#চারুলতা পর্ব-৮ /শেষ পর্ব (শেষ খন্ড)
#শারমিন আঁচল নিপা
ঠিক সে মুহুর্তে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। ঘরটা সজোরে কাঁপতে লাগল। বাচ্চাটা আমার বুকে জোরে কামড়ে ধরল। আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। পাশ থেকে মৃধা বলে উঠল
– বাচ্চাটার মধ্যে অশুভ শক্তি প্রবেশ করেছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে না পারলে এরিককে ধ্বংস করা যাবে না। আর এরিক এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে গেলে সারা পৃথিবী কালো জাদুর হাতে জিম্মি হয়ে যাবে।।আমাদের কিছু একটা করতে হবে।
মৃধার কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল সে সাথে বাচ্চাটাকে বুক থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছিলাম না। বুক দিয়ে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। জানি না কী হতে চলল। তবে জয়ের আশঙ্কা এখানে ক্ষীণ। পুরো ঘরটা এবার বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। মৃধার নিঃশ্বাস শোনা গেলেও তাকে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এদিকে আমি সমস্ত শক্তি খাটিয়ে বাচ্চাটাকে স্তন থেকে ছুটিয়ে জোরে আঁচরে ফেললাম। বাচ্চাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে জানি না। অন্ধকার রুমে চক্ষুগোচর কিছু না হওয়ায় একটু দৃঢ় গলায় মৃধাকে ডাকতে লাগলাম। মৃধার কোনো সাড়া শব্দ মিলছে না। শুধু কয়েকটা গুঙানোর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে সে সাথে ভারী নিঃশ্বাসেরও। মনে হচ্ছে কেউ কারও গলায় চেপে ধরে শ্বাসরোধ করছে।
আমার ভয়টা ক্রমশ বর্ধমান হতে লাগল। ভেতরটায় কম্পিত হতে লাগল। চুপ হয়ে গেলাম। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না আমার। এদিকে গুঙানোর আওয়াজটা প্রখর হয়ে মৃদু হয়ে গেল।
আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গুটি মেরে আছি। নিজেকে সামলে রাখা এ মুহুর্তে ভীষণ কঠিন। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল। আলোটা জ্বলার সাথে সাথে আমার শরীরটা শিউরে উঠল। আমার সামনেই মৃধার নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। আর তার বুকের উপর বাচ্চাটা বসে খিলখিল করে হাসছে। বুঝতে আর বাকি রইল না বাচ্চাটা অশুভ শক্তিতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আমার পরাজয় হয়তো সুনিশ্চিত। জয়ের কিঞ্চিৎ আশাও রাখতে ইচ্ছা করছে না আমার। তবুও নিরাশ হয়ে জীবন দেওয়ার চেয়ে মরার আগে একটা বার চেষ্টা করে মরাই শ্রেয়। তাই নিজেকে একটু স্থির করলাম। বাচ্চাটাকে কী করলে এ অভিশপ্ত বাচ্চা শুভ শক্তি লাভ করবে সে চিন্তায় করতে লাগলাম। চিন্তাটা বেশিক্ষণ করার সুযোগ পেলাম না। এর মধ্যেই মামা রুমে প্রবেশ করল। বাচ্চাটা পুরোপুরি মামার আয়ত্ত্বে চলে গেল। আর মামা এসেই আমাকে উলঙ্গ করে ফেলল। সে সাথে মাথায় জোরে আঘাত করল। আমি অচেতন হয়নি তবে শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। কী হচ্ছে টের পেলেও শরীর নাড়াতে পারছি না। মামা আমার সমস্ত শরীরে কাচা হলুদ মেখে দিল তারপর আমার চুলগুলো ধরে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেল পিশাচ মূর্তির সামনে। আমার বাকশক্তি এবং শরীরের সমস্ত শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে মূর্তির সামনে রেখে কী যেন বিড়বিড় করছে মামা। আর সারা শরীরে গোলাপ জল ছিটাচ্ছে আর বাচ্চাটাকে আমার বুকের উপর বসিয়ে দিল। এতে করে আমার নিঃশ্বাস আরও ভারী হয়ে গেল।
মিনেট দুয়েকের মধ্যে আমার শরীর আরও স্তব্ধ হয়ে গেল আমি বুঝতে পারছিলাম এ যুদ্ধে আমি হেরে যাব জিতে যাবে কালোজাদু। আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কানে শুধু আওয়াজ আসছে। কম্পনের আওয়াজ পাচ্ছিলাম কেবল। এর মধ্যেই কানের কাছে কারও কণ্ঠের আগমন পেলাম। কণ্ঠটা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম মৃধার কণ্ঠ। আমি কিছু বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না। এদিকে মৃধা ক্ষীণ গলায় বলল
– দ্বিতীয় বারের মতো আমার জীবন এরিকের হাতে শেষ হলো। চারুলতা এখনও সময় আছে সবকিছু ঠিক করার। তুমি তোমার মনের জোর দিয়ে শরীরটা সচল করো তারপর বুকে বসে থাকা বাচ্চাটাকে তোমার শরীরের যেকোনো অংশ কেটে শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত বাচ্চাটার মুখে লেপ্টে দাও বাচ্চাটা তাহলে অশুভ শক্তির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে আর এরিকও ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি কথাগুলো শুনার পর বেশ কষ্টসাধ্য হলেও মৃধার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। বাচ্চাটার মুখে আমার শরীরের একাংশ কামড়ে সেটা থেকে রক্ত বের করে লেপ্টে দিলাম। সাথে সাথে ঘরটা জোরে কম্পিত হয়ে পিশাচ মূ্র্তিটা ভেঙে গেল আর মামাও পুরোপুরিভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সে সাথে আমার মৃত্যু ঘটল। আমার মৃত্যু ঘটলেও আমি এ বাড়ির আশে পাশে অতৃপ্ত হয়ে ঘুরছি ফিরছি। কারণ আমার লাশটা এ পর্যন্ত সঠিক উপায়ে সৎকার হয়নি। সেদিন শুভ শক্তির জয়লাভ হলেও আমার মৃত্যু রোধ হয়নি। বহু বছর এ বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন পূর্বে একজন বাড়িটাকে বেশ কৌশলে নিজের বলে দাবি করে বাড়িটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তোমাদের কাছে ভাড়া দিয়ে দেয়। আমি বেশ কয়েকবার তোমাদের সামনে আসার চেষ্টা করেছি সত্যটা বলার জন্য, তবে তোমাদের প্রাপ্ত ভয়ের জন্য আর পারিনি। কথাগুলো চারুলতা স্থিতিকে বলে চুপ হয়ে গেল।
স্থিতি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এ বাড়িটা মূলত পুরনো একটা বাড়ি। শহর থেকে বেশ দূরে অবস্থান করায় এ বাড়ির দিকে তেমন লোক সমাগম নেই। বর্তমানে এ বাড়িটা ভুতুরে বাড়ি নামেই পরিচিত। তাই এদিকে মানুষ আাসার সাহস তেমন পায় না। স্থিতি ভুতুরে বিষয় গুলো নিয়ে গবেষণা করার দরুণ তার বন্ধু সৌভিক নিয়ে এ বাড়িতে আসে। এ বাড়িটায় আসার পর থেকেই একের পর এক কান্ড কাহিনি ঘটতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে কাহিনির সূত্র ধরেই চারুলতার আত্মার সাথে দেখা। স্থিতি এখনও নীরব। সৌভিক নীরবতা ভেঙে চারুলতার দিকে তাকিয়ে বলল
– তুমি যা করেছো তা নিঃসন্দেহে অনেক উত্তম কাজ। তবে তোমার মুক্তি কীভাবে হবে বলো?
চারুলতা হালকা গলায় জবাব দিল
– বাড়িটার পেছনে নারিকেল গাছের তলায় সাত হাত মাটি খুড়লেই আমার হাড় পাওয়া যাবে সেগুলো দাফন করলেই আমার মুক্তি মিলবে।
স্থিতি এবার নড়েচড়ে বসে বলে উঠল
– তুমি ভালো থেকো। আমরা তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করছি।
কথাটা বলেই স্থিতি আর সৌভিক দৌড়ে গেল বাড়ির পেছনটায়। সেখানে নারিকেল গাছের তলায় সাত হাত মাটি খুড়ার পর চারুলতার হাড় গুলো পেল। তারপর সেগুলো দুজন মিলে বাড়ি থেকে খানিক দূরে দাফনের ব্যবস্থা করল।
হাড়গুলো দাফন করার সাথে সাথে বাড়িটা হালকা কাঁপুনি দিল সে সাথে একটা বাজ পাখি উড়ে গেল। বুঝতে আর বাকি রইল না চারুলতার আত্মার মুক্তি মিলল।
সৌভিক আর স্থিতি নিজেদের কাজগুলো সম্পন্ন করে সবগুলো তথ্য লিপিবদ্ধ করল তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সে সাথে চারুলতার ঘটনারও সমাপ্তি ঘটল।
কপি করা নিষেধ।