#আমার_চন্দ্রাবতী পর্ব ৬+৭
লেখিকা- সালসাবিল সারা
কলেজের পাঠ চুকলো বেশ কিছুক্ষণ।চার বন্ধু-বান্ধবী কলেজের মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে মন প্রাণ উজাড় করে।মেঘলা আবহাওয়ায় চলমান তীব্র পবনের ঝটকায় আড্ডা চালিয়ে যেতে বেশ লাগছে তাদের।আগামীকাল দুআ এবং রামিসা ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে।তাই কয়েকদিনের যেই আড্ডা বাদ যাবে,সেটা আগে থেকে যেনো পুষিয়ে নিচ্ছে তারা।কলেজ ইতিমধ্যে জনশূন্যে পরিণত হচ্ছে।অনার্সের শিক্ষার্থীগণ তাদের শ্রেণী কার্যকলাপের জন্য ভবনের ভেতরে।তাই কলেজের চারিদিকের পরিবেশ বেশ শান্ত।
মনের খোরাক মিটিয়ে আড্ডা দেওয়া শেষ হলে চারজন বেরিয়ে পড়লো কলেজের আয়তন থেকে। সামনের দিকে কিছুটা এগোতেই দুআ সবার উদ্দেশ্যে বললো,
–“ফুচকা চলবে নাকি?”
–“চলবে মানে,দৌড়াবে আজব!”
মাহির কথায় হাসলো সবাই।কলেজের থেকে অল্প দূরত্বের সেই ছোট দোকানে ভিড় জমালো চারজন।ফুচকা আসা অব্দি আবারও তারা আলোচনায় ব্যস্ত হলো।মাহি টেবিলে একহাতে ভর চেপে দুআকে প্রশ্ন করলো,
–“তুই আমার আগেই ইয়াদুকে দেখে ফেলবি। তাই না?”
–“উনি আমার দেখা পাওয়ার জন্যে বাসায় বসে থাকবে?উনার খেলা নেই বুঝি?তাছাড়া উনার সাথে দেখা করার আমার কোনো তলব নেই।আমার যতো তলব হলো,ঢাকায় ঘুরাঘুরি করা।”
দুআ নেত্রযুগলের আয়তন ছোট করে জবাব দিলো।
–“ইসস,চাঁদের বাচ্চা! তুই কি জানিস,ইয়াদ ভাই এখন ছুটি কাটাচ্ছেন? তার বাসায় গেলে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ৮০%।আর আমি ভাইকে বলেই রেখেছি,আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।ভাই কি জবাব দিলো জানিস?”
দুআ মাথা নাড়ালো রামিসার কথায়,
–“আমি কিভাবে জানবো?আমি কি মনোবিজ্ঞানী?”
–“ইয়াদ ভাই বললো,ভাই অবশ্যই বাসায় থাকবে।কতো মাস পর আমার ভাইকে দেখবো!”
রামিসা দুই হাত এক করে আকাশের পানে তাকালো।মুখে তার মিষ্টি হাসি।
–“তুই কেনো এত খুশি হচ্ছিস,রামিসা?এমন ভাব করছিস ইয়াদের সাথে তোর দেখা হয় না?একটা মানুষ কিভাবে এতো নাট্যকার হয়?”
সঞ্জয় মুখ ভেংচি দিলো রামিসার পানে চেয়ে।
–“ঐ চুপ সবাই! বর্তমানে আমি জেলাসিত।দুআর উপর আমার হিংসা হচ্ছে।”
মাহি দাঁতে দাঁত চাপলো।
দুআ তার সরু ভ্রুযুগল নিলো কুঁচকে।মাহির কথা তার বোধগম্য হলো না,
–“আমি কি করলাম?”
–“আমার পূর্বে তুই কেনো দেখবি ইয়াদুকে?”
মাহির এমন প্রশ্নে দুআ মুখ ফসকে সেদিনকার ঘটনার কথা বলেই দিচ্ছিলো,এর পূর্বে নিজেকে সংযত করলো সে,
–“ইয়াদ কোন ক্ষেতের মূলা আবার?উনার সাথে দেখা করলে কি আমাকে পরীক্ষায় এ’প্লাস দিবে?নাকি আমাকে বড় কোনো পদে চাকরি দিবে?কিসব কাপজাব মার্কা কথা বলিস মাঝে মাঝে এটাই আমি বুঝিনা।”
দুআ নিজের দৃষ্টি লুকালো সবার অগোচরে।মনে মনে যে জপলো,
–“দেখা তো অনেক আগেই হয়েছে তোর ইয়াদের সাথে।কিন্তু আফসোস,আমরা দুইজনই দুইজনের কাছে আগুন্তক ছিলাম।দেখা হলে,একটা সুযোগ থাকবে কৃতজ্ঞতা জানানোর।”
কিন্তু আবারও সে পরক্ষণে ভাবলো,
–“উনি আমাকে চিনবেনই না।আর আগ বাড়িয়ে কথা বলা আমার রুচিতে নেই।এতো ব্যস্ত মানুষের কি সেই ঘটনার কথা মনে থাকবে?উহু,একদমই না।দেখা যাবে,আগ বাড়িয়ে কিছু বললে আমারই দুর্নাম হবে।আর দুআ কখনো নিজের দুর্নাম করাতে চাই না।মরে গেলেও না।ইয়াদ এর ব্যাপারটা চেপে যাওয়া ভালো।উনার সাথে দেখা হলেও আমার কিছু যায় আসে না।”
দুআ অন্যমনস্ক।এর মধ্যেই সঞ্জয়ের চেঁচামেচিতে কেঁপে উঠলো সে।
–“শালা,এতো কি ভাবিস?তোর তো প্রেমের কোনো তৃষ্ণা নেই।অর্থাৎ, তুই কোনো ছেলে নিয়ে ভাবছিস না।তাহলে ভাবছিস কি নিয়ে?”
–“ঐ,তোর জন্যে কি ও কিছু ভাবতে পারবে না?সঞ্জয়ের বাচ্চা তোর সমস্যা কি?”
রামিসা ক্ষেপলো।
–“আজব,সমস্যা কি তোদের?”
মাহির পাল্টা প্রশ্ন।
দুআ নিজের কানে হাত রেখে সজোরে বলে উঠলো,
–“ফুচকা গিল চুপ করে।নাহলে সব আমি সাবাড় করছি!”
–“আফা,মেজাজ ঠান্ডা গরো।”
রামিসা দুআর মাথায় হাত রেখে চাটগাঁ ভাষার ব্যবহার করলো।আর এই শুনে “হি হি” করে হাসির রোল পড়লো সকলের মাঝে।দুআর বেজার মুখখানাও অট্টহাসিতে রাঙা হলো।
ফুচকা খাওয়া শেষে সবাই বেরিয়ে পড়লে,দুআর নজরে এলো তার গাড়ি।রামিসা তার সমেত যাবে আজ তারই বাসায়।কিন্তু, দুআ দু কদম সামনে দিতেই তার সম্মুখে এক পুরুষ এসে হাজির হলো।দুআ চমকে আগানো দু কদম আবারও পেছালো,অতঃপর সে গিয়ে ঠেকলো মাহির সাথে।
–“আপনি কে?”
সঞ্জয় প্রশ্ন ছুঁড়লে লোকটা হাসিমুখে বলে উঠলো,
–“আমি ইশফাক।তোমরা এই কলেজে পড়ো?”
মাহি নিজের এপ্রোনের একপাশে কলেজের লোগো দেখিয়ে জবাব দিল,
–“সেটাই তো মনে হচ্ছে।আপনি বোধ হয় অন্ধ!”
ইশফাক হচঁকিয়ে উঠলো।এমন কথার জবাব সে আশা করেনি,
–“অন্ধ না।অন্ধ হলে, এতো মোহনীয় মেয়ের সন্ধান পেতাম কিভাবে?”
দুআর দিকে ইশফাক এর নজর।দুআ সেই নজর লক্ষ্য করে একটু নোংরামির আভাস পেলো।ছেলেটার নজর দুআর পছন্দ হয়নি বৈকি।
–“এইসব বলে লাভ নেই।এই দুআ চল তো।”
রামিসা তাড়া দিয়ে বললো।
–“মিস,দুআ।আমার কথাটা যদি একটু শুনতে!”
দুআ বন্ধুদের বা পরিবারের সামনে যতো প্রাণবন্ত,
বাহিরের মানুষের সামনে ততোই বেশি ভীত এবং চুপচাপ প্রকৃতির রূপ ধারণ করে।তাও কাহিনী আগে যেনো না গড়িয়ে যায়,সেই ভেবে দুআ স্ফীত স্বরে বললো,
–“আমি বাহিরের লোকের কথা শুনতে চাই না।”
–“তুমি চাইলে আমি বাড়ির লোক হতে…”
ইশফাকের কথা শেষ হওয়ার পূর্বে মাহি চেঁচিয়ে উঠলো,
–“আস্ত লুচ্চা লোক তো আপনি!”
দুআ মাহির হাত চেপে ইশারা করলো,চুপ থাকতে।এর মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে এলো দুআর বাবার এক কর্মচারী,
–“ছোট আম্মাজান,কোনো সমস্যা হইসেনি?অনেক্ষণ ধইরা দেখি এই লোক এইহানে।প্রথমে স্যার ভাইবা নামলাম না।এহন দেহি!”
লোকটা এক ভ্রু কুঁচকে ইশফাকের দিকে তাকালে ইশফাক ভয় পায়।কৃষ্ণ বর্ণের লোকটাকে তার হিংস্র মনে হলো।নিজের মান সম্মান এবং প্রাণ বাঁচাতে ইশফাক মনে করলো, এইখান থেকে কেটে পড়াই উত্তম!দুআর দিকে আবারও তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে সে দ্রুত পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো।
–“ঐ বেডা!”
–“থামো চাচা।আমি ঠিক আছি।চলো যায়!”
দুআ সেই কর্মচারিকে থামিয়ে দিলো।বাড়তি ঝামেলা দুআর সর্বকালের অপ্রিয়।মাহি আর সঞ্জয়কে পুনরায় বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো দুআ এবং রামিসা।
দুআ বেশ ধীর গলায় কয়েক শব্দ রামিসার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করলো,
–“এইসব কথা মাইশা আপুকে একদম বলবি না।আপু জানলে ভাইয়ার কানে যাবে আর ভাইয়া ঠিকই এই ছেলের খোঁজ করে কথাটা আরো বেশি বিগড়ে ফেলবে।আর বাবা জানলে তো কথায় নেই।”
–“চাপ নিস না।আমি কিছুই বলবো না।”
দুআর বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো নিঃশ্বাস।
রামিসা দুআকে সাহায্য করলো ব্যাগ গোছাতে।তারা পাঁচদিনের সফরে যাচ্ছে ঢাকায়। রিজোয়ান এবং তার মামা হোটেলে অবস্থান করলেও,দুআ; রামিসা এবং তার মায়ের সাথে আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করবে।এই বিষয়ে দুআর মা এবং বাবাকে রাজি করাতে স্বয়ং রামিসার মা এসেছিল তাদের বাসায়।রামিসার পরিবারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তাদের।এছাড়াও রিজোয়ান তার ভরসায় দুআকে ছাড়ার অনুমতি দিতে বললো তার চাচাকে।সবকিছুর ঊর্ধ্বে মেয়ের খুশির কথা বিবেচনা করে জমিদার তার মতামত পরিবর্তন করেনি।মেয়েকে সবার ভরসায় ছাড়ার সাহস দেখালেন উনি।অবশ্য,সকলেই জানে;দুআর কিছু হলে জমিদার কাউকেই ছেড়ে দিবে না।
সকালে উঠে তৈরি হলো দুআ।সব সময়ের মতো লম্বা হাতার কামিজ পরিধান করলো সে।সুন্দর এই গোলাপী রঙের কামিজে দুআকে চমৎকার লাগছে। গত বছর ইদে এই জামা সে শহর থেকে কিনেছিলো।এমন অনেক কামিজ সে ব্যাগে নিয়েছে নানাদিক ঘোরার পরিকল্পনা করে।মাথার তালুতে ওড়না আটকে দুআ তার মাকে ডাকলো।আহেলি মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলো মেয়ের রূপের বর্ণনা দিয়ে।দুআ নিজের মায়ের কথায় মুচকি হাসছে।তার মায়ের চোখে সে যেনো সবচেয়ে সুন্দরী নারী!কাজের মেয়েকে ডেকে দুআর ব্যাগ নিচে নেওয়ার নির্দেশ দিলো আহেলি।দুআ মায়ের হাত চেপে নিচে নামছে।
সকলকে বিদায় জানিয়ে রিজোয়ান এবং দুআ গাড়িতে উঠে পড়লো।অসুস্থ দুআর কাকিমা দুইতলা থেকেই হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়েছে তাদের। রিজোয়ানের এই বড় গাড়ি করে সবাই ঢাকায় পাড়ি জমাবে।এই মুহুর্তে তারা যাচ্ছে রামিসার বাসায়।সেখানে তার মা এবং রামিসা উঠে পড়বে রিজোয়ানের গাড়িতে।
গাড়ি থেমে রইলো গেইটের সামনে।দুআ পেছনের সিটে বসে দৃষ্টি জ্ঞাপন করে আছে রামিসার বাসার পানে।
আকাশটা মেঘলা আজও।বর্ষাকালের আগমন যে হতে চলেছে!এই গুমোট আকাশ যেনো একমুঠো বর্ষণের অপেক্ষায় আছে!হালকা পবনের ঝটকায় দুলে যাচ্ছে গাছের পাতা,রাস্তার কাগজ এবং ময়লা। রামিসা দুআর দৃষ্টিতে এলে দুআর হাসি চওড়া হয়।কিন্তু হাসিটার ক্ষণকাল, বেশিক্ষণ হলো না।রামিসার মায়ের পিছনে তার কাকী তথা তাসনিমকে দেখে দুআর মনটা বিষাদে পূর্ণ হলো।এই মহিলাকে দুআ প্রচণ্ড ভয় পায়।এই বাড়িতে আসলে মহিলাটা সকলের আড়ালে দুআকে নানান ভাবে হেনস্তা করে।এতমাস যাবত এই মহিলা তার বাপের বাড়ি ছিলো, বিধায় নির্দ্বিধায় দুআ রামিসার বাড়ি আসতো।
এই মহিলা কবে ফিরেছে এটা কেনো রামিসা তাকে জানায়নি, এটাই দুআ ভেবে কুল পাচ্ছে না।অত্র মহিলার খারাপ ব্যবহারের কথা দুআ শুধু রামিসাকে জানিয়েছে। যার দরুণ,এই বাড়িতে দুআ এলে রামিসা সর্বদা তাকে রক্ষা করে।তারপরও কিভাবে যেনো সুযোগ বুঝে এই মহিলা দুআকে কটু কথা শুনিয়ে দেয়! এইদিকে রামিসার পরিবারের মান-সম্মান খোয়ানোর ভয়ে ব্যাপারটা সে তার পরিবারকে কখনো জানায়নি।
সকলে গাড়িতে উঠে পড়লে গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।
–“তাসনিম কাকী কবে ফিরলো?”
–“আজ ভোরেই।দেখি ব্যাগ নিয়ে হাজির।অদ্ভুত মহিলা।তুই ভাবিস না।আমি তোর সাথে সাথেই থাকবো।”
দুআর কথার জবাবে রামিসা উত্তর দিলো।
–“ওহ।দজ্জাল মহিলাকে খুবই ভয় করে আমার।তোর আত্মীয়ের বাসায় আমায় হেনস্তা করলে আমি তো শেষ,রামিসা।”
দুআর ভীত কণ্ঠ।
–“আরে,রিজোয়ান ভাই আছে।উনি আত্মীয়ের বাসায় তোর দিকে ভয়ে চোখ তুলেই দেখবে না আমার দুলাভাইয়ের জন্যে।দুলাভাই কেমন সেটা কাকী ভালো জানে।”
দুআ নিঃশ্বাস ছাড়লো।কেমন যেনো শূন্য শূন্য লাগছে তার এই তাসনিম নামের মহিলার আগমনে।
কিছুদূর পথ যেতেই দুআ নিদ্রায় শায়িত হলো।রামিসা খুবই যতনে দুআকে নিজের কোলে শায়িত রেখেছে।রাস্তাভর এই মেয়ের দেখভাল করে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো রামিসা।এর একটাই কারণ,গতবারের দুআর ঢাকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা!
মধ্যরাতের অন্তিম কালে ঢাকায় পৌঁছে তারা রামিসার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলো।তাদের নামিয়ে দিয়ে রিজোয়ান তার মামার সমেত চলে গেলো হোটেলে।
যাওয়ার পূর্বে সে বারংবার রামিসার মা এবং তাসনিমকে দুআর খেয়াল রাখতে বলেছে।তাসনিম হিংসুক মুখে দুআর দেখভাল করার আশ্বাস দিলো রিজোয়ানকে।
মাথায় তীব্র যন্ত্রণা আড়াল করে হাসিমুখে সবার সাথে আলাপ করছে দুআ।তাসনিমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে অল্প কিছু খাবার খেয়ে রামিসাকে নিয়ে তাদের জন্যে নির্ধারণ করা কামরায় চলে এলো সে।
–“খারাপ লাগছে,চাঁদ?”
–“মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে রে।প্রচুর যন্ত্রণা।”
দুআ অসহায় ভঙ্গিতে বললো।
–“আম্মাকে বলবো?”
–“নাহ।দোহায় লাগে তোর।তাসনিম কাকী জানলে আমাকে সবার সামনে জলিল করবে।একটু মাথা টিপে দে।”
–“আয়।”
রামিসা দুআর মাথায় অল্প পানি দিয়ে আলতো হাতে মাথায় মাসাজ করতে আরম্ভ করলো।ঢাকার পরিবেশটা আজ গুমোট লাগছে দুআর।যেনো আকাশ চিরে এখনই ভয়ংকর কিছুর আগমন হবে! হলোই তা। গুড়ুম করে তীব্র শব্দ হলো বজ্রপাতের।বদ্ধ চোখ জোড়া খুলে ফেললো দুআ।আলোর ঝলকানি তার দৃষ্টিতে এলো।আবারও শব্দ হওয়ার পূর্বে দুআ নিজের কানে হাত রাখলো।মিনিট দু’এক পরেই ঝরঝর করে নামলো গগণ থেকে পানির ধারা।বদ্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে দুআ বৃষ্টির পানির আগমন দেখছে।এই মুহূর্তে সে যদি তার বাড়ি থাকতো,তবে রুমের বড় ব্যালকনিতে গিয়ে পা ভেজাতে একটুও দেরী করতো না!দুআর ভাবলেশহীন দৃষ্টি এখনো কাঁচের জানালায় আবদ্ধ।
________________________
ছাদে ক্রিকেট অনুশীলন শেষে ইয়াদ সোজা এলো নিজের রুমে।আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ক্লান্ত সে। কাল রাতে ভারী বর্ষনের কারণে মাঠের অনুশীলন আজ বাদ পড়েছে।অগত্য সকালের নিদ্রা থেকে সজাগ হয়ে এই খবর পেয়ে সে ছাদে চলে গেলো অনুশীলন করতে।ইয়াসির তার সাথে দেখা করবে জানালে,ইয়াদ জানালো তাকে বাসায় আসতে।
গোসল সেরে বেরুতেই ইয়াদ অনুভব করলো তার ব্যালকনিতে অন্য কারো উপস্থিতি। ঘাড়ের উপর থেকে তাওয়াল সরিয়ে ইয়াদ দ্রুত বিছানায় রাখা তার টিশার্ট জড়িয়ে নিলো গায়ে।ব্যালকনিতে গিয়ে ইয়াদের আঁখি বিস্ফোরিত হলো যেনো।অল্পবয়সী এক মেয়ে তার ব্যালকনির পানি পরিষ্কার করছে।ইয়াদ প্রচুর বিরক্ত এমন দৃশ্য দেখে। বিনা অনুমতিতে তার রুমে প্রবেশ করা,সে সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করে।না চাওয়া সত্ত্বেও সে মেয়েটিকে ধমক দিলো,
–“এই মেয়ে কে তুমি?”
মেয়েটা ভয় পেলো যেনো! চমকে উঠে হাতে থাকা বালতি শব্দ করে নিচে রাখলো।ইয়াদকে এমন সরাসরি দেখে মেয়েটার চোখ চড়কগাছ।ভেবেছিলো ইয়াদের সাথে সে রসিক ভাব জুড়বে।তার সাথে ছবি তুলে বস্তির সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে।কিন্তু, মেয়েটার স্বপ্ন যে কোনোদিনও পূরণের নয়!মেয়েটাকে চুপ থাকতে দেখে ইয়াদ একহাত বাঁকিয়ে আবার তাকে প্রশ্ন করল,
–“কি?আকাশ থেকে টপকে পড়েছো?”
ইয়াদের গমগম শব্দে মেয়েটা যেনো এখন কেঁদেই দিবে।কোনোভাবে নিজেকে সামলে সে তিন লাইন বলতে সক্ষম হলো,
–“বড় আম্মা কইলো সব রুমের বারান্দা থেকে পানি পরিষ্কার করবার জন্যে।আমি সব রুম ধারাবাহিক ভাবে পরিষ্কার কইরা ফেলাইছি।এটাই শেষ রুম আছিলো।”
–“আমার অনুমতি ছাড়া রুমে এসেছো কিভাবে? আম্মি বলেছে আমার রুমে আসতে? আম্মি, আম্মি?”
ইয়াদ শেষ বাক্য আওড়াতে আওড়াতে রুম থেকে বের হলো। ডালিয়া ছেলের ডাকে নিজের রুম থেকে গমগমে বেরিয়ে,এগিয়ে আসলো ছেলের কামরার দিকে,
–“আব্বা,কি হয়েছে?”
এর মধ্যে অনন্যা ইয়াদের রুম থেকে বালতি হাতে বেরিয়ে এসেছে।ইয়াদ সেদিকে লক্ষ্য করে চোখ বুঁজে নিলো। দাতে দাঁত চাপলো সে,
–“এই মেয়ে আমার রুমে কি করে?তুমি জানো,আমার রুমে কেউ নক করে না আসলে আমার মেজাজ খারাপ হয়।এই মেয়ে..!”
ইয়াদ আর কিছু বলল না।রাগে তার শরীর যেনো তরতর করছে। ডালিয়া ছেলের এমন কান্ডে চুপ করে রইলেন।তিনি জানেন ইয়াদের বানানো নিয়মে ব্যাঘাত ঘটলে ইয়াদের রাগের সীমা থাকে না।তাও ইয়াদকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করে তার মা বললো,
–“মেয়েটা নতুন এসেছে কাজে।আমার অনুমতি নিয়েই সবার ব্যালকনি সাফ করতে গেলো।গত দুইদিনের বৃষ্টিতে ব্যালকনি স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাচ্ছিল,তাই!”
–“আম্মি,আমার নিয়মটা মেয়েটাকে জানিয়ে দিও।আর প্লিজ,এইসব ব্যাপারে একটু খেয়াল রাখবে।অযথা কেউ আমার রুমে আসুক,এটা আমি চাই না।অন্তত আমি থাকা অবস্থায় না।আমার রুম পরিস্কার করতে হলে আমার অবর্তমানে করতে বলবে।”
ইয়াদ রুমে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হলে দেখে,মেয়েটা দরজার সামনে সটান দাঁড়িয়ে রইলো।
–“মুভ!”
ইয়াদের কথা বুঝতে না পেরে অনন্যা ভেলকার মতো চেয়ে রইলো তার দিকে,
–“হো?”
ইয়াদ মুখে “চ” উচ্চারণ করতেই ডালিয়া অনন্যাকে বললো,
–“এইদিকে সরে আয়।”
অনন্যা সরে এলো।ইয়াদ রুমে প্রবেশ করে সশব্দে বন্ধ করলো দরজা। অনন্যা বুকে হাত চেপে জোরে দম ফেললো,
–“মাগো মা।ডরাইছি।”
–“ইয়াদের রুমে যাবে না তুমি।যখন প্রয়োজন আমার নির্দেশে যাবে।ছেলেটা তার নিয়মের ব্যাঘাত একেবারেই পছন্দ করে না।”
–“ওরে মা,আমার বয়েই গেলো আর ইয়াদ সাহেবের সামনে আইবার!আমার সখ মিইটা গেছে এই আগুনের গোল্লার সামনে আইসা।”
ডালিয়া শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হাসলো অনন্যার কথায়।
.
ইয়াসির আসলে তাকে নিয়ে লিভিংরুমে আলোচনায় বসলো ইয়াদ।ঢাকায় আশেপাশের কোনো জায়গায় ভ্রমণের জন্যে তারা আপাতত ভাবছে।ইয়াদ সোফায় নিজের গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
–“আবহাওয়ার যা অবস্থা,রাস্তাঘাট খারাপ।যাবি,
শিউর?”
–“যাবো।আমার বুকে আনচান করছে।আমার ট্যুরে যাওয়া এখন বাধ্যতামূলক।”
ইয়াসির অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলো।
–“আমার মনে হয়, না যাওয়া বেটার।বৃষ্টিতে অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।দেখি,আজ এবং কাল বৃষ্টির তেজ কেমন হয়!যদি কম থাকে,তাহলে যাবো।আর যদি বেশি হয়, তাহলে না।”
ইয়াদ কথাটা বলে ঘাড়ে হাত ঘষলো।
–“ঠিক আছে।তোর খেলার কি খবর?”
–“দুই সপ্তাহ পর থেকে আবার সিরিজ শুরু।”
ইয়াদ নিঃশ্বাস ছাড়লো মুখ দিয়ে।
–“বিরক্তিকর তাই না?”
–“নাহ,বরং আনন্দের। আই লাভ ক্রিকেট।এটা আমার একমাত্র নেশা।”
ইয়াদ ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো কথাটা বলে।
দুই বন্ধু আলোচনায় ব্যস্ত।
খানিকক্ষণ বাদে সেখানে আগমন ঘটলো জিয়া এবং ডালিয়ার।আয়তনে বিশাল লিভিংরুমের অপর প্রান্তের সোফায় বসতেই,কাজের মহিলা দুইজন বড় আকারের ফুলদানি এবং শোপিজ এনে যথাযথ স্থানে রাখলো।তখনই ঘুম ঘুম চোখে মারিয়া ইয়াদের পাশে এসে বসে তার মাকে চিল্লিয়ে প্রশ্ন করলো,
–“আম্মি,কেউ কি আসবে?তোমার প্রিয় জিনিসপত্র রাখছো লিভিংরুমে!”
–“হাত মুখ না ধুয়ে এইখানে কি?উঠে আয় মা। কাল তোর ছোট ফুফু আসবে।”
ডালিয়া মারিয়ার সংস্পর্শে এসে তার গাল ছুঁয়ে বললো।
মারিয়া লাফিয়ে উঠলো আনন্দে,
–“সত্যি?তারা আসবে কালকে?রামিসা আপু আর দুআ আপুটাও কি আসবে?”
–“হ্যাঁ,সবাই আসবে।বৃষ্টির জন্যে আজ আসতে পারেনি।আগামীকাল আসবে বলে জানালো। তা ছাড়া,দুআ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অন্য আত্মীয়ের বাসায় যেতে পারেনি মেয়েটা।কিন্তু আমি বারবার বলেছি তোর ফুফুকে,দুআ মেয়েটাকে যেনো আমাদের বাড়ীতে নিয়ে আসে।মেয়েটা ঢাকায় আসলেই শুধু অসুস্থ হয়ে পড়ে।আমি তাই বললাম,দরকার পড়লে আমাদের বাড়ীতে সারাদিন শুয়ে থাকবে;তাও যেনো নিয়ে আসে তাকে।”
মা এবং বোনের কথোপকথন শুনে অজানা কারণে ইয়াদ থমকে রইলো।আবারও তার আঁখিজোড়ায় দুআর মুখমন্ডল উঁকি দিচ্ছে বারংবার।ইয়াদ খেয়াল করলো অদ্ভুত ভাবে তার শরীরটা একটু তাপ ছড়াচ্ছে!
–“তারপর কি বললো ফুফু?”
মারিয়া পুনরায় প্রশ্ন করলো মাকে।
–“বললো,দুআ এখন মুটামুটি সুস্থ আছে।আর রামিসা ইয়াদের সাথে দেখা করার জন্যে পাগলপ্রায়।দুআ তার বন্ধুবি ছাড়া চলবে কিভাবে?আসবে আসবে।তুই ভাবিস না এতো।”
মারিয়া মাথা নাড়ালো আর বলে,
–“ঠিক আছে।আমরা অনেক মজা করবো। আম্মি,
একটু পরে যায়?আমি ভাইয়ার সাথে বসে থাকবো।”
–“মারু,যাও।হাত মুখ ধুয়ে আসো।”
ইয়াদের গম্ভীর কথায় মারিয়া কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লো মায়ের পিছু পিছু।জিয়া কিছু না বলে লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে গেলো ইয়াদের বাঁকা চাহনীতে।
–“দুআ কে?”
ইয়াসির নাস্তায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় প্রশ্ন করলো ইয়াদকে।
–“তোর কাজ কি তাতে?”
ইয়াদের পাল্টা প্রশ্নে বিরক্তির সুর।
–“রেগে যাচ্ছিস কেনো?জিজ্ঞেস করলাম শুধু।বল না, কে?”
ইয়াদের সাথে রসিকতার ফন্দি আটলো ইয়াসির।মারিয়া এবং ডালিয়ার কথা চলাকালীন ইয়াদকে অনেক প্রশ্ন করেছিলো ইয়াসির।কিন্তু ইয়াদ ছিলো ভাবলেশহীন।তার সম্পূর্ণ মনোনিবেশ ছিলো মারিয়া আর তার মায়ের কথায়।ইয়াসিরের চোখ এড়িয়ে যায়নি ব্যাপারটা।রামিসাকে ইয়াসির চিনে।গ্রামে তাদেরই বাড়ি গিয়েছিলো সে ইয়াদের সাথে।রামিসার কথা শুনে ইয়াদের ভাবলেশহীন হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।বাদবাকি প্রশ্ন উঠে দুআ নামের মেয়েটাতে।সেই জিনিস উদঘাটন করতেই ইয়াসিরের যতো চালাকি!
–“ইয়াসির!চুপ করে থাক।”
ইয়াদ ফুঁসে উঠলো।
–“ছবি আছে?দেখা না,প্লিজ!দুআ মেয়েটার নাম সুন্দর।দেখতে কেমন?অপ্সরী?”
–“বাড়াবাড়ি হচ্ছে,ইয়াসির।”
ইয়াসির এইবার হাসিতে ফেটে পড়লো,
–“মেয়েটা রামিসার বান্ধবী আন্টি বলেই দিলো।আমি তাও তোকে জিজ্ঞেস করলাম,কিন্তু জবাব পেলাম না।মেয়েটা রামিসার বান্ধুবী বুঝলাম।কিন্তু তোর কি?তুই কেনো এই মেয়ের ব্যাপারে এত হাইপার হচ্ছিস?”
ইয়াদ ইয়াসিরের প্রতি দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো। সত্যিই তো!ইয়াদ কেনো দুআর ব্যাপারে ইয়াসিরের প্রশ্নে এতো উত্তেজিত হচ্ছে?ইয়াদ নিজের চুল টেনে ধরলো বাম হাতে,
–“এই তোর সমস্যা কি?বা হাতে দিবো একটা?ট্যুরের চিন্তা কর।”
ইয়াসির খুশিতে গদগদ,
–“সত্যি,ট্যুরে যাবি?”
–“বৃষ্টি কমলে।”
–“যায় বলিস।আমার মনে হয় না এইবার তুই যেতে পারবি ট্যুরে।প্রকৃতির বৃষ্টি থামলেও,মনের বৃষ্টির কারণে তোর ট্যুরে যাওয়া সম্ভব হবে না।উঠছি আমি।আজকের একটা তাজা খবর অন্যদের দিতে হবে।”
ইয়াসির উঠে পড়লো।
ইয়াদ তার কুঁচকে নেওয়া ভ্রুযুগল হালকা উপরে তুলে ইয়াসিরের জন্যে ছুড়লো এক হুমকি,
–“উল্টো পাল্টা বকবি তো,মেরে লাশ বানিয়ে ফেলবো।মুখ বন্ধ রাখবি।”
–“দেখা হবে বন্ধু,কারণে অকারণে।”
ইয়াসির ইয়াদের কথায় এক চোখ টিপে গানের সুর তুলে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।মনে মনে কিছু কথা ভেবে ইয়াসির আজ একটু বেশিই খুশি।
ইয়াদ উঠে পড়লো।মাথা ভার লাগছে তার।দুআ মেয়েটার কথায় কেনো সে ইয়াসিরের সাথে রেগে গেলো এটাই নিজের বিবেক প্রশ্ন করছে তাকে।সামান্য দুই নাকি একবার ছবি দেখা,সেদিন পরিচয় বিহীন এক নজর আঁখি দেখে দুআ তার মস্তিষ্কের এমন হাল করেছে, যার দরুণ সে ইয়াসিরের সাথে রাগারাগি পর্যন্ত করলো!ইয়াদ বর্তমানে নিজের সাথে রেগে গেলো হঠাৎ।সে দুইহাত মুঠ করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
–“আমি ট্যুরেই যাবো।কে আসবে না আসবে আমার কিছু যায় আসে…”
ইয়াদের আঁখিতে আবারও ভাসলো দুআর ক্লান্ত সুন্দর নেত্রযুগল। এতে সে বিরক্ত হয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
–“আহ, গড!”
__________________________
ঢাকা শহর যেনো দুআর জম।দুর্বলতার কারণে সে বেড়াতে পারেনি।এই রুমটাতে ছিলো এই কয়দিন।রিজোয়ান নিজেই নেয়নি দুআকে,বিশ্রাম করার উদ্দেশ্যে।অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ দুআ ভালবোধ করছে প্রচুর।তাই আজ রিজোয়ানের নির্দেশে যখন শুনেছে সে বেড়াতে যাবে,তখন তার অসুস্থ শরীর যেনো আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলো।এইদিকে মেঘলা গগণটাতে আর বৃষ্টির আভাস নেই।তাই তারা যতো দ্রুত সম্ভব যাত্রা শুরু করার তাড়া লাগালো। পরিবেশ শান্ত,দুআর ছোট্ট মন অশান্ত।ইয়াদের সম্মুখীন হবে আজ সে? অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! দুআ একটুও এটা বিশ্বাস করতে পারছে না।সেদিনের জন্য ধন্যবাদ দিবে কি সে ইয়াদকে?পরক্ষণে সে চিন্তা করলো,
–“আমি যে সেই মেয়েটা এটা উনি কখনোই জানবেন না।আর না উনি সেই ঘটনার কথা মনে রাখবেন?ইয়াদের সামনেই আমি যাবো না।যাওয়ার কোনো দরকার আমি দেখছিই না।কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে আমার!কুল দুআ। অন্য কোনো ব্যপার চিন্তা কর।”
আবাসিক এলাকায় ঢুকতেই গাড়ির কোলাহল,ব্যস্ত শহরের জনজাট সব যেনো কোথায় পালালো।দুআ বুঝতে পারলো,বাহিরের ঢাকা শহর আর আবাসিক এলাকার ভেতরকার অবস্থা একেবারে উল্টো।যতো ভেতরে এগুচ্ছে তারা ততো পরিবেশটা শান্ত মনে হচ্ছে তার।কালো সোনালী রঙের বিশাল ফটক।সেটা ভেদ করেই গাড়ি প্রবেশ করলো ভেতরে।খুবই সুন্দর পরিপাটি একটা বাড়ি এবং এর চারপাশ।শুভ্র রঙের দুইতলা দালানের দরজা, জানালা এবং ব্যালকনির গ্রিলের রং কালো। এতে যেনো দালানের রূপটা আরো মোহনীয় করেছে।একপাশে বড় গ্যারাজের এক দরজা খোলা,অন্যটা বন্ধ।বাগানের দিকটায় দুআ চোখ বুলাতে পারলো না। হাঁটার গতির সাথে তাল মিলাতে পারেনি সে বাগান পরিদর্শন করার।সামান্য সময়ে দুআর চোখ এই সম্পূর্ণ জায়গার ভ্রমণ করতে পারলো না।
ঘরের ভেতরের সবটাই সফেদ রঙের।আসবাবপত্র সবই কালো এবং খয়েরী রং দ্বারা আবৃত।সাইজে সবকিছুই যেনো একটু বেশি বড়।সত্যি বলতে,দুআর কাছে এই ঘরটা রাজমহল বলে মনে হচ্ছে। তাদের দুই তলা ভবন একদম সাদাসিদে তো এইখানে এই দুই তলা ভবনটা একদম আধুনিকতায় ও চাকচিক্যে ভরপুর।তবে,এই ভবনের চেয়ে দুআর মন টানছে তার নিজস্ব ভবনের দিকে।
ডালিয়া,জিয়া এবং মারিয়ার ব্যবহার অমায়িক।তাদের এতো আন্তরিকতা আশা করেনি দুআ।ডালিয়ার স্বামী তথা ইয়াদের বাবার সাথে তাদের মিললো না।জনাব সাজ্জাদ বরাবরই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষদের একটু কম পছন্দ করে।শহরের আবহাওয়ায় আর দাম্ভিকতার কারণে উনি মানুষ কম যন্ত্র বেশি।তাই,কাজের বাহানায় উনি গত রাতেই শহরের অন্য এলাকায় পাড়ি জমালেন।
মারিয়া দুআর সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেললো।দুআর চুপচাপ এবং মিষ্টি ব্যবহারে মারিয়া হয়ে গেলো দুআর ভক্ত।দুআ নিজেও মারিয়ার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে।তারা সিঁড়ির পাশে অবস্থিত ছোট টেবিলের ধারে বসে আছে।মারিয়ার প্রিয় জায়গা এটা। ছোট টেবিলের পাশে গদি দেওয়া আছে।আপাতত তারা সেই গদির উপরই বসে আলোচনায় মশগুল।
–“ইয়াদ ভাইয়ের ঘুম আজ ভাঙবে না?”
মারিয়া তখন দুআর কালো দীঘল চুল ছুঁয়ে দেখছিলো।রামিসার প্রশ্নে সে দুআর চুলে হাত বুলিয়ে জবাব দিলো,
–“কিজানি?আজও সকালে ছাদে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করে ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে হঠাৎ।উঠে পড়বে হয়তো।”
–“ওহ!অনেকদিন ভাইয়ার সাথে দেখা হয়নি।”
রামিসার পানে চেয়ে মুচকি হাসলো মারিয়া।এরপর সে দুআর মুখের সম্মুখে নিজের মুখখানা এনে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“তোমার মাথার কাপড় ফেলে একটা হেয়ার স্টাইল করে দিই আপু?”
দুআ মারিয়ার গাল চেপে বললো,
–“আচ্ছা,মারিয়া।”
–“তুমি আমাকে ভাইয়ার মতো ‘মারু’ ডাকবে,প্লিজ?”
–“আমি?হ্যাঁ,ডাকবো।”
দুআ কেনো তার ভাইয়ের মতো মারু ডাকবে,এই প্রশ্নটা দুআর মনেই থেকে গেলো।জড়তার কারণে সে আর প্রশ্নটা করলো না।
–“এই তুই আমার জানুর সাথে এতো ননাই করছিস কেনো?”
–“দুআ আপুকে আমার অনেক ভালো লেগেছে।তোমার চেয়েও ভালো আপু।তাই আমাকে আপু ‘মারু’ ডাকবে।”
–“ইস,ঢং।এই দুআ,তুই শুধু আমার।”
–“মারু এবং রামিসা ছাড়া আমি সবার।”
দুআ হেসে বললো।
দুআর ফাইজলামি বুঝতে পেরে বাকি দুইজনই ফিক করে হেসে উঠলো।
‘
ঘুমের ঘোরেই মোবাইলের শব্দ অনুসরন করে কানে ফোন লাগালো ইয়াদ। অপর পাশ থেকে ইয়াসির বলে উঠলো,
–“তুই আজ ফোন ধরছিস না কেনো?”
–“ঘুম ছিলাম।বল না,কি হয়েছে?”
ইয়াদের কণ্ঠ ঘুম মাখানো।
–“তোকে হাজারটা ফোন করে এখন পেলাম।এর পূর্বে মারিয়ার কাছে দিয়েছিলাম ফোন তোর খোঁজ করতে।শুনেছি তোদের বাসায় মেহমান এসেছে?দুআ মেয়েটাও নাকি এসেছে!”
–“বাজে বকিস না।এখনো আসেনি হয়তো কেউ।আসলে আম্মি এসে জ্বালাতন করতো।”
ইয়াদ আড়মোড়া ভেঙে বললো।বিছানা থেকে পা নামিয়ে সে নিচে যাওয়ার জন্যে এগুলো।
–“এসেছে রে এসেছে।গিয়ে দেখ।শুনলাম কাল নাকি দুআ মেয়েটার জন্যে তুই ইয়াসিরকে ধমক দিয়েছিস?”
–“স্পন্দন?”
ইয়াদের অবাক প্রশ্ন।
–“এইযে,আমিও আছি।কাহিনী কি বস?”
–“ফারসিভ!সবাই একসাথে করছিস কি?”
–“ট্যুরে যাব বলে ভাবছি।কিন্তু,তুই আসবি কি আসবি না এই নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি।”
ইয়াসির বললো।
–“বৃষ্টি তো আজ থেমেছে।যাওয়া যায়।”
ইয়াদ বিনা দ্বিধায় জানালো।
–“শিউর?”
ফারসিভের প্রশ্নে আর উত্তর দেওয়া হলো না ইয়াদের। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াতেই এক রমণী প্রতি স্তব্ধ হয়ে গেলো তার নেত্রযুগল।মাথায় ঘুরঘুর করা ছবির সেই বাস্তব প্রতিচ্ছবি জলজ্যান্ত বসে আছে ইয়াদের চক্ষুর সম্মুখে।দুআর লম্বা ঘন চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মারিয়া।মাথার কাপড় পড়ে যাওয়ায় বিচলিত হয়ে আবারও মাথায় কাপড় খানা তুলে দিলো দুআ নামের মেয়েটা।বেগুনি রঙের ওড়নার আড়ালে তার শুভ্র চেহারা বিদ্যমান।কথার ছলে মুখের সামনের চুলটা খুব যত্ন সহকারে সরিয়ে নিচ্ছে সে।ইয়াদ স্বাভাবিক নেই।সরাসরি দুআকে দেখে অস্থির লাগছে তার।দুআর মুখটায় পবিত্রতায় ঘেরা।হাসিটাও তার চমৎকার।অট্টহাসিতে হাত দিয়ে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরছে সে।ইয়াদ নিষ্পলক চেয়ে রইলো তার পানে।এই দেখার যেনো অন্ত নেই।মোবাইলে বলা “হ্যালো, হ্যালো” ইয়াদের কর্ণগহ্বরে এলে তার হুঁশ হয়।সে সরে আসে সিঁড়ির দিক থেকে।
–“বল।”
ইয়াদ বুকে হাত রাখলো।বুকটা আজ অতিরিক্ত শব্দ করছে উত্তেজনায়।
স্পন্দন প্রশ্ন করে,
–“দেখেছিস তাহলে দুআকে? তা,ট্যুরে যাবি?”
–“নাহ,ওয়েদার ভালো নেই।কয়েকদিন পরে যাবো।”
ইয়াদ ভেবে চিন্তে জবাব দিলো।
–“দেখেছিস,আমি বলেছিলাম না এই ছেলে কিছু লুকাচ্ছে!দুআ মেয়েটার জন্যে সে ট্যুর ক্যানসেল করে দিলো।”
ইয়াসির হেসে বলে।
–“চুপ থাক।আমি এমনিতেই বলেছি।”
ইয়াদ ট্রাউজারের পকেটে হাত রাখে।দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে সে।উদ্দেশ্য,তার রুম।
–“বুঝি ভাই বুঝি।এইবার হয়তো একটা বিয়ের সানাই বাজবে?”
ফারসিভ বললো।
–“কি?মাথা ঠিক আছে?পাগল হয়েছিস তোরা।রাখছি।”
ইয়াদ বিরক্ত হলো যেনো।
–“আচ্ছা, চালতাহু দুআও মেঁ ইয়াদ রাখনা।”
স্পন্দন,ইয়াসির,ফারসিভ সবাই একসাথে গেয়ে উঠলো।
ইয়াদ ইংরেজি এক গালি উচ্চারণ করলো,
–“ফাঁ*!”
পুনরায় সবার অট্টহাসি শুনলে ইয়াদ ফোন কেটে দিলো।দুআর চেহারা স্মরণ করলে ইয়াদ বুঝতে পারলো গতকালের মতো তার দেহ থেকে একটা তাপ বেরুচ্ছে।বিছানায় উবুত হয়ে শুয়ে পড়লো সে।নিজ মনে সে আওড়াতে লাগলো,
–“মেয়েটা এতো শুভ্র কেনো?কেনো তার মুখশ্রী এতো মনোরম!পবিত্রতার সবটাই যেনো মেয়েটার মুখে এসে জড়ো হয়েছে।এতো মেয়ে দেখলাম,কিন্তু চেহারায় এমন পবিত্রতার ছোঁয়া কখনোই দেখিনি।মেয়েটার মুখশ্রী, সত্যি যেনো একফালি চাঁদ!আসর গড!হচ্ছেটা কি আমার সাথে?”
চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।পেজের রিচ কম তাই হয়তো গল্প সবার কাছে যায় না।সাইলেন্ট রিডার্স আপনারা গল্প পড়ে রিয়েক্ট দিবেন এবং কমেন্ট করবেন।