#শিশির বিন্দু পর্বঃ ০২

0
829

#শিশির বিন্দু পর্বঃ ০২
#খাদিজা আরুশি আরু

বাবার ছাত্র! তারমানে এসব আগে থেকেই সাজানো ছিলো। আমি কানখাড়া করে আয়না নানুর কথাগুলো শুনছিলাম, আমি যে বাবার বিছানো জালে বাজেভাবে ফেঁসে গেছি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার পালানোর কোনো পথ নেই। আমি কবুল বললাম, স্পষ্ট উচ্চারণেই বললাম এবং মনে মনে পণ করলাম, আর কখনো বাবার সঙ্গে কথা বলবো না আমি। মা কিংবা আয়না নানুর সঙ্গেও না, কারন তারা বাবাকে শতভাগ সমর্থন দিয়েছেন।

বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে বাকি রাতটার জন্য আমাদের দু’জনকে এক ঘরে থাকতে দেয়া হলো। যদিও আমার গায়ে তেমন গয়না নেই তবুও আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খোলার নাটক করে যাচ্ছিলাম অনবরত, তাছাড়া আমার করারই বা কি আছে? বাবার প্রতি আমার যত অভিমানই থাকুক না কেনো, তার মুখটা একবার দেখার জন্য আমার মনটা অস্থির হয়ে ছিলো। হয়তো বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে থাকা আজহার নামক মানুষটা বাবার জন্য আমার মনের অস্থিরতা টের পাচ্ছিলো, ক্ষীণস্বরে বললো,

-“স্যার ভালো নেই নাফিসা। হাসপাতালে যাবার সময় বারবার আমার হাত ধরে বলছিলেন, আমার নাফুটা কি আমার সঙ্গে রাগ করেই থাকবে, মৃত্যুর আগে ওকে একবার দেখতে পারবো না? আমি কিছু বলতে পারি নি, কারন তোমার ব্যাপারে আমি এখনো নিশ্চিত নই। তবে একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা রক্ষার্থে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ, আমার মতো একজন অনাথকে একটা পরিবার দিয়েছ তার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ। নাফিসা, তুমি কি একবার স্যারকে দেখতে হাসপাতালে যাবে? ওনার ভেতর মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে, আমার মনে হয় না উনি বেশিদিন বাঁচবেন। বেশিদিন বলছি কেনো, হয়তো কয়েক ঘন্টায়ও…”

আমি বসা থেকে উঠে মানুষটার গালে সজোরে চড় বসালাম, আমার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে তার? তাছাড়া এ লোকটাই সকালে আমাকে আপদ বলেছিলো, আসলে আমি তো আপদই। তাইতো বাবা নিজের ঘাড় থেকে আপদ নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। চড় খেয়ে মানুষটা ম্লান হাসলো, হালকা কাশলো, গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-“স্যার ঠিক বলতেন। তুমি ওনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো। যাও নাফিসা, একবার দেখে আসো মানুষটাকে। নতুবা সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে।”

আমি কিছু বললাম না, মায়ের থেকে ঠিকানা নিয়ে ফজর নামাজ পড়েই বাবাকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। বাবার শুকনো মুখটা দেখে আমার সাজানো পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলো। কি হাল হয়েছে মানুষটার… আমি এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত রাখলাম, পিটপিট করে চোখ খুললো বাবা। আমাকে দেখে তার চোখের কোন বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি হাত বাড়িয়ে মুছে দিলাম সে অশ্রু। বাবা কাঁপা হাতে আমার দু’হাত আঁকড়ে ধরলেন। ভাঙা ভাঙা শব্দে যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলো, “আজহার খুব ভালো ছেলে, তোমাকে সে ভালো রাখবে মা। তুমি মন খারাপ করো কেনো? বাবা কি তোমার খারাপ চাই? সে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিলো, আমরা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকি বাড়িটা তার দাদার। ছেলেটার কেউ নাই, তার দরকার ছি্ল একটা পরিবারের আর তোমাদের দরকার ছিলো অভিভাবকের। তুমি মন ছোট করো কেনো, সে তোমাদের ভালো রাখবে।” আমি কিছুই বলতে পারি নি, একটুখানি কাঁদিও নি। নিরবে কেবল বাবার কথাগুলো শুনেছি। তারপর হাত ছাড়িয়ে হাসপাতালের করিডরে এসে বসেছি। আমার সে মুহূর্তে নিজেকে অনুভূতিশূণ্য মনে হচ্ছিলো, বাবার অহেতুক জেদের জন্য আমার হুট করে বিয়ে করা, বাবার হঠাৎ এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়া সব মিলিয়ে আমি যেনো এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছিলাম। একবার মনে হচ্ছিলো এইটা বুঝি স্বপ্ন, এক্ষুণি ঘুম ভাঙলে দেখবো আমি হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে আছি। যখন নার্স আর ডাক্তারদের আইসিইউ এর দিকে ছুটে যেতে দেখলাম, একজন নার্সকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে শুনলাম, “আমিনুল হকের বাড়ির লোক কে?” যা বুঝার তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। এক পা’ও নড়তে পারি নি, পাথরের মুর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা তখন চরকির মতো ঘুরছে, আমি সেই আলো-আঁধারির খেলার মাঝে দেখলাম আজহার নামের লোকটি দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। তার গায়ে সফেদ পাঞ্জাবী, কি পবিত্র লাগছে তার মুখটা। উনি এসে নার্সের সঙ্গে কি যেন কথা বললেন, তার কিছুই আমার কানে গেলো না। আমার সামনে পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো, আমি লুটিয়ে পড়লাম কারো বাহুতে…

যখন চোখ খুললাম তখন আমি নিজের ঘরে, আমার মাথার কাছে আয়না নানু বসা। বসার ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আমি এক পা, দু’পা করে বসার ঘরে এলাম, আমার বাবার নিথর দেহটা চোখের সামনে পড়ে আছে। আমি কাছে গেলাম না, শেষবারের মতো ছুঁয়েও দেখলাম না। মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, আমার মনে হচ্ছিলো বাবা ঘুমোচ্ছে। এক্ষুণি জেগে সবাইকে ধমকে বলবেন, “এভাবে কাঁদছো কেনো? তোমাদের জ্বালায় তো আমি শান্তিমতো ঘুমোতেও পারবো না।” আর আমি ফিক করে হেসে বলবো, “এতো ঘুমিয়ে কি হবে বাবা? বেলা তো কম হলো না।” এ নিয়ে বাবা আর আমার মাঝে দু’দফা বাকবিতণ্ডাও হবে আর প্রতিবারের মতো যুক্তিতর্কে জিতে যাবে বাবা। বাবার চুপচাপ শুয়ে থাকা আমার চোখে সুঁচের মতো বিঁধছিল, আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবাকে দাফন করার আগে সবাইকে একবার দেখানো হচ্ছিলো। মা, আয়না নানু, আজহার নামক লোকটা সবাই আমাকে ডাকতে এসেছিলো, আমি যাই নি। কাফনে মোড়ানো বাবাকে দেখতে একদম ইচ্ছা করছিল না আমার। আমাকে কেউ জোরও করে নি।

বরাবর ছিঁচকাঁদুনে আমি বাবার মৃত্যুতে শক্ত পাথর হয়ে গেলাম, একটু কাঁদলাম না। বরং পরদিন সকালে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আজহার লোকটার জন্যই কি না কে জানে, আমাকে কেউ কিছু বললো না। বাড়ির সকলের সঙ্গে একটা শীতল মনোযুদ্ধ চলছিলো আমার, তারাও আমাকে কিছু বলতেন না, আমিও তাদের কিছু বলতাম না। তবে নাঈমা প্রায়ই বসার ঘরের ল্যান্ডলাইন থেকে কল করতো। কল করেই নানা অভিযোগ দিতো, মায়ের নামে, আয়না নানুর নামে। অবাক করা ব্যাপার হলো, একমাত্র আজহার নামের মানুষটার সুনাম করতো নাঈমা। সবসময় বলতো, মানুষটা ভীষণ ভালো, একদম বাবার মতো। আমি কখনো শুনতাম, আবার কখনোবা না শুনার ভান করে থাকতাম। কোনো এক সকালে আজহার আমার হোস্টেলে এলেন, বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন,

-“নাফিসা, বাড়ি চলো। মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবা যাবার পর তুমি আর বাড়ি যাও নি। ওনাদের তোমার প্রয়োজন।”
-“আর আপনার?”

প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি, তবে কোনো উত্তর দেন নি। আমি সেবার বাড়ি ফিরে গেলাম, কারো মন ভালো করতে নয়, বাড়ির পরিস্থিতি দেখতে। বাড়ি পৌঁছে বেশ চমকে গেলাম আমি, বাসার সবকিছু আগের মতোই আছে কেবল আমার ঘরটা ছাড়া। আমার ঘর এখন অন্য একজনের দখলে, পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে স্পষ্টভাবে। আমি আয়না নানুকে ডেকে বাজখাঁই গলায় বললাম,

-“আমার ঘরটা এমন গোয়ালঘর হয়ে আছে কেনো? কোন মানুষ এ ঘরে থাকতে পারে?”

আজহার দ্রুত ঘরে ঢুকলেন, তার ছড়িয়ে থাকা জামা প্যান্টগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন,

-“ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে আনতে চলে গিয়েছিলাম। ঘর গুছাতে মনে নেই, তাছাড়া এ ঘরে কেউ আসে না। আমিই গুছিয়ে রাখি। তুমি একটু বাহিরে বসো, আমি এক্ষুণি সব গুছিয়ে দিচ্ছি।”

আমি নিরবে বেরিয়ে এলাম, আয়না নানু মুখ ঝামটা মেরে বললো,

-“জামাইরে এমনে বকলা কেন বইন? তুমি জানো সে সারাদিন কতো কাম করে? ঘরের কাম, বাইরের কাম সবই তো সে করে। এইতো এখন আবার যাইবো দোকানে দোকান থেইকা অফিসে। এই মানুষটারে এতো খাটানের মানে হয়?”

আমি অবাক চোখে আয়না নানুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, এইযে এতোমাস পর আমি এলাম, আয়না নানু একটুও আমাকে খেয়াল করলেন না! কিছুক্ষণ পর মা এসে শান্তস্বরে বললেন,

-“ছেলেটাকে আর কতো জ্বালাবি? আমাদেরই ভুল, মানুষ চিনতে ভুল করছি আমরা। তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছেলেটার জীবন নষ্ট করলাম। এমন নামাজি, ভদ্র, কর্মঠ ছেলের কদর তো তুই করতে পারবি না। তোর দরকার ছিলো দিনরাত ঝাটাপেটা করে এমন জামাই, তাহলে তুই লাইনে থাকতি। মেয়ে মানুষের এতো তেজ কিসের?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here