#চারুলতা পর্ব৩
#শারমিন আঁচল নিপা
আরও বেশি কাঁপতে শুরু করলাম যখন কোনো হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরল। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের হাত পা বেঁধে রেখেছে কয়েকজন মিলে। বুঝতে পারছিলাম আমার মুখ চেপে যারা ধরে রেখেছে তারা আমার মামা না, বা মামার লোকও না। আমি আমার সমস্ত শক্তিকে একীভূত করে ওদের হাত থেকে মুখটা ছুটিয়ে দূরে গেলাম। দূরে যেতেই একটু সামনে গাছের সূচালো অংশ পেলাম। অন্ধকারে এতটা স্পষ্ট না এটা কী। কোনোরকম নিজেকে সামলে সূচালো অংশটা নিয়ে জোরে আঘাত করলাম। এ আঘাতটা একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না বরং আঘাতটা করলাম পরপর কয়েকজনকে। কারও পেট এতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আবার কারও মুখ চোখ। সবাই যখন কপোকাত ঠিক তখন মেয়েটার মুখ,হাত,পা খুলে দিলাম। মেয়েটার মুখ খুলতেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
– দূরে দৌড়ে চলো বোন। তুমি তো তিন চারজনকে খুন করে দিয়েছো।
মেয়েটার কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে সামনের দিকে তাকালাম। আমার সামনে চারজন লোক মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে এর মধ্যে একজন মারাও গিয়েছে। নিজেই অবাক হলাম। এত শক্তি আমার মধ্যে কী করে আসলো বুঝতে পারলাম না, তার উপর এত নির্মম ভাবে আমি হত্যা করেছি তা যেন মেনেও নিতে পারছি না। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী হচ্ছে আমার সাথে কিছুই যেন বুঝতে পারছি না। পরক্ষণেই মেয়েটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
– বোন চলো এখান থেকে। নাহয় আরও বিপদে পড়তে হবে। এদের দল অনেক বড়ো। আমাকে এনেছিল ধর্ষণ করতে। বাকিরা জঙ্গলের বাইরে আছে। বাকিরা চলে আসলে আর রক্ষা নেই।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখারও সুযোগ পেলাম না। শরীর যেন পুরোপুরি অসাড় হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই। মেয়েটা আমার অপেক্ষা করল না। আমার হাতটা হেঁচকা টান দিয়ে দৌড়াতে লাগল। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে দৌড় দিলাম। জানি না কোথায় যাচ্ছি এ কোন পথ আর কোন রাস্তায় এসে ঠেঁকেছি। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে আমার কাছে।
দৌড়ের এক পর্যায়ে প্রায় অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার পর একটা ভাঙা অবশেষের কাছে এসে দুজন দাঁড়ালাম। আলো নেই চারপাশে। ঘুটঘুটে অন্ধকার না তবে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে সব। এবার মেয়েটার দিকে তাকালাম। অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে। হালকা অন্ধকারে মেয়েটার সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি কিছুটা দম নিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম
– কে তুমি? আর ওরা কে ছিল যারা তোমার হাত পা বেঁধে রেখেছিল?
মেয়েটা কিছুটা চুপ থেকে বলল
– আমি কে সেটা বললে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
– বিশ্বাস না করার মতো কী আছে শুনি।
– মুখ দিয়ে না বলি। তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও তাহলেই বুঝতে পারবে আমি কে।
আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেই একটা সাপের অভয়ব আমার সামনে ভেসে উঠল। ভয়ে চুপসে গিয়েও মৃদু গলায় বললাম
– তাহলে তুমি কি সাপ? মানুষ কী করে সাপ হয়!তুমি সত্যি করে বলো, তুমি কে? তোমার চোখে রহস্যের ভাঁজ। আর ওরা কে ছিল যারা তোমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছিল।
মেয়েটা হালকা হেসে উত্তর দিল
– আমি মৃধা। একজন ইচ্ছাধারী নাগিন।
– আমি বিশ্বাস করলাম তুমি নাগিন। কিন্তু তুমি চাইলে যারা তোমাকে ধরে এনেছে তাদের সাপ হয়ে মেরে ফেলতে পারতে। তাহলে সেটা কেন করোনি?
– কারণ আমি নাগিন হলেও আমার মধ্যে এখনও কোনো শক্তি আসেনি। আমি শক্তি পাব যখন আমার একুশ বছর পূর্ণ হবে। একটা অভিশাপের জন্য আমি নাগকূল থেকে বিতারিত হয়ে মনুষ্য সমাজে বাস করতে শুরু করি। আমার রুপের জন্য অনেকের লালসার দৃষ্টি পড়ে আমার উপর। তারা তো জানত না আমি নাগিন। তাই তারা আমাকে তাদের ভোগের পন্য বানাতে জঙ্গলে নিয়ে এসেছিল। সময় মতো তুমি এসে আমাকে বাঁচিয়েছো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো সাধারণ মেয়ে না। কারণ একটা অল্প বয়সী মেয়ের পক্ষে এতগুলো মানুষকে একসাথে নির্মমভাবে হত্যা করা সম্ভব না। আর তুমি লক্ষ্য না করলেও আমি লক্ষ্য করেছি তোমার চোখে খুনের সময় জ্বলে উঠেছিল অগ্নি লাভা। কোনো সাধারণ মেয়ের চোখে এমন লাভা জ্বলার প্রশ্নই উঠে না।
আমি মৃধার কথা গুলো শুনে কিছুটা বিস্ময় হলাম। আমার মতো মেয়েকে সে কেনই বা অসাধারণ বলছে। তার উপর মনে হলো সে গায়েবী কণ্ঠ স্বরের কথা। সে কণ্ঠ স্বরটা আমাকে বলেছিল আমার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় আছে কিছু শক্তি। সময়ের পরিক্রমায়, কাহিনির স্রোতবেগে সেগুলো প্রকাশিত হবে। তবে আমি কে? কী এমন শক্তি আমার মধ্যে আছে। এটা নিশ্চিত আমার মধ্যে কোনো শুভ শক্তিই বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু সেটা কী শক্তি। আর মামার মতো মানুষ ধ্বংস ও হবে আমার হাতে। কীভাবে ধ্বংস করব। কীভাবে আবিষ্কার করব আমার সে শক্তিগুলোকে?
আমি মৃধার দিকে তাকিয়ে বললাম
– আমার বয়স অল্প হলেও আমি সাক্ষী হাজারো নির্মম কাহিনির। আমার বুঝ অন্যদের তুলনায় বেশি। আমি জানি না আমার মধ্যে কী শক্তি রয়েছে। তুমি জানলে আমাকে বলো। তুমি তো নাগিন তুমি নিশ্চয় আঁচ করতে পারবে আমার মধ্যকার শক্তিটা কী ঘিরে।
মৃধা হালকা গলায় বলল
– দেখো আমার পক্ষে এখন বলা সম্ভব না। আমি তোমাকে বলতে পারব যখন আমার বয়স ২১ পূর্ণ হবে এবং আমি অভিশাপ মুক্ত হব। এজন্য তোমাকে আরও ১ মাস ১৭ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত তুমি কোনো শুভ শক্তির ইঙ্গিত। এটা আমি নিশ্চিত কারণ তোমার গলায় বাম দিকে এক কোণায় একটা উল্টা তীরচিন্হ রয়েছে। যাদের ভেতরে শুভশক্তি থাকে তাদের গলায় এমন চিন্হ থাকে আর যারা অশুভ শক্তি বহন করে তাদের গলায় ক্রস চিন্হ থাকে।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম
– আমি তো কখনও এমন চিন্হ আমার গলায় দেখিনি।
– তোমার চক্ষুগোচর হবে না এখন। আর কোনো সাধারণ মানুষের চোখেও এটা পরিলক্ষিত হবে না।আমি নাগিন বলেই দেখতে পারছি। তোমার পথ মসৃন নয়। অনেক বাঁধা তোমার জীবনে আসবে। তবে তোমাকে তা কাটাতে হবে।
আমি নির্বাক। আমার মাথায় এখন কিছুই আসছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজেকে অসাধারণ কেউ ভাবতেও পারছি না। শত ভাবনা আমার ভেতর ডানা মেলছে। আমি মৃধার দিকে তাকলাম তারপর পাশের ভাঙা দেয়ালটার দিকে তাকালাম। বুঝতে পারছি না এটা কোন জায়গা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ গ্রামে এমন ঘন জঙ্গল আছে সেটা আমার জানাই ছিল না। এ কোন জায়গায় এসে ঠেঁকলাম জানিনা। এসব ভাবতে ভাবতেই উপর থেকে একটা বিড়াল মাটিতে আঁচড়ে পড়লো। মাটিতে আঁচরে পড়ার সাথে সাথে বিড়ালের মাথাটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল আর বিড়ালটার কাটা মাথা রগরগিয়ে তাকাল।
আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। বিষয়টা এখানেই থেমে থাকল না বরং আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির রূপ নিল।
কপি করা নিষেধ।