছে? তাহলে এই যে চিটাগং ছেড়ে ঢাকায় আসা এসব কি আশরাফ আঙ্কেলের ইচ্ছায়? দিলারার তর সইলো না, সে বলেই ফেললো-
“কি কথা দিয়েছিলে? আমার মেয়ে অনন্তকাল তার ছেলের পথ চেয়ে থাকবে এই তো?”
“আহ থামোতো! কথার মাঝে কথা বলোনা। আমি আগে শেষ করি তারপর যতখুশি কথা বলো।”
দিলারা ফোঁস করে উঠতে চাইলে রুহি মাকে ইশারায় শান্ত থাকতে বললো। ইয়াকুব আলী নিঃশ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলেন-
“অন্তত পাঁচ বছর রাযীনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যদি পাঁচ বছরের মধ্যে রাযীন না ফেরে তাহলে তুই ডিভোর্স ওর আবেদন করলেই ডিভোর্স পেয়ে যাবি। আর যদি এই পাঁচ বছরের মধ্যে রাযীন ফিরে আসে, সংসার করতে চায় তবে তোর তার সাথে ফিরতে হবে। একবার অন্তত সুযোগ দিতে হবে রাযীনকে। সুযোগ দেওয়ার পর তোর যদি মনেহয় সে সংসার করার যোগ্য না হয় তাহলে তুই ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবি। কিন্তু সু্যোগ তাকে দিতেই হবে এবং সেটা মন থেকে।”
রুহি পাথরের মতো মুখ করে বাবার কথা শোনে। ওর চেহারা দেখে বোঝার উপায় নাই মনে কি চলছে। অথচ রুহির হাতপা অসার হয়ে আসছে ভবিষ্যৎ চিন্তায়। মনের মধ্যে ঘুর্নিঝড় সব লন্ডভন্ড করে ফেলতে চাইছে। ক্ষনে ক্ষনে শুভর মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ও কি কিছু বুঝতে পেরেছিল? এইজন্য বুঝি বারবার বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছিলো?
“আমি জানি তুই এখন শুভকে নিয়ে ভাবছিস।”
রুহি চমকে বাবার মুখের দিকে তাকালো। ওর বাবা ঠিক ওকেই দেখছে আঁখি পেতে-
“শুভ ভালো ছেলে রুহি। ওকে নিয়ে ভাবায় দোষের কিছু নেই। ওকে জামাই হিসেবে পেলে যে কেউ বর্তে যাবে। কিন্তু মারে, আমি যে তোর চাচাকে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম? বাবার মুখের কথাকে ফেলনা করে দিস নারে মা। গতকাল রাযীন এসেছিলো আমার কাছে। সে তার ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। এবার ভুল সংশোধন করার জন্য সুযোগ চায় একবার। তাকে সুযোগ না দিলে যে পাপ হবে আমার? আল্লাহর দরবারে দায়ী থেকে যেতে হবে চিরটাকাল। মারে, তুই কি তাই চাস? তোর বাবাকে আখিরাতে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাস?”
“বাবা!”
রুহি আর্তনাদ করে উঠলো-
“সব জানার পরও এভাবে বলছো?”
এই প্রথম নিজেকে সামলে রাখতে পারে না রুহি। ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। কি করে শুভকে দূরে ঠেলে দেবে? যে মানুষটার কারনে আজ সুস্থ ভাবে বেঁচে আছে তাকে কি করে ভুলে যাবে? শুভ এতো আশা করে আছে ওর মন ভাঙবে কি করে? কারো মন ভাঙাও তো গুনাহের কাজ? বাবা কি একটুও বুঝতে পারছে না সে কি বলছে? বাবার কাছে নিজের কথা দেওয়াটাই বড় হয়ে গেলো? রুহির মনের আর্তচিৎকার ওর বাবার কান অবধি পৌঁছে না। ইয়াকুব আলী রুহির হাত আঁকড়ে ধরে-
“মারে, অন্য কারো জন্য না শুধু আমার জন্যই না হয় একবার ফিরে যা রাযীনের সাথে? মন থেকে চেষ্টা কর না হয় সংসার করার?”
রুহি গুমরে উঠলো-
“এ কি করেছো তুমি বাবা? এইজন্যই আমাকে ডিভোর্স নিতে দাওনি? তাহলে কি ঢাকায় আসা, নিজের চির পরিচিত স্হায়ী জায়গা ছেড়ে আসা সবই মিথ্যে নাটক? সবই তোমার এই কথা দিয়ে কথা রাখার চেষ্টা? বাবা হয়ে মেয়ের সাথে এ কেমন ধোঁকা? এরপর জীবনে আর কাকে বিশ্বাস করবো বাবা?”
ইয়াকুব আলী ছটফট করে ওঠেন-
“মারে, এভাবে বলে আমাকে আর ছোট করিস না। আমি ভেবেছিলাম রাযীন বুঝি আর ফিরবে না। অপেক্ষায় ছিলাম পাঁচ বছর হওয়ার। কিন্তু মন্দ কপাল, আমার ভাবনা ভুল প্রমান হলো।”
রুহির চোখে শ্রাবনঢল ঠোঁট কাঁপছে তিরতির যেন প্রচন্ড শীত করছে তার এমনভাবে গা কাঁপুনি দিচ্ছে-
“কিন্তু আমি যে ফিরতে পারবোনা বাবা? কিভাবে সম্ভব বাবা? নিজেকে বারবার কি করে খন্ড খন্ড হতে দেই? আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করলে বাবা!”
চলবে—
©Farhana_Yesmin