নাইওরি পর্ব ৭
মৌরি মরিয়ম
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। রঞ্জুকে উঠোনে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। উঠোন ভর্তি লোকজন। সালিশ বসবে একটু পরেই। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের অপেক্ষা। গ্রামের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এসে পড়েছেন। মাঝরাতে রঞ্জুকে জেসমিনের জানালার সামনে থেকে ধরে আনা হয়েছে, সারারাত সে এই গাছের সাথেই বাঁধা। কাঠফাটা রোদে মগজ গলে পড়ছিল যেন। এখন রোদটা মরে এসেছে। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুদায় কাতর সে, শরীরের সব শক্তি শেষ।
মানিক টের পেয়েছে দুপুরে। কিন্তু রঞ্জু সবার চোখের সামনেই। পাহাড়াও দেয়া হচ্ছে তাই ধারেকাছেও যেতে পারেনি সে। তাই সে এখন রঞ্জুর বাবার কাছে যাচ্ছে খবর দিতে। চেয়ারম্যানের ভয়ংকর কোনো শাস্তির হাত থেকে হয়তো একমাত্র উনিই বাঁচাতে পারবেন রঞ্জুকে।
যেহেতু রাতে ধরা পড়েছে সেহেতু সালিশ সকালেও হতে পারতো। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আজকে কঠিন ব্যস্ত। মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কি কিছু থাকতে পারে? মানিক ভালোভাবেই জানে, ব্যস্ততা আসলে কিছুই না। অপরাধীকে যাতে সালিশ হবার আগেই অভুক্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ বেঁধে রেখে কষ্ট দেয়া যায় তাই এই ব্যস্ততার নাটক। এই নাটক শুধু সে নয় গ্রামের অনেকেই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। গরীবের না আছে কিছু বলার ক্ষমতা, না আছে কিছু করার ক্ষমতা। গরিব সর্বক্ষেত্রেই অক্ষম!
রঞ্জু ধরা খাওয়ার পর থেকে জেসমিনকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করেছে। ঘরের ভেতর থেকেই বারবার রঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছে সে। কেউ তেমন একটা গায়ে মাখেনি। তবে কোহিনুর বানু একবার এলেন। জানালা খুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, “বেশি চিল্লাইলে গরম শিক আইন্যা গলায় ঢুকাই দিমু।”
জেসমিন ফুসে উঠলো,
“দেও। আমারে মাইরা হালাও। খালি রঞ্জুরে ছাইড়া দিতে কও মা। আল্লাহর দোহাই লাগে।”
“পোড়াকপালি! পিরিত মারানির আগে মনে আছিলো না কী অইতে পারে? তোর আহ্লাদির ঠেলায় জোয়ান পোলাডার জীবন দিতে অইবে এহন।”
জেসমিন পা দাপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মাফ কইরা দেও মাগো, মাফ কইরা দেও।”
“আমার বাপে আইলেও তোর বাপেরে আইজকা আটকাইতে পারবে না লো সর্বনাশী ছেড়ি৷ যে সর্বনাশ তুই করছোস, হেইয়া এহন চক্ষু মেইল্যা দ্যাকতে অইবে।”
জয়নাল মির্জা সালিশে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন। জেসমিন বিছানায় বসে ছিল। বাবাকে দেখে নেমে এলো। তবে বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার মুখের উপর কোনোদিন কথা বলেনি। জয়নাল মির্জা বললেন,
“কী বলি মনোযোগ দিয়া শোনো মা। সালিশে তোমারে ডাকা হবে। ছেলে যাই বলুক তুমি বলবা এই ছেলে তোমারে পছন্দ করে, তবে তুমি কখনই তার ডাকে সাড়া দাও নাই। এই কথার যেন নড়চড় না হয়। তার জীবনে সর্বনাশ ডাইকা আনবা না আশা করি।”
জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সালিশ শুরু হবার আগেই রঞ্জুর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে জয়নাল মির্জার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। কারণ রঞ্জুর বাবা হারুন ব্যাপারী। এই ছেলে যে হারুন ব্যাপারীর ছেলে সেটা যদি তিনি আগে জানতেন তবে খেলার চাল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। ঘুনাক্ষরেও সালিশ ডাকতেন না। এই ছেলেকে তুরুপের তাস বানিয়ে জমির ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন।
তিনি সবসময় ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেন। সেই হিসেবে তার প্রথমে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল ছেলেটির বাবা কে? কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক ধরা পড়ায় তার মাথা আউলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। সেইজন্যই সালিশ ডেকে বসলেন।
কেশবপুরের সকল সালিশে সাধারণত চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জা, মেম্বার কাশেম মোল্লা, কেশবপুর বাজারের একমাত্র ডাক্তার প্রনব সাহা, কেশবপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার নাসেরউদ্দিনসহ গ্রামের প্রভাবশালী অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেহেতু ভিকটিম চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা সেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর। সকলেই এসেছেন। যে ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাকে রাতবিরাতে উত্যক্ত করতে পারে, অবশ্যই সেই ছেলের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথমেই জেসমিনকে ডাকা হলো। সে যেহেতু ভিকটিম তার কথাই আগে শুনতে হবে। জেসমিনের গায়ে জ্বর, শরীর কাঁপছে। তাকে ধরে আনলেন কোহিনূর বানু। রঞ্জু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সালিশ শুরুর আগে অবশ্য তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রদ্বয় পাশেই দাঁড়ানো। হারুন ব্যাপারী অন্য গ্রামের হলেও প্রভাবশালী এবং সম্মানীয় লোক। তাই অপরাধীর বাবা হওয়া স্বত্তেও তাকে বিচারকারীদের সাথেই বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, চুপচাপ দেখছেন। খবর পেয়ে এখানে আসতে আসতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি তবে তার আগে জেসমিনের বক্তব্য শোনা দরকার। জেসমিন এবং রঞ্জুর বক্তব্যের উপর নির্ভর করছে তার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে নাকি যাবে না।
সকল সালিশ চেয়ারম্যান সাহেবই শুরু করেন তবে এই সালিশ শুরু করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মেম্বার কাশেম মোল্লাকে। প্রয়োজনে তিনি তার বক্তব্য পেশ করবেন। কাশেম মোল্লা জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বলো মা, এই ছেলে কবে থেইক্যা তোমারে উত্যক্ত করে?”
জেসমিন কিছু বলার আগেই প্রণব সাহা বললেন,
“আগে গতকাল রাইতের ঘটনাটা জেনে নিলে ভাল হয় না?”
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না জেসমিন। সে দৃঢ় গলায় বলল,
“সে আমারে উত্যক্ত করে নাই। আমি তারে ভালোবাসি, সেও আমারে ভালোবাসে। আমার জ্বর হইছে সেই খবর পাইয়া সে আমারে দেখতে আসছিল। আমি ঘরে, সে বাইরে। জানলা দিয়া কথা কইতাছিলাম আমরা। তখনই বড় ভাইজান দেইখ্যা ফালায়। তারে ধইরা নিয়া বাইন্ধা রাখে। সে যদি অপরাধ করে তাইলে আমিও অপরাধ করসি।”
চলবে…
আগের পর্ব
https://facebook.com/100044423166701/posts/549052499918851/