#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ১
#জারিন তামান্না
‘আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর ভালোবাসবো?’
প্রশ্নটা শুনে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পলক। হতভম্ব চোখে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সাথের মানুষটাকে। সে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। বলতে গেলে,,পলক পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। কিন্তু সামনের মানুষটা নির্বিকার। ভাব এমন যেন খুব স্বাভাবিক আর কমন প্রশ্ন করেছে সে। কিন্তু পলকের অবস্থা এমন যে সারা বছর পড়াশোনা না করার ফলে সবচেয়ে কমন প্রশ্নটাই তার কাছে একদম ভিনগ্রহী প্রাণীর মতই উদ্ভট আর অজানা লাগছে।
এদিকে নিবিড় নয়নে ফুরিয়ে আসা দুপুরের শুভ্র আকাশ দেখছিল সিফাত। এই আকাশের সাথেই তার যত প্রেম,যত টান। ছোট থেকেই আকাশের প্রতি তার এই টানটাই তাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে গেছিল পাইলট হওয়ার ইচ্ছার দিকে। আর এখন সে জীবনের প্রায় সময় আকাশের বুকে,,মেঘের কোল ঘেঁষে উড়ে বেড়ায়।অবসরে একান্ত সময়ে আকাশ দেখে। এটা তার এক রকম শখ বলা চলে। কিংবা নিগূঢ় প্রেম থেকে অসীম ভালোবাসা।
বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে সিফাত আর তার পরিবার। আকাশের প্রতি টানটা তাকে টানতে টানতে পাইলট বানিয়ে দিলেও প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠার সুযোগটা আর দেয়নি। অথবা সে নিজেই সেই সুযোগটা নেয়নি।আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েই কেটেছে কৈশোর থেকে যৌবনের একচোট। একজন পাইলট হিসেবে মানসিক দক্ষতার সাথে সাথে শারীরিকভাবেও একজন সুদর্শন ছেলে সে। স্টুডেন্ট লাইফে তো অনেক মেয়েরই পছন্দের শীর্ষ তালিকায় ছিলই আর চাকরিতে আসার পরে মেয়ে কলিগদেরও মন কেড়েছে। কিন্তু তার সে সবের খেয়াল কই! সে নিজের মতই থাকতে ভালোবাসে। কাজ, পরিবার,,অবসরে বন্ধুমহল আর এই সীমাহীন বিস্তৃত আকাশের প্রতি টানটাই তার সব। এর বাইরের দুনিয়ার রং তামাশা সব চুলোয় যাক। তাতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু বয়স তো আর থেমে নেই। এবার বছর ৩২ পেরুলো। জীবনটাও এবার অন্যভাবে থিতু হতে চাইছে যেন। অনেক তো হলো একলা ছোটা।এবার সঙ্গে একান্ত নিজের বলে কেউ একজন থাকলে মন্দ হয় না। তবে তার এই থিতু হওয়ার চিন্তাভাবনার পেছনে সিংহভাগ ক্রেডিট তার পরিবারের। তারা এবার সংসারে নতুন প্রজন্ম চায়।তাই এবার তার বিয়ে করাটা অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার কাছে।
কিন্তু সমস্যা হলো সিফাতের ধ্যান ধারণা আর যুক্তি। তার মতে, খুঁজে পেতে প্রেমে পড়ার বয়স, সময় কিংবা ধৈর্য্য তার নেই এখন আর। তাই পরিবার থেকেই শুরু হলো মেয়ে দেখার যত তোড়জোড়। সিফাতের তেমন সময় হয় না।তাই বেশিরভাগ সময় মেয়েদের ছবি আর বায়োডেটা দেখেই রিজেক্ট করে দেয় সে। কখনো কাউকে সিলেক্ট করা হলে ছুটির দিনে গিয়ে দেখা করে আসে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আলাপ চারিতার পরে সেসব সিলেক্ট করা মেয়েকেও সে পছন্দ করে উঠতে পারেনি। কারও ব্যক্তিত্ব তার মনে দাগ কাটে না। তার মতে, প্রতিটা মানুষের চেহারায় তার ব্যক্তিত্বের একটা ছাপ থাকে। সুন্দর মুখের চাইতে মানুষের কথায়, তার ভেতরের মন মানসিকতাটা চেহারার এক্সপ্রেশনে প্রকাশ পায় বেশি।তাই বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হওয়ার চাইতে মন থেকে সুন্দর হওয়া অতি আবশ্যক। কারণ,যে মানুষটা রাত দিন আকাশের বুকে ছুটে চলে,আকাশের বিশালতায় বুদ হয়ে থাকতে ভালোবাসে..তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার মনও হওয়া চাই আকাশের মতই বিস্তৃত। কিন্তু আজ অবদি এমন কোন মেয়েকে সে পাইনি। আর যতদিন না পাবে,, পরিবারের ধৈর্য্য থাকলে মেয়ে খুঁজুক আর নইলে ছেড়ে দিক। বিয়ে করাটা জরুরি না এতটাও। সে একলা হয়েও বেশ তো আছে।বাকি সময়টাও না হয় চলে যাবে এমনি করেই।
পলকের ব্যাপারটায় একটু নয় বরং বেশ আপত্তি ছিল সিফাতের পরিবারের সবার। মেয়ে শিক্ষিতা, ভদ্র হলেও ওমন একটা মেয়ে কি তাদের একমাত্র ছেলের সাথে মানায়! কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। আর সেই ভাগ্যের জোড়েই বোধয় পলকের ছবিটা সিফাতের চোখে পড়ে যায় কোন একভাবে। হাসি বিহীন একদম শান্ত চাহনির একটা মুখ। প্রথম দেখায় মনে হবে বেশ গোমড়া মুখ করে ছবিটা তোলা। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে আসল ব্যাপারটা। মুখটা গোমড়া নয় বরং ভেতরটা শূন্যতায় ভরপুর। কিচ্ছু নেই এমন। স্বচ্ছ আর ফাঁকা। ব্যস,এটুকুতেই কি যে কি খুঁজে পেল সে। একপ্রকার জেদ ধরেই বসলো,,এই মেয়েকে তারা দেখতে যাবে আর খুব সম্ভবত এই মেয়েকেই তারা তাদের বাড়ির বউ হিসেবে পাবে।
শুরুতে খুব জোড় আপত্তি করলেও বাড়ির একমাত্র ছেলের জেদের কাছে সেই সব আপত্তি ঝেটে বিদেয় করতে বাধ্য হলো তার পরিবার। আর সেই সূত্র ধরেই আজ পলকের বাড়িতে আসা। সিফাত মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলার ইচ্ছেপোষণ করে। যার ফলশ্রুতিতে এই মূহুর্তে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির ছাদের রেলিং ঘেঁষে।
_______________________________
পলকের তার দিকে এভাবে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকাটা পাশে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছিল সিফাত। তাই পলকের এহেন হতভম্বিতা বুঝতে পেরেই মৃদু হাসলো সে। পাশ ফিরে তাকালো পলকের মুখপানে। কি টলটলে মুখশ্রী তার। ঠিক যেন পদ্মপাতার জলের মত। উজ্জ্বল শ্যামবরণ গায়ের রংটাকে অনেকটা ভিজে মাটির মতই স্নিগ্ধ লাগে সিফাতের কাছে। হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েটার নাম মৃণ্ময়ী হলে ভালো হতো। মানাতো বেশ। এরপর কি একটা ভেবে আপন মনেই মৃদু হাসলো। আর এদিকের সিফাতের এমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যেন হুশ ফেরালো পলকের। বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল তাকে। চঞ্চল হলো তার দৃষ্টি। দ্রুত চোখ নামিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগলো তার দৃষ্টি। পলকের এমন অবস্থা দেখে বেশ হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে নিল সিফাত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিল, বললেন না তো! আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ে..
তার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে পলক পাল্টা বলে বসলো,,এ আবার কেমন কথা! এরেঞ্জম্যারেজে কি কেউ ভালোবেসে বিয়ে করে নাকি…বিয়েটা তো সম্পূর্ণই পারিবারিকভাবেই হয়। আর তখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে ভালোবাসবে এটাই তো নিয়ম।
এই বলেই চুপ হয়ে গেল পলক। ভেতর ভেতর অপেক্ষা করতে লাগলো সিফাতের কিছু বলার।
নিয়ম! পলকের শেষের কথাটায় এই শব্দটার ব্যবহারটা কেমন বেমানান শোনালো সিফাতের কাছে। মনে মনে শব্দটা আওড়ালো একবার,নিয়ম! তারপর একদম ঝরঝরে গলায় বললো, হ্যাঁ,সেটা ঠিক। এরেঞ্জম্যারেজে প্রেম করে বিয়ে হয় না। তবে আমি যতদূর জানি আপনি পিওর সিঙ্গেল। কখনো কোন রিলেশনশিপে বা কমিটমেন্টও জড়াননি।কেন জড়াননি সেটা জানতে চাইবো না। আর যেহেতু এসব কোন পাস্ট প্রেজেন্ট পিছুটান আপনার নেই,তাই জানতে চাইছিলাম যে আপনি কি চান…আমি আপনার বিবাহিত প্রেমিক হই নাকি নিজের প্রেমিক আপনার বিবাহিত স্বামী হোক?
বিস্ময়ে এখন পলকের মাথা চক্কর দিচ্ছে। এতক্ষণে একটা বিষয় খুব ধীরে কিন্তু বেশ তীক্ষ্ণভাবে তার মাথায় ক্যাচ করেছে যে তার সামনে এই মূহুর্তে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে,কথা বলছে সেই মানুষটা নিজেকে তার স্বামী বলছে।এর মানে তো এই দাঁড়ায় যে, মানুষটা তাকে বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে। এও কি সম্ভব?!চেনা নেই, জানা নেই কেবলমাত্র দেখতে এসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। প্রেম করে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর প্রেম করবে এমন সব উদ্ভট কথা জিজ্ঞেস করছে। সেটাও তার মত একটা মেয়েকে! কি দেখে পছন্দ করলো তাকে?নাকি অন্য কোন মতলব আছে এই লোকের। এমন সুদর্শন, সুযোগ্য ছেলের জন্য তো মেয়েদের হুমরি খেয়ে পড়ার কথা। কথা কি..হয় তো রোজ রোজ, দিবা রাত্রি এসে পড়ে থাকে। আর সেই লোক কিনা তার মত অগোছালো,,,মেটে গায়ের রংএর মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাইছে?? আবার কি ভাবে বলছে দেখো..প্রেম করার কথা। আর অতীত নেই মানে!!!! এই লোক কি জানেটা কি তার ব্যাপারে যে এত কনফিডেন্টলি বলে দিল সে একদম পিওর সিঙ্গেল। না.. না এখানে নিশ্চয় কোন ঘাপলা আছে। বাবা আবার এদের টাকা টুকা অফার করে নাই তো? নাহ,,এদের তো এম্নিতেই অনেক টাকা। অনেক বড়ঘরের মানুষ এরা। মা বলেছিল কাল। তাহলে?!
সিফাতের দিকে চেয়ে পলক এসব আকাশ পাতাল ভাবনায় মশগুল।তা দেখে বেশ বিচলিত হলো সিফাত। ভ্রুকুটি কুচকে জিজ্ঞেস করলো,,এই যে কি এত ভাবছেন মৃন্ময়ী? সিফাতের প্রশ্নে নিজের আকাশ পাতাল ভাবনা ফুরে সোজা নিজ জগতে ফিরলো পলক। কিন্তু মৃন্ময়ী বলে ডাকায় আশে পাশে তাকিয়ে খুঁজলো কাউকে। তার এই খোঁজা খুঁজির দৃষ্টি দেখে সিফাতও এদিক ওদিক তাকালো। বিশেষ কিছু খুঁজে না পেয়ে সরাসরি পলকেই বললো,,কি খুঁজছেন এভাবে?
হ্যাঁ..হ্যাঁ.! সিফাতের প্রশ্নে এবার সত্যিই বিচলিত হলো সে। আরও একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,,ওই যে মৃন্ময়ী বলে কাউকে ডাকলেন না। তাই কে এলো এখানে সেটাই দেখতে চাইছিলাম।
এতক্ষণ বেশ গম্ভীর দৃষ্টিতে মনোযোগসহকারে পলকের কথা শুনছিল সিফাত। কিন্তু তার এহেন বোকা বোকা টাইপ চিন্তা আর কান্ড দেখে একগাল হেসে দিল সে পলকের দিকে তাকিয়ে। আর পলক! সে তো মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো সেই প্রাণবন্ত হাসিখানা। যেন শেষ দুপুরের রোদ চলে যাবার আগে একঝলক প্রশান্তির উষ্ণতা রেখে গেল কোথাও।
চলবে..