#শিশির বিন্দু পর্বঃ ০১
#খাদিজা আরুশি আরু
কোন এক বিষন্ন প্রাতে তার সঙ্গে আমার প্রথমবার দেখা হয়েছিলো, বড়ই সাদামাটা সাক্ষাৎ। আমি সবে লঞ্চঘাট থেকে সিএনজি করে বাড়ি ফিরেছি, ড্রাইভারের কাছে পাঁচশো টাকার খুচরো ছিলো না। এত সকালে কোন দোকানপাটও খোলা নেই, আমাকে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি এলেন। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
-“মামা, কোনো সমস্যা? কাকভোরে রাস্তাঘাটে আপদ ঘাড়ে করে দাঁড়াই থাকলে তো মানুষ অন্য কিছু ভাববো।”
একজন অপরিচিত মেয়েকে আপদ বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন, অথচ আমি নির্বিকারই রইলাম। একজন অযাচিত লোক আমাকে আপদ বললেই তো আর আমি আপদ হয়ে গেলাম না। ড্রাইভার মামা সংক্ষেপে সবটা খুলে বললেন ওনাকে, উনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ালেন তারপর হনহন করে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। মিনিট না গড়াতে অবশ্য ফিরেও এলেন… আমার হাতে ধরা পাঁচশত টাকার নোটটা কেড়ে নিয়ে সেখানে একশত টাকার কচকচে পাঁচটা নোট ধরিয়ে দিয়ে আগের মতোই হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। তার এই নির্বিকার ভাব, সাহায্য করেও ধন্যবাদ না নেয়া, নিজ থেকে পরিচিত হবার চেষ্টা না করা আমাকে অবাক করেছিলো, বেশ কিছুক্ষণ তার যাবার পথে তাকিয়ে রইলাম আমি। পরমুহূর্তে ভাড়া মিটিয়ে মূল ফটক দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। অন্য সময় হলে হয়তো লোকটাকে নিয়ে আগ্রহ কাজ করতো কিন্তু সে মুহূর্তে একজন আগুন্তুককে নিয়ে ভাবার সময় আমার হাতে নেই। বাবাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। দু’দিন আগে হোস্টেলে ফোন করে আমাকে জানানো হয়েছে, বাবা অসুস্থ। তাও সাধারণ অসুখ নয়, গুরুতর অসুখ। ফোনে বলা সম্ভব নয়, আমি এসেই যেনো বিস্তারিত শুনি। সেই থেকে মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা উপশিরায় বাবা নামক মানুষটির জন্য চিন্তারা চষে বেড়াচ্ছে। কলিংবেল বাজাতেই ভেতর থেকে আয়না বানুর কণ্ঠ শোনা গেল। আয়নাবানু আমাদের বাসার বহু পুরোনো কাজের লোক, মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের বিয়ের সময় নানুবাড়ি থেকে আয়না বানুকে মায়ের সঙ্গে দেয়া হয়েছিলো। তারপর এ বাড়িতেই থিতু হন আয়না বানু, আমি তাকে ডাকি আয়না নানু। দরজা খুলেই আয়না নানুর মাথায় হাত, চিৎকার করে আমার চারদিকে ঘুরছেন আর বলছেন,
-“ও আমার আল্লাহগো, পরীর মতো মাইয়াডা এতো শুকাইলো কেমনে? দেইখা তো চেনাই যায় না। হায় হায় চোখও দেখি ভিতরে হান্দাই গেছে। ও নাফিসার মা, তাড়াতাড়ি আসো, দেখো তোমার মাইয়া নিজের কি সর্বনাশ ঘটাইছে। এই সুরত লইয়া সে যাইবো স্বামীর ঘর করতে, স্বামী তো ফিরাও তাকাইবো না।”
আমি প্রতিবার আসার পর আয়না নানু এভাবেই আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে হাহুতাশ করেন। তিনি শুদ্ধ ভষায় কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন তবে মাঝে মাঝে কিছু আঞ্চলিক শব্দ আপনাআপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, সুতরাং তার কথা শুদ্ধ-অশুদ্ধের মাঝামাঝিতেই রয়ে যায়। তার ধারনা প্রতিবার বাড়ি থেকে যাবার সময় আমি বেশ রিষ্টপুষ্ট হয়ে যাই এবং ফিরি একেবারে রোগা হয়ে। তবে এবারের আফসোসটা অন্যবারের তুলনায় আলাদা, আমার চেহারা নিয়ে আগে কখনো আয়না নানুকে এতোটা উদ্বিগ্ন হতে দেখি নি। তাছাড়া স্বামীর বাড়িতে যাবার কথাই বা আসছে কেনো? কোন এক অজানা শঙ্কায় আমার মন সংকচিত হলো, আমি চুপচাপ বাসার ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছোট বোন নাঈমা থাকে এ ঘরে। আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো সে, আদুরে গলায় বললো,
-“আপু, বিয়ে করা কি খুব জরুরি? বিয়ে না করলে বাবা-মা অসুস্থ হয়ে যায়?”
নাঈমার প্রশ্নে অবাক হলাম, ওর বয়স সবে ছয়ে পড়েছে, ওর দ্বারা এ প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখেছে যার জন্য এ প্রশ্ন তার মাথায় এসেছে। আমি নাঈমাকে কোলে তুলে নিলাম, খাটে নিজের পাশে বসিয়ে বললাম,
-“হঠাৎ এ প্রশ্ন করছিস কেনো? কিছু হয়েছে?”
-“তুমি বিয়ে করছো না বলে বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে। তার বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথা, সারা শরীরে ব্যথা। ডাক্তার কতো ব্যথা সারাবে বলো? কিন্তু মা বলেছে, তুমি বিয়ে করলে বাবার সব ব্যথা সেরে যাবে। আপু, বাবার সব ব্যথা সারিয়ে দাও না…”
নাঈমার কথা শুনে বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম, তবে এতোক্ষণে বাসা থেকে জরুরি তলব করার কারন উদঘাটন করতে পারলাম। আমার বড় ফুফুকে বাবা বরাবরই বেশ মান্য করতেন, সেই ফুফু ছ’মাস আগে মারা গেছেন। তখন থেকে বাবার মনে মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে, ওনার ধারনা উনি যখন তখন মারা যাবেন। বাবা মারা গেলে আমরা ঘরে চারজন একা মেয়ে মানুষ, আমি, মা, আয়না নানু আর নাঈমা। তাই এ মুহূর্তে বাবার ধারনা আমার বিয়েই হলো সমস্যার একমাত্র সমাধান, বাবার অবর্তমানে আমার বর হবে এ পরিবারের অভিভাবক। এ নিয়ে দু’মাস আগে বাবার সঙ্গে আমার তুমুল ঝগড়া হয়েছে, ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি রাগ করে হোস্টেলে চলে যাই। তারপর আর বাড়ি ফিরি নি, কল করলে ফোনও তুলি নি। তাই হয়তো আমাকে ফেরাতে বাবার এ অসুস্থতার নাটক, কিন্তু বাবা এতো ভাবছেন কেনো, আমার বিবিএ শেষের দিকে। আমি তো চাইলেই বাবাবিহীন পরিবারের হাল ধরতে পারবো, আমাকে বিয়ে করে অন্য বাড়ির ছেলেকেই কেনো এ পরিবারের হাল ধরতে হবে! যুক্তিযুক্ত কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেই হয়তো বাবার প্রতি অভিমানের মেঘ জমে ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। অভিমানে আমি বাবার অসুস্থতার কথা ভুলে গেলাম, তাকে যে আমার একবার দেখে আসা উচিত আমার মনেই পড়লো না। বাসায় ঢোকার পর থেকে মাকে একবারও দেখি নি, তাও আলাদা করে ভাবালো না। আমি নির্বিকার নিজের ঘরে পড়ে রইলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মাঝরাত, আয়না নানুর আহাজারির শব্দ এখনো আমার কানে স্পষ্ট বাজে। আমি দ্রুত পায়ে বসার ঘরে গেলাম, আয়না নানু বুক চাপড়ে কাঁদছেন, নাঈমা ঘরের এক কোণে মায়ের কোল ঘেঁষে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। আমি বাবার ঘরে গেলাম, বাবা নেই। ঘরের কোথাও বাবা নেই, পুরো ঘরটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা অন্ধকার ঘরটা আমায় বারংবার জানান দিচ্ছিলো, কোনো ভয়াবহ ঘটনার। আমি বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের পাশে বসলাম, শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
-“বাবা কোথায় মা?”
এই একটা প্রশ্নে আমার সবসময় বিপদে শান্ত থাকা মা কাটা কলাগাছের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কান্নার দমকে অনবরত তার শরীর কাঁপছিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উপায়ান্তর না পেয়ে ছোট্ট নাঈমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“বাবা কোথায় নাঈমা?”
নাঈমা যেন আমার প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিলো, কাঁদতে কাঁদতে আমার দু’হাত ধরে বললো,
-“নাফিসাপু তুই বিয়ে করে নে না, তুই বিয়ে করলে বাবা চলে আসবে। তুই বিয়ে না করলে বাবা ফুফির মতো আর কখনো বাড়ি আসবে না।”
আমি স্তব্ধ হয়ে ছোট্ট নাঈমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তার কন্ঠে কি করুণ আকুতি। আমার হঠাৎ মনে হলো, বাবাকে আমার তুলনায় হাজার গুণ বেশি নাঈমা ভালোবাসে। আমার তো ব্যক্তিগত পছন্দ নেই, তবে কেনো রাজি হচ্ছি না আমি? কিসের জেদ আমার! বাবার উপর অভিমান হচ্ছিলো না, তা’ও নয়। বাবা আমায় প্যাঁচে ফেলে বিয়েতে রাজি করাতে চাচ্ছেন। আমার চিরকাল জয়ী হয়ে আসা বাবার পরাজয় সহ্য হতো না আমার, তাই নিজেই হেরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বেচ্ছায় হার যাকে বলে… দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
-“আমি বিয়ে করবো। আজ, এক্ষুণি, এই মাঝ রাতেই বিয়ে করবো। আমার বিয়ে যদি বাবার বেঁচে থাকার ঔষধ হয় তবে তাই হোক।”
জেদের বসে বিয়ে করলাম, যখন কাজী আমাকে কবুল বলতে বললো তখন প্রথমবারের মতো আমার বরের নামটা শুনলাম, আজহার তালুকদার। পাশ থেকে আয়না নানু বললো,
-“ও নাফিসা, মুখ গোমরা কইরা থাকোনের সময় না এটা, কবুল বইলা ফালাও বইন। তোমার যে বর হইতাছে সে হইলো রাজপুত্র, তোমার বাপের ছাত্র মানুষ। বাপ-মা মরা পোলা, তোমার বাপের হাতের তালুতে মানুষ হইছে। এ পোলা তোমারে রাজরানী বানাই রাখবো, আইতে যাইতে শ্বশুর-শ্বাশুড়িরে আব্বা-আম্মা ডাইকা গলা শুকাই ফালাইবো। কবুল বলো বইন, দেরী কইরো না। তুমি যতো দেরী করবা, তার ততো অপেক্ষা করা লাগবো।”
চলবে…