#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ২২
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম
৫৬.
তড়িঘড়ি করে রুমটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় উপমা। বাইরে থেকে বারবার অফিসার আমান ডেকে চলেছে। কিন্তু হাতে যে সময় একদমই নেই। বড়জোর আর পাঁচ সাত মিনিট রয়েছে। এরই মাঝে পূর্ণাকে নিরাপদে এখান থেকে বের করতে হবে তার। ভেবেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে উপমা। চারপাশে মাকড়সার জাল বাজেভাবে বিশালাকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার উপর ধুলোর গন্ধ তো আছেই। অনেক বছর বন্ধ থাকায় ভেতরে যেতেই একটা উটকো গন্ধ এসে নাকে বিঁধলো উপমার। এই জায়গায় পূর্ণাকে খুঁজে পাবেই বা কি করে। একে একে পুরো আলমারি, পুরনো দিনের মটকা, খুঁজে পেলেও পূর্ণাকে আর খুঁজে পেল না উপমা। এবার সত্যিই কান্না পাচ্ছে তার। বেশি দেরি হলে যে অয়ন্তিকার মতো পূর্ণাকেও হারিয়ে ফেলবে সে। এরই মাঝে হঠাৎ করে কোনো বস্তুর নড়াচড়ার শব্দ কর্ণগোচর হতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে সে। আওয়াজটা তো একদম কর্ণার থেকে আসছে। ভয় না পেয়েই আওয়াজ অনুসরণ করে সেদিকেই পা বাড়ায় উপমা। একটা বস্তার ভেতর কিছু একটা নড়ছে। পূর্ণার কথা মনে পড়তেই ভয় পেয়ে যায় সে। বিলম্ব না করে দ্রুত বস্তার গিট খুলতেই ভেতর থেকে পূর্ণার দেহ বেরিয়ে আসে। মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। তার উপর হাত পা, মুখ বেঁধে রেখেছে। সাথে সাথে সেগুলো খুলে ফেলতেই আতঙ্কে ভরপুর হয়ে থাকা পূর্ণা উপমাকে জড়িয়ে ধরে। পুরো শরীর ভয়ে কাঁপছে তার। নিঃশ্বাস নিতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
– “পূর্ণা তুই ঠিক আছিস?”
উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উপমা। পূর্ণাও খুব কষ্টে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। উপমাও পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় ইফতেখার সাহেবের বলা সেই ভয়ঙ্কর কথা। এ বাড়িতে বোমা আছে! আর তা যেকোনো সময় ফেটে যেতে পারে ইফতেখার সাহেবের ইশারায়। পূর্ণাকে সুরক্ষিত ভাবে বের অফিসার আমানের কাছে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে নাহলে ইফতেখার সাহেব যেকোনো সময় তার ক্ষতি করে দিতে পারে।
– “পূর্ণা চল তাড়াতাড়ি, এইখানে বোমা আছে যা যেকোনো সময় ফাইটা যাইতে পারে।”
উপমার কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় পূর্ণা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে উপমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। তাৎক্ষণিক রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে পৌঁছাতেই পা দুটো থমকে দাঁড়ায় উপমার। পাশের রুমটা তো তারই। আর এখানেই তো রয়েছে তার প্রয়োজনীয় সবচেয়ে প্রিয় সামগ্রী যা তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু একটা ভেবেই সে পূর্ণার হাত ছেড়ে দেয় সে মুহুর্তেই।
– “পূর্ণা তুই বাইরে যা! বাইরে গিয়ে সোজা অফিসার আমানের কাছেই যাবি আর কোনোদিকে তাকাবি না; পেছনে তো ভুল কইরাও না।”
উপমার কথা ভাবার্থ হলো না পূর্ণার। সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কি বলছে উপমা? সে চলে গেলে উপমার কি হবে?
– “না বুবু আমি তোরে ছাড়া যামু না। তুই ও আমার সাথে চল।”
একপ্রকার জেদ ধরে বসে পূর্ণা।
– “বলছিনা তোরে এখান থেকে যেতে। আমি ঠিকই পেছনের দরজা দিয়া বাইর হইয়া যামু তুই চিন্তা করিস না। হাতে সময় নাই পূর্ণা। তাড়াতাড়ি বের হ এইখান থেইকা। আর কোনো কথা বলবি না তোরে আমার কসম যা এইখান থেইকা।”
উপমার দৃঢ় কথার সামনে দমে যায় পূর্ণা। কিছু বলতে পারে না সে। শুধু একপলক উপমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতঃপর উপমার কথা অনুযায়ী বারান্দায় দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এই সুযোগে উপমাও নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মায়ের, নিজের ডায়েরীর সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষটির দেয়া আমানত তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। জিনিসটা যে শুধু তার নয়; লকেটটির সঙ্গে আবেগের মায়ের স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে। দ্রুত গতিতে সেই ভাবনা নিয়েই এগিয়ে যায় উপমা।
৫৭.
অফিসার আমান সেই কখন থেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এই আশায় উপমা আর পূর্ণা কখন আসবে। ইফতেখার সাহেবের উপর ও আলী সাহেবকে দিয়ে কড়া নজরে রাখা হয়েছে। তিনি যে সবার আড়ালেও এত বড় মারাত্মক পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলবেন তা জানা ছিল না অফিসার আমানের। তবুও বেশ কয়েকবার চালাকির সঙ্গে ইফতেখার সাহেবের হাত থেকে রিমোট টা বিচ্যুত করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি। এত এত প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও তিনি যেন কিছুই করতে পারছেন না। কেননা দু দুটো নিষ্পাপ প্রাণ ইফতেখার সাহেবের হাতের মুঠোয় বন্দী আপাতত। অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই যে করার নেই।
অফিসার আমানের সুক্ষ্ম ভাবনার মাঝেই পদার্পণ করে পূর্ণা। অনেকটা হাঁপিয়ে সদর দরজায় আসতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ান আমেনা বেগম সহ সজল। দুজনের চোখেমুখে আতংকের ছাপ। একটু আগেই পানি নিয়ে আসার বাহানা করেই পূর্ণাকে বস্তাবন্দি করে সেই রুমটায় ফেলে রেখে এসেছিলেন আমেনা বেগম। কারণ একটাই ইফতেখার সাহেবের করা পরিকল্পনার বেশ খানিকটা অংশ পূর্ণা আড়ালে শুনে ফেলেছিল। কিন্তু উপমা যে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পূর্ণাকে খুঁজে বের করবে তা কে জানত? ইফতেখার সাহেব ও একই আশংকায় ভুগছেন। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
পূর্ণার দিকে চোখ যেতেই সজাগ হয়ে উঠেন অফিসার আমান। তার মানে উপমা সঠিক সময়েই পূর্ণাকে খুঁজে পেয়েছে। দারোগা আলীকে চোখের ইশারা দিতেই আলী সাহেব ইফতেখার সাহেবের উপর নজরদারি করতে শুরু করেন যাতে তিনি উল্টাপাল্টা কিছু করতে না পারে। অন্যদিকে অফিসার আমান ও এগিয়ে গিয়ে দ্রুত পূর্ণাকে সামলে নেন। মেয়েটা বড্ড বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। পূর্ণাকে চোখে পড়লেও উপমাকে আশপাশে চোখে পড়ে না তার। গুনে গুনে আর মাত্র ১:০৩ মিনিট রয়েছে। এই অসময়ে আবার উপমা কোথায় গেল?
– “উপমা কোথায় পূর্ণা?”
প্রশ্ন করে বসেন অফিসার আমান।
– “ভেতরে। বুবু ভেতরেই আছে। সে নাকি পেছনের দরজা দিয়া বাইর হইব।”
আস্তে করে বললেও পূর্ণার কথাটা সে মুহূর্তে ইফতেখার সাহেবের কানে গিয়ে পৌঁছায়। অফিসার আমান এবার একটু ভীত হন। উপমা সঠিক সময়ে বের হতে পারবে তো?
উপমাকে খুঁজে বের করার জন্য ভেতরে পা বাড়াতেই পেছন হতে ইফতেখার সাহেবের কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আহা অফিসার সাহেব ভুল কইরাও পা রাইখেন না ভেতরে। এতে কইরা লোকসান আপনেরই। এ কূলও হারাইবেন ও কূলও হারাইবেন।”
ড্রায়ারের ভেতর হাতড়ে হাতড়ে ডায়েরী সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে আঁচলে লুকিয়ে নেয় উপমা। যাক মনে তাও একটা প্রশান্তি পেল সে। দ্রুত এখন কক্ষ ত্যাগ করে যেতে হবে। আর ভুল করে সামনের দরজা দিয়ে বের হওয়াই যাবে না। রুম থেকে বেরিয়ে সিড়িঘরের পাশ দিয়ে পেছনের দিকে চলে যায় সে। উদ্দেশ্য পেছনের দরজা দিয়ে সাবধানে বাইরে বের হয়ে যাওয়া। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি। দরজা বেশ কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি করার পরও খোলা যাচ্ছে না। বোধহয় কেউ বাইরে দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। ভয়ে ঘাম ঝরছে তার। তবে কি রূপকথার গল্পের মৃত্যুপুরীর মতো উপমার জীবন গতিও এই মৃত্যুপুরীতে আটকে গেল?
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আর ভেতরে প্রবেশ করে না অফিসার আমান। তবে উপমাকে সতর্ক করার জন্য গলা বাড়িয়ে বলে উঠেন,
– “উপমা তাড়াতাড়ি বের হও ভেতর থেকে। হাতে সময় নেই একদমই আর ২৫ সেকেন্ড বাকি।”
আর অফিসার আমানের বলা এ কথাই যেন সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়ায় উপমার জীবন স্রোতে।
– “লাভ নাই অফিসার সাহেব। আমার ক্ষমতার খেলায় শেষ গুটি হিসেবে তো উপমার প্রাণটাই যাইব!”
বলেই বিদঘুটে হাসি দেন ইফতেখার সাহেব। হিংস্রতার সঙ্গে হাতে থাকা রিমোটের বাটনে চাপ দিতে গেলেই ভয় পেয়ে যান অফিসার আমান।
– “ওহ্ নো শিট!”
দ্রুত পূর্ণাকে নিয়ে দৌড়ে খানিকটা দূরে দাড়াতেই বিকট শব্দের সূত্রপাত হতেই থমকে দাঁড়ান তিনি। আশপাশে আগুনের জ্বলন্ত শিখা আর ধুলোর গন্ধে পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মুহূর্তেই।
৫৮.
জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইশিতা বেগম। সেই কখন থেকেই অপেক্ষায় আছেন যে আবেগ এসে তার সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু না সন্ধ্যে হয়ে এল তবুও আবেগের কোনো হদিস নেই। ছেলেটাকে কতদিন ধরে ভালো করে আদর করে খাইয়ে দেননি তিনি। এসবের মাঝেই হঠাৎ করে বাসার কলিং বেল বেজে উঠতেই তিনি পেছন ফিরে তাকান। বাসার কাজের মেয়ে লিজা আওয়াজ শুনে দ্রুত দরজা খুলে দেয়। ইশিতা বেগম ও উঠে গিয়ে দরজার কাছে যান কে এসেছে তা দেখতে। দরজার অপর পাশে আবেগকে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে ইশিতা বেগমের চোখজোড়া চিকচিক করে উঠে। মাকে দেখে আবেগও মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
– “আমি ফিরে এসেছি মা।”
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১:০০ টা বাজে। একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে এসেছে আবেগ। শরীরটা একটু বেশিই ক্লান্ত। খাবার টেবিলে অবশ্য মিস্টার আহিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ও বটে কিন্তু কথা হয়নি। রুমে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরের আবহাওয়া উপভোগ করতে ও উপমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করতে ব্যস্ত ছিল তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ডক্টর ঈশানের পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “Hey, doctor Abeg! How was the journey?”
– “It was a great journey doctor Ishaan.”
এভাবেই কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় কেটে যায় আবেগের সময়। ডক্টর ঈশান ও জানিয়ে দেয় ঠিক কবে থেকে আবেগ হসপিটালে জয়েন করতে পারবে।
কথা বলা শেষে আবেগ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় ঠিক কটা বাজে। পরে এগিয়ে গিয়ে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে উপমার দেয়া সেই রুমালটা বের করে নেয় সে। মেয়েটা যে এই অল্প সময়ের মাঝেই তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যাবে তা ভেবেই মাঝেমধ্যে অবাক হয় আবেগ। রুমালটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেই বলে উঠে,
– “ভালোবাসি মায়াবনের মায়াবতী!”……………….
#চলবে