#আকাশে আমার সঙ্গী পর্ব শেষ পর্ব

0
878

#আকাশে আমার সঙ্গী পর্ব শেষ পর্ব

মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো ঝুমুর। এখনও পুরোপুরি অন্ধকার না হলেও কুয়াশার কারণে চারিদিক সাদাটে হয়ে আছে। সেই সাদা আস্তরণের ভেতর দিয়ে একটু আলো দেখা গেল। দোতলার বারান্দায় আলো জ্বলছে। ইজিচেয়ারে বই নিয়ে বসে আছে মালেক, ঝুমুরের বর। ঘন ঘন সিগারেট টানতে টানতে বই পড়ছে সে।

হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল রাতুল। গেটের সামনে ঝুমুরের মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়ায় সে।

“ভাবি! কার সাথে এসেছ?”

“একা।”

“একা! ভাইয়া বলল পরশুদিন তোমাকে নিয়ে আসবে। আর তুমি কাউকে কিছু না বলে আজকেই একা একা চলে এলে। কারণটা কী?”

ঝুমুর জবাব দেয় না। সে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে এসেছে। ছোটোবোনের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি করেছিল বলে মা তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছেন। ছোটোবোনটাকে একটু কিছু বলেননি। বরং সাপোর্ট করেছেন। এজন্য তার ভীষণ রাগ হয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গে কাপড়চোপড় সব নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে যত ঝামেলা। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না। এরপর যে কী আছে কপালে!

রাতুল ঝুমুরের দেবর হলেও বয়সে তারা সমবয়সি। এজন্যই বোধহয় রাতুলকে আসল কথাটা বলতে ভয় হলো না তার। প্রথমে সে এক গ্লাস পানি চাইলো। রাতুলের ঘরে বসে টানা দু’গ্লাস পানি শেষ করে রুদ্ধশ্বাসে সব কথা খুলে বলল সে। রাতুল অনেক্ষণ তব্ধা মেরে বসে রইল। হঠাৎ চোখ কপালে তুলে বলল, “লাগেজ সহ সবকিছু চুরি হয়ে গেছে! বিয়ের আঙটিটাও!”

“আস্তে বলো!”

ঝুমুরের চাপা অনুরোধে গলা নামিয়ে নেয় রাতুল। নিচু স্বরে বলে, “তুমি কি শিয়োর যে বিয়ের আঙটিটাও চুরি হয়ে গেছে? আঙটি তো আঙুলে থাকে। ভ্যানিটিব্যাগে রেখেছিলে এ-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?”

ঝুমুর ক্লান্ত স্বরে সম্মতি জানায়। রাতুল সাবধান করে দিয়ে বলে, “যা হবার তা হয়ে গেছে। আপাতত ভাইয়াকে কিছু বলো না। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক আগে। তারপর তাকে জানিয়ো।”

মালেকের থেকে প্রায় ছয় হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ আওয়াজ দেয় ঝুমুর, “আসসালামু আলাইকুম।”

তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় মালেকের। হাতের বইটা টেবিলের ওপর রেখে বলে, “তুমি! কার সাথে এসেছ?”

“একা।” মিনমিন করে জবাব দেয় ঝুমুর।

“সকালে না বললাম পরশুদিন গিয়ে নিয়ে আসব? তবুও একা আসতে গেলে কেন?”

“ওখানে আপনাকে ছাড়া ভালো লাগছিল না।”

কথাটায় মালেক একটু খুশি হলো কি? উঁহু, তার মুখ দেখে তো কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না!

ফের বইয়ে মনোযোগ দেয় মালেক। নির্লীপ্ত ভঙ্গিতে বলে, “সালোয়ার কামিজ পরেছ কেন? খুলে ফেল। শাড়ি পরবে সব সময়।”

মালেকের কথামতো আলামারি থেকে শাড়ি বের করে পরে নিয়েছিল ঝুমুর। শাড়িতে তার কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগে। মনে হয় দমবন্ধ করা কারাগারের ভেতরে তার দেহ আটকে রাখা হয়েছে। অস্বস্তি হয়। তবুও গত কয়েক ঘন্টা ধরে শাড়ি পরে আছে সে। কালো আকাশের বুকে চাঁদটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও ওই বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে ঝুমুরের। বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখছে। মালেক শোবার ঘরে বসে বসে কী একটা কাজ করছিল। সে যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা ঝুমুর এখনও টের পায়নি।

মালেক দু’বার গলা খাঁকরি দিতেই দ্রুত পেছনে তাকায় ঝুমুর। সেই কখন থেকে ভয়ে মরছে সে। একবার যদি তার খালি হাতটা মালেকের চোখে পড়ে তাহলে কী যে হবে! ভাবতেই ভেতরে কাঁপন ধরে যায়। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায় ঝুমুর। মালেক নরম গলায় বলে, “আমার কথায় শাড়ি পরেছ ভালো কথা। তাই বলে ঠিক করে পরবে না? এভাবে কেউ শাড়ির কুঁচি দেয়?”

ঝুমুর একবার নিজের দিকে তাকায়। মিনমিন করে বলে, “এভাবেই তো পরি আমি।”

ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে মালেক। বলে, “এত বড়ো হয়ে গেছ এখনও শাড়ি পরতে পারো না? রান্নাবান্নায় ও তো গোল্লা। পারোটা কী তুমি?”

ঝুমুর চুপ করে রয়। তাকে অবাক করে দিয়ে এক কান্ড করে বসে মালেক।
হঠাৎ হাঁটু ভাঁজ করে ঝুমুরের সামনে বসে পড়ে সে। নিজ হাতে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে গিয়ে খেয়াল করে, ঝুমুর বারবার কেঁপে উঠছে। বারবার দূরে সরে যাচ্ছে। মালেক ধমক দিয়ে বলে, “আঃ! এত নড়লে চলে? সোজা হয়ে দাঁড়াও!”

ঝুমুর পাথর হয়ে যায়। মালেক শাড়ি ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তোমার হাতে কী হয়েছে?”

শ্বাসরুদ্ধকর এই সময়ে মালেক এমন একটা প্রশ্ন করবে তা কল্পনাও করেনি ঝুমুর। অবচেতনে তার বুকের ভেতরে নিশ্বাস ভারী হয়ে যে প্রবল ঢেউয়ের সঞ্চার হয়েছিল, সেটা কমে গিয়ে ভয় ঢুকে যায় মনে। ঝুমুর হাতদু’টো আগের মতোই পেছনে লুকিয়ে রাখে। মালেক রেগে যায়। গর্জন করে বলে, “কী হয়েছে হাতে? আড়াল করছো কেন?”

ঝুমুরের হাত টেনে এনে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পায় না মালেক। সে ভেবেছিল ঝুমুর হয়তো হাত পুড়ে ফেলেছে, কিংবা হাতের কোথাও খুব বাজেভাবে কেটেছে কিংবা… কিন্তু এসবের কিছুই নেই। ঝুমুরের কাঁদোকাঁদো গলায় শোনা যায়,

“বিয়ের আঙটি চুরি হয়ে গেছে।”

খারাপ খবরটা শুনেও শান্তি পায় মালেক। যাক! সে যা ভেবেছিল সেরকম কিছু নয়।

“হাতে কিছু হয়নি তো?”

“উঁহু।”

“শুধু আঙটি চুরি গেছে। আরকিছু হয়নি তো?”

“লাগেজটাও চুরি হয়ে গেছে। কাপড়চোপড়, কসমেটিকস্…”

“আরে তোমার কিছু হয়েছে কিনা! কোথাও ব্যথা পেয়েছ?”

“না।”

ঝুমুরের হাতদু’টো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে মালেক। না, কোথাও আঘাত পাওয়ার চিহ্ন নেই। সোনার আঙটি, লাগেজ, কাপড়চোপড় খোয়া গেলেও স্বস্তি লাগলো তার। ওসব চলে যাক। মানুষটার যে কিছু হয়নি এটাই তো অনেক! একা একটা মেয়ে এতদূর এসেছে। কত রকমের বিপদ হতে পারত!

“তোমাকে কে বলেছিল একা একা চলে আসতে?”

ধমক শুনে চুপসে যায় ঝুমুর। মাথা নিচু করে চুপ মেরে থাকে সে। এই মুহূর্তে কী বলা দরকার তা সে জানে না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিত মানুষটা, যাকে সে আজ অবধি একটুও বুঝতে পারেনি, তার সামনে বরাবরের মতোই চুপ রইল সে। কেন জানি এই মানুষটাকে বড্ড অচেনা, ভারী অদ্ভুত লাগে তার। বিয়ে হয়েছে একমাস হলো। এখন অবধি ঝুমুরকে ছুঁয়ে দেখেনি মালেক। ঝুমুরের সাথে তুলনামূলক কথাও কম বলে। শুধু হাঁ-হুঁ-তে চালিয়ে দেয়। আজই প্রথম ঝুমুরের পরনের শাড়ি ঠিক করে দিয়েছে মালেক। এজন্য আরো বেশি ভয় লাগছে ঝুমুরের। আবার রাগও হচ্ছে লোকটার প্রতি। সে যদি বউয়ের মর্যাদাই দেবে না তবে বিয়ে করল কেন? লোক দেখানোর জন্য?

“কী হলো? মুখে তালা মেরে বসে আছো কেন?”

“আমি বুঝতে পারিনি…”

“বুঝতে পারোনি মানে! তুমি কি এখনও ছোটো বাচ্চা, যে বুঝতে পারোনি? নূন্যতম কমনসেন্স তো থাকা দরকার, না কি?”

ঝুমুর জবাব দেয় না। মালেকের গলার আওয়াজ হঠাৎ কোমল হয়ে আসে। একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে সে বলে, “এই হলো তোমার অরিজিন্যাল বার্থ সার্টিফিকেট। গতকাল তোমার আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে।”

কাগজটা হাতে তুলে নেয় ঝুমুর। হঠাৎ জন্মনিবন্ধনের কী দরকার বুঝে উঠতে পারে না সে। মালেক নিজ হাতে ঝুমুরের মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে যায়। তারপর থেকেই ঝুমুরের বুকের ভেতর তুমুল ঝড় বইছে। বারবার একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। প্রশ্নটা এমন, মালেক হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন? কী কারণেই বা তার মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিলো? ঝুমুরের আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে বলে?

ফের আকাশের দিকে তাকায় ঝুমুর।
লাজুক হাসিতে লেপ্টে যায় তার চোখ-মুখ।
কেন জানি মালেককে আজকে আবার নতুন করে ভয় লাগছে তার।
তবে আজকের ভয়টা ভিন্নরকম। একটু অন্যরকম।
চকিতে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় ঝুমুর।
মালেক বিছানা গোছগাছ করছে। ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে। সবচে’ বড়ো কথা হলো, মালেক আজ পাঞ্জাবি পরেছে!

ঝুমুর বারান্দার এক কোণে নিজেকে আড়াল করে নেয়।
চুপটি করে দাঁড়িয়ে প্রহর গুণতে গুণতে একসময় তার মনে হয়, একটা মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সহসা চোখ ফেরাতেই মালেকের বুকের উপর মুখ লেগে যায় তার। সে পালিয়ে যাবে তখনই…

সমাপ্ত

[সবাই বলে, যার শুরু আছে তার শেষও আছে। তবে আমি মনে করি গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই কথাটা অবাস্তব। গল্প-উপন্যাসের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। কারণ, যেখানে একটি গল্প শেষ হয়, ঠিক সেখানে আরো অসংখ্য গল্পের শুরু হয়ে যায়।

পাঠকদের জন্য ভালোবাসা।]

লেখক : মো. ইয়াছিন

গত পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/100054727422264/posts/516878446813065/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here