#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২৪
#ফারহানা ইয়াসমিন
খাওয়া শেষে মুখ মুছিয়ে দিতেই আশরাফ রুহিকে ইশারায় বসতে বলেন। সামনে দাঁড়ানো রোজীকে চোখের ইশারায় কিছু বলতেই রোজী উঠে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে দুটো বাক্স নিয়ে ফিরে এলো। রুহির সামনে বসে বাক্স খুলে একজোড়া মোটা বালা বের করে রুহির দু’হাতে পড়িয়ে দিলেন-
“এটা আমার শাশুড়ী মায়ের থেকে পেয়েছিলাম। উত্তরাধিকার সুত্রে তোমায় দিলাম। আর এটা তোমার শশুরের তরফ থেকে উপহার তোমার জন্য। নিজে পচ্ছন্দ করে তার ভবিষ্যৎ বংশধরের মায়ের জন্য বানিয়েছেন। একটু পরে তোমার শশুরকে দেখাও।”
রোজী নিজেই রুহির গলায় হীরের হারটা পরিয়ে দিলেন। অপ্রস্তুত রুহি কিছু বলতে পারে না। এতোদিন পর হঠাৎ করে এসব দেওয়ার মানে কি বুঝতে পারে না। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার শশুরের দিকে তাকাতেই দেখলো রুহির দিকে তাকিয়ে থেকে আশরাফের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। রোজী রুহির সামনে এসে বসলো, রুহির হাত নিজের হাতে নিলো-
“বউমা, এসব দেখে তোমার হয়তো অবাক লাগছে। ভাবছো এতোদিন পর এসবের আবার কি দরকার? আসলে মা, তোমার শশুরের শরীরটা তো ভালো না। কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না। তোমাকে এ বাড়িতে বউ করে আনার পরে যথাযথ সম্মান দিতে না পারার আক্ষেপ সবসময় ছিলো তার। এসব দিয়ে সে হয়তো তার আক্ষেপ কিছুটা কমাতে চায়।”
রুহি চুপ করে রইলো। সোনা গয়না টাকা পয়সা এসব দিয়ে মনের শুন্যতা পূরণ হয়? রুহির আসলে জানা নেই। রোজী হয়তো রুহির মনের ভাব বুঝতে পারলেন-
“এক জিনিসের অভাব কিছুতেই আরেকটা দিয়ে পূরণ হয় না। তবে কি জানো, আজকাল রাজের বদলটা বেশ টের পাই। সুস্থ থাকাকালে নিজের ছেলের সাথে তার কোনদিন বনেনি। এখন আর বনাবনির প্রয়েজনই নেই। তবুও রাজ প্রতিদিন নিয়ম করে বাবার খোঁজ নিচ্ছে, ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করছে এসব দেখেও ভালো লাগে। বুড়ো বয়সে সন্তানের কাছে বাবা মা বেশি কিছু তো চায় না। এই সামান্যতেই আমরা খুশি। জানি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে তুমি তেমন কিছু পাওনি তবুও ধৈর্য্য ধরে রাজের সাথে আছো এজন্য তোমার শশুর খুব খুশি হয়েছে তোমার উপর। তার ইচ্ছে তার ভুলত্রুটি তুমি ক্ষমা করে দেবে।”
“ছি মা এসব কেন বলছেন? বাবার উপর আমার কোন রাগ নেই। সত্যি বলছি বাবা, আমি আপনার উপর রাগ করে নেই।”
রুহি আশরাফের দিকে তাকিয়ে মনের কথাগুলো বলতেই আশরাফের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঠোঁট বাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। সুস্থ হাতটা তুলে আশির্বাদের ভঙ্গি করে নামালো। রোজী চুপচাপ তা দেখলো পাশে বসে। তারপর হালকা গলায় রুহিকে ডাকলো-
“একটা কথা বলি বউমা?”
রুহি মাথা নাড়তেই রোজী মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে-
“বয়স হয়ে গেলে মানুষ সবসময় বেঁচে থাকার উৎস খুঁজে বেড়ায়। বংশের রক্ত খুঁজে বেড়ায়। তোমার শশুরের খুব ইচ্ছে রাজের সন্তানকে দাদার আদর দেওয়ার। যদি পারো তবে তার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করো তোমরা।”
শাশুড়ীর কথায় লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো রুহি। রোজী তা লক্ষ করে হাসলো, দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে খুব ধীরে গলায় বলে-
“একজনকে তো হারিয়েই ফেললাম অকালে তাই আমি এখন আর স্বপ্ন টপ্ন দেখি না। তোমাদের উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। তবে এ বাড়িতে মনেহয় একটা শিশুর সত্যিই প্রয়োজন আছে। ভেবে দেখো কিছু করা যায় কিনা।”
রুহির থুতনি বুকের সাথে সেটে আছে। বাচ্চার কথা ভাবা তো দূরের কথা মাথাতেই আসেনি। এখনো তো নিজেকে সামলে নিতেই পারলোনা। রুহি কিছু না বলে প্রায় পালিয়ে এলো রোজীর সামনে থেকে।
★★★
ক্লজেট থেকে নিজের কাপড় বের করতে যেয়ে বিরক্ত হলো সৌরভ। একটা কাপড়ও ঠিক জায়গায় নেই। পচ্ছন্দের শার্টটা খুঁজে না পেয়ে পুরো ক্লজেট এলোমেলো করে ফেললো। কিন্তু না কোথাও নেই শার্টটা। ঝিলিক একবার সে দৃশ্য দেখে নিজের কাজে মন দিলো। সৌরভ বিরক্ত নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝিলিকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-
“আমার আকাশি রঙের শার্টটা দেখেছো?”
ঝিলিক উত্তর দিলো না। সৌরভ ভ্রু কুঁচকে ঝিলিককে দেখলো। ওর মধ্যে কোন উৎকন্ঠা না দেখে সামনে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে থাকা কাগজটা কেঁড়ে নিতেই রুহি বিরক্তি নিয়ে তাকালো-
“কাগজটা ফেরত দাও সৌরভ।”
সৌরভ রাগে দাঁত কিড়মিড় করে-
“কিছুক্ষণ আগে তোমার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি তার উত্তর দাও আগে।”
“তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। আমার কাগজ ফেরত দাও।”
ঝিলিক ঠান্ডা গলায় জবাব দিতেই সৌরভ বিস্মিত কন্ঠে বলে-
“বাহ, দারুণ জবাব দিলে এইজন্য তালি দিয়ে এপ্রিসিয়েট করা উচিত তোমাকে। তা ম্যাডাম কি রাজ কার্জ সম্পাদন করছিলেন আগে দেখি। মেকাপ আর শপিং ছাড়া পারোটা কি তুমি যে এতো ভাব দেখাচ্ছ?”
বলেই হাতের কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। একটা ড্রেসের ডিজাইন করার চেষ্টা করছে ঝিলিক। তা দেখে সৌরভ হেসেই খুন হলো। ফটাফট হাতের কাগজটা ছিড়ে কুটিকুটি করলো-
“তোমার এই ফালতু কাজের চাইতে অনেক জরুরি আমার শার্ট খোঁজা। আজকে একটা জরুরি মিটিং আছে আমার, যাও শার্টটা খোঁজো।”
ঝিলিক ওঠার নাম নিলোনা, মুখচোখ শক্ত করে বসে রইলো-
“তোমার শার্ট তুমি খুঁজে নাও।”
সৌরভ কোমরের দু’পাশে হাত রেখে ঝিলিকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে জানতে চাইলো-
“মানে কি?”
ঝিলিক সৌরভের চোখে চোখ রেখে বললো-
“মানে তাই যা তুমি শুনেছো। আমি তোমার শার্ট খুঁজে দিতে পারবোনা।”
সৌরভের চোখ লাল হচ্ছে ক্রমশ, অগ্নিমূর্তি ধারন করছে চেহারা-
“কেন পারবে না? এখন আমার কাজ করতে ভালো লাগে না বুঝি? হ্যা তা লাগবে কেন? এখন তো নাগ…”
“খবরদার যদি একটাও বাজে কথা বলো। তুমি জানো আমি এমন মেয়ে নই। রাজ পাঁচবছর দেশে ছিলোনা। ওর সাথে কোন যোগাযোগ ছিলোনা আমার। তোমার সাথে বিয়ের পর সে চেষ্টাও করিনি। কিন্তু তবুও প্রতিনিয়ত তোমার এসব কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। যা নয় তাই বলেছো, বউ হিসেবে কখনো সম্মান দাওনি। অথচ তুমি অন্যায় করে জোর করে বিয়ে করেছিলে আমাকে। সে আচরণ নিয়ে কখনো তোমায় অনুশোচনা করতে দেখিনি। এতোদিন অনেক সয়েছি কিন্তু আর না। তুমি যদি তোমার আচরণে পরিবর্তন না আনো তবে তোমার সাথে থাকার আর কোন প্রয়োজন দেখি না আমি। তবে ভেবোনা চুপচাপ চলে যাবো তোমার জীবন থেকে। যাওয়ার আগে অবশ্যই সবাইকে সব জানিয়ে যাবো।”
ঝিলিক দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।পেছনে বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো সৌরভ।
★★★
“কি করছো?”
রুহি চমকে উঠে পিছু ফিরতেই শুভকে দেখলো। দরজায় দাঁড়িয়ে রুহিকে দেখছে। আলমারির দরজা আঁটকে রুহি প্রশ্ন নিয়ে শুভকে দেখলো। শুভ ওর দৃষ্টি পাত্তা ন দিয়ে রুমে এলো-
“তুমি তো আসতে বলবে না তাই আমি চলে এলাম। তা ভাইয়ের সাথে সংসার কেমন চলছে?”
রুহি নিজের বিরক্তিকর অভিব্যক্তি না লুকিয়ে জানতে চাইলো-
“কি চাই তোমার? এভাবে না বলে কারো রুমে আসতে নেই এটা কি জানো না?”
শুভ ফিকফিক করে হাসলো-
“অনেক কিছুই জানি না আমি যেমন তুমি জানো না অনেককিছু।”
রুহি বিস্মিত হলেও প্রকাশ করলোনা। ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকালো-
“কি বলতে চাইছো স্পষ্ট করে বলো।”
“মানে বলছিলাম ভাইয়ার ব্যাপারে কতটুকু জানো তুমি? এই যে পাঁচ বছর দেশে ছিলোনা ওখানে কি একা একাই ছিলো? কারো সাথে প্রেম বা বিয়ে করেনি তো? এখন হঠাৎ দেশে এসে তোমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো কেন সেটা নিয়েও তো ভাবা উচিত।”
“সেসব নিয়ে তোমার এতো ভাবনা কেন? তুমি নিজের ভাবনা ভাবো।”
মুখে বললেও মনে মনে রুহি শুভর প্রশ্নগুলোই ভাবছে। রুহির কথায় শুভর মুখের হাসি চওড়া হলো-
“নিজের ভাবনা ভাবছি বলেই তোমার কাছে এলাম। আমার কাছে নিজ বলতে তো তুমিই সে তুমি স্বীকার করো বা না করো।”
রুহি রেগে গেলো, গর্জে উঠে বললো-
“শুভ! বিহেভ ইয়োরসেলফ।”
শুভ আঁতকে উঠার ভঙ্গিতে দু’হাত উপরে তুলে-
“আরে আমি কি করলাম? তোমার ভালোর জন্যই তো বলা। আসলে জগতে ভালো মানুষের দাম নেই। আচ্ছা বলো তো, এই যে তুমি আমাকে আগে থেকেই চেনো, আমি তোমার সদ্য হওয়া প্রাক্তন প্রেমিক সেসব কি বলেছো ভাইকে?”
রুহি মনে মনে ভয় পেলেও চেহারার সে ভয় প্রকাশ করতে চাইলোনা। সে নিরুত্তর রইলো। শুভ মুচকি হাসলো-
“ভাইয়ের ও কপাল। যাকেই বউ হিসেবে পচ্ছন্দ করেছে বা করে তারই কিছু না কিছু ঘটনা হয়। বেচারা এবার এসব জানলে যে কি হবে?”
রুহি এবার ঘৃনা মিশ্রিত কন্ঠে বললো-
“তুমি নিশ্চয়ই নিজেকে এতোটা নিচে নামাবে না?”
“নিশ্চয়ই না। শুধু ভাবছিলাম কখনো যদি ভাইয়া জানে তখন কি হবে? ভাবো, ভাবো ব্যাপারটা রুহি, ভাবো একবার।”
শুভ শিষ দিতে দিতে চলে গেলে রুহি বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষের পথে। আমার দ্বিতীয় বই ‘অনসূয়া’ পাবেন এশিয়া পাবলিকেশন্স এর স্টল ৯১-৯৪ এ। আমার প্রথম বই তিয়াস পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় ১৪৯ নং স্টলে। দুটো বই রকমারিতেও পাবেন। চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি অর্ডার লিংকঃ
তিয়াসঃ
https://www.rokomari.com/book/211757/tiyas
অনসূয়াঃ
https://www.rokomari.com/book/226534/anosoya)