প্রেমাতাল পর্ব ৪৩
মৌরি মরিয়ম
মা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শীতল গলায় বলল,
-“কি করে হলো এসব?”
তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো। নিজের মেয়েকে কেউ এসব জিজ্ঞেস করে? এমনি লজ্জা লাগছে আবার ডিটেইল জানতে চাচ্ছে। এমন তো না যে মা জানেনা কি করে মানুষ প্রেগন্যান্ট হয়। ওকে চুপ থাকতে দেখে মা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করে হলো? আমরা তো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে বলেছিলাম এ বিয়ে কক্ষনো সম্ভব না। যোগাযোগ রাখিস না, তুইও তো বলেছিলি যোগাযোগ নেই। তাহলে প্রেগন্যান্ট হলি কি করে?”
তিতির মনে মনে ভাবলো, ও আচ্ছা মা এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছে! বলল,
-“আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হয়েছে মা। আমরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারি না।”
-“এই অকাজ কোথায় করেছিস? ওই বদমাইশ টা তোকে হোটেলে নিয়ে গেছে?”
তিতির লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেলে হবে না ওকে বলতেই হবে। বলল,
-“না মা। ওর বাসায়।”
-“কি করে হয় এসব? দেশে কি প্রটেকশন ছিল না?”
তিতিরের লজ্জায় এবার মরেই যেতে ইচ্ছে করছিল। চুপ করে রইল। মা একটু থেমে আবার বলল,
-“আমি আগেই বুঝেছিলাম এই ছেলে সুবিধার না।”
তিতির যেকোনো মূল্যে মুগ্ধকে চায়। বুকে সাহস রেখেই বলল,
-“মা ও তো জোর করে আমার সাথে কিছু করেনি। যা হয়েছে আমার স্বজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় হয়েছে।”
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মা এব্যাপারে আর কথাই বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
-“তুই প্রেগন্যান্সির কথা জানলি কি করে?”
-“টেস্ট করিয়েছি।”
-“বাহ! আমার মেয়ে দেখছি অনেক এডভান্স।”
তিতির মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো যেন মা এটা জিজ্ঞেস না করে যে কোথায় টেস্ট করিয়েছে। তাহলে তো মহাবিপদ। ঠিক তখনই মা জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় টেস্ট করিয়েছিস?”
-“হসপিটালে।”
-“কয় মাস?”
কি বলবে! আন্দাজে বলে দিল,
-“আ.. দুই মাস হবে।”
-“এরকম আন্দাজে বলছিস কেন? ঠিক করে জানিসও না? আবার মা হতে যাচ্ছে! যত্তসব।”
“মা হতে যাচ্ছে” এই কথাটা শুনে একটা অদ্ভুত ফিলিং হলো। ফিলিং টা তো জোস! ওকে নিশ্চুপ দেখে মা বলল,
-“কবে টেস্ট করিয়েছিস?”
-“দেড় মাস আগে।”
-“দেড় মাস আগে মানে? দ্বিতীয় মাসে যাস নি?”
প্রতি মাসে যেতে হয়! নাকি মা বিশ্বাস করতে না পেরে ঢপ মারছে! কিছুই বুঝতে পারছে না তিতির। মা বলল,
-“আমি জানতাম ওই ছেলে এরকম ইরেস্পন্সিবলই হবে।”
তিতিরের খুব অসহায় লাগলো। মা মুগ্ধকে দোষ দিচ্ছে! মুগ্ধ যদি ইরেস্পন্সিবল হয় তাহলে দুনিয়াতে রেস্পন্সিবল বলে কোন শব্দই নেই। কিন্তু তিতির কোন প্রতিবাদই করতে পারলো না। যাই হোক, বিয়ের পরে তো জানাজানি হবেই যে ও মিথ্যে বলেছিল তখন তো মায়ের ভুল ভাঙবে, তখন ঠিকই বুঝবে মুগ্ধ কতটা ভাল। দুজনে এটুকু খারাপ হয়ে যদি সারাজীবনের জন্য দুজনে এক হতে পারে তো দোষের কি?
মা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
-“তোর ভাবীকে বল বাকী রান্নাটা শেষ করতে। আমার মাথা ঘুরছে। তোর বাপ ভাই কে একথা আমি কি করে বলবো আমি জানিনা।”
মা নিজের রুমে ঢুকতেই তিতির লাফিয়ে উঠলো। ইয়েস! মা পজেটিভ। চিন্তার চোটে বকতেও ভুলে গেছে!
লাঞ্চের সময় সবাই স্বাভাবিক। তার মানে মা এখনো কাউকে কিছু বলেনি। মাকে চিন্তিত দেখালো। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। লাঞ্চ শেষ করে তিতির নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকালো। এরপর মুগ্ধকে কল করলো। মুগ্ধ ফোন ধরেই বলল,
-“তিতির, পরে কল করছি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
-“শোনো, শোনো.. এক মিনিট দাওনা। শুধু একটা কথাই বলবো।”
-“আচ্ছা বলো।”
-“তুমি বাবা হতে চলেছো।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“হোয়াট?”
তিতির হেসে বলল,
-“হুম।”
মুগ্ধ কিছু বলার আগেই একটা মেয়ের মিষ্টি গলা পাওয়া গেল। মুগ্ধকে বলল,
-“মে আই কামিং স্যার?”
-“নো।”
-“ওহ, সরি স্যার। একচুয়েলি ওনারা চলে এসেছে।”
-“এসেছে তো কি হয়েছে? বসতে বলেন, চা-কফি খাওয়ান। আমি ডেকে নিব। আপনি এখন যান।”
-“ওকে স্যার।”
তারপর মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা বলো কি হয়েছে? ইন শর্ট বলবে। ক্লায়েন্ট বসে আছে, আমি মিটিং এ বসবো।”
-“ওহ, সরি আমি দুষ্টুমি করছিলাম।”
-“নাহ এটা শুধু দুষ্টুমি না। কাহিনী কি তাড়াতাড়ি বলো।”
-“আরে সিরিয়াসলি এটা দুষ্টুমি ছিল। তুমি ফ্রি থাকলে দুষ্টুমিটা আরেকটু কন্টিনিউ করতাম। জাস্ট তোমাকে এই ফিলিং টা দেয়ার জন্য যে বাবা হচ্ছো শুনলে কেমন লাগে, হোক না মিথ্যেমিথ্যি।”
-“এরকমটা হলে আমি বিজি শুনেও এক মিনিট চাইতে না বলার জন্য।”
-“আরে নারে বাবা। সত্যি আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এরকম বিজি। আর তুমি কি বাবা হওয়ার মত কিছু করেছো যে বাবা হবে?”
-“না।”
-“তাহলে? যাই হোক, ওই মিষ্টি কণ্ঠী মেয়েটা কে?”
-“আমার কলিগ।”
-“তো ওরকম ঝাড়ি মারলে কেন? মিষ্টি করেই তো বলতে পারতে।”
-“অফিসের কলিগ আমার ঘরের বউ না যে মিষ্টি করে কথা বলবো। আর ও ঝাড়ি আরেকটা খাবে আমি না বলার পরেও ভেতরে আসবার জন্য, যেতে বলার আগ পর্যন্ত বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য। কারন, ও দেখেছিল আমি ফোনে কথা বলছি। কেউ ফোনে কথা বলার সময় তার সাথে কথা বলতে হয়না এটা নরমাল
ম্যনার। এটুকু না জেনে চাকরি করতে চলে আসলে তো হবে না।”
-“থাক, এত বকাবকি করো না।”
-“এটাই সিস্টেম। আমার বস আমাকে ঝাড়বে। আমি আমার জুনিয়র কে ঝাড়বো, ও আবার ওর জুনিয়র কে গিয়ে ঝাড়বে। এই হ্যায়ারারকি সব যায়গায় আছে।”
-“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা মাথা ঠান্ডা করো। এতটা মাথা গরম করার মত কিছু হয়নি। তুমি আসলে বাবা হচ্ছো না। আমি দুষ্টুমিই করছিলাম। তুমি যাও মিটিং এ বসো।”
একথা বলে তিতির একটা চুমু দিলো। মুগ্ধ বলল,
-“এসবে আমার কিছু হয়না, লাইভ লাগে আমার।”
-“গতকালই তো লাইভ দিলাম।”
-“হ্যা সেটা তো অনেক আগে।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে যাও তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, বাই।
-“বাই, কিন্তু কিছু ঘাপলা আছে। রাতে দেখছি ব্যাপারটা।”
একথা বলে মুগ্ধ ফোন রেখে দিল।
বিকেলে মা এসে দরজায় নক করলো। তিতির দরজা খুলতেই মা বলল,
-“১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে।”
-“কেন মানে? ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না? ওই ইরেস্পন্সিবল টা তো তোকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি!”
-“নিয়েছে তো মা।”
-“নিয়েছে তো টেস্ট করাতে। দু’মাস হয়ে গেছে অথচ একবারও চেকাপ করাতে নেয়নি যখন, তখন তো ও অবশ্যই ইরেস্পন্সিবল। যাই হোক, এত কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।”
একথা বলে মা চলে গেল।
তিতির ভাবনায় পড়ে গেল। কি হবে এখন? ডাক্তারের কাছে গেলে তো ধরা পড়ে যাবে ও আসলে প্রেগন্যান্ট না। তখন? কি করবে? মুগ্ধকে ফোন করে যে বুদ্ধি চাবে সেটাও সম্ভব না। ও এখন মিটিং এ, ফোনটা নিশ্চিত সাইলেন্ট করা। তবুও একটা ফোন করলো। মুগ্ধ ধরলো না। টেনশানে তিতিরের গা কাঁপছে। এতদূর এসে ধরা খেয়ে প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে ভাবতেই তিতিরের কান্না পেল। ইশ, কেন মিথ্যের উপর ভর করে ব্ল্যাকমেইল করতে গেল? মুগ্ধকে বলে সত্যি সত্যি প্ল্যান করে প্রেগন্যান্ট হত! তারপর নাহয় ব্ল্যাকমেইল টা করতো! এত তাড়াহুড়ার তো কিছু ছিল না। উফ কি হবে এখন? এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে তিতিরের মনে এই কথাটাই এল যে, ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করে যদি ম্যানেজ করা যায়? সে যদি মাকে সত্যিটা না বলে তাহলেই তো আর কোন প্রব্লেম নেই কিন্তু কোন ডাক্তার কি সেটা করতে রাজী হবে? কেন হবে না যদি সেভাবে বোঝানো যায়? কিন্তু আলাদা করে কথা বলার সুযোগটাই যদি না পায়? পাবে না কেন? ও বলবে যে ওর মায়ের সামনে লজ্জা লাগছে। তাহলে তো ডাক্তার ওর মাকে সামনে রাখবে না। অবশেষে এই ভরসায় তিতির বের হলো। মা একটা কথাও বলল না পুরো রাস্তায়।
তিতিরকে ওদের এলাকারই একটা ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই তিতিরের চক্ষু চড়কগাছ! ইমা আন্টি! এটাই ইমা আন্টির ক্লিনিক তাহলে? ড. ইমা তিতিরের মায়ের বান্ধবী। একে কি করে কনভেন্স করবে ও? হায় খোদা। মানুষ নিজের অবিবাহিত মেয়ের প্রেগনেন্সি চেকাপ করাতে পরিচিত মানুষের কাছে যায় এই প্রথম দেখলো ও। সবাই তো এরকম কেস এ লুকিয়ে চুরিয়ে অপরিচিতদের কাছেই যায় গোপন রাখার জন্য।
চেম্বারে ঢুকে বসার পর তিতির বলল,
-“মা তুমি বাইরে যাও।”
ড. ইমা বলল,
-“ওর বোধহয় লজ্জা লাগছে। স্বাভাবিক প্রথমবার তো। তুই বাইরে অপেক্ষা কর। আমি ডেকে নেব।”
তিতিরের মা বলল,
-“না না আমি বাইরে যাব না। ওর মোটেও লজ্জা লাগছে না। আমার চোখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সব কথা বলেছে। ওর লজ্জাশরম সব গেছে। যে মেয়ে বিয়ে না করেই কারো সাথে শুতে পারে তার আবার লজ্জা কিসের?”
একথা শোনামাত্রই তিতিরের চোখ ফেটে কান্না এল। একটা শব্দও করলো না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। এ যেন পানি না রক্ত!
ড. ইমা বলল,
-“আহা, মাথা ঠান্ডা কর। কি সব বলছিস। তুই বাইরে যা তো। আমি দেখছি।”
মা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইরে চলে গেল। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই উঠে এসে ড. ইমার পা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আন্টি, প্লিজ আমাকে বাঁচান।”
-“আরে আরে করছো কি? পা ছাড়ো। এই পাগলী মেয়ে কি হয়েছে?”
-“আন্টি, আমার ফ্যামিলি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হচ্ছেনা। ৬ বছরের সম্পর্ক আমাদের। অনেকদিন ধরে অনেকভাবে চেষ্টা করছি, কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই আমি এবার প্রেগনেন্সির কথা বলেছি। আসলে আমি প্রেগন্যান্ট নই, আমার বয়ফ্রেন্ড এসব করার মত ছেলেই না। কিন্তু প্লিজ আন্টি আপনি মাকে সত্যি কথাটা বলবেন না।”
-“সেকী!”
-“হ্যা।”
-“কিন্তু আমি কি করতে পারি?”
-“আপনি শুধু বলবেন সব ঠিকাছে, কোন প্রব্লেম নেই। আমি যে প্রেগন্যান্ট না সেটা প্লিজ বলবেন না।”
-“আরে আগে পা তো ছাড়ো।”
ড. ইমা তিতিরকে টেনে উঠিয়ে পাশের চেয়ারটাতে বসালো। বলল,
-“তিতির, আমি এটা কি করে লুকাবো বলো, তোমার মা তোমাকে এখানে এবরশন করাতে নিয়ে এসেছে।”
তিতিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। উনি আরো বলল,
-“তোমাকে একথা বললে কি তুমি আসতে? তাই চেকাপের কথা বলে এনেছে।”
তিতিরের কান্না আরো বাড়লো। ড. বলল,
-“বাচ্চাদের মত কান্না করো না। এসব না করে বাবা-মাকে বোঝাও যে তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকেই বিয়ে করতে চাও।”
-“অনেক বুঝিয়েছি আন্টি। কোনটাতে কাজ হয়নি বলে আজ এই পথ বেছে নিয়েছি।”
-“তিতির, যেভাবে তুমি এসে আমার পা জড়িয়ে ধরেছো! আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। বড্ড মায়া লাগছে, কিন্তু আমি কি করবো মা? আমার যে কিছুই করার নেই। তাও ভাগ্য ভাল যে তুমি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট হওনি। হলে একটা জীবন পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলা হতো। আমি মায়ায় পড়ে না করলেও তোমার মা তোমাকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।”
তিতির কেঁদেই চলেছে। ড. আন্টি আবার বলল,
-“শুধু তোমার মা বলে কথা না। আমার এই ক্লিনিকে কয়েকদিন পরপর এরকম মায়েরা আসে তাদের মেয়েদের নিয়ে এবরশন করাতে। আজকাল অহরহ ঘটছে এসব। কাউকে তো দেখলাম না মেনে নিয়ে মেয়ের পছন্দমত বিয়ে দিয়েছে। আমি একজন মা বলেই বুঝি কোনো মায়েরাই এসব মানতে পারেনা। নিজে যখন মা হবে তখন বুঝতে পারবে। আসলে মায়েরা চিন্তা করে, যে ছেলে বিয়ের আগে এসব করতে পারে তারা আর যাই হোক ভাল ছেলে না তাই বিয়ে দিতে রাজী হয়না। প্রত্যেকটা মা ই তো চায় তার মেয়ের ভাল একটা ছেলের সাথে বিয়ে হোক। টাকা পয়সা, লেখাপড়া, চাকরী, যোগ্যতা সবকিছুর আগে দেখে চরিত্র। তার মেয়েরই ভাল জীবনযাপনের আশায়। তাই বলছি এভাবে বাবা-মা কে বিয়েতে রাজী করানো যায়না।”
-“কি করবো আন্টি? কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। আমি তো পারতাম ইচ্ছে করলেই পালিয়ে গিয়ে ওকে বিয়ে করতে। ওদের বাসার সবাই রাজী। আমাদের কোন প্রব্লেমই হতো না। কিন্তু বাবা-মায়ের কথা ভেবেই তো পারিনি। যাদের কথা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছি আরেকজনকেও দিচ্ছি তারা কি পারেনা একটু আমার কথাটা ভাবতে?”
-“হ্যা, সেটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু তুমিও মা খুব বাজে একটা ওয়েতে গিয়েছো। এভাবে হবে না, অন্যভাবে বোঝাও।”
ড. আন্টি মাকে ডেকে বলল,
-“তোর মেয়ে প্রেগন্যান্ট না। শুধুমাত্র তোদেরকে বিয়েতে রাজী করানোর জন্য একথা বলেছে। ও ছেলেটাকে প্রচন্ড ভালবাসে। বুঝতে পারছিস একটা মেয়ে কখন ভয়ডর, লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে একথা বলতে পারে? কতটা ভালবাসলে? তাছাড়া ও তো পারতো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে। তা না করে তোদেরকে রাজী করানোর চেষ্টা করছে। এবার মেনে নে বোন।”
তিতিরের মা তখনই তিতিরকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা চড় দিল। তারপর ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রিক্সায় উঠিয়ে সোজা বাসায়। পুরো রাস্তা একটা কথাও বলল না হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো শুধু। বাসায় ঢুকেই এক সেকেন্ড দেরী না করে নিজের ঘরে চলে গেল। তিতিরও গেল নিজের ঘরে কিন্তু দরজা আটকালো না। এমন সময় ফোন এল মুগ্ধর। এখন ধরতে সাহস পেল না। মা যদি আসে? ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল।
মা নিজের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে সেই ৩ ফিটের কাঠের স্কেল টা নিয়ে এল যে স্কেল টা ছোটবেলায় বানানো হয়েছিল তিতিরের ছবি আঁকার জন্য। একপাশে একটু ভেঙে যাওয়ায় ওটা আর তিনি ব্যাবহার করতে দেয়নি তিতিরকে। আজ সেই বহু বছরের অব্যহৃত স্কেলটি দিয়ে ইচ্ছেমত মারলো তিতিরকে। তিতির বরাবরই সবার খুব আদরের ছিল। কেউ কখনো ওর গায়ে হাত তোলেনি। মুগ্ধর কথা জানার পর কয়েকটা চড় থাপ্পড় খেয়েছে বটে কিন্তু এমন মারের সাথে পরিচিত ছিল না তিতির। মা এতই পাগলের মত মারছিল যে, কখন তিতির ফ্লোরে পড়ে গেছে সেদিকে খেয়ালই করেনি। তিতির একটা কথাও বলল না। নীরবে কাঁদতে লাগলো শুধু। এত জোড়ে মারার পরও চিৎকার করছেনা বলে মা আরো জোরে মারছিল। প্রথমে ভাবী আর চম্পা ছাড়া কেউ বাসায় ছিল না থামাবার মত। ভাবী থামাতে আসায় মা ভাবীকে এমন ধাক্কা দিল ভাবী গিয়ে পড়লো দরজার উপর। মাথায় ব্যাথা পেল। আর আগাতে সাহস পেলনা। কাঁদতে লাগলো শুধু। চম্পা তো এগোলোই না, দূরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। মায়ের শরীরের সব শক্তি একসময় শেষ হয়ে গেল। এবার সেও কাঁদতে লাগলো। একসময় বাবা এল। চম্পা দরজা খুলেই বলল,
-“খালুজি আফারে বাঁচান।”
বাবা অস্থির হয়ে বললেন,
-“কি হয়েছে তিতিরের?”
চম্পা বাবাকে নিয়ে এল তিতিরের ঘরে। মেয়েকে ফ্লোরে মরার মত পড়ে কাঁদতে দেখে বাবা ছুটে এলেন,
-“কি হয়েছে মা? কি হয়েছে?”
তিতিরের গায়ে স্কেলের দাগ বসে গেছে। তিতির কিছুই বলতে পারলো না শুধু হিচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভাবী বলল,
-“বাবা, তিতির আর মা বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে হঠাৎই মা তিতিরকে মারতে লাগলো কেন তা জানিনা।”
এমন সময় তান্নাও রুমে ঢুকলো। মা যখন তিতিরকে মারতে শুরু করে ভাবী তখনই তান্নাকে ফোন করেছিল। ফোন পেয়ে তান্না দৌড়ে এসেছে। তান্না তিতিরকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বাবা এবার মাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন,
-“তুমি আমার মেয়েকে এভাবে মারার সাহস কোথা থেকে পেলে? কি করেছে ও? মুগ্ধর সাথে বিয়ের কথা বলেছে তো? এ আর নতুন কি? তাই বলে এভাবে মারবে তুমি?”
মাকে চুপ থাকতে দেখে তান্না বলল,
-“কি হলো মা? বলছো না যে? এভাবে মারলে কেন ওকে? ইশ দাগ বসে গেছে।”
তান্নাও কেঁদে ফেললো। বাবা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বের করে দিব বাসা থেকে। আমার মেয়েকে জানোয়ারের মত মেরে এখন চুপ করে বসে কাঁদছে।”
মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে পুরো ঘটনাটা বললো। সবাই কয়েক সেকেন্ড চুপ। সবার আগে কথা বলল তান্না। চোখ মুছে কান্না থামিয়ে বলল,
-“শোন তুই যদি ভাবিস যে এসব করলে আমরা তোকে ওই হারামজাদার সাথে বিয়ে দেব তাহলে ভুল ভাবছিস। কোন কিছু করে লাভ হবে না। এটা অসম্ভব। তোর মায়ের প্রতি সম্মান না থাকতে পারে আমার আছে, আমাদের আছে।”
বাবা চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
মা বলল,
-“ওকে যদি বিয়ে করতেই চাস তো চলে যা ওর কাছে, আমরা তো তোকে আটকে রাখিনি। ভাববি তোর বাপ-মা, ভাই কেউ নেই। আমরাও ভাববো আমাদের কোন মেয়ে নেই।”
তিতির কথা বলতে পারছিল না। সারাশরীর ব্যাথায় বিষের মত হয়ে আছে। অনেক কষ্টে বলল,
-“আমি গেলে তো অনেক আগেই যেতাম। তোমাদের পারমিশন ছাড়া বিয়ে করবো না বলেই তো মানাতে চাইছি। প্লিজ মা মেনে নাও না।”
তান্না ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলল,
-“ও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মেরে ফেলো, আমার আর কিছু বলার নেই।”
মা তিতিরকে বলল,
-“তোকে পেটে ধরেই বড় পাপ করেছি আমি।”
To be continued…