নাইওরি পর্ব ১২
মৌরি মরিয়ম
হারুন ব্যাপারী আসরের নামাজ পড়ার জন্য পুকুর থেকে ওযু করে এলেন। এসে দেখেন ধুনারি (লেপ তোষক বানানোর কারিগর) এসে উঠানে বসে আছে। তিনিই ডেকেছেন নতুন লেপ বানানোর জন্য। পুরোনো লেপগুলো অল্প দিনেই ভারী হয়ে গেছে। গায়ে দিতে কষ্ট হয়। তুলা ভালো পড়েনি। তাকে দেখেই হারুন ব্যাপারী বললেন,
“কি হে ধুনারী, তোমাকে বলছিলাম সকালে আসতে। এটা একটা আসার সময় হইল?”
“বেইন্যাবেলায় ম্যালা কাম আছিল ব্যাপরীসাব। মাফ করবেন।”
“দাঁড়াও তোমার চাচীরে ডেকে দেই। সে যেমন লেপ চায় তেমন করেই বানাইয়া দিও। খরচ বেশি পড়লে দাম বেশি নিবা। জিনিস যেন ভালো হয়।”
“জিনিস নিয়া আমনে কোনো চিন্তা কইরেন না সাব। খুব ভালো কইরা বানাইয়া দিমু।”
হারুন ব্যাপারী ভেতরে ঢুকতেই তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম এসে বললেন,
“আব্দুর রহমান আসছে। আপনের সাথে দেখা করতে চায়। বললো খুব জরুরি।”
“নামাজটা পড়ে যাইতেছি। ধুনারী আসছে উঠানে বসা। যাও তারে মাপঝোপ সব বুঝাইয়া দাও।”
“আচ্ছা।”
হারুন ব্যাপারী নামাজটা সেড়ে কাচারি ঘরে গেলেন। আব্দুর রহমান তার মাছের আড়তের এক কর্মচারী। খুব বিশ্বস্ত লোক। তাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়ালো, চোখেমুখে আতঙ্ক। তিনি বললেন,
“বসো আব্দুর রহমান। আমি তো একটু পরেই আড়তে যাইতাম। কী এমন জরুরি খবর যে এতদূর থেকে বাড়ি আসলা?”
“সর্বনাশ অইয়া গেছে চাচা।”
হারুন ব্যাপারী ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কী সর্বনাশ? সরাসরি বলো।”
“উকিলসাব খুন অইছে।”
চমকে উঠলেন হারুন ব্যাপারী। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বের হলো,
“আলমগীর মৃধা খুন হয়েছে?”
“জি চাচা। রাইতের অন্ধকারে গলা কাইটা হ্যার বাড়ির রাস্তায় ফালাইয়া রাখছে। আমনেরে কইছিলাম জয়নাল মির্জা দরকারে খুনও করতে পারে। এর আগেও হে এরহম অনেক কাম করছে।”
হারুন ব্যাপারী একটুও সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ পটুয়াখালী রওনা দিলেন।
জেসমিন দুপুরবেলা পুকুর থেকে গোসল করে এসে চুল ঝারছিল। তখন মতি এলো রঞ্জুর চিঠি নিয়ে। রঞ্জুকে চিঠি পাঠানোর এক দিন পর থেকেই নিয়মিত মতিকে পোস্ট অফিসে পাঠায় সে। চিঠি না আসা পর্যন্ত পাঠাতে থাকে। চিঠিটা হাতে নিয়ে জেসমিন সোজা নিজের ঘরে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর আয়েশ করে পা ঝুলিয়ে বসে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো,
তুমি নেই সঙ্গে সখি
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছো তুমি অঙ্গে সখি
আছো পরশও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয় কোঠর
ফুরাবেনা গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখি
তুমি নেই কক্ষে,
আছো তুমি রোমন্থনে
আছো স্মৃতির দংশনে।
প্রিয় জেসমিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি। আশা করি তুমিও ভালোই আছো। গত সপ্তাহে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছো। তুমি যাওয়াতে তারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছেন।
তোমার কামিনী গাছ দেখি ভালোই কথা শিখেছে। এরপর গেলে তাকে বলো, খুব দ্রুতই তার কাছে আমাদের ভালোবাসার সুবাস পৌঁছাবে।
আর শোনো মেয়ে, কামিনী ফুল শীতকালে ফোটে না। এটা বর্ষার ফুল। বর্ষা আসলেই আবার ফুটবে তুমি আমি থাকি বা না থাকি।
জেসমিম আর কটা দিন একটু কষ্ট করো। আমি এখন বাড়ি গেলে এই একমাস আমার ঢাকা থাকা বৃথা। কারণ আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষাগুলো দিয়ে চলে আসব। এরপর থেকে আর ক্লাস করব না শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেব। তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্যে কতটা কষ্টের আশা করি বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো আমার ফুল। খুব শীঘ্রই তোমার নাইওর শেষ হবে।
ভালোবাসা নিও।
ইতি তোমার রঞ্জু।
আলমগীর মৃধার মৃত্যুর আগেই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল। হারুন ব্যাপারী আলমগীর মৃধার সহকারীর কাছ থেকে সকল তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে শুনানির দিনে আদালতে উপস্থিত হন। বাদী পক্ষের উকিল জীবিত না থাকায় আদালতে উপস্থিত হতে পারেন নি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সকল তথ্য প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে। বিবাদী পক্ষ সমনপত্র গ্রহন করেও আদালতে উপস্থিত না হওয়াতে সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কালিসুরির জমির দখল হারুন ব্যাপারীকে হস্তান্তর করেছে আদালত। উক্ত জমিটি এতদিন অন্যায় ভাবে ভোগদখলের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ জয়নাল মির্জাকে জরিমানা করা হলে হারুন ব্যাপারী জানালো সে ক্ষতিপূরণ চায় না। জমি ফেরত পেলেই সে খুশি। হারুন ব্যাপারী ভীষণ আনন্দিত। অবশেষে তার স্বপ্নের জমিখানা তার হলো। জয়নাল মির্জাকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেল না। সে বিনাবাক্যে জমির দখল ছেড়ে দিল।
চলবে…
আগের পর্ব,
https://facebook.com/100044423166701/posts/552183136272454/