প্রেমাতাল পর্ব ৫১
মৌরি মরিয়ম
হসপিটালে কেবিনের সামনেই তান্নাকে দেখা গেল। তিতিরের পেছন পেছন মুগ্ধও কেবিনে ঢুকতে নিতেই তান্না ওকে আটকে বলে,
-“তোর ভাগ্য ভাল যে আমার বাবা অসুস্থ নাহলে তোকে এখানেই মেরে পুঁতে দিতাম।”
একথা শুনে তিতির চমকে পেছনে তাকালো। মুগ্ধ চোখের ইশারায় ওকে ভেতরে যেতে বলল। তিতির ভেতরে গেল।
বাবার নিস্তেজ শরীর টা পড়ে আছে বিছানায়। বাবাকে এভাবে দেখে তিতিরের সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। বাবা ঘুমিয়ে আছে। বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতির। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো, ‘আল্লাহ, আমি যদি জীবনেও একটা ভাল কাজ করি তার বিনিময়ে বাবা জীবনটা রক্ষা করো।’
মুগ্ধকে তান্না কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। তবুও মুগ্ধ বসে রইল হসপিটালের লবিতে। ওর কেন যেন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
বাবার ঘুম ভাঙলো রাত ৮ টার দিকে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তিতির কাছে গিয়ে বসে বাবার হাতটা ধরে বলল,
-“সরি বাবা, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। তোমাকে না বলে আমি আর এক পা ও ফেলবো না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা, আমি আর কোনদিন এমন করবো না।”
তিতিরের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগলো। বাবা বললেন,
-“সুশান অনেক ভাল ছেলে। তোকে সুখে রাখবে। তুই চলে গিয়েছিস শুনেও বলেছে বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেইই বলল,
-“হ্যা বাবা, আমি জানি সুশান অনেক ভাল। আমি সুশানকেই বিয়ে করবো বাবা। আমি তোমার সব কথা শুনবো। তুমি শুধু সুস্থ হয়ে ওঠো না বাবা প্লিজ।”
বাবা আর কিছু বললেন না, শুধু তিতিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রইলেন। যেন ছাড়লেই তিতির আবার পালিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। যাতে বমি না হয় তাই ওনাকে ঘুমের অষুধ দেয়া হয়েছে। কেবিনে একটা এক্সট্রা বেড ছিল সেখানেই মা আর তিতির বসে আছে। চেয়ারে বসে আছে তান্না। মা বলল,
-“তান্না বাসায় চলে যা, সকালে তো আবার অফিসে যেতে হবে।”
তান্না বলল,
-“না না, আমি থাকবো। আমি গেলে ইঞ্জেকশান কে এনে দিবে। ১০ টায় ইঞ্জেকশান দিতে হবে তো আবার। এখন যে এনে দিয়ে যাব সেটাও তো সম্ভব না। ইঞ্জেকশান টা ঠান্ডা দিতে হয়। এখানে তো আর ফ্রিজ নেই।”
মা চাপা গলায় আস্তে আস্তে বলল,
-“কে আনবে মানে? যার জন্য এতকিছু সে আনবে। গায়ে বাতাস লাগিয়ে বাবার পাশে সঙের মতো শুধু বসে থাকলে তো হবে না।”
তান্না বলল,
-“না না, ও পারবে না। এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে হবে।”
মা বলল,
-“অবশ্যই পারবে, যে মেয়ে এতকিছু পারে সে মেয়ে সবই পারবে। যা বলেছি তাই কর।”
মায়ের খোঁচা দেয়া কথাগুলো তিতিরকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিল, কিন্তু কিচ্ছু বলার ভাষা নেই ওর। সত্যিই তো ওর জন্যই এতকিছু হলো। ও বলল,
-“ভাইয়া তুই যা, আমি পারব।”
রাত পৌনে দশটার দিকে তিতির গেল ইঞ্জেকশান কিনতে। মুগ্ধ হসপিটালের লবিতে বসেই দেখছিল তিতির বেরোচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো ওর সাথে কেউ আছে নাকি সেটা বোঝার জন্য। যখন বুঝলো কেউ নেই তখন পিছন পিছন গেল। তিতিরকে ডাকলো কিন্তু ও দাঁড়ালো না। ও কি ইচ্ছে করে দাঁড়ালো না নাকি ডাকটা শুনতে পায়নি! তিতির রাস্তা পাড় হতে নিল আর কোত্থেকে একটা গাড়ি চলে এল। মুগ্ধ দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
-“তিতির দাঁড়াও, গাড়ি আসছে তো।” তিতির সেকথা শুনলোও না নিজেও খেয়াল করলো না, ততক্ষণে গাড়িটা একদম কাছে এসে থেমে গেল। কিন্তু তবু তিতিরের গায়ে হাল্কা একটা ধাক্কা লাগলো। তিতির ছিটকে পড়ে গেল রাস্তায়। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ওঠালো। বলল,
-“কি করছিলে তিতির? রাস্তাটা দেখে পার হবে তো? এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? আরেকটু হলে তো সাংঘাতিক বিপদ হতো।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“তুমি এখনো এখানে কি করছো? যাওনি কেন?”
-“আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না।”
-“তুমি বাসায় চলে যাও। মা চিন্তা করবে।”
-“মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো যে এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
-“বাবার ইঞ্জেকশান কিনতে।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“তুমি কেন? তান্না কোথায়?”
-“মা ভাইয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সকালে অফিস আছে তো।”
-“তো? ছুটি নিতে পারতো না?”
-“ছুটি পায়নি হয়তো।”
-“দুনিয়ার এমন কোন অফিস আছে যে বাবার হার্ট এ্যাটাক হলেও ছুটি দেয়না?”
-“বাদ দাও।”
-“আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু কয়টাই বা বাজে এখন? এখন ইঞ্জেকশানটা এনে দিয়ে বাসায় যেতে তো ১১ টাও বাজতো না ওর। তোমার ভাই মনে হয় ১১ টা পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকে না?”
-“এসব বলে কি লাভ? কেন বলছো? উল্টো আমার দেরী করাচ্ছো। ১০ টায় বাবাকে ইঞ্জেকশানটা দিতে হবে।”
-“ও হ্যা সরি, চলো।”
মুগ্ধও গেল তিতিরের সাথে। ইঞ্জেকশান নিয়ে মুগ্ধ টাকা দিতেই তিতির বাধা দিয়ে বলল,
-“দিওনা তুমি। আমি দিচ্ছি।”
-“কেন তিতির? এটুকু কি আমি করতে পারিনা? মাত্র তো পাঁচশো টাকাই।”
-“না, আমি টাকা নিয়ে এসেছি। ফেরত নিতে পারবো না। ব্যাগ আনিনি দেখতেই পাচ্ছো।”
মুগ্ধ টাকাটা রেখে দিল। তিতির নিজের টাকাটা দিয়ে ইঞ্জেকশান নিল। তারপর দুজনে দোকান থেকে বেড়িয়ে সোজা হসপিটালের সামনে চলে এল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি আর আমাকে সেভ করতে বা সাপোর্ট দিওনা প্লিজ। আজ থেকে আমি একা। সব প্রতিকূল অবস্থা নিজেকেই ফেস করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বাবা, ভাইয়া আমাকে আগলে আগলে রেখেছে। তারপর সেই ১৭ বছর বয়স থেকে তুমি আগলে আগলে রেখেছো। আর কত? এবার তো নিজেরই নিজের হাল ধরতে হবে।”
-“তিতির, এভাবে বলো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“হয়তো হবে কিন্তু তোমার আমার পথটা আজ থেকে সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ভাল থেকো তুমি আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো।”
একথা বলে তিতির চলে গেল উপরে। মুগ্ধ তারপরেও অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলো হসপিটালে।
রাত একটার পর যখন মুগ্ধ বাসায় ফিরলো তখনও মা, পিউ, স্নিগ্ধ সবাই জেগে। মুগ্ধ বলল,
-“তোমরা এখনো জেগে বসে আছো কেন?”
মা বলল,
-“তিতিরের বাবা কেমন আছে?”
যদি বলে তান্না দেখতেও দেয়নি তো মা আবার কি না কি বলবে কে জানে! এখন অন্তত কোন কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না ওর। তাই বলল,
-“এখন ভাল আছে। মেডিসিন চলছে, চলবে।”
-“কি থেকে কি হয়ে গেল!”
-“তোমরা যে যার মত ঘুমাতে যাও। সারারাত জেগে থাকার মত কিছু হয়নি।”
কেউ আর একটা কথাও বলল না। যে যার মত ঘুমাতে গেল। মুগ্ধ ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই থমকে গেল মুগ্ধ! বাসর ঘর এখনো সাজানো! কমন সেন্সের এত অভাব কেন এদের? বিয়ে ভেঙে গেছে, বউ নেই কিন্তু বাসর ঘর এখনো আগের মতোই সাজানো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মুগ্ধ। তারপর এক হাতে টান দিয়ে সব ফুলগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিল। লাল রঙের বেডকভার টাও টেনে ফেলে দিল ফ্লোরে। কি হবার কথা ছিল আর কি হলো! একেই বলে ভাগ্য। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! কিন্তু কার উপর? কার উপর রাগ হলে একটু লাভ হবে? প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে কিন্তু চোখে পানি আসছে না। কেন আসছে না? কেন কাঁদতে পকছে না ও? কোন প্রশ্নের উত্তর আজ মুগ্ধর কাছে নেই। ও আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফেইলার। সবার কাছে হেরে গেছে ও, সব কিছুর সাথে। এতদিনের ঝুলন্ত সেতু আজ ভেঙে পড়লো, বাহ!
ছোট্ট বেডসাইড টেবিলের উপরে ফ্রেমে রাখা ওদের কাপল ছবিটা হাতে নিল মুগ্ধ। দুজন দাঁড়িয়ে আছে, তিতির মুগ্ধর বামপাশে। মুগ্ধ তিতিরের কাধে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, তিতিরের বাম হাতটা মুগ্ধর বুকের উপর। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনের মুখেই হাসি। তিতির আর কখনো এই বুকে আসবে না। মাতাল করা দৃষ্টি, আর পাগল করা হাসি নিয়ে আর তাকাবে না। সব শেষ আজ। ৭/৮ বছর ধরে দেখা স্বপ্নটা সত্যি হতে পারলো না, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এবার মা কে ও কি বোঝাবে? এতদিন তো বলতো, তিতির ফিরে আসবে তাই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখন? মা হয়তো কয়দিন চুপচাপ থাকবে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার টাইম দেবে। কিন্তু তারপর তো ঠিকই বিয়ের জন্য প্রেশার দিতে থাকবে। মা কেন বোঝেনা যে অন্য কোন মেয়েকে ও আর এই জায়গাটা দিতে পারবে না। অন্য কোন মেয়ের সাথে ওর এতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং কখনো হয়নি, হবেও না। অন্যকারো সাথে থাকা অসম্ভব, কেউ পারবে না তিতিরের মত হতে, কেউ না। অন্য কারো সাথে থাকার চেয়ে তিতিরকে ছাড়া থাকাটাও অনেক সহজ এটা মাকে কি করে বোঝাবে ও?
ঘড়ির কাটায় রাত আড়াইটা। তিতিরের বাবা ঘুমাচ্ছে, অন্য বেডে মাও ঘুমাচ্ছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তিতির, দৃষ্টি বাইরের দিকে। মায়ের পাশে ঘুমানোর মত যায়গা রয়েছে কিন্তু ওর চোখে তো ঘুম নেই। মুগ্ধ এখন কি করছে কে জানে। পাগলটার কত প্ল্যান ছিল আজকের রাতটাকে নিয়ে। আজ এক হবার কথা ছিল ওদের কিন্তু সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ও তো হসপিটালের জানালার গ্রিলে চোখের জলের আহুতি দিচ্ছে কিন্তু মুগ্ধ? ওর তো ওর ঘরটাতেই থাকতে হবে, সেই ঘরে যে ঘরে ওদের জন্য বাসর ঘর সাজানো হয়েছিল। সেই ঘরে যে ঘরে বসে আজ বিকেলেও ও ভয় দেখিয়েছিল তিতিরকে। সে ঘরে কি করে থাকবে পাগলটা? তিতির নিজের পেটে হাত রাখলো, আর পারবে না ও মুগ্ধর বাচ্চার মা হতে! আর পারবেনা নাতি-নাতনীর মুখ দেখিয়ে বাবা-মার মন ভোলাতে। সব শেষ।
আজ দুটি মানুষের মৃত্যু হলো। যে মৃত্যু কেউ চোখে দেখতে পায়না। যে মৃত্যুতে কেই লাশ হয়ে যায় না। যে মৃত্যুর পর সৎকার করতে হয়না, লোক খাওয়াতে হয়না। যে মৃত্যু লুকিয়ে থাকে হাজার হাসির আড়ালে, লক্ষ সুখের মাঝের কাঁটা হয়ে। যে মৃত্যুতে জীবন শেষ হয়ে যায়না, শেষ হয়ে যায় শুধু সুখটুকু, অনুভূতিগুলো। আজ থেকে শুরু হলো দুটি মানুষের মৃতজীবন।
To be continued…