#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩৮
#ফারহানা ইয়াসমিন
ছেলেকে দেখেই রোজী ডুকরে কেঁদে উঠলো। রাযীন জড়িয়ে ধরতেই অঝোর ধারায় কান্না করে চলেছেন তিনি। রাযীন চুপচাপ মাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। তার এখনো সবকিছু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে ছোটমার আক্রোশের স্বীকার হয়ে এতো সাফার করেছে এটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা চাপ ধরে আসছে তার। শুধু শুধু জীবন থেকে এতোগুলো বছর নষ্ট করে ফেলেছে ভেবে আফসোস হচ্ছে। এতোদিন ঝিলিককে দোষী ভেবে স্বান্তনা পেয়েছে কিন্তু ঝিলিকও অকারণে সাজা পেলো। সৌরভের সাথে তার বিবাহিত জীবনটা শান্তির হলে এতোটা খারাপ লাগতো না। ওদের পারিবারিক কারনে ঝিলিক সাফারার সেজন্য খারাপ লাগাটার পরিমাণ আরো বেশি। তবুও মেয়েটা নিজের দুঃখ পাশে ফেলে তার কথা রুহির কথা ভেবেছে। তা না হলে হয়তো আরো একটা ভুলে জীবনটা নিঃশেষ হয়ে যেতো। অকারণে কারো গুনাহগার হতে হতো। রাযীন আলগোছে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
আশরাফ অনেকক্ষণ ধরে রাযীনের সাথে কথা বলতে চাইছে। নিজেকে কি করে ছেলের সামনে মেলে ধরবেন সেটাই ভেবে চলেছেন এতোক্ষণ। রোজীর কান্না থামার কোন লক্ষন নেই দেখে গলা খাকরানি দিলেন। রাযীন বাবার দিকে তাকালো একবার। আশরাফের সাথে চোখাচোখি হতেই আশরাফ কথা বলে-
“রাজ আব্বু, তুমি আলিফের ব্যাপারে আমাকে ভুল বুঝে গেছে সবসময়। আলিফের ব্যাপারটা একটা এ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া কিছুই না।”
“ওসব কথা থাক আব্বু, আমি তখন সব শুনেছি।”
রাযীনের কথা শুনে খুশি হয়ে গেলো আশরাফ। রোজী চোখ মুছে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
“তুই না ফিরলে আমার হয়তো মরতে হতো। রুহির দুঃখ দেখার সাহস আমার হতোনা কিছুতেই।”
রাযীন মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। আশরাফ ছেলের কাছে এসে বসলেন-
“তুমি প্লিজ আমার উপর রাগ করে থেকো না বাবা। এতোদিন যা করেছি সবই তোমাকে কাছে পাওয়ার আশার। আমার একছেলে অকালে চলে গেছে আরেক ছেলে ভুল বুঝে দূরে থাকে। আমরা দুই বুড়োবুড়ি কি করি বলোতো? আমার কথা তাও বাদ দিলাম কিন্তু তোমার মা? তার মায়ের হৃদয়ে কেমন অনুভব হয় সেটা কি একবারও বোঝার চেষ্টা করেছো? এই মানুষটা নীরবে সব সয়ে যাচ্ছিলো। এই মানুষটার জন্যই আমার অসুস্থ হওয়ার অভিনয়টা করতে হচ্ছিলো। তুমি ছাড়া আমাদের আপন কে আছে বলোতো? এই যে সকলের জন্য ভেবে ভেবে এতো কিছু সয়ে গেলাম আদৌও কোন লাভ হলোকি? উল্টো সবাই ভুল বুঝে গেলো। আমারও আর ভালো লাগে না এসব। এখন আমার নাতিকে নিয়ে হেসে খেলে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চাই। আর কিছু চাওয়ার নেই।”
রোজী পাশ থেকে আশরাফকে ধমকে উঠলো-
“কি কথা বলে যাচ্ছ চুপ করো তো। ওকে রুহির কাছে যেতে দাও। মেয়েটা কি পরিমাণ রেগে আছে সেটা কি তোমায় বলে দিতে হবে? রাজ, রুহির রাগ ভাঙানো এখন তোর সবচেয়ে বড় কাজ। তুই খুব বড় একটা অপরাধ করতে যাচ্ছিলি। মেয়েটার কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তোকে করতেই হবে। যা বউমার সাথে দেখা কর।”
রুহির মুখোমুখি হতে ভয় লাগছে। মেয়েটা কিভাবে রিয়্যক্ট করবে কে জানে। মাকে দেখে এসে পনেরো মিনিট ধরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রাযীন। রুহির গেট খোলার নাম নেই। ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছে কিন্তু ওপাশ থেকে সারা মেলেনি। রুহির রাগের পরিমাপ আন্দাজ করা যাচ্ছে। রাযীন শেষবারের মতো ডাকলো-
“রুহি, আমি কি চলে যাবো? ছেলেকে তো পেয়ে গেছো তাই আমাকে আর দরকার নেই তাহলে? ঠিক আছে আমি চলে গেলাম।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই গেটটা খুলে গেলো। রুহির কান্নাকরা লাল চোখ জোড়া অগ্নি দৃষ্টি হেনে চলে গেলো রুমের মধ্যে। রাযীন রুহির পেছনে পেছনে। রাহি বিছানায় গভীর ঘুমে। বোঝাই যাচ্ছে সারাদিন পর মায়ের কাছে আসতে পেরেই এই শান্তির ঘুম। রাযীন অপরাধী চোখে ছেলেকে দেখলো। ছেলেটা সারাদিন প্রায় কেঁদেছে। ফিডারের অভ্যাস করলেও আজ কেনো যেনো ফিডার খেতে চাইছিলো না। হয়তো বাপের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলো। ওকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ফন্দি বুঝতে পেরেছে বলেই হয়তো এমন কেঁদেছে সারাদিন। ঝিলিক যদি না বোঝাতো রা্যীন হয়তো ছেলেকে নিয়ে চলেও যেতো বহুদূরে। তীব্র অভিমান রুহির প্রতি নাকি ভাগ্যের প্রতি সেটা সেটা যাচাই করার চেষ্টা করেনি। ভাগ্যিস ঝিলিক ওকে সময়মতো খুঁজে পেয়েছে না হলে এই মেয়েটার প্রতি চরম অন্যায় করা হয়ে যেতো।
রুহির দিকে তাকাতে ভয় করছে রাযীনের। বড্ড অন্যায় হয়ে যাচ্ছিলো। এখন রুহি ওকে কি বলবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। রাযীন দেখলো উল্টো ফিরে ফুপিয়ে কাঁদছে রুহি। মাঝে মাঝেই শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রা্যীন রুহির কাছে যেয়ে আলতো করে হাত রাখলো ওর পিঠের উপর। রুহি ঝাটকা দিয়ে সে হাত সরিয়ে দিলো। রাযীন আবার হাত রাখলো রুহি আবার হাত সরিয়ে দিলো। তৃতীয়বার হাত রাখতেই রুহি খেঁকিয়ে উঠলো-
“কি চাই? চলে তো গেছিলেন ছেলেকে নিয়ে এখন আলগা ঢং দেখাতে আসছেন? আরেকবার আমার সাথে অন্যায় করার আগে আপনার বুক কাঁপলো না? আমাকে কি আদৌও মানুষ বলে বিবেচনা করেন?”
“একহাতে তালি বাজেনা রুহি। আমার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কারন কি জানো? দোষ তো তোমারও আছে রুহি।”
রাযীন কেন যেন নিজেকে সামলে নিতে পারে না। না চাইতেই অনিচ্ছায় মুখ থেকে কথাগুলো বেড়িয়ে গেলো। রুহি অবাক চোখে রাযীনকে দেখলো-
“আমার কি দোষ? কি করেছি আমি?”
“শুভই যে তোমার প্রাক্তন সেটা কি জানানো উচিত ছিলো না তোমার? কেন বলোনি আমাকে?”
রুহি একটু চমকে গেলো, শুষ্ক গলায় বললো-
“প্রাক্তন ছিলো এটা তো লুকাইনি। এখন সে শুভ হোক বা অন্য কেউ তাতে কি এসে যায়? আমি তো এখানে আসার পর কারো সাথে সম্পর্ক রাখিনি।”
রাযীন বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো-
“সম্পর্ক রেখেছো কি রাখোনি সেটা পরের কথা। আমার ভাই তোমার কাছের মানুষ এটা জানা উচিত ছিলো আমার। তোমার কাছে হয়তো ব্যাপারটাকে কিছু মনেহচ্ছে না কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ সংবেদনশীল। আমি কাউকে ভালোবাসার পর যদি দেখি একজনকে বড়ভাই বিয়ে করেছে আরেকজনকে ছোট ভাই পচ্ছন্দ করে এটা শুনে কি আমার ভালো লাগার কথা? তুমি কি ভেবেছো কখনো ব্যাপারটা নিয়ে?”
রুহি ভাবলো আসলেই এমন করে ভেবে দেখেনি সে আগে। প্রথমে ঝিলিক তারপর সে, রাযীনের জন্য ব্যাপারটা খুব কুল না। তার যায়গায় রুহি হলে হয়তো ধৈর্য্য থাকতোনা। রাগ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। রাযীনের উপর রাগটা জোরদার হলোনা। কিন্তু তাই বলে নিজের সন্তানকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করবে? এতোটুকু দুধের বাচ্চা মা ছাড়া কি করে থাকতো? সে তো কোন দোষ করেনি তাহলে তাকে কেন এতোকিছু সইতে হবে? এমনটা মনে হতেই মনটা শক্ত হয়ে এলো রুহির। কাঠ গলায় বললো-
“যত যাইহোক, মায়ের থেকে বাচ্চা আলাদা করার মতো পাপ কি করেছি? এতো বড় সাজা দিতে চাইছিলেন আমায়?”
রাযীন এবার এগিয়ে এলো। রুহির দু’হাত নিজের হাতের উপর তুলে নিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়-
“এইটা আমার ভুল রুহি। রাগে দুঃখে অন্ধ হয়ে গেছিলাম। মনেহচ্ছিলো বারবার আমার সাথে এমন ধোঁকাবাজি কেন হবে? কেন আমি কাউকে কখনো নিজের করে পাবোনা। কেন আমার জীবন সঙ্গীর দিকে সকলের নজর? তুমি ঠিক বুঝবে না আমার কেমন লেগেছিলো।”
“কেন বুঝবোনা কেন? আর আপনার এতো খারাপই বা লাগছে কেন? আপনি তো সবসময় দাবী করেন আমাকে ভালোবাসেন না। আর যাকে ভালোবাসেন না তার জন্য এতো কষ্ট কেন পাচ্ছেন?”
রুহি হঠাৎ করে কথাগুলো বলে ফেলতেই রাযীন চমকে উঠলো। আসলেই তো? রুহির জন্য এতো কষ্ট কেন লাগছে তার? শুভর সাথে সম্পর্ক ছিলো শোনার পর থেকে কেন মনটা বারবার চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো? কেন বারবার মনেহচ্ছে এই মেয়েটা শুধু তার কেন হলোনা? অথচ রুহি শুরুতেই সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছিলো। তবে কি সেও নিজের অজান্তে রুহিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? যাকে কখনো স্ত্রী হিসেবে চায়নি ভালোবাসবে ভাবেনি শেষমেষ তারই কি প্রেমে পড়লো রাযীন?
চলবে—
©Farhana_Yesmin