#শিশির বিন্দু পর্বঃ ০৩
#খাদিজা আরুশি আরু
মা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। নাঈমা সবে স্কুল থেকে ফিরেছে, দৌঁড়ে সে আমার ঘরে চলে গেলো। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, আজহার নাঈমাকে দেখে কাজ বন্ধ করে বিছানার কোনে বসলো। নাঈমা তার পাশে বসে আনন্দে হাত নেড়ে নেড়ে স্কুলের গল্প করছিলো। নাঈমার চোখে মুখে সে কি আনন্দের ছটা… আমি মুগ্ধ নয়নে ওদের দুজনকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজহার নামক মানুষটার মাঝে কিছু একটা আছে। যা তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। এই যে আমার বাড়ির প্রতিটা মানুষ তাকে ভালোবাসছে, তার নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে। আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আজহার নামক লোকটাকে। কিছু মানুষ থাকে না? যাদের সব ভালো, আজহার মানুষটাও তেমন। ফজরের আযান দিলে নামাজ পড়ে হাঁটতে যায়, বাড়ি ফিরে নাস্তা করে দোকানে যায়। দোকান থেকে অফিস। মাগরীবের পর বাড়ি ফিরে নাঈমার সারাদিনের গল্প শুনে, মায়ের শরীরের খোঁজ নেন, আয়না নানুর সঙ্গে কি সব আলাপ করেন। রাতে খাবার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে একটা সাদা মলাট মোড়ানো ডায়েরীতে খসকস শব্দ করে কি সব লেখেন। লেখা শেষে সে ডায়েরী লুকিয়ে তারপর ঘুমান। মাঝে মাঝে আবার ডায়েরীর জায়গা বদলও করেন। আমি অবশ্য এ কয়দিনে ডায়েরী লুকোনোর সব জায়গাগুলোই চিনে নিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার হোস্টেলে ফিরে যাবার সময় ওনার ডায়েরীটা চুরি করে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমিও দেখি, রাত জেগে কি সব হাতি-ঘোড়া লেখা হয় এ ডায়েরীতে…
মোটামুটি পনেরো দিন বাড়িতে থাকার পর আমি গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, আজহার আমাকে বাসে তুলে দিয়ে গেলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উনি নিজের জন্য কখনোই আমার কাছে কিছু চান না। তবে এবার উনি চাইতে বাধ্য, ওনার রাত জাগার সঙ্গী ডায়েরীটাতো আমার কাছে। হোস্টেল পৌঁছতেই আমার পাশের বিছানার মিনতি এসে বললো,
-“বাড়ি গিয়ে এতোদিন থাকলি কেনো এবার নাফু? ইনকোর্সের তারিখ দিয়ে দিলো, কবে পড়বি, আর কি করে পরিক্ষা দিবি?”
খবরটা শুনে যেন মাথায় বাজ পড়লো, কতোশত পড়া বাকি, অথচ সময় খুবই কম। আমি যেনো অকুল পাথারে পড়লাম। ইনকোর্স, পড়া এসবের চিন্তায় আজহার সাহেবের ডায়েরীর কথা আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। মনে পড়লো ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ গোছানোর সময়। এতোদিনে ধুলো পড়ে ডায়েরীর মলাটের সাদা রঙটা কেমন ফিঁকে হয়ে গেছে। সবাই ঘুমানোর পর টেবিল ল্যাম্পের আলোতে পড়তে শুরু করলাম ডায়েরীটা। প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম লিখেছে মানুষটা। কি সুন্দর হাতের লেখা, এ মানুষটার সবকিছুই এতো ভালো কেনো? এই যে হাতের লেখাটা, তাও কি সুন্দর। পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“বরাবরই আমি মন্দভাগ্যের মানুষ। অন্তত বাবা, মা আর দাদু মারা যাবার পর এটাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু আমার সব ভাবনাকে মিথ্যে প্রমান করলেন আমিনুল স্যার। কেমন করে যেনো এই চালচুলোহীন আমার মাথার উপর বটবৃক্ষের মতো ছাউনি হয়ে গেলেন তিনি। ওনার বড় মেয়ে নাফিসা, মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আসলে স্যারের মুখে সবসময় মেয়েটার সুনাম শুনতে শুনতে আজকাল তাকে আমি হিংসে করতে শুরু করেছি। কাউকে না দেখে হিংসে করা কেমন না!”
মুচকি হাসলাম আমি, আমাকে হিংসে করার কি হলো? মাথা খারাপ নাকি… পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“আজ সকাল থেকে সব কেমন এলোমেলো লাগছে। ছোট চাচা চান আমি তার সঙ্গে ইউএসএ থিতু হই কিন্তু আজহার স্যারের মতো পিতৃতুল্য মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে যাই কি করে? চাচা বলেছেন, স্যার আমার ভালো চাইলে নিশ্চয়ই আমাকে চাচার সঙ্গে যেতে বলবেন। উনি বলেছেনও তাই কিন্তু…”
আমার মনে হলো, আমি বাবাকে যতোটা মান্য করি নি তার থেকে বেশি মান্য করেছেন এই লোকটা। এতোটা যে, তার কথায় দেশও ছাড়তে পারেন।
“যাবার আগে স্যারকে বললাম, আমাদের বাড়িতে থাকতে। দাদুর শেষ স্মৃতি, যারতার হাতে তো ফেলে যেতে পারি না। স্যার রাজি হলেন তবে সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলেন। উনি প্রতিমাসে ভাড়া দেবেন আমাকে। আমি মানা করলাম, উনি বললেন দেখা যাবে। কিন্তু আমি জানি ওনার সেই দেখা যাওয়ার মানে উনি ভাড়া দেবেনই। মানুষটার প্রবল আত্মসম্মানবোধ তার প্রতি আমার সম্মান প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।”
বাবা আর তার আত্মসম্মানবোধ, আমার থেকে ভালো কে জানে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার শক্ত সমর্থ্য বাবার এ সুপ্ত কোমল দিকটা আমি কোনোদিন দেখতেই পাই নি। একজন অভিভাবকহীন মানুষকে কতো সুন্দর পথ দেখাচ্ছিলেন তিনি!
“ইএসএ আসার পর থেকে মনটা কেমন করছিলো। অথচ আশেপাশে সব আমার আপন লোক। চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন। অথচ আমি অস্থির হয়ে পায়চারী করছি। আমার এ অস্থিরতার কারন টের পেলাম পরদিন আজহার স্যারের ফোন পেয়ে। এই ভিনদেশে আমার মন কেমন করছিলো বাংলাদেশে বসা আজহার স্যারের জন্য। ফোন পেয়ে আমি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছি। যে আমি দাদুর মৃত্যুর পর কোনোদিন কাঁদবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেই আমি কাঁদলাম। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো, ফোনের ওপাশে বসে স্যারও কাঁদছেন। মানুষটা আমায় এতো ভালোবাসে কেনো? স্যার ফোনে বলেছিলেন, “কাঁদলে হবে বেটা? মানুষ হতে হবে না? তোকে তো আমি পড়াশুনা করে অনেক বড় হবার জন্য ভিনদেশে পাঠিয়েছি। বুড়ো বয়সে তুইই তো হবি আমার অন্ধের যষ্টি।” আমার কি হলো কে জানে, আমি সেদিন থেকে প্রতিনিয়ত নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করতে লাগলাম। পড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করতাম, সে চাকরির টাকা দিয়ে নিজের পড়ার খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেগুলোর কথা শুনেই স্যার বললো, ঢাকায় দোকান কিনতে। হয়তো আমার দেশে ফেরাটা নিশ্চিত করতেই এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজি হয়ে গেলাম, স্যারকে টাকা পাঠানোর পর অনেক খুঁজে সবচেয়ে ভালো দোকানটা আমার জন্য কিনলেন।”
এ লোকটা কর্মঠ জানতাম, কিন্তু এতোটা! তার উপর বাবার প্রতি তার ভক্তি তো চুড়ান্ত পর্যায়ের। আমার হঠাৎ মনে হলো, আমি বাবার মেয়ে হয়েও বাবাকে ততোটা বুঝি নি যতোটা উনি বুঝেছিলেন। নিজের অজান্তেই ওনার প্রতি সুপ্ত শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো।
“স্যারের সঙ্গে প্রতিদিনই নিয়ম করে আমার কথা হতো। একদিন স্যারের কণ্ঠটা কেমন বিষন্ন শোনালো। আমার বরাবরের চেনা স্যার কেমন ভোজবাজির মতো নিমিষে মিয়িয়ে গেলো। আমি তখন স্যারের চিন্তায় অস্থির। অনেক জোরাজুরির পর সব সংকোচ ভুলে স্যার বললেন, “আজহার, তুমি হয়তো ভাববা স্যার তোমার সরলতার সুযোগ নিতেছি। আসলে বাবা, স্যারের বয়স হইতেছে তো তাই মনের মধ্যে নানা কু’ডাক দেয়। মনে কষ্ট নিও না তুমি। দেশে ফিরা আসো বাবা, আমার মেয়ে বলে বলতেছি না, নাফিসা আমার সোনার টুকরা মেয়ে। রূপে, গুণে কোনো কমতি নাই। রাগটা একটু বেশি তবে তুমি ঠিক মানাই নিবা আমি জানি। বাবা কি রাগ করলা?” স্যার সবসময় আমার ভালো চেয়েছেন। ভালো শিক্ষা, ভালো পরিবার, ভালো দোকান, ভালো চাকরি। তবে এতোটা ভালো চাইবেন ভাবতে পারি নি। স্যারকে বাবা ডাকার লোভে কিংবা একটা পরিবার পাবার লোভে আমি নাফিসাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। স্যার অবশ্য আমি রাজি হবার পর নাফিসার একটা ছবি ফ্যাক্স করেছিলেন। মেয়েটাকে দেখে তো আমার মাথা ঘুরার অবস্থা, এতো মিষ্টি হাসির মেয়ে হয়? সেদিন থেকে আমার দেশে ফেরার অপেক্ষা শুরু, আমার স্বপ্নবধূকে প্রথমবার দেখার অপেক্ষা…”
স্বপ্নবধূ, কেনো যেনো শব্দটাকে বেশ মিষ্টি মনে হলো। এক মিষ্টতাপূর্ণ অনুভূতি আমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেলো। অনেক তেতো খাবার পর একটুখানি মিষ্টি মুখে পড়লে যে অনুভূতি হয়, ঠিক তেমন।
“আমার স্বপ্নবধূকে দেখার স্বপ্ন বুকে করে আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম, কিন্তু আমার জন্য তখন এক অন্য পরিক্ষা অপেক্ষা করছে। একদিকে স্যারের শারিরীর অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে, অন্যদিকে আমার স্বপ্নবধূ রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। সে আমাকে বিয়ে করবে না… বড্ড অভিমান হলো, একজন মানুষকে না দেখে মুখের উপর মানা করে দিলো? তুমি এতো পাষাণ হৃদয়ের স্বপ্নবধূ? স্যার অবশ্য আশ্বস্ত করলেন আমাকে, যে করেই হোক নাফিসাকে উনি ফেরাবেন। ফেরালেনও… স্যারের তখন অবস্থা খুব খারাপ, উনি হাসপাতালে ভর্তি। আমি তখন দিনরাত এক করে স্যারের সেবাযত্ন করছি, হাসপাতালে রাত জাগছি। সেদিন সকালে টাকা নিতে বাড়ি এসেছি, শরীর ম্যাজম্যাজ করছিলো বলে গোসল সারলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি নাফিসা শুকনো মুখে সিএনজির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিচে নামলাম এবং সে মুহূর্তে নাফিসার প্রতি আমার অভিমানটা শত সহস্রগুণ বেড়ে গেলো। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম না, চুপচাপ সিএনজি ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে প্রস্থান করলাম। তার সহবোধের নমুনা দেখে অবাক না হয়ে পারি না, আমি না হয় চলে আসছিলাম কিন্তু সে আমাকে পিছু ডেকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না! স্যারের অবস্থা রাতে আরো খারাপের দিকে গেলো, বাসায় ফোন করে জানাতেই আয়না নানু চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন। আন্টি অবশ্য কিছু বলেন নি, শান্ত ছিলেন। তার এক ঘন্টা পর কল করে আন্টি আমায় দ্রুত বাসায় যেতে বললেন। বাসায় যাবার পর কাজী ডাকতে বললেন। আমি তখন হতবম্ব.. স্যারের এ অবস্থায় বিয়ে! তবুও আন্টির তাড়াতে সব হলো। শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে হলো আমার আর নাফিসার। একটা কবুল বলাতে নাফিসা আমার বউ হয়ে গেলো। আমার স্বপ্নবধূ, আজ থেকে আমার সত্যিকারের বউ। আন্টিকে আজ থেকে আমি মা ডাকার অধিকার পেলাম। বিশেষ করে স্যারকে বাবা ডাকার অধিকার পেয়ে আমার খুশির অন্ত ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম স্যার আর নাফিসার সম্পর্ক ঠিক করবো। করলামও, কিন্তু প্রথম রাতেই বউয়ের চড় খেয়ে।”
চলবে…