#আমার_চন্দ্রাবতী পর্ব ৮
লেখিকা- সালসাবিল সারা
নেভি-ব্লু রঙের ফুল হাতা গেঞ্জি পরিধান করে নিজের প্রতিচ্ছবি আয়নায় বারংবার দেখছে ইয়াদ।পেশীবহুল মাংসপেশির পিন্ড স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আঁটসাঁট গেঞ্জির উপরেই।কালো রঙের ট্রাউজারে গেঞ্জির বামের দিকের অংশ অল্প গুঁজে দিলো সে।মসৃণ চুল আজ অবাধ্য।তাই অল্প জেল নিয়ে দুই হাতের তালুর সাহায্যে ঘষে চুলের উপর হাত বুলালো।মুহূর্তেই মসৃণ অবাধ্য চুলগুলো বাধ্যে রূপান্তরিত হলো। খরশান চোয়ালে ডান হাতের উল্টপিঠ রাখতেই,তার মাথায় আবারও দুআর খেয়াল জেঁকে বসলো। যার দরুণ সে পুনরায় নিজের শরীরে সেই উত্তাপ অনুভব করতে পারছে।সাথে হৃদপিণ্ডটা তীব্র গতিতে ছুটছে।বৃষ্টির ঠান্ডা আবহাওয়ায় মুটামুটি শীত শীত ভাব।তাই সে বেছেই এই নেভি ব্লু রঙের লম্বা হাতার গেঞ্জিটা পড়েছিলো।তবে বর্তমানে,দুআর খেয়ালে তার আবারও অস্থির লাগছে।অতঃপর তার কপালে বিন্দু ঘামের আভাস দেখা গেলো।ইয়াদ,ভেবে নিলো সে এই গেঞ্জি পরিবর্তন করে নিবে।দুই হাত ক্রস করে গেঞ্জির সামনের দিকের অংশে হাত রাখতেই দরজায় শব্দ হলো,”ঠক্, ঠক্”।ইয়াদ হাত থামিয়ে থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
–“কে?”
–“আমি,আব্বা। নিচে মেহমান এসেছে।জলদি আসো।”
ইয়াদ দরজা খুললো।সে উত্তর দেওয়ার পূর্বেই তার মা আবারও তাকে বলে উঠলো,
–“এইতো,তুমি তৈরি।আসো আসো।তোমার চাচী আম্মাও এসেছে।”
–“যাও।আসছি।”
ডালিয়া চললো নিচে দরজা ভিড়িয়ে।ইয়াদ দ্রুত কয়েকটা শ্বাস ফেলে পুনরায় নিজেকে আয়নায় পরখ করে বাহির হলো কামরা থেকে।চুলে জেলের আস্তরণ আজ কম বলে,কিছু চিক্কণ চুল কপালের সামনে চলে আসছে।আর ইয়াদ হাতের সাহায্যে সেই চুল আবারও তার নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দিচ্ছে।
সিঁড়ি থেকেই ইয়াদের চোখ চারিদিকে স্ক্যান করা শুরু করলো তার কাঙ্খিত মানুষকে খোঁজার উদ্দেশ্যে।তবে ফলাফল শূন্য।ইয়াদের দৃষ্টির ত্রিসীমানায় তার কাঙ্খিত মানুষটার কোনো দেখা নেই। নিচের ঠোঁট চেপে ইয়াদ বোঝার চেষ্টা করছে,দুআ মেয়েটা গেলো কোথায়?
লিভিং রুম-
সকলেই নিজেদের মতো কথা বলছে।ইয়াদকে দেখে তার ফুফু সোফা থেকে উঠে এক প্রকার দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো তাকে,
–“ইয়াদু,কেমন আছিস?”
–“ভালো।তুমি কেমন আছো ফুফু?”
–“তোকে দেখে একদম ভালো আছি।এইযে সাক্ষাৎ কর,মাইশার হবু বর; রিজোয়ান।”
রিজোয়ান সোফা ত্যাগ করে হাত মেলালো ইয়াদের সাথে,
–“কেমন আছো,ইয়াদ?”
–“জ্বী ভালো।আপনি?”
–“ভালো।”
রিজোয়ান এর কথার বিপরীতে ইয়াদ তাকে ইশারায় বসতে বললো।ইয়াদ নিজেও সোফায় জায়গা করে নিলো নিজের।ইয়াদ সৌজন্যতা খাতিরে রিজোয়ানের সাথে কথা বললেও তার মন,প্রাণ, আঁখিজোড়া সেই দুআ নামের মানুষকে খুঁজে যাচ্ছে হন্য হয়ে।এইসবের মাঝে হঠাৎ ইয়াদের চাচী বলে,
–“আমাদের ইয়াদেরও জন্যেও একটা ভালো মেয়ে দরকার তাই না,ভাবী?এইভাবে আর কত দিন অবিবাহিত থাকবে তুমি?”
–“বিয়ের ব্যাপারটা পুরোটাই আল্লাহ্ এর উপর।আমার ভাগ্যে যখন বিয়ে লিখা থাকবে তখনই হবে।আপাতত আমি এইসব নিয়ে ভাবছি না।”
ইয়াদ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো।
রিজোয়ান ইয়াদের এমন পরিবর্তন দেখে অবাক হতে একটুও দ্বিধাবোধ করলো না।সে ভেবে পায় না,এই ইয়াদ কি তারই সেই চিরচেনা উগ্র,বিগড়ে যাওয়া ছেলেটা!তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ইয়াদ তো এমন ছিলো না।রিজোয়ান ভেবেছিলো,ইয়াদ এখনো পূর্বের ন্যায় আছে।তবে আজ তার সাথে কথা বলে এবং তার কথার জবাবে ইয়াদের পূর্বের রূপের সাথে কোনো মিল পেলো না রিজোয়ান।তার মনের মধ্যে যেনো ইয়াদকে নিয়ে চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটলো কিঞ্চিৎ।
–“আরে আরে,বিয়ে এখন করতে কে বললো?মেয়ে দেখো,পছন্দ করো,কিছু সময় বাদেই না হয় বিয়ে করবে?”
–“যে আমার নসিবে আছে সে এমনিই আসবে আমার কাছে। এতো পর্যবেক্ষণের কি দরকার?সঠিক সময়ে আল্লাহ্ এর পক্ষ থেকে আমার জন্যে ঠিক করা মেয়েটা আমার জীবনে চলে আসবে।”
ইয়াদ তার চাচীর কথার জবাবে বললো।ইয়াদের চাচী মুচকি হাসলো তার জবাবে।ইয়াদের কাছে তিনি যেনো ঠিক এই জবাবটা আশা করেছিলেন!
–“ঠিক বলেছো,বাবা।”
টুকটাক আলাপ করে ইয়াদ উঠে পড়লো নাস্তার উদ্দেশ্যে।পথিমধ্যে জরুরী ফোন আসায় ইয়াদ তার মাকে জানালো, নাস্তা তার রুমে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে।ইয়াদ কানে ফোন চেপে দ্রুত গতিতে হাঁটছে। সিঁড়িতে পদক্ষেপ রাখার পূর্বে সে খেয়াল করলো,
সিড়ির নিচে দেওয়ালে লাগানো বড় জানালার কাঁচ একদম অস্পষ্ট।কাছে গিয়ে ইয়াদ বুঝতে পারলো,
বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আধুনিক সব প্রযুক্তির কারণে বাহিরের এই গমগম বৃষ্টির শব্দ একেবারে প্রবেশ করছে না বাড়ির ভেতরে।জানালা খোলা থাকলে হয়তো,ইয়াদ আগেই বুঝতে পারতো বাহিরে তীব্র ঝড় হচ্ছে।
বড় আলোচনা হবে।তাই অপর পক্ষের মানুষটা ইয়াদ থেকে বিশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে ফোন রাখলো।ইয়াদ দ্বিতীয় তলার বামে বাঁক ফিরতেই পেছন থেকে মারিয়া ডেকে উঠলো,
–“ভাইয়া!”
ইয়াদ মারিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালো।
–“বলো?”
ইয়াদ প্রশ্ন করলো।
–“রুমে আসো।রামিসা আপু অনেক্ষণ ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।কিন্তু তোমার তো পাত্তাই নেই।”
ইয়াদ সবার জন্য ব্যস্ত এবং গম্ভীর হলেও, তার এই ছোট ছোট বোনেদের জন্যে সে সর্বকালের ফ্রি। রামিসা এবং মাইশার ভালো ব্যবহার এবং সরল আন্তরিকতার জন্যে ইয়াদ তাদের ছোট থেকেই অনেক বেশি স্নেহ করে।তার নিকট রামিসা এবং মাইশা হলো জিয়া এবং মারিয়ার মতোই স্নেহে পরিপূর্ণ।তাই ইয়াদ নির্দ্বিধায় রামিসার সাথে দেখা করতে চললো মারিয়ার পিছু পিছু।রুমের দেখা মিলতেই ইয়াদ হঁচকিয়ে উঠলো।তার মনে উদয় হলো এক অস্থির প্রশ্নের,
–“রামিসা এইখানে, তার মানে দুআও?”
ইয়াদ আর ভাবতে পারলো না।মারিয়া ইয়াদের হাত চেপে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো।প্রথমেই ইয়াদের নজর স্থির হলো দুআর অবয়বে।বর্তমানে মেয়েটা জানালার কাঁচের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।মাথার কাপড় না থাকার দরুণ, ঝলমলে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা ইয়াদের নজরে আটকে গেলো এক পলকেই! কাঁচের জানলার উপর আংগুলের সাহায্যে আঁকিবুকি করার দৃশ্যটাও নজর এড়ালো না ইয়াদের।
এইদিকে রামিসা ইয়াদের সামনে এসে এতো বকবক করছে সবটা যেনো ইয়াদের কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করতে গিয়েও প্রবেশ করতে পারছে না।ইয়াদের এহেন কান্ড লক্ষ্য করে রামিসা এবং মারিয়া চোখাচোখি করতে লাগলো।তারা স্পষ্ট দেখছে, ইয়াদের সম্পূর্ণ দৃষ্টি পেছনে বাঁক ফেরানো দুআর প্রতি।
মারিয়া এবং রামিসা দুইজন দুইজনের দিকে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে দুআ ইয়াদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাথরের নয় শক্ত হয়ে রইলো।কাঁচের জানালায় ইয়াদের অস্পষ্ট অবয়ব দৃশ্যমান।সেই অবয়বে ইয়াদের লম্বা সুঠাম দেহটা দুআর নজরে এলে কিছুদিন পূর্বের ঘটনাটা স্মরণে এলো দুআর।অস্থিরতায় দুআ কুঁকড়ে উঠছে বারংবার।
–“ইয়াদ ভাইয়া?”
রামিসা এবং মারিয়া চিল্লিয়ে উঠলো।তাদের এমন চিল্লানোতে দুআর কম্পিত হওয়ার দৃশ্যটাও ইয়াদের দৃষ্টির অগোচরে যায়নি।
–“রামিসা,আমার রামু কাকা।কেমন আছে আমার রামু কাকা?”
–“ইয়াদ ভাইয়া!এতদিন পর এসে তোমার মুখে এইসব শুনতে চাই বলো?তাছাড়া এতক্ষণ তোমায় ডাকছিলাম,তোমার খেয়াল এইদিকে ছিলোই না।কি ব্যাপার বলো? কার দিকে তোমার সজ্ঞান?”
রামিসার প্রশ্নে ইয়াদ মলিন হাসলো,
–“কিছুই না।তোমার ইয়াদ ভাইয়ার জন্যে তুমি সর্বদা তার রামু কাকা।”
ইয়াদ সশব্দে হাসলো।
–“আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে ইয়াদ ভাইয়া দুআ আপুর দিকে চেয়েই নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।”
মারিয়ার কথায় ইয়াদ পৌঁছালো অবাকের চূড়ান্ত সীমানায়।
দুআ নিজেও যেনো এখনই টপকে পড়লো গগণ থেকে।
রামিসা মারিয়ার মুখ চেপে ধরলো,
–“কিসব বাজে বকিস, মারু।ওহ ভাইয়া,এই হচ্ছে দুআ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আবার আমার দুলাভাইয়ের বোন মানে আমার তালতো বোন।এই দুআ,ইয়াদ ভাইয়ার সাথে সাক্ষাৎ কর।”
ইয়াদ দুআর পানে চেয়ে রইলো।দুআ তার দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করার অপেক্ষা করছে সে।
মাথার কাপড় ঠিক করতে গিয়ে দুআ বুঝলো তার মাথায় কাপড় নেই।আবারও এক দ্বিধায় পড়লো সে।কোনমতে মাথায় কাপড় দিয়ে সে সামনে ফিরলো।নিচে ঝুঁকানো নজর উপরে তুলতেই দুআ হতবাক।তার সামনে ইয়াদ দাঁড়িয়ে রইলো তাও,ছবিতে নয়;পেপারে নয়,টিভিতে নয়,হেলমেট পরিহিত নয়।ইয়াদের নেত্র- যুগলে তাকানোর চেষ্টা করলে দুআ বুঝলো তার ঘাড় অনেকটা উচুঁ করতে হয়েছে এই মানবের চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে।সেদিনও দুআ আন্দাজ করতে পারেনি,ইয়াদের উচ্চতা ঠিক এতটা হবে! দুইজনের চোখাচোখি হলো।
ইয়াদ দুআর নজরে যেনো নিজেকেই হারিয়েছে।সে চেয়ে রইলো তো আর দুনিয়ায় ফিরলো না।
দুআ নিজের নজর পুনরায় ঝুঁকে ফেললো।সে আজ বুঝতে পারছে, কেনো দেশব্যাপী নারী এবং স্বয়ং মাহি, রামিসা ইয়াদের ব্যাপারে এতো হইচই করে!দুআর কাছে মনে হলো, ইয়াদ যেনো সত্যি এক অপরূপ সুন্দর মানব।
ইয়াদকে আবারও চুপ হতে দেখে মারিয়া পুনরায় প্রশ্ন করলো,
–“কি হলো আজ তোমার?দুআ আপুর দিকে চেয়ে আছো তো আছোই।”
–“হ্যাঁ তো, ইয়াদ ভাইয়া।কি হলো তোমার?তোমাদের দুইজনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আর তোমরা হাই/হ্যালো কিছুই বললে না।দুআর কথা কি বা বলবো!মেয়েটা আমার এবং আমাদের বাহিনীর সামনে একরকম আর বাহিরের মানুষের সামনে অন্যরকম।এইযে তুমি এত বড় ক্রিকেটার,অথচ দেখো এই মেয়ে কেমন লজ্জায় কুঁকড়ে আছে।ওর পরিবর্তে অন্য মেয়ে হলে কি করতো বলো তো,মারিয়া?”
–“ইয়াদ,ইয়াদ আমি অনেক বড় ভক্ত একটা সেলফি তুলবো,প্লিজ!”
মারিয়ার অভিনয়ে হেসে উঠলো রামিসা।তবে ইয়াদ এখনো লজ্জায় কুঁকড়ে থাকা সেই মানবীতে আটকে রইলো।তার দৃষ্টি যেনো কিছুতেই দুআ উপর থেকে সরতে নারাজ।
–“জানো,ভাইয়া।শুধু তুমি না,সালমান খান এসে যদি এইখানে বসে থাকে তাও দুআ মাথা উঠিয়ে একটি বার দেখবে না।আমরা সব সময় তোমাকে নিয়ে কতো কথা বলি,আলোচনা করি সেখানে দুআ থাকে নীরব দর্শক।তাছাড়া তুমি কি জানো?এই মেয়ে ক্রিকেট খেলা দেখে না এমনকি সে তোমার ভক্ত না।তোমার নাম শুনেও এই পাথরের মন গলে না।”
দুআর ইচ্ছা করছে রামিসার মুখে তালা দেওয়ার।কি সুন্দর রামিসা এই মানবকে তাদের ব্যক্তিগত কথা বলে দিচ্ছে!
ইয়াদ রামিসার কথায় হেসে উঠলো,
–“এটাই স্বাভাবিক।একেকজনের ন্যাচার একেকরকম।”
লোকটার হাস্যোজ্বল বুলি দুআর কাছে গানের সুর বলে মনে হলো।এমন বাস্তববাদী ব্যক্তিক্তের হাসিমাখা চেহারা সরাসরি দেখার ইচ্ছে হলো দুআর।নজর উঠিয়ে মানবটার দিকে তাকালে আবারও তাদের চোখাচোখি হলো।এই দেখে দুআ নিজের মনে ভাবলো,
–“উনি কি আমার দিকে তাকিয়েই রইলেন?নাকি আমি দেখলেই উনি আমার দিকে নজর ফেরান?”
–“এই অনন্যা,ট্রে হাতে এইখানে দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
মারিয়ার কথায় দুআ দরজার দিকে দৃষ্টি পাতলো।
কিশোরী একটা মেয়ে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়।হাতে নাস্তার ট্রে বিদ্যমান।
–“সাহেবের নাস্তা দিতে কইলো বড় আম্মা।গরম করতে গিয়া দেরী হইয়া গেলো।অনেক্ষণ রুমের দরজা খটখটাইছি কেউ খুলে নাই দেইখা উনারে খুঁজতে আইলাম।”
অনন্যা ভীত মুখে জবাব দিলো।
–“রুমের পাশে স্টাডি রুমে রাখো ট্রে।”
–“আইচ্ছা।”
ইয়াদের কথায় অনন্যা যেতে নিলে বাঁধ সাধে জিয়া,
–“নাস্তার ট্রে নিয়ে ধেইধেই করার কি দরকার?কাজ নেই আর?মা কখন থেকে ডাকছে।নক করে দরজা না খুললে সোজা ঢুকে পড়বি।”
–“সেদিন আমারে সাহেব অনেক ঝাড়ি দিছে।তওবা,
আমি খটখটানি ছাড়া উনার রুমের ভেতরে যামু না।”
–“ও আর পারে কি? সারাদিন মানুষকে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যায় এই নিয়েই ওর ভাবনা।অহংকারী মানুষ একটা।কিরে ইয়াদ,কাজের মেয়ের সাথেও রাগারাগি করা লাগে?”
জিয়া রেগে বললো।
–“জিয়া আপু তোমার মাথা ঠিক আছে?বাসায় মেহমান।চোখ কি অন্ধ?এই তুই এখনো দাঁড়িয়ে বকবক করছিস ট্রে নিয়ে?”
ইয়াদ জিয়ার চেয়ে তিনগুণ বেশি রাগ ঝেড়ে প্রশ্ন করলো।
দুআ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।মুহূর্তেই ইয়াদ এর যেনো দ্বিতীয় রূপ দেখতে পেলো সে।দুআ খেয়াল করলো লোকটার রাগী কণ্ঠে দুআর বুকটা কাঁপছে।দুআ ভাবতেও পারলো না,বড় বোনের সাথে ইয়াদ এর ব্যবহার এমন হবে। ইয়াদের প্রতি জিয়ার ব্যবহারটাও দুআর ঢের অদ্ভুত লাগলো।
অনন্যা কাঁদো মুখে বেরিয়ে পড়লো।আর জিয়া হাঁসফাঁস করে পুনরায় চিল্লিয়ে উঠলো,
–“আমার সাথে তুই কথা বলবি না একদম।”
–“আচ্ছা।তুইও কথা বলবি না আমার সাথে।”
ইয়াদের তুই তোকারি শুনে জমে গেলো সেখানকার তিন প্রাণী,যথাক্রমে: দুআ,রামিসা এবং মারিয়া।
মাথা ঝাঁকিয়ে চিল্লানোর কারণে ইয়াদের চিক্কণ কিছু চুল কপালের উপর অবস্থান করলো।ইয়াদ সেইসব বিবেচনা না করে,ধপধপ পা ফেলে সে জিয়াকে অতিক্রম করলো।
দুআ ইয়াদের এমন দুমুখো আচরণ দেখে হাওয়ায় ভাসছে।ইয়াদ যে রগচটা মানব এটা মোটামুটি দুআর ছোট্ট মন বুঝে নিলো।
–“কিছু মনে করো না তোমরা।আমার ভাইটা এমনই।তুই তো জানিস ই রামিসা।ইয়াদ রেগে গেলে আশে পাশের মানুষের উপস্থিতি,পরিবেশ তার কাছে কিছুই পাত্তা পায় না।সে তার রাগ দেখিয়েই ছাড়বে। রামিসা আমার রুমে চল দুআকে নিয়ে।জামাল আমার জন্যে থাইল্যান্ড থেকে কি কি এনেছে সব দেখাবো।”
জিয়া মলিন মুখে বললো।
–“আরে ধুর। ইয়াদু ভাই এমনই আমি জানি। কিন্তু ভাইয়ার একার দোষ নেই এইখানে।বাদ দাও,দুআ চল।”
দুআ অবাক হয়ে সবার কর্মকাণ্ড দেখছে।দুআ রামিসার দিকে এগিয়ে গেলে মারিয়া দুআর হাত চেপে আহত সুরে বলে উঠলো,
–“দুআ আপু আমার সাথে থাকো!”
–“তুইও চল আমাদের সাথে।”
জিয়া নির্দেশ দিলো মারিয়াকে।
–“আমি যাবো না তোমার সাথে।দুআ আপু আমার সাথে থাকবে।”
মারিয়ার চোখে পানিতে টুইটুম্বর।
–“ঠিক আছে,মারিয়া।আমি তোমার সাথে থাকবো। রামিসা থাকবো?”
দুআ মলিন মুখে প্রশ্ন করলো রামিসাকে।
–“হ্যাঁ,অবশ্যই।জিজ্ঞেস করা লাগে বুঝি?এই ওকে দেখে রাখবি।”
–“একদম একদম।”
মারিয়া গমগমে মুখে হাসি দিলো।
–“জিয়া আপু ভাইয়াকে শুধু ভুল বুঝে।”
মারিয়া মুখ গোমড়া করলো।
–“এই নিয়ে মন খারাপ বুঝি?”
দুআ মাথায় বুলিয়ে প্রশ্ন করলো তাকে।
–“হ্যাঁ।ভাইয়া সবসময় আমাদের ভালো চায়।কিন্তু জিয়া আপু বুঝে না।অন্য ছেলের জন্যে ভাইয়াকে কথা শোনায়।ভাইয়া একদিন খুব মারবে সেই ছেলেকে।আমি জানি।”
দুআ তাদের পরিবারের কথা গোপনীয় ভাবে জানাটা সঠিক মনে করলো না।তাই দুআ মারিয়ার মন অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে বললো,
–“তোমাকে আমি কিছু গল্প শোনায় আমার গ্রামের।শুনবে?”
মারিয়া দুআর কোলে শুয়ে পড়লো।
–“অবশ্যই আপু।”
দুআ নিভৃতে হাত রাখলো মারিয়ার মাথায়।ছোট মেয়েটার মন ভুলাতে পেরে দুআ বেজায় খুশি।
__________________________
ইয়াদ ক্ষিপ্ত মেজাজে মিটিং শেষ করলো।দুআর সামনে সে যে খারাপ ব্যবহারের ব্যাখ্যা দিয়েছে এতে দুআ নিঃসন্দেহে তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা নিবে!এটা চিন্তা করেই ইয়াদ চটে যাওয়া মেজাজে, ম্যাচের সময়কাল আরেকটু এগিয়ে দিলো।ইয়াদ এখনো স্টাডি রুমে অবস্থান করছে।তার শরীর রি-রি করছে ক্রোধে। ইয়াদের এই রাগের আভাস কেনো যেনো দুআর সামনে আনতে চায়নি সে।কিন্তু, মনের মতো কাজ তো সর্বকালে মনের মতো হয় না।নাস্তা প্লেটে পড়ে রইলো।শুধু কফির কাপ খালি।ইয়াদ বিড়বিড় করে বলছে,
–“তার সামনেই কি মেজাজ টা এমন বিগড়ে যাওয়ার দরকার ছিলো?”
প্রকৃতি বৃষ্টির পানিতে ভিজে আঁটসাঁট হয়ে রইলো।বৃষ্টি অল্প থামতেই রিজোয়ান তার ঢাকার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে পড়লো। তাদের গন্তব্য আশেপাশের এলাকা।অবশ্য দুআর সাথে দেখা করেছে সে যাওয়ার পূর্বে।দুআ ভাইকে বিদায় জানিয়ে মারিয়ার সাথে আবারও উপরে উঠলো।তবে এইবার মারিয়া তাকে অন্যদিকে নিয়ে এসেছে।এই জায়গাটা দুআর বেশ লেগেছে। বৃহৎ আয়তনের স্ক্রিন দেওয়ালের সাথে লাগানো।তার সামনে কিছু সোফা রাখা আছে।আবার পাশে আছে কয়েকটা গদি,কুশন।সুন্দর ফুলদানি এবং দেওয়ালে বিদ্যমান সিনারির জন্যে জায়গাটা আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।দুআ সেখানকার পাশের ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো মারিয়ার সমেত।আকাশটা গুমোট অন্ধকার।বৃষ্টির গতি এখন কম।কিন্তু শরীরটা কাটা দিয়ে আসছে এমন হিম পবনে।দুআ ওড়না গায়ের সাথে চেপে ধরলো।মারিয়া দুআর নিকটে এসে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“তোমার ঝর্ণা ভালো লাগে?”
–“হ্যাঁ,আমাদের গ্রামে আছে।পাহাড়ি ঝর্ণা।”
–“তাই?আমাকে নিয়ে যেও প্লিজ তোমাদের গ্রামে গেলে।”
–“অবশ্যই নিয়ে যাবো।”
দুআ উত্তর দিলো।
–“কিন্তু আমাদের বাড়িতে আর্টিফিসিয়াল ঝর্ণা আছে।দেখবে?”
–“সত্যি তাই!”
মারিয়া মাথা দুলিয়ে দুআর হাত ধরলো পুনরায়।ঘরের বাম দিকে একেবারে শেষ মাথায় নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই স্টাডি রুম থেকে ইয়াদ বের হলো।মারিয়া দুআর পূর্বে অবস্থান করার কারণে সে ইয়াদের ধাক্কা থেকে বাঁচলেও দুআ বাঁচতে সক্ষম হলো না।
ইয়াদ দুআর বাহু চেপে ধরলো।ভীত মনে দুআ কম্পনরত।ইয়াদ দুআর বাহু চেপে সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো,
–“ঠিক আছো তুমি?”
–“হ্যাঁ।”
দুআ ছোট শব্দে বললো।
ইয়াদের বুক ধকধক করছে।মেয়েটার সংস্পর্শে এসে তার কন্ঠ কর্ণধার করে ইয়াদের মনে অন্য অনুভূতির জানান দিচ্ছে।দুআর কাছাকাছি এসে ইয়াদের সকল মন খারাপ যেনো কোথায় উবে গেলো।
–“ইয়াদ ভাইয়া,তুমি দুআ আপুকে একটু দেখে রাখো।আমি আমার মোবাইল নিয়ে আসি।দুআ আপুর সাথে কিছু কাজ আছে।”
মারিয়া দাঁড়ালো না আর।ইয়াদ এবং দুআকে একা রেখে মারিয়া স্থান ত্যাগ করলো।
দুআ অন্যপাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।পাশে ইয়াদের নজর সম্পূর্ণ দুআতেই সীমাবদ্ধ।দুআর সাথে কথা বলার মতো কোনো বিষয় খুঁজে না পেয়ে সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুআকে সে প্রশ্ন করলো,
–“সেদিন কি বেশি ব্যাথা পেয়েছিলে?”
দুআ হতবাক।দুআ বুঝতে পেরেও বুঝলো না ইয়াদ কোনদিনের কথা বললো!
–“কোনদিন?”
দুআ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করলো।
–“বাইকের ঘটনা কি ভুলে গেলে?ভাগ্যিস সঠিক সময়ে ব্রেক করেছিলাম। পরেরবার অন্যের ভালো করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করতে বসো না।”
ইয়াদ হেসে জবাব দিলো।দুআ ইয়াদের পানে একবার দৃষ্টি বুলালো।ইয়াদ এখন একেবারে হাস্যোজ্বল।দুআ বুঝতে পারলো না ইয়াদ কিভাবে বুঝতে পারলো সে মেয়েটাই দুআ ছিলো!দুআর প্রশ্নে ঘেরা মনের প্রশ্ন মনেই থেকে গেলো।
–“ঠিক ছিলাম সেদিন।আপনাকে অনেক শুকরিয়া সেদিনের জন্যে।”
দুআ এইবার একটু হাসলো।ইয়াদের মন দুআর হাসিতে লুটিয়ে পড়লো মুহূর্তেই।দুআর শুভ্র চেহারার পবিত্র হাসি, পবিত্র চাহনি, যেকোনো মনকে মুহূর্তেই গলাতে সক্ষম।ইয়াদ বুঝলো এখন তার মনের অবস্থাটা যেমন বারোটা বাজলো, এমনটা কখনো হয়নি।এই মেয়ের লাজুক হাসিতে ইয়াদের মনটা শহীদ হলো যেনো।বুকের বাম পাশে হাতটা অনায়াসে রাখলো ইয়াদ।এতো ভালোলাগার অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি ইয়াদ।এই অনুভুতির নাম কি দিবে,এই ক্রিকেটার?তাহলে কি এই সহজ সরল মেয়েটার উপর ক্রিকেটার তার পাথর মনটা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো! কোনো উত্তর আসছে না মন থেকে। তাহলে কি তার মনে এই অনুভূতি বোঝার জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন?
–“সরি আসতে দেরী হয়ে গেলো।মোবাইলটা পাচ্ছিলাম না।অনেক খুঁজে পেলাম।”
মারিয়া কথাটা বলে দুআকে শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু, ইয়াদের হুঁশ নেই।তার মনে হলো,প্রথম দেখায় দুআর প্রতি তার মনটা এমন কিছু অনুভব করলো,যেটা ইয়াদের আগে কখনো অনুভব হয়নি।তবে কিসের এত অস্থিরতা এই মনে!ইয়াদের এমন হৃদয়ক্ষরণের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে।এক প্রকার দ্বিধায় জড়িয়ে পড়লো যেনো। এই অনুভূতি পরখ করতে যেনো এখন প্রয়োজন শুধু সময়ের।
চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।পেজের রিচ কম তাই হয়তো গল্প সবার কাছে যায় না।সাইলেন্ট রিডার্স আপনারা গল্প পড়ে রিয়েক্ট দিবেন এবং কমেন্ট করবেন।