#শিশির বিন্দু শেষ পর্ব
#খাদিজা আরুশি আরু
ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো, মনে হলো চড় মারাটা আসলেই বেশি বেশি ছিলো। ঠিকই তো, সেদিন না গেলে বাবার সঙ্গে শেষবার কথা বলা হতো না।
“আমাদের বিয়ের পরদিন স্যার মারা গেলেন, মানুষটার মুখটায় কি অদ্ভুত দীপ্তি! বুঝতে পারছিলাম, সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তবেই তিনি চোখ বুজেছেন। তার পরদিন সকালে নাফিসা হোস্টেলে ফিরে গেল, স্যারের মৃত্যুতে তার এ প্রতিক্রিয়াহীনতা সত্যিই অবাককরা। স্যারের মৃত্যু শোক, নাফিসার অবহেলা সব মিলিয়ে পুরো পরিবারটা কেমন মরা গাছের মতো নেতিয়ে পড়লো। আমি শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরলাম। একদিন মা এসে আমাকে একটা একাউন্টের কার্ড দিলেন, বললেন, স্যার এতো বছরের বাড়িভাড়ার টাকা এ একাউন্টে জমা করেছেন আমার জন্য। আমি নিতে চাই নি কিন্তু মা যখন বললো, “ছেলের জন্য বাবা কিছু রেখে গেলে না করতে হয় না।” সত্যিই এ কথার পর আমি আর না করতে পারি নি। তবে টাকাটা আমি খরচ করেছি গ্রামে স্যারের নামে মসজীদ করতে গিয়ে। স্যার সম্ভবত নিজের সবটা সঞ্চয়ই আমাকে দিয়ে গেছেন নতুবা এতো টাকা তো বাড়া হবার কথা নয়…”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সত্যিই বাবা তার সবটা সঞ্চয় আজহার সাহেবকে দিয়ে গেছেন। সে সঞ্চয়ের বিনিময়ে দিয়ে গেছেন তার পরিবারের দায়ভার। বাবার সিদ্ধান্ত কতোটা সঠিক ছিলো তা আজ বুঝতে পারছি, বাবা সঠিক হাতেই তার পরিবারের খুঁটি দিয়ে গিয়েছিলেন।
“নাফিসা নেই, কিন্তু পুরো ঘরের পরতে পরতে তার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। সে স্মৃতি বুকে ধারন করেই আমি আমার স্বপ্নবধূর মানভঞ্জনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আশায় থাকলাম সে আসবে, আমার সঙ্গে সব বোঝাপড়া শেষ করে সংসার জীবনের শুভ সূচনা করবে। সে এলো কিন্তু আমাদের সংসার জীবনের শুভ সূচনা হলো না। যেমন নির্বিকারভাবে এলো তেমন নির্বিকারভাবেই দিন কাটতে লাগলো। কাল আমার স্বপ্নবধূ চলে যাবে। সে যদি এমন নির্বিকারভাবে ফিরে যায়, আমার ধৈর্য্যে যদি না কুলোয়, যদি আমার দিশেহারা লাগে তখন কি হবে? আমার ছটফটানি, আমার মন কেমন করা, কিছুই কেনো তার মনে দাগ কাটে না? আমার দিকে কেনো তাকায় না সে, করুণা করেই হোক, একটু তাকাতো। এ পরিবারের সবাই আমায় কতো ভালোবাসে, সে কেনো একটু ভালোবাসতে পারে না? কেনো?”
ডায়েরীরতে আর কিছু লেখা নেই, কারন সেদিন রাতে উনি ঘুমোনোর পরই আমি ডায়েরীটা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম। নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হতে লাগলো। কতোটা অন্যায় করেছি আমি, নিজের সঙ্গে, ওনার সঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে। ডায়েরীর মাঝের দিকে ভেতর থেকে একটা ছবির কোনা বেরিয়ে আছে। ছবিটা হাতে নিলাম। ডায়েরী উল্টে দেখি সেখানে লাল কালিতে কিছু লেখা। পড়তে শুরু করলাম,
“নাফিসা, আমার স্বপ্নবধূ। মেয়েটার অনেক সুনাম শুনেছি, আজ নিজ চোখে দেখলাম তাও ছবিতে। কি মিষ্টি হাসি। আমি ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছি, নাফিসাকে আমি কোনো কাজ করতে দেবো না। বিদেশে থেকে রান্নাবান্না আমি তার তুলনায় ভালো পারি বলেই আশা করি। তাকে নিয়ে আমি বিশ্ব ঘুরবো তবে প্রথমে বাংলাদেশ ঘুরবো। জন্মভূমিকে না দেখে ভিনদেশ দেখার মানে হয় না। নাফিসার যখন যা লাগবে মেয়েটা আমার কাছে আবদার করতে পারবে। বিয়ের পর মেয়েটাকে একটা পরামর্শ দিতে হবে। এমন চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষকে পাগল করার মানে কি? একটু পর্দা করলেও তো পারে। তার সৌন্দর্য্য তো কেবল আমার জন্য হবে। আমার স্বপ্নবধূকে আমি মনভরে দেখবো, সারাদিন দেখবো। উঠতে বসতে বউ বলে ডাকবো। স্বপ্নবধূ কবে তুমি আমার সত্যিকারের বউ হবে?”
ডায়েরীটা বন্ধ করে ব্যাগে রাখলাম, ফজরের আজানের পরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাড়ি ফিরে দেখি এক হইহই রইরই ব্যপার। বাবা প্রতি বছর রোজাতে একদিন এলাকাল সবাইকে বাড়িতে ডেকে ইফতার করাতেন। বাবার মৃত্যুর পর এমন দায়িত্ব কাঁধে নেবার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটাই এবাড়ির কারো মাঝে নেই। সুতরাং আমার ধারনা ছিলো এ পরম্পরার ইতি ঘটবে বাবার মৃত্যুর পরই। আজাহারকে দেখা গেলো আয়োজনের বিশেষ ভূমিকাতে। আমাকে দেখে নাঈমা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো, আজহার কাজের ফাঁকে একবার সম্ভবত চোখ তুলে তাকালেন, তারপর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মা, আয়না নানু তারাও নানা রকম কাজে ব্যস্ত। আমাকে দেখে হেসে জড়িয়ে ধরলেন। মা বললেন,
-“দ্রুত গোসল সেরে কাজে লেগে পড়তো নাফু, দুপুরের পর থেকেই তো লোকজন আসা শুরু হবে। ছেলেটার কান্ড দেখেছিস? তোর বাবা যাদের যাদের ডাকতো খুঁজে খুঁজে সবাইকে বের করে ডেকেছে। আমি ভেবে পাই না, তোর বাবার নাড়ি নক্ষত্র এ ছেলে এমন মুখস্ত করলো কি করে! অদ্ভুত কান্ড।”
ইফতারের পর সবাই সবার মতো বাড়ি ফিরে গেলো। ক্লান্ত আফজাল সাহেব গোসল করে বের হয়ে ঘরে আমাকে দেখে যেন থমকালেন। অবাকস্বরে প্রশ্ন করলেন,
-“তুমি সত্যিই এসেছ নাফিসা?”
আমি মুচকি হেসে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-“বিশ্বাস না হলে ছুঁয়ে দেখুন।”
উনি অবশ্য ছুঁলেন না, তবে হাবভাব দেখে মনে হলো আমার উপস্থিতি বিশ্বাস করেছেন। বিছানায় একহাত দুরত্বে আমার পাশে বসলেন তিনি, ক্ষীণস্বরে বললেন,
-“তখন তোমাকে দেখে ভাবলাম ভুল দেখছি। হয়তো আমার ভ্রম তুমি। এখন দেখছি সত্যিই এসেছ। তা কতোদিন থাকবে? ঈদের পরেই ফিরে যাবে?”
আমি মুচকি হেসে ওনার গা ঘেষে বসলাম, বললাম,
-“ভাবছি এবার আর যাবো না। একেবারে পরিক্ষার সময় গিয়ে পরিক্ষা দিবো।”
আমার দিকে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আফজাল সাহেব। হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার কথা। তাই আমি আবার বললাম,
-“আমি চলে গেলে তো কেউ একজন তার স্বপ্নবধূর শোকে ডায়েরীর পাতায় পাতায় অভিমান ঝরায়।”
আফজাল সাহেব সম্ভবত এতোক্ষণে তার ডায়েরীর সঠিক হদিস পেলেন, তিনি মাথা নিচু করে এক হাতে আরেক হাতের নখ খুটতে লাগলেন। আমি ওনার পাশে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলাম। বেশ ভূমিকা নিয়ে বললাম,
-“শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে করেই এতো জল্পনা কল্পনা করে ফেললেন? আইনি কাগজপত্র সামলাবে কে? বলি বিয়ের রেজিস্টার ছাড়া আজকাল বিয়ে সম্পন্ন হয়?”
উনি মিনমিন করে বললেন,
-“দ্রুতই করে ফেলবো।”।
একটু ইতস্তত করলেন সম্ভবত। তারপর বললেন,
-“আমার ডায়েরীটা আমাকে ফেরত দেবে?”
-“দেবো, তবে এক শর্তে।”
-“কি শর্ত?”
-“ডায়েরী লুকোনো যাবে না। নির্দিষ্ট জায়গায় থাকবে। আমার যখন মন চাইবে আমি পড়বো।”
-“তুমি তো পড়েছো।”
-“আবার পড়বো, বারবার পড়বো।”
উনি চুপ হয়ে গেলেন, মেঝেতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। আমি সটান তার কোলে শুয়ে পড়লাম। উনি এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলেন, হয়তো আমার দিকে তাকানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলেন না। আমি চোখ বুজে গম্ভীরস্বরে বললাম,
-“আমাকে গল্প শোনাবেন?”
-“কিসের গল্প?”
-“আমার বাবার গল্প। আমার বাবার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় আপনি। আপনার সামনে বাবা যেভাবে উন্মুক্ত পুস্তকের মতো উপস্থাপন করেছেন আমাদের বেলায় তার ঠিক উল্টো। তাই বাবার সেই বিশেষ দিকটি আমি জানতে চাই, আমার বাবাকে আমি নতুন করে চিনতে চাই।”
উনি সারারাত বসে বসে আমাকে বাবার গল্প শোনালেন, বাবার মৃত্যুর প্রায় সাতমাস পরে আমি প্রথমবার বাবার জন্য কাঁদলাম। মন খুলে কাঁদলাম, উনি পুরোটা সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। ফজরের আজানের পর নামাজ পড়া হলে বললেন,
-“নাফিসা, স্যারের একটা প্রিয় জায়গায় যাবে?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম, তারপর ওনার হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে চললাম। বাবা যে কলেজে চাকরি করতেন তার পাশেই একটা কচুক্ষেত। কচুপাতায় ভোরের শিশির পড়ে আছে। কি মনোরম সে দৃশ্য। আজহার আমার একহাত শিশিরে ছুঁয়ে দিতেই আমি শিউরে উঠলাম। সামান্য শিশির বিন্দুতে কি অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি! আজহার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিশির দেখলো আর আমি আজহারকে। মানুষটাও তো এই শিশির বিন্দুর মতো, কেমন অদ্ভুতভাবে সবার মন ছুঁয়ে যায়। প্রথমবার দেখা হবার পর কে ভেবেছিলো সেই এক ঝলক দেখা আগন্তুক আমার জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে যাবেন! তবে শিশির বাষ্প হয়ে যাবার পরও যেমন কচু পাতায় শুকনো দাগ রয়ে যায় তেমন আজহার নামক মানুষটার ভালোবাসার দাগ আমার মনে থেকে যাবে আজীবন। আজহারের স্বপ্নবধূ তার বাহুডোরে আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে রইবে…
“শেষ”