#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব৩৩
#ফারহানা ইয়াসমিন
পুরো আঠারো ঘন্টা প্রসব বেদনা সহ্য করে অবশেষে হাসপাতালে যাওয়ার একদিন পর বিকেল পাঁচটা নাগাত একটি ফুটফুটে ছেলে শিশুর জন্ম দিলো রুহি। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে রুহির, ঘুম ঘুম চোখে ছেলেকে একনজর দেখেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। রোজী খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এলেন, নাতি কোলে নিয়ে কেঁদে দিলো। মাঝের বছরগুলো এতো খারাপ কেটেছে যে এমন সুখের ভাবনা মাথাতেই আসেনি। ভেবেছিলেন জীবন বুঝি এমনই নিরানন্দে কেটে যাবে। হঠাৎ এমন প্রাপ্তিতে পুনরায় সবকিছু আগের মতোই লাগছে। মনেহচ্ছে বাড়িটা আবারও কচিকাঁচার কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠবে, আনন্দবাড়ি হয়ে উঠবে। শিশুটিকে কোলে নিয়ে তার মনেহলো জীবনটা অনেক বেশি সুন্দর আর এই কচি মুখ দেখে অনেকদিন বেঁচে থাকা যাবে। রোজী মুখে হাসি আর চোখ ভর্তি জল নিয়ে সদ্য পৃথিবীতে আগমন করা শিশুদির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রোজী জোর করে শিশুটিকে রাযীনের কোলে তুলে দিলেন। নরম তুলতুলে শিশুটিকে কোলে নিতেই রাযীনের চেহারার ঔজ্জ্বল্য দেখার মতো হলো। এতোদিন যেমনই মনে হোক না কেন এখন মনে মনে ভাবছে এই ফুটফুটে শিশুটি সত্যিই কি তারই সন্তান? কোলের মধ্যে মুচড়ে ওঠা শিশুটি যখন ঘুমের মধ্যে হাসি দিলো মনটা মায়ার সাগরে ডুবে গেলো যেন। রাযীন আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় ছেলের গালে। বাপের স্পর্শ টের পেয়েই মনেহয় যেন পুচকার হাসি চওড়া হলো। রাযীন টের পেলো না সেই হাসিতে নিজেও সংক্রমিত হলো। তার মুখেও অপার্থিব হাসি ছড়িয়ে পড়লো। মায়ের দিলে তাকিয়ে জানতে চাইলো-
“ওর নাম কি রাখবে মা?”
রোজী স্মিতহাস্যে বলে-
“তোর ছেলে তুইই ভালো দেখে কোন নাম রাখ।”
“আরে আমি কি জানি নাকি এসব? তুমি দাদী না ওর? সুন্দর দেখে একটা নাম দাও।”
রোজীর হাসি প্রসস্ত হলো-
“রুহির কাছে আগে যেনে নেই ও কোন নাম রাখতে চেয়েছে কিনা?”
রাযীন মাথা নাড়লো-
“ও কিছু ভাবেনি। ভাবলে আমাকে বলতো।”
“আচ্ছা তাহলে তোর আর রুহির নামের সাথে মিলিয়ে ওর নাম রাখি রাহি। রাহি মানে বসন্ত, খুশির বার্তা দেওয়া। ও তো আমাদের জীবনে বসন্ত নিয়ে এলো, তাই না বল?”
রোজী উচ্ছসিত হয়ে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন-
“নে এবার একটা ছবি তুলে আমার দাদু ভাইয়ের। তোর বাবাকে দেখাবো। মানুষটা কি যে খুশি হবে তুই চিন্তাও করতে পারবিনা। অনেক বড় একটা খুশি উপহার দিলি তোর বাবাকে। তোর জন্য অনেক অনেক দোয়া বাবা।”
রাযীন ফটাফট ছেলের কয়েকটা ছবি তুলে দিলো মায়ের ফোনে। তখনই রেনু আর বেনুকে দেখা গেলো বাচ্চাদের নিয়ে ছুটে আসতে। এসেই দু’বোন কাড়াকাড়ি শুরু করলো কে আগে কোলে নেবে রাহিকে। রাযীনের ভালো লাগছিলো এমন দৃশ্য দেখতে। সে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে খুনসুটি দেখছে আর মুচকি হাসছে। কতোদিন পরে এমন হাসিখুশি পরিবার দেখছে। নিজের অজান্তেই রাযীন মুগ্ধ চোখে ছেলেকে দেখে, মনটা দ্রবীভুত হয় তার।
তখনই মনে হলো বাচ্চার মায়ের খবর নেওয়া হয়নি অনেকক্ষণ। রুহির কি জ্ঞান ফিরলো? সে প্রায় দৌড়ে গেলো রুহির কাছে।
★★★
“রোজী, ওরা কখন আসবে বলো তো? আমার যে আর তর সইছে না। দাদাভাইকে কখন কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবো বলোনা?”
আশরাফের এমন পাগলামি দেখে রোজী মিটিমিটি হাসছেন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন-
“আরে এই তো এলো বলে। এতো অস্থির না হয়ে চুপচাপ বসো তো।”
“এইদিন দেখার অপেক্ষায় কতোগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করছি তুমি তো জানোই। সুস্থ মানুষ হয়ে অসুস্থতার নাটক করছি কতোটা কষ্টে। আজ যখন অপেক্ষার পালা ফুরালো তখন তুমি বলছো অস্থির হয়োনা?”
আশরাফের কন্ঠে অভিমান ঠিকরে পড়ে। রোজী এসে কাছে বসে-
“তুমি অসুস্থ এটা ভুলে যেয়ো না। রাজ যদি টের পায় বা অন্যরা যদি জানতে পারে তাহলে বুঝতে পারছো কি হবে?”
আশরাফ পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে মাছি তাড়ালেন মুখের সামনে-
“আরে ধুর, কিছুই হবে না। রাজ নিজে এখন বাবা হয়েছে ও বুঝবে আমাকে। বুঝবে সন্তানের জন্য অনেক কিছুই করতে হয়।”
“তবুও। সাবধান থাকা ভালো। কি থেকে কি হবে…”
রোজীর কথা শেষ হওয়ার আগেই শিখা হাসিমুখে ঘরে ঢুকে গেলো আকস্মিক-
“ভাইজান, ভাবি কিন্তু ঠিকই বলছিলো। সাবধান থাকা ভালো। কিন্তু আপনি তো আপনি কারো কথা শুনবেন না। এই যে দেখুন আমি এখন আপনাকে দেখে নিলাম। অবশ্য আমি আগেই বুঝে গেছি আপনার নাটক। সেদিন আপনাদের কথা বলতে শুনে ফেলেছিলাম কিনা।”
আশরাফ থতমত খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভান করলেও লাভ হলো না। শিখার চোখ ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।
“থাক ভাইজান, আর কষ্ট করতে হবে না। আমার সাথে আর অভিনয় না করলেও চলবে। একটা কথা আপনাকে জানাতে ভুলে গেছিলাম। আপনার বৌমারও একটা অতীত আছে সেটা তো মনেহয় জানেন না?”
শিখা প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে ভ্রু নাচায়-
“অবশ্য সম্পর্ক থাকা তো দোষের না। সম্পর্ক তো আমাদের রাজেরও ছিলো। কিন্তু যদি সম্পর্কটা দেবরের সাথে হয় তাহলে সমস্যা। কি বলেন ভাইজান? কি বোঝেননি? আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি।”
রোজী আর্তনাদ করে উঠলো-
“কি সব যাতা বলছো শিখা। এতো ঘৃনা বুকে নিয়ে বেঁচে আছো কি করে?”
শিখা হাসলো-
“উফফ ভাবি, কথাটা শেষ তো করতে দিন? আমাদের শুভ আপনার বউমার প্রাক্তন ছিলো। কিন্তু কথা এটা না। কথা হলো এটা রাজ জানলে কি হবে? আর আপনার ব্যাপারটা জানলেই কি করবে রাজ? এতোগুলো সত্যি কি ও হজম করতে পারবে? অথচ সত্য জানা ওর অধিকার।”
“প্লিজ শিখা, তুমি কিন্তু কিছু করবে না। কি চাও তুমি? সম্পদ চাও আমি লিখে দিচ্ছি তবুও এমন কিছু করো না যাতে রাজ কষ্ট পায়। তোমার জন্য ছেলেটা এতোবছর দেশে আসেনি। এবার দয়া করে ক্ষান্ত দাও।”
আশরাফ সোজা হয়ে বসে শিখার দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোর করে। শিখা হো হো করে হাসলো-
“সম্পদ দিয়ে কি করবো ভাইজান? তাছাড়া আপনার দান চাইনা আমি৷ আপনি যদি ভালো মানুষ হতেন তবে সৌরভ শুভ আর রাজের মধ্যে সম্পদের সমান বন্টন করতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। এখন বিপদে পড়ে আসছেন সম্পত্তি দিতে?”
“ওদেরকে আমি আলাদা চোখে দেখি না শিখা। আমি কি করেছি কেন করেছি এসব তুমি কখনো বুঝবে না আর না কখনো বুঝতে চাইবে।”
শিখা উঠে দাঁড়ালো-
“থাক ভাইজান আমার বুঝে কাজ নেই। আপনি আপনার বুঝ নিয়ে থাকেন দেখেন কতদিন ভালো থাকতে পারেন।”
★★★
রাহির কারনে শাহরিয়ার পরিবার যেন নতুন করে প্রান পেলো। প্রতিদিন পালা করে আত্মীয় স্বজন দলবেঁধে ওকে দেখতে আসছে। আবার সেই আগের হইহল্লা, হাসাহাসি চলছে সমান তালে। বাড়ির সবাই খুব খুশি। শুভ, সৌরভ, আফজাল, ঝিলিক এমনকি শিখাও রাহিকে কোলে নেওয়ার জন্য তিতিক্ষা করে।
রোজীর অবশ্য কড়া নজর নাতির দিকে। শিখা কোলে নিলে নিজের নজর এক সেকেন্ডের জন্য অন্য কোথাও সরায় না। পাঁচ দশমিনিট পরে নিজেই শিখার কোল থেকে রাহিকে নিয়ে নেয় খাওয়ানোর বাহানায়। শিখা সব বুঝে বাঁকা হাসি দেয় কিন্তু কোন প্রতিবাদ করে না। রোজী আসলে কিছুতেই শিখাকে বিশ্বাস করতে পারে না। বারবার মনেহয় সুযোগ পেলেই শিখা রাহির কোন ক্ষতি করবে। সে তো বলেছো যে রুহিকে কষ্ট দেবে। এখন কিভাবে কষ্ট দেবে সেটা তো বলেনি। তাই সাবধান থাকতে হবে।
রুহির দিনকাল এখন বেশ ভালো যাচ্ছে। রাযীনের পূর্ণ মনোযোগ এখন রুহির দিকে। সে যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে এই চেষ্টা রাযীনের। রাতে যাতে রুহির কষ্ট না হয় সেজন্য নিজে ইচ্ছে করে রাত জাগে, ছেলেকে কোলে নিয়ে হাটে ঘরময়, ন্যাপি চেঞ্জ করে, পটি পরিস্কার করে, প্রয়োজনে ফিডারে দুধ খাওয়ায়। রুহি অবশ্য ফিডার দিতে চায়নি। এতো ছোট বাচ্চাকে কৌটার দুধ খাওয়ানোর দরকার কি? এ প্রশ্নের জবাবে রাযীন বলে-
“অভ্যাস না করলে তোমারই কষ্ট। যখন তখন তোমাকে বিরক্ত করবে। লোকজনের মধ্যে এমব্যারাস হবে।”
রুহি আর বাঁধা দেয়নি। সে যেমন মা রাযীন বাবা। বাচ্চার ভালো মন্দ ভাবার হক দুজনেরি আছে। রুহি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে রাযীনকে দেখে। এই লোককে আসলেও বোঝেনা সে। বেবি পেটে থাকা অবস্থায় খুব একটা উত্তেজনা দেখেনি রাযীনের মধ্যে। বাচ্চা হবে? ও আচ্ছা, এ আর এমনকি? সবারই হচ্ছে এই টাইপ এক্সপ্রশন ছিলো লোকটার।
সেই মানুষ এখন বাচ্চার সব কাজ নিজ হাতে করে। রুহি সেসব ভেবে ফিক করে হাসলো। মানুষের মন বড় আজব জিনিস, সর্বদা পরিবর্তনশীলও।
চলবে—
©Farhana_Yesmin