#না চাহিলে যারে পাওয়া যায় শেষপর্ব

0
1229

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায় শেষপর্ব
#ফারহানা ইয়াসমিন

কখনো কখনো সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে দূরত্ব জরুরি হয়ে যায়। এই কথাটা আশরাফ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে। তাই মনে কষ্ট হলেও আফজালদের চলে যাওয়ার ব্যাপারে মনকে শক্ত করেছেন। রোজী অনেকবার বুঝাতে চেয়েছে কিন্তু আশরাফকে টলানো যায়নি। তাছাড়া কাছে থাকলে শিখা আবার এমন করবে না তার গ্যারান্টি কি? শিখার মধ্যে তো অনুতাপ নেই। কাজেই এরকম শত্রুকে কাছে রেখে সংসারের সুখশান্তি বিনষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আফজালরা চলে যাওয়ার আগেই ঝিলিক এ বাড়ি থেকে বিদায় নিলো। আশরাফ জানতে চাইলো-
“কেন চলে যাচ্ছিস মা? আমাদের উপর রাগ করেছিস?”
“না বড় আব্বু, রাগ করবো কেন? আসলে সৌরভের সাথে মনের মিল হচ্ছে না। এডজাস্ট করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এভাবে আমার দমবন্ধ লাগছে। অনেকদিন তো হলো এবার নিশ্চয়ই নিজের মতো করে বাঁচতে চাইতে পারি আমি?”
ঝিলিক যথেষ্ট বিনয়ের সাথে কথাগুলো বলে।
“সমস্যা কি আমাকে খুলে বলা যায়?”
আশরাফ শেষ বারের মতো চেষ্টা করলো ভাঙন ঠেকাতে। এ বাড়ির সব ঐতিহ্য একে একে ভেঙে যাচ্ছে বলে বুকের ভেতর ব্যাথা টের পাচ্ছেন। সৌরভ গনগনে দৃষ্টিতে ঝিলিককে দেখছে। ঝিলিক সৌরভের সামনে আর কথা বাড়াতে চাইলো না-
“না বড় আব্বু, এসব নিয়ে বলে কোন লাভ নেই। আর আমি চাই না কোন চাপে পড়ে সৌরভ নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করুক। যে নিজ থেকে এতোদিনেও পরিবর্তন হয়নি এরপর তার পরিবর্তনে আমার কিছু যায় আসে না। এই সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি টানছি। আপনি প্লিজ এসব নিয়ে ভেবে কষ্ট পাবেন না বড় আব্বু। আর আমাকে কোন অনুরোধও করবেন না। আমি চাই না আপনারকে কোনভাবে অসম্মান করি।”
“বেশ। আর কিছু বলবো না আমি। তুই যেভাবে ভালো থাকিস সেভাবেই চল।”
ঝিলিক মাথা নেড়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ছাড়লো। শিখা বেশ অসন্তুষ্ট হলো সৌরভের উপর। ঝিলিক মেয়েটা ভালো ছিলো ওকে কেন সৌরভ ধরে রাখতে পারলোনা? ছেলেকে বকে দিলেন বেশ করে কিন্তু তাতে কোন ফায়দা হবেনা। ঝিলিক তো আর ফিরবে না? সৌরভ অবশ্য বোকা বনে গেছে। সে কিছুতেই ভাবেনি ঝিলিক সত্যি সত্যি তাকে ছেড়ে চলে যাবে। অনেকবার এমন কথা বললেও বাপের বাড়ি ঘুরে আবার ঠিকই ফেরত এসেছে। সৌরভ ভেবেছিলো এবারও সেরকম কিছু হবে। কিন্তু ঝিলিক যখন বড় আব্বু আর বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলো তখন বুঝলো যে এবার আর ঝিলিক ফান করছে না। যদিও এখন সে মনে মনে তিরস্কার করছে ঝিলিককে। যাচ্ছে যাক, কতোদিন টিকতে পারবে বাবার বাড়ি দেখা যাবে। ওর বাবা যখন সামাজিকভাবে হেনস্তার স্বীকার হবে তখন ঠিকই এ বাড়িতে ফিরতে হবে ঝিলিক কে। সৌরভ হাসলো, এইবার নাকে খত দেওয়াবে যদি ঝিলিক ফিরতে চায়। তারপর বুঝবে কতো ধানে কতো চাল।

শুভ এ বাড়ির থেকেই বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আপাতত নতুন করে জীবনে থিতু হওয়ার চেষ্টা করবে। কাজেই নাসিরাবাদের বাড়িতে কেবল শিখা আফজাল আর সৌরভ গেলো। পুরনো ভৃত্যরা কেউ শিখার কাছে যেতে রাজি নয়। তবুও একজনকে প্রায় জোর করে সাথে পাঠালেন রোজী। শিখা মর্জিনাকে নিতে চাইলেও সে যাবে না কিছুতেই। রাহিকে সেই ছায়ার মতো আগলে রাখে কিনা, ভীষণ মায়া পড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো আফজালের। সে অযথাই ভুক্ত ভোগী পুরো ঘটনায়। সে মুখে কিছু না বললেও প্রায় দিনই অফিস শেষে পৈতৃক নিবাসে এসে বসে থাকেন। রাত করে নিজের ডোরায় ফিরেন আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। শিখা নিজের ইগোকে পাশ কাটিয়ে সরির মতো ছোট্ট শব্দ বলার ক্ষমতা অর্জন করেনি বিধায় প্রায় একাকি জীবন কাটাচ্ছে। এইটুকু শাস্তি মনেহয় তার পাওয়া। অযথাই মনে যে কুটিলতার জায়গা দিয়েছিলো তার জন্য এটুকু সাফারার তো তাকে হতেই হবে। আর ঝিলিক সত্যি সত্যি যখন ডিভোর্স লেটার পাঠালো সৌরভ বুঝলো ঝিলিক এবার আর ফিরবে না। সে আর ঝামেলা না করে ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিলো। সৌরভ এখন বাধাহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। একটা ছন্নছাড়া জীবন তার অথচ এমন হবে সেটা মনেহয় সে ভাবেনি আগে।

★★★

বছর তিনেক পর এক সন্ধ্যায়

সারা ঘর রবীন্দ্র সংগীতের সূরের মুর্ছনায় মাতোয়ারা। রুহি গান শুনছে, মিটিমিটি হাসছে আর ঘর সাজাচ্ছে। মাঝে মাঝেই পেটে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দিচ্ছে। আজ ডাক্তারের কাছে গেছিলো। বাচ্চার পাঁচমাস পূরণ হয়ে ছয়ে পড়েছে। জেন্ডার জানার পর থেকে মনটা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে রুহির। রাযীন শুনলে কি করবে তাই ভেবে এখন থেকেই মনটা খুশিতে বাকবাকুম করছে। পুরো ঘরটা ডেকোরেট শেষে দেখলো একনজর। নাহ, দারুণ হয়েছে সাজানো। রাহি আর রাহির বাবা দু’জনেই খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই? রুহি শান্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসলো। আজ রাহির তৃতীয় জন্মবার্ষিকী। রাত বারোটায় নিজেরা মিলে কেক কাটা হবে আর আগামীকাল বড়সড় অনুষ্ঠান করা হবে। দেখতে দেখতে ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে। রুহির চোখ বুজে পুরনো দিনের কথা ভাবছে৷ রাযীনের সাথে বিয়ের বয়স দশ বছরের। প্রথম পাঁচ বছর বিবাহিত ব্যাচেলর তারপর দু’বছর নরমাল দিনযাপন। তবে গত তিনবছর ধরে দূর্দান্ত ভালোবাসাময় জীবন কাটাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার চাইতে সুখী স্ত্রী আর কেউ নয়। কি দেয়নি রাযীন তাকে? বিয়ের পরের না পাওয়া দিনগুলো এই ক’বছরে সুদে আসলে উসুল করেছে। যখন থেকে বুঝেছে সে রুহিকে ভালোবাসে তখন থেকেই যেন নিজেকে রুহিতে বিলীন করেছে। এতো ভালোবাসা দিয়েছে রুহিকে যে আগের সবকিছুর জন্য রাযীনকে মাফ করে দিয়েছে। রাহির ছয়মাস পূর্ণ হওয়ার পর ওরা তিনদিনের হানিমুন ট্যুরে সুইজারল্যান্ড গেলো। রাহি তখন দাদা দাদীর সাথে বাংলাদেশে ছিলো। বাচ্চা ফেলে যেতে না চাইলেও রাযীনের সাথে পেরে ওঠেনি। সত্যি বলতে ও’ই তিনদিনের স্মৃতি সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি রুহির কাছে। নতুন প্রেমিকার মতো রাযীন যেভাবে ওকে ট্রিট করেছে তার তুলনা হয় না। এই লোক এরপর একদিনের জন্যও ওকে ফেলে কোথাও যায়নি এমনকি কোন বিজনেস ট্রিপেও না। আশ্চর্য পাগল একটা! এতো ভালোবাসা এতোদিন কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিলো আল্লাহ জানেন।

“বাব্বাহ, এতো খুশি? বলি চেহারার এই উজ্জ্বলতার কারন কি? দিন দিন এতো সুন্দর হচ্ছেন কেন ম্যাডাম? আপনার রুপে আমাকে কি মেরে ফেলার তাল করছেন?”
কপালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই রুহি চোখ মেলে চাইলো। অফিস থেকে ফিরে এরই মধ্যে শাওয়ার নিয়ে ট্রাউজার আর গেঞ্জি পরে নিয়েছে রাযীন। ভেজা পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে মন চাইছে রুহির। রুহির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে রাযীন। রুহি মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললো-
“আপনি কখন এলেন? আমি টের পেলাম না যে?”
“টের পাবে কিভাবে সুখস্মৃতি বিলাস করছিলে যে?”
রাযীন ঠোঁট টিপে হাসলো। রুহির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো-
“আজ ডাক্তারের কাছে গেছিলে না? কি বললো ডাক্তার? আমার মেয়েটার সবকিছু ঠিক আছে তো?”
রুহির গালের রক্তিম আভা বলে দিচ্ছে সব ঠিক আছে। তবুও ওর মুখ থেকে সব শুনতে চায় রাযীন। রুহি নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলো-
“মেয়ে আছে একথা কে বললো আপনাকে?”
“আমি জানি তো আমার মামনি আসছে। মনে আছে তো কি কথা হয়েছিলো আমাদের মধ্যে?”
রুহি না জানার ভান করে-
“কি কথা হয়েছিলো আবার? কোন কথা হয়নি।”
রাযীন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো-
“তারমানে সত্যিই মেয়ে আছে? ইয়েস ইয়েস।”
রুহি লজ্জায় লাল হতে হতে জবাব দিলো-
“দেখেন আর পারবোনা আমি। এবারই শেষ আর না প্লিজ!”
“এহহহ, বললেই হলো? তোমার সাথে বাজি ধরেছিলাম মেয়ে হলে আরেকটা বেবি নেবো। তুমি রাজি হয়েছিলে এবার না করলে শুনবো না।”
রাযীন হইহই করে উঠলো। রুহি যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে-
“অসভ্য লোক একটা। এখনো মেয়েটা ঠিক ঠাক দুনিয়ায় এলোই না তার আগেই আরেকটার প্ল্যানিং করছে।”
রুহি রেগেমেগে রাযীনের দিকে তেড়ে আসতেই রাযীন ওকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কপালে গালে পরপর কয়েকটা ভালোবাসাময় স্পর্শ দিতে দিতে বললো-
“তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো রুহি। আমাকে এতেবড় উপহার দিচ্ছ তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার মেয়ের মায়ের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা মিসেস রাযীন। তোমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি।”
“কতো ভালোবাসেন তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আরেকবার এই পেইন দিতে চাচ্ছেন।”
নিজের পেটের দিকে ইশারা করলো রুহি। রাযীন রুহিকে মন দিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ তারপর বললো-
“আচ্ছা যাও আর লাগবে না। আমার মেয়ে পেয়ে গেলে আর কাউকে লাগবে না।”
রুহি ঠোঁট ফুলিয়ে অবাক হয়ে বলে-
“কাউকে লাগবেনা? আমাকেও না?”
রাযীন মিটিমিটি হাসতে হাসতে মাথা নাড়তেই রুহির চোখ ছলছল-
“এই আপনার ভালোবাসা?”
রাযীন মাথা নাড়তেই রুহি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে রাখে অন্যদিকে। তা দেখে রাযীন হো হো করে হাসলো। তারপর রুহির সামনে যেয়ে দু’হাতের আজলায় রুহির মুখটা তুলে ধরলো। গভীর ভালোবাসার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অনেকটা সময়। তারপর ধীর কন্ঠে বললো-
“না চাইতে তোমাকে পেয়েছিলাম বলেই হয়তো বুঝতে পারিনি কি পেয়েছিলাম। শুকরিয়া আল্লাহর যে দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছি তুমি আমার জীবনে কি। অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পরে যা পাওয়া যায় তা আসলে অমুল্য। আর আমার জীবনের এই অমুল্য সম্পদ হলে তুমি। আমার বাকী জীবনের সমস্ত ভালোবাসার প্রথম হকদার শুধু তুমি তারপর আমার সন্তানেরা। আর কখনো আমার ভালোবাসা নিয়ে ডাউট করোনা প্লিজ।”
রাযীনের ভালোবাসাময় বাক্যে রুহির চোখের কোলে জলের আভাস। এতো ভালোবাসে কেন লোকটা তাকে? রুহি রাযীনের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে বলে-
“কোন ডাউট নেই। আপনি আমাকেই ভালোবাসেন যেমনটা আমি আপনাকে। বাকী জীবন এভাবেই সুখে দুঃখে পাশাপাশি চলতে পারলেই আমি খুশি, এ জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। আপনি বাকী জীবন এভাবেই ভালোবেসে আমাকে আগলে রাখবেন প্লিজ।”
“তা আর বলতে? তোমাকে আগলে রাখবো না তো কাকে রাখবো?”
রাযীন আলগোছে দু’হাতে আগলে বুকে জড়িয়ে নেয় রুহিকে। রুহিও পরম নির্ভরতায় আরেকটু সেধিয়ে যায় রাযীনের বুকে। অডিও প্লেয়ারে তখন রবীন্দ্র সংগীত বাজছে-
‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবসে সে ধন হারায়েছি
আমি পেয়েছি আঁধারও রাতে
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’

সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin

(যারা এতোদিন ধৈর্য্য ধরে গল্পটি পড়েছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন আর আমাদের দোয়ায় রাখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here