#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২৩
#ফারহানা ইয়াসমিন
খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো রাযীনের। খুশি মনে চোখ মেলতেই রুহিকে নজরে এলো। লক্ষী মেয়ের মতো শুয়ে আছে মেয়েটা। একটা বালিশ দু’হাতে আগলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে আছে। এলো চুলগুলো বালিশে ছড়িয়ে আছে। রাযীন কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। কি এক অমোঘ আকর্ষনে রুহির দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো। কপালের উপর পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো আঙুলের স্পর্শে সরিয়ে দিয়ে রুহির কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বালিশ টেনে এনে রুহির মুখের কাছে মুখ রেখে বালিশে মাথা রেখে রুহিকে দেখতে লাগলো। মেয়েটা ততটা অসুন্দর না যতটা প্রথমে লেগেছিলো। দাঁতগুলো বড় হলেও ঝকঝকে বলে হাসলে দারুণ লাগে। রাযীনের ভীষণ ইচ্ছে হলো রুহিকে বুকের মাঝে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে। পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় লজ্জা পেলো। ধ্যাৎ! আজকাল সে রুহিতে একটু বেশি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেই রাযীন মুগ্ধ চোখে রুহিকে দেখতে দেখতে পূনরায় ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
ঘুম ভাঙতে নিজেকে কারো বাহুতে বন্দি টের পেলো রুহি। মাথার উপর কেউ থুতনি ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে কারো বুকের উপর। রুহি আলতো করে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। মানুষটা আরো একটু চেপে ধরলো তাকে। রুহি লোকটার বুকের আরেকটু কাছে ঘেঁষে গেলো। এখনতো নিশ্বাস ফেলারও জায়গা নেই। রুহির বুক দুরুদুরু কাঁপছে। মাথাটা বেকিয়ে কোনরকমে দেখলো মানুষটাকে। রাযীন মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ঘুমাচ্ছে। রুহি ভ্রু কুঁচকে নিজের শোয়ার জায়গা দেখলো। সে কি আজ নিজের জায়গা ছেড়ে এসেছে? দেখে একটু লজ্জাই পেলো। দোষ অবশ্য ওর একার না। দু’জনেই বিছানার মাঝখান বরাবর শুয়ে আছে। রাযীনের উপর রাগ হচ্ছে সামান্য। মানুষটা আজকাল তার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবে চললে খুব দ্রুতই তারা হয়তো.. বাকীটা ভাবতে পারে না রুহি। লজ্জায় গাল রক্তিম বর্ন ধারণ করলো, নিশ্বাস গাঢ় হলো কিছুটা উষ্ণও হলো হয়তে। নিজের মধ্যকার দ্বিধা এখনো কাটেনি রুহির। তবুও রাযীনের কাছে আসাটাকে খারাপ কিছু মনে হচ্ছে না। এটা কি বিয়ে নামক বৈধতার কারনে? ঠিক ভেবে পেলোনা। ভাবতে ভাবতে রাযীনের বুকে মাথা ঠেকালো। কিছু মনে হতেই বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে ফিক করে হেসে দিলো। গল্পের নায়কের মতো রাযীন বুকের দু’টো বোতাম খোলা রেখে শার্ট পরা নেই। বরং ওর পরনে গলা অব্দি নরম গেন্জি। কাজেই বুকের পশম দেখার চান্স নেই। ভেবেই নিজেকেই খুব করে শাসন করলো রুহি। দিনদিন খুব অসভ্য হচ্ছিস রুহি। এসব কি ভাবছিস উল্টো পাল্টা বলতো? নিজের ভাবনার লাগাম টেনে ধর বদ মেয়ে।
“এই কি করছো কি রুহি সুরসুরি লাগছে তো?”
রাযীনের কন্ঠ কানে আসতেই রুহি স্হির হয়ে গেলো। কি করছিলো সে? না চাইতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো রাযীনের দিকে-
“কি করলাম আমি?”
রাযীন হঠাৎ উপুড় হলো, রুহির চোখে চোখ রেখে বললো-
“কি করছিলো জানোনা? আমার বুকে নাক ঘষছিলে। দিলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে।”
রুহি ব্রীড়ার কারনে চোখ নামিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো-
“আপনিও তো আমার ঘুম নষ্ট করেছেন। এভাবে আমায় জড়িয়ে ধরেছেন কেন?”
“আমার কি দোষ! সব দোষ তোমার, তোমাকে ভীষণ আদুরে বিড়ালছানার মতো দেখালে আমি কি বুকে না নিয়ে পারি?”
রুহির মুখে রা কাড়ে না। হঠাৎ কোথা থেকে লজ্জারা মেঘের দলের মতো নেমে এসে ওকে ঘিরে ধরছে যেন। রুহি মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকালে রা্যীন দু’হাতে রুহির মুখ আগলে ধরে কানে ফিসফিস করলো-
“বিড়ালছানাটাকে একটু আদর দেই? প্লিজ প্লিজ মানা করোনা প্লিজ?”
রা্যীনের উষ্ন নিশ্বাস রুহির মুখের উপর আছড়ে পড়তেই ওর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। লজ্জাবনত চোখ বুজে ফেললো, নাকটা লালচে রং হয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সেখানে। রাযীন মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুহির নাকের ডগায় ঠোঁট ছোঁয়ায় তারপর চোখে গালে কপালে। রা্যীনের আচরন ধীরে ধীরে দখলদারি হয়ে উঠছে। রুহির তনুমন কেঁপে কেঁপে উঠছে রাযীনের স্পর্শে। রাযীনের স্পর্শে তলিয়ে সুখের সাগরের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে রুহির মনে আচমকা প্রশ্নটা বাড়ি মেরে যায়। আচ্ছা! রাজ তাকে ভালোবাসে তো? নাকি এই কাছে আসাটা শুধু শরীরী আকর্ষন? ওই যে স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ডের কথা বলে ওটা কি সত্যি? আর সে যে এতো সহজে আত্মসমর্পণ করলো শুভকে কি পুরোপুরি ভুলতে পেরেছে? যদি শুভর কথা কখনো রাজ জানতে পারে কি করবে তখন? ভাবমাটা মনে আসতেই রুহি যেন আচমকা কারেন্ট শক খেয়েছে। হুট করে চোখ মেলতেই রাযীনের ঘোলাটে লাল চোখে চোখ আঁটকে গেলো। দু’জনার মধ্যে ব্যবধান একইন্চিরও কম। রাযীনের গরম শ্বাস আর মাতাল চাহুনি উপেক্ষা করে রুহি কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময় রাযীনের উষ্ণ আর্দ্র ওষ্ঠদ্বয় নেমে এলো ওর ওষ্ঠের উপর। সেই মুহুর্তো সুখের আবেশে বিলীন হতে হতে রুহির মনের প্রশ্নগুলোও যেন হাওয়াই মিঠাই এর মতো মিলিয়ে গেলো।
★★★
রুহি জানে না শুভ ওকে সবসময় ফলো করে। পারলে রাযীনের বেডরুমেও সর্বদা চোখ কান দিয়ে রাখে। খুব অসভ্য আচরণ হলেও শুভ নিজেকে এ থেকে নিরস্ত্র করতে পারে না। যে মেয়েটার জন্য নিজের বাসা বাড়ি ছেড়ে মধ্যবিত্ত চালে চলেছে, টিউশন করেছে, মেয়েটার খারাপ সময়ে পাশে থেকেছে বন্ধুর মতো, ভালোবেসেছে তাকে অন্য কারো হতে দেখাটা অসম্ভব। যত দিন যাচ্ছে রুহিকে পাওয়ার আকাঙ্খা বাড়ছে। কিন্তু কিভাবে পাবে রুহিকে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। আজ সকালে রুহি যখন নিচে নামলো ওকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিলো। খাওয়ার টেবিলে রাযীন বারবার চোরা চোখে রুহিকে দেখছিলো, একটা মুচকি হাসি লেগেছিলো দু’জনার চেহারায়। শুভ যা বোঝার বুঝে গেলো। সে সেই মুহূর্তে নিজের নাস্তার প্লেট মেঝেতে ফেলে দোতলায় নিজের কামরায় ফিরে এসে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করলো। শিখা দৌড়ে এলো ছেলের পেছনে। শুভকে থামানোর বৃথা চেষ্টায় জানতে চাইলো-
“শুভ, আব্বু কি হলো হঠাৎ? এমন করছিস কেন বাবা?”
শুভ জবাব না দিয়ে আপন মনে জিনিস ভাঙছে। নিজের মোবাইল দুটো, ল্যাপটপ, শখের গিটার। ড্রেসিং টেবিলে হাত দিতেই শিখা এসে ছেলের হাত ধরলেন-
“শুভ! এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর? কি লাগবে বল। তুই যা চাইবি মা তোকে তাই দেবে।”
“একথা তুমি আগেও বলেছো।”
শুভ মায়ের দিকে তাকালো। শিখা ভ্রু কুঁচকে বলে-
“হ্যা, তো? তোর কি চাই সেটা না বললে দেবো কি করে?”
“সত্যি দেবে?”
“আমি মিথ্যে বলি না।”
শুভ মায়ের হাত ছাড়িয়ে বিছানায় বসলো চুপচাপ। চুলগুলো ঠিক করে হাত দিয়ে-
“ভেবে দেখো মা, আমি আজপর্যন্ত কিছু চাইনি তোমার কাছে। এবারই প্রথম তুমি আমায় কিছু দিয়ে তোমার ভালোবাসা প্রমান করার সুযোগ পাচ্ছ। আশাকরি সেই সুযোগ কাজে লাগাবে।”
শিখা বিরক্তি নিয়ে ছেলেকে দেখলো-
“এতো হেয়ালি না করে বলো তোমার কি চাই। লাল টুকটুকে বউ চাই নাকি? আমি অবশ্য একটা মেয়েকে দেখেছি। আমার খুব পচ্ছন্দ হয়েছে। মেয়েটা কে জানো? তন্দ্রা। তন্দ্রাকে মনে আছে তোমার? তোমার ছোট আন্টির মেয়ে।”
শুভ সেসব কথা কানে তুললো না। ঠান্ডা গলায় বললো-
“আমার রুহিকে চাই মা। আই লাভ হার। ওর জন্যই বাড়ি ছাড়লাম। এতোদিন তোমাদের ছাড়াও কতো ভালো ছিলাম ওকে নিয়ে। হঠাৎ করে রাজ ভাই ফিরে এসে সব গুবলেট করে দিলো। মা শুনেছো কি বলেছি? আমার রুহিকে চাই রুহি রুহি রুহিকে চাই। না পেলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমি কি করবো আমি জানিনা।”
শিখার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। সে বড় বড় চোখে ছেলেকে দেখছে। ওহহ, এতো বোকা কেন সে? ছেলের হঠাৎ ফিরে আসা, রুহির মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, শুভর আচমকা নানা বাড়ি থেকে ফিরে আসা, প্রায়ই রুহির আসেপাশে থাকা। মর্জিনা কয়েকবার বলেছিলো তবুও মাথা ঘামাননি এদিকে। শিখার কি খুশি হওয়া উচিত? না চাইতেই তুরুপের তাস হাতে পেয়ে যাওয়ার কারণে। কিন্তু এবার কি করবে শিখা? রাযীন কি এবার এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবে? গতবারের মতো না বরং এবার এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন রাজ আর ফিরে না আসে। একেবারে দীর্ঘস্হায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু করবেটা কি? যা হোক কিছু একটা করা যাবে। আপাতত খুশি হওয়া যাক না হয়। শিখা চেহারায় অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে শুভর পাশে এসে বসলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষের পথে। আমার দ্বিতীয় বই ‘অনসূয়া’ পাবেন এশিয়া পাবলিকেশন্স এর স্টল ৯১-৯৪ এ। আমার প্রথম বই তিয়াস পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় ১৪৯ নং স্টলে। দুটো বই রকমারিতেও পাবেন। চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি অর্ডার লিংকঃ
তিয়াসঃ
https://www.rokomari.com/book/211757/tiyas
অনসূয়াঃ
https://www.rokomari.com/book/226534/anosoya)