#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ১১
©জারিন তামান্না
লজ্জা পাচ্ছে।ভীষণ লজ্জা লাগছে পলকের। খানিক জড়তাও কাজ করছে ভেতর ভেতর।যার কারণে, বিগত তিন মিনিট ধরে ফোন কানে ঠেকিয়ে রেখেছে অথচ একটা টু শব্দও মুখ দিয়ে বের করতে পারেনি সে।
আজ রুকুর কথায় পলকের কাছে মূহুর্তেই ঝকঝকে আয়নার মত পরিষ্কার হয়ে গেছিল ইয়ানা আর সিফাতের সম্পর্কটা।তারপর থেকেই অনুশোচনা হচ্ছে। লজ্জা করছে তার আর কিছুটা রাগও লাগছে তার। লজ্জা লাগছে কারণ সেদিন সে পুরো কথাটা না শুনেই নিজের মত করে উল্টাপাল্টা ভেবে নিয়েছিল। নিজের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অহেতুক একটা ভুল ধারণা তৈরী করে নিয়েছিল নিজের মনেই।আবার সেটার জন্য সিফাতকেও যাচ্ছে তাই বলেছে। আবার যা বলেছিল তো বলেছিলই পরের দিন সিফাতের বেশ কয়েকবার কল আর ম্যাসেজ করার পরেও সে রেসপন্স তো করেইনি বরং তার নাম্বারটাও ব্লক করে দিয়েছিল। হয় তো সিফাত তাকে সত্যিটা বুঝিয়ে বলতেই কল করেছিল। ম্যাসেজ করে কল রিসিভ করতে বলেছিল।কিন্তু সেই সুযোগটাও পলক দেয়নি তাকে। এর জন্য ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে তার। আর রাগও লাগছে। ভীষণ রাগ লাগছে তার। নিজের এহেন বোকামির জন্য কি বিচ্ছিরি কান্ডটাই না বাঁধিয়েছিল আজ। বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসেছিল।ভাগ্যিস মানুষটা এত কিছুর পরেও তাকে এরজন্য বকাঝকা করেনি।কিন্তু,সে যখন রুমে এসেইছিল,তাহলে কেন তখন সবটা বললো না!সে বিয়ে করবে না তো বলেইছিল আবার তাকে মুখের উপর প্রতারকও বলে দিয়েছিল। তবুও,মানুষটা তাকে কিচ্ছুটি বলেনি।কিন্তু এত কিছুর পরেও বিকেলে রুকুর বলার ঐ কথাগুলো যতবারই মনে পড়ছে,ততোবারই একরাশ মুগ্ধতা এসে ঘিরে ধরছে তাকে। মানুষটা সত্যিই অন্যরকম!
———————————-
বিকেলে…
_তার বড় সন্তান?!
_হ্যাঁ। আর জানো, তাকে বিয়ে বাচ্চা এসবের কথা বললে..সে নিজেই বলতো,ইয়ানাই আমার জন্য যথেষ্ট। আর বিয়ে যদি কখনো করি ইয়ানাই হবে আমার আর আমার স্ত্রীর প্রথম সন্তান। তাকে ইয়ানা “মামণি “বলে ডাকবে। আর সেই জন্যই আজ তোমাকে দেখেই সে মামণি বলে ডেকেছে। তুমি কিছু মনে করোনি তো?
_আরেএএ না..না! বরং আমি খুশি হয়েছি।আমার ইয়ানার মত একটা মেয়ে হবে। আর উনি আমাকে বলেওছিলেন ইয়ানার কথা। এটুকু বলেই লাজুক হাসলো পলক।
পলকের কথা শুনে রুকু বড্ড স্বস্তি পেল। তার মানে সিফাত ঠিকই বলেছিল। এই মেয়েটা সত্যিই তার মনের মত।তারপর রুকু বললো,
_ইনু, ভাইকে পাপা ডাকে তার একটা বিশেষ কারণ আছে। শুনবে?
_জ্বী,অবশ্যই। আগ্রহী সুরে বললো পলক।
_আমার যখন প্রেগ্যান্সির ৪ মাস চলে,আমি বাসার সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছিলাম। ব্লিডিংও হয়েছিল অনেক। ইনুর বাবাই তখন সিঙ্গাপুরে। আর আমি ছিলাম আমার শশুড় বাড়িতে। ওখানেই ঘটে ঘটনাটা। তারপর যখন হসপিটালে নেওয়া হয় ব্লাড প্রয়োজন ছিল অনেকটা। কিন্তু ইমার্জেন্সিতেও ব্লাড পাওয়া যাচ্ছিল না। ভাইয়ের সেদিন খুব ইম্পরট্যান্ট একটা ফ্লাইট ছিল। ভিআইপি কেউ একজন সেদিন সেই ফ্লাইটে যাওয়ার কথা ছিল। আর সেই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিল ভাই। কিন্তু আমার এমন অবস্থা শুনে সেই ফ্লাইট ক্যান্সেল করে ছুটে এসেছিল আমাকে ব্লাড দিতে। কারণ,ওর আর আমার ব্লাডগ্রুপ সেইম। পর পর দু ব্যাগ ব্লাড দিয়েছিল ভাই। ওর জন্যই সেদিন ইয়ানা নতুন করে জীবন পেয়েছিল। নয় তো সেদিন হয় তো আমার গর্ভেই..।সেদিন ইনু তো বেঁচে গেছিল। কিন্তু ওকে বাঁচাতে গিয়ে ভাইকে একটা কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল।ওর ক্যারিয়ারের একটা দাগ লেগে যায় এই শাস্তির কারণে। বিনা নোটিশে ফ্লাইট ক্যান্সেল করার কারণে ইরেসপন্সিবল বিহেভিয়ার এর জন্য ওকে ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। ছয় মাস সে কোন ফ্লাইট এ্যাটেন করতে পারেনি। সেই সময়টা ও কতটা কষ্টে ছিল সেটা আমি জানি। রোজ রোজ দেখেছি। কিন্তু তারপরেও আমার আর ইয়ানার জন্য যত্নের কোন কমতি রাখেনি সে। হসপিটাল থেকে আসার পরে ইয়ানার জন্ম না হওয়া পর্যন্ত সে আমাদের নিজের কাছেই রেখেছিল। বড্ড কেয়ারিং ছেলেটা। বলতেই একটা প্রশান্তির হাসি এসে উঁকি দিলো রুকুর চোখে মুখে। সে আবার বলতে শুরু করলো।
_ইনু যখন জন্মালো…ইনুর বাবা নিজে না নিয়ে প্রথমে ভাইয়ের কোলে তুলে দিয়েছিল ওকে। বলেছিল,আমার আর ওর রক্ত যেমন ইনুর শরীরে আছে। তেমনি ভাইয়ের রক্তও তার শরীরে মিশে আছে। ভাইয়ের রক্ত না পেলে তো মেয়েটা বাঁচতোই না। তাই ইনুর উপর সবসময় প্রথম অধিকার থাকবে ভাইয়ের। সেদিন থেকেই ভাই ইয়ানাকে নিজের বড় সন্তানের জায়গাটা দিয়েছে। ইয়ানাও হয়েছে মামার ভক্ত। বাবাকে তো খুব একটা কাছে পায় না। ভাই নিজের জব আর ফ্যামিলি বিজনেসের দিকটা সামলে যতটা পেরেছে সময় দিয়েছে ইনুকে।ওকে ভালবাসে খুব । তাই তার বিয়ের জন্য তার একপ্রকার শর্তই এটা ছিল যে, ইয়ানাকে নিজের সন্তান হিসেবে ভালবাসতে পারবে এমন মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো। আর যেদিন তোমার কথা বললো, আমাদের সব থেকে বেশি খুশি আমার মেয়েটা হয়েছিল। কারণ, ফাইনালি তার মামণি পাচ্ছে সে। বলেই হেসে দিল রুকু।
এতক্ষণ যাবৎ মন্ত্রমগ্ধের মত রুকুর কথা শুনছিল পলক। রুকুর কথা শেষ হতেই লজ্জা,অনুশোচনা এসে ঘিরে ধরলো তাকে। ইইইইশশ….কত বড় ভুল ধারণা করে নিয়েছিল সে নিজ মনে।তার তো ধৈর্য্য নিয়ে একটাবার মানুষটার কথা শোনা উচিৎ ছিল। আর এই মানুষটা! এতটা সুন্দর মন কেন তার? এত কিছুর পরেও না কোন অভিযোগ আর না কোন অশান্তি করলো সে।বরং নিজের কথা মত আজ স্বপরিবারে এসে বিয়ের ডেট ফিক্স করলো।ভাবতেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে গেল পলক।
________________________________
_আসসালামু আলাইকুম, মৃন্ময়ী। -কল রিসিভ করার অনেকটা সময় পরেও যখন পলক কিছু বলছিল না, তাই সিফাত নিজে থেকেই সালাম দিল। সিফাতের কন্ঠস্বরে ধ্যান ভাংলো পলকের। ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। কি শান্ত সাবলিল কণ্ঠস্বর! কিন্তু তাও লজ্জায় সে টু শব্দও করতে পারলো না। তাই সালামেরও জবাব না পেয়ে সিফাত আবার বললো,
_চুপ করেই যখন থাকবে তাহলে কল কেন করেছো?
এবারের কথায় আর চুপ রইলো না পলক। বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করলো সে। এরপর বরাবরের মতো ধীর স্থির কন্ঠে সালামের জবাব দিল।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম।
এরপর দুজনেই চুপ। কয়েকটা সেকেন্ড নিরবেই কাটলো।তারপর, সিফাত নিজে থেকেই বললো,
_কেমন আছেন?
_জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
_ঠিক আছি আমি।
_আচ্ছা। এখনো রেগে আছেন?
_মানে?
_আমার উপর কি এখনো রাগ করে আছেন?
_আমি কারও উপর রেগে নেই।-কাঠকাঠ গলায় বললো সিফাত।
_কিন্তু আমি তো বেশ বুঝতে পারছি , আপনি রেগে আছেন আমার উপর।মন খারাপের সুরে বললো পলক।
পলকের এমন গলার স্বরে হাসি পেয়ে গেল সিফাতের। তবুও সে হাসিটা চেপে গেল। গম্ভীর গলায় বললো,
_রাগ করার কোন কারণ আছে কি?
সিফাতের এমন সরাসরি প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে গেল পলক। ভুল তো তারই হয়েছে। কিন্তু সেটা স্বীকার করার জন্য কিভাবে কি বলবে ভেবে পেলনা সে। চুপ করে রইলো। এদিকে পলকের থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সিফাত আবারও বললো,
_আমি তোমার উপর রাগ করে নেই।যা বলার জন্য কল করেছো সেটা বলো। -শান্ত কিন্তু বড্ড রুক্ষ শুনালো তার কণ্ঠস্বর।
_কিন্তু আপনি তো রাগ করে আছেন। আমি জানি তো।বাচ্চাদের মতো সহজ সরল গলায় বললো পলক।
_আচ্ছা? কিভাবে জানো তুমি? সিফাতের অকপট প্রশ্ন।
সিফাতের এই প্রশ্নে পলক আবারও চুপ রইল কিছুক্ষণ। তারপর বিজ্ঞের মত বললো,
_এই যে আপনি আমাকে আপনি থেকে এখন তুমি তুমি করে বলছেন!আপনি যখনই রেগে যান শুধুমাত্র তখনই আমাকে তুমি করে বলেন।আমি খেয়াল করেছি সেটা।তাই জানি আপনি রেগে আছেন।
পলকের এমন করে বলা কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সিফাত।যেন তার কোন বড় চুরি ধরা পড়ে গেছে। সে ভুলেও ভাবেনি পলক ব্যাপারটা খেয়াল করেছে।কারণ,সে নিজেও কখনো ইচ্ছে করে তাকে তুমি করে বলে না। রাগ হলে বা উত্তেজনায় আপনা আপনি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। কিন্তু মূহুর্তেই আবার মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। মেয়েটা তাকে এভাবে খেয়াল করে!তাকে বুঝতে শুরু করেছে পলক।আপনমনেই মৃদু হাসলো সে। তার ভেতর ভেতরে ফুরফুরে হাওয়া বইছে যেন।
পলকের উপর তার কখনোই রাগ ছিল না।তবে অভিমান ঠিকই হয়েছিল তার। পলক কেন পুরোটা না জেনে তাকে ভুল বুঝলো? ফোন নাম্বারটাও ব্লক করে রেখেছিল। কিছু বলার সুযোগই দেয়নি তাকে আর। মানছে যে তার অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না খুব একটা। তাই বলে এতটা অবুঝ হবে সে? মেয়েটার কি একবারও মনে হয়নি তারও যে কিছু বলার থাকতে পারে? কিংবা এ সম্পর্কটার কি হবে সেটার কথাও ভাবেনি একবারও?পলকের অতীত সে জানে। তাই সে চাইলেও রাগ করতে পারেনি তার ওমন অবুঝের মত আচরণে। কিন্তু,প্রিয় কেউ ভুল বুঝলে, ভুল ভাঙানোর সুযোগ না দিলে না চাইতেও অভিমান আপনা আপনি জুড়ে বসে মনের আনাচে কাণাচে।সিফাতের বেলায়ও সেই অভিমান এসে জুড়ে বসেছিল। কিন্তু, প্রিয়র প্রতি কতক্ষণই বা অভিমানী হয়ে থাকা যায়? সিফাতও পারেনি। আজ পলকের ওমন এলোমেলো মুখটা দেখেই অভিমানের দেওয়ালে ফাটল ধরে গেছিল তার। কষ্ট তো সে একা নয় মেয়েটাও পেয়েছে। তাই অভিমানটাও যেন বিবশ হয়ে গিয়েছিল।অতঃপর ফাটল ধরা সেই দেওয়ালটা ইয়ানার সাথে পলকের এত আদর আহ্লাদ দেখে পুরোপুরি ভেঙে চৌচির হয়ে গেছিল। কিন্তু,পলককে তার ভুল আচরণ উপলব্ধি করানোর জন্যই সে রেগে থাকার ভাব করছে।সিফাত আপন মনে এসব নানান কথা ভেবে চলেছে তখনই পলকের কথায় তার ঘোর কাটলো।
_স্যরি। আদ্র গলায় বললো পলক।
পলকের আচমকা বলা এমন একটা কথায় ভাবনাচ্যুত হয়ে গেল সিফাত। কি বললো, বুঝতে পারেনি সে।তাই জিজ্ঞেস করলো,
_হ্যাঁ…কিছু বললেন?
_জ্বী।আমি দুঃখিত…আমার ওমন কাজের জন্য।এভাবে অবুঝ আচরণ করাটা আমার ঠিক হয়নি।-অনুতপ্ত স্বরে বললো পলক।
আরও একবার..একটা প্রত্যাশিত প্রশান্তির হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল সিফাতকে।তার যা বোঝার সে বুঝে গেছে। মৃন্ময়ী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এটাই যথেষ্ট তার কাছে। কিন্তু, এই নিয়ে কথা বাড়িয়ে পলককে আর বিব্রত করতে চাইলো না সে। তাই, সরাসরি কথার প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বললো,
_মৃন্ময়ী…
সিফাতের এতটা দরদমাখা ডাকে ঈষৎ কেঁপে উঠলো পলকের ভেতরটায়। হার্ট বিটও কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল বোধয়। তাও নিজেকে সামলে জবাব দিল সে,
_জ্বী..
_আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে? নাকি শুধুমাত্র পরিবারের কথায় এই বিয়েতে মত দিয়েছেন?
সিফাতের এমন অকপট প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল পলক। সহসা কি বলবে বুঝতে পারলো না।আসলে সত্যি বলতে তো কেউ তাকে একবারও জিজ্ঞেস করেনি যে সে এই বিয়েটা করতে চায় কি না। শুধুমাত্র ছেলের পরিবার রাজি বলেই তারা চাইছে বিয়েটা হোক। কিন্তু পলক কি চায় এটা কেউ জানতে চায়নি।বরং যখন সে বিয়ে করবে না বলে আপত্তি করলো সেটাও একেবারে অগ্রাহ্য করে তার পানচিনির অনুষ্ঠান করা হলো। সিফাতকে তার পছন্দ হয়নি এমন না। মানুষটা দেখতে সুদর্শন।তার ক্যারিয়ার, পরিবার সবই ভালো। পলকের বেলায় কেমন এক অঘোষিত অধিকারবোধ নিয়ে কথা বলে সে।যে অধিকারবোধটাতে কোন জোর জবরদস্তি নেই।আছে নিজস্ব স্বকীয়তা।কোথাও না কোথাও পলকেরও খারাপ লাগে না সেটা।এই মানুষটা তাকে জেনে বুঝে গ্রহণ করলেও সে তো তেমন কিছুই জানে না তার সম্পর্কে।বিয়েটা পারিবারিকভাবে হচ্ছে।সিফাতের জায়গায় অন্য কেউ হলেও ঠিক এটাই ঘটতো। একটা অচেনা মানুষকেই নিজের জীবনের সাথে জড়াতে হতো। নিজেকে তার কাছে সঁপে দিতে হতো।সেক্ষেত্রে এই মানুষটাকে অপছন্দ বা উপেক্ষা করার মত নয়।সে রাজি না হলেও এই বিয়েটা তাকে করতেই হবে। তাহলে সিফাতের এমন প্রশ্নের জবাবে কি বলবে সে?!
ফোনের ওপাশে পলকের কোন সাড়া না পেয়ে সিফাত নিজেই বললো,
_আমাকে বিয়ে করবেন মৃণ্ময়ী?গ্রহণ করবেন আমাকে?
আচমকা সিফাতের এভাবে বলায় থমকে গেল পলক। একটা অজানা কিন্তু তীব্র শিহরণ বয়ে গেল তার পুরো শরীর জুড়ে। হুট করে কোথা থেকে এক অপরিচিত সুখানুভূতি এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।হালকা হালকা কাঁপছে তার শরীর। কাঁপছে কণ্ঠস্বরও।সুখজল এসে ভীড় করছে চোখের কার্ণিশে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। দমবন্ধকরা এক ভালো লাগা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে তাকে।তার মত মেয়ের জীবনেও যে কখনো এমন একটা মূহুর্ত আসবে সেটা বরাবরই তার ভাবনাতীত ছিল।বড় বোনের ওমন একটা কান্ড ঘটানোর পর যে ঝড় পলকের জীবনে শুরু হয়েছিল তারপরে তো এমন কিছুর আশা তো দূর ভুলেও এমন কিছু ভাবা তার জন্য দুঃসাহসিক ব্যাপার হয়ে গেছিল। কিন্তু আজ সেই অপ্রত্যাশিত মূহুর্তটা সত্যিই এসেছে তার জীবনে। এই মূহুর্তে ঠিক কিভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিৎ বুঝতে পারছে না সে। ভালো লাগা,লজ্জা, জড়াতার এক মিশ্র অনুভূতিতে শিহরিত হচ্ছে সে। মুখ ফুঁটে কিছু বলার শক্তিটাও যেন হারিয়ে গেছে তার। চুপচাপ অনুভব করছে এই নতুন পরিচিত হওয়া অনুভূতিটাকে।
ওদিকে সিফাতের অপেক্ষার প্রহর চলছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধতায় সে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটার ঘনীভূত হওয়া নিঃশ্বাসের শব্দ।তবুও সে চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে যাচ্ছে পলকের কিছু বলার। তার কাঙ্ক্ষিত জবাবের। কিন্তু, তার এই নিরব অপেক্ষার মূহুর্তটাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে টুট টুট শব্দ করে কলটা কেটে গেল। পলকের ফোনের ব্যালেন্স শেষ। তাই কলটা কেটে গেছে। কিন্তু সেদিকেও পলকের খেয়াল নেই।সে দিব্যি কানে ফোন ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার গ্রিল ধরে। ডুবে আছে তার অব্যক্ত সুখানুভূতিতে। কিন্তু সিফাত বেশ বিরক্ত হলো এতে। এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর কোন জবাব তো সে পেলই না উল্টো তার রোমান্টিক মোমেন্টের বারটা বাজিয়ে কলটাও কেটে গেল। কিন্তু সিফাতও কম নয়। এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রও সে নয়। তাই পাল্টা ডায়াল করলো পলকের নাম্বারে। ফোনের রিংটোন বাজতেই চমকে উঠলো পলক।ধ্যান ভাংলো তার। কানের কাছ থেকে ফোনটা নামিয়ে এনে দেখলো সিফাত ফোন করেছে। কিন্তু কেন? চকিতেই আবার মনে পড়ে গেল একটু আগের ঘটনাটা। সে তো সিফাতের সাথেই কথা বলছিল আর তখনই…. ভাবতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো তার পদ্মপাতার জলের মত টলটলে মুখখানা।রিং হচ্ছে কিন্তু পলক কল রিসিভ করছেনা। সিফাতের এবার রাগ লাগছে।
তৃতীয়বার রিং হতেই রিসিভ করলো পলক। আর রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিফাতের আক্রমণাত্মক ঝাড়ি শোনা গেল।
_এইইইইইই…মেয়ে! সমস্যা কি তোমার? যখন তখন বিনা নোটিশে এমন মৌনব্রত ধারণ করো কেন? এদিকে যে কেউ তোমার জবাবের অপেক্ষায় থাকে সে খেয়াল কোন ভুবনে হারিয়ে রেখে আসো তুমি?? কি হলো এখন আবার মৌনব্রত ধারণ করে আছো কেন?
সিফাতের এমন হুট করে হওয়া আক্রমণে থতমত খেয়ে গেল পলক।একটা ফাঁকা ঢোক গিলে মনে মনে বললো,এই রে..এতো আবার রেগে গেছে মানুষটা! এক রাগের সেমিস্টার শেষ হওয়ার আগেই আরেকটা শুরু হয়ে গেল!
_কি হলো আবার চুপ কেন! সিফাতের আরেকদফা তাড়ায় এবারে নড়েচড়ে উঠলো পলক। থতমত খাওয়া গলায় আমতা আমতা করে বললো,
_আ… ব..বি..
_কিইই?
_আ..বি..বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। এখন আর বিয়ে না করে উ..উপায় আছে নাকি?
পলকের উত্তর শুনে সিফাতের এবার সত্যি সত্যি মেজাজ চড়ে গেল।গম্ভীর গলায় বললো,
_অহ…তারমানে শুধুমাত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই বিয়ে করবা আমাকে!তোমার কোন মত নাই আমাকে বিয়ে করায়। কি তাই তো?
_এই রে…এটা কি হইলো! কি বললাম আর কি বুঝলো। নাকি আমিই কি বুঝাইলাম আর সেই কি বললো। ধুত..আমি আবার কি সব বলতেছি উল্টাপাল্টা।- এতক্ষণ যবৎ পর পর একের পর এক পরিস্থিতে পড়ে একরমক হাঁপিয়ে উঠেছে পলক।তাই কি বলছে না বলছে নিজেই বুঝতে পারছে না। কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে বারেবারে।
ওদিকে আবার সিফাত চেঁচাচ্ছে তার জবাব না পেয়ে। তাই এবার সেও পাল্টা চেঁচিয়ে উঠলো।
_এই!স্টপ যান তো এবার। এত মুড সুয়িং হয় কেন আপনার!এই তো একটু আগে বেশ রোমান্টিক মুডে ছিলেন এখন আবার সুয়িং করতে করতে রুড মুডে যাওয়ার কি হলো? পেঙ্গুইন একটা! -শেষ কথাটা বলেই জিভ কাটলো পলক। চট করেই খেয়াল হলো ঝোঁকের বশে কি না কি বলে ফেলেছে। রোমান্টিক টু রুড মুড! ইইশশ…কি বলে ফেললো সে এটা!!চকিতেই একরাশ লজ্জা এসে জাপটে ধরলো তাকে।লজ্জায় চোখ বুজে ফেললো সে।
ওদিকে সিফাত শকড! কি বললো এটা মৃন্ময়ী? রোমান্টিক টু রুড মুড? তার উপর সে নাকি আবার পেঙ্গুইন! এটা ভাবতেই চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে গেল সিফাতের। তারপর হুট করে বিনা মেঘে ঝুমঝুমিয়ে পড়া বৃষ্টির মতই অট্টোহাসিতে ফেঁটে পড়লো সে। সিফাতের হাসির আওয়াজে পলক যেন আরও বেশি করে লজ্জায় গুটিয়ে গেল। লজ্জার আস্তরণ ভেঙে কিছু বলা তো দূর একটা শব্দও বলতে পারছে না সে নিজ মুখে। ওদিকে সিফাত হেসেই চলেছে। না পারতে এবার পলক বললো,
_ধুর.. হাসুন আপনি। রাখছি আমি। আল্লাহ হাফেজ।
বলেই টুক করে কলটা কেটে দিল। কিন্তু সেখান থেকে নড়লো না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো সে।
পলক কল কাটতেই সিফাত বুঝতে পারলো বেশ লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা। কিন্তু তার লজ্জা আর বাড়াতে চাইলো না সে। তাই, ছোট একটা ম্যাসেজ করলো তাকে।
_লজ্জাবতী মৃন্ময়ী…রাত হয়েছে অনেকটাই। লজ্জা সাজ ছেড়ে লক্ষী মেয়ের মতো করে এবার ঘুমিয়ে যান। গুড নাইট।
ম্যাসেজটা দেখে এবার পলকের লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। মনে মনে বললো,এখন আবার জনাবের দুষ্টুমি মুড অন হয়েছে।পেঙ্গুইন একটা। বলেই আপন মনে হেসে উঠলো সে।
_________________________________
বিকেলবেলা বাসার ছাদ থেকে শুকনো কাপড় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উপর থেকেই পলক দেখলো, একজন লোক তাদের বাসার দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছে। দেখে ডেলিভারি বয় মনে হচ্ছে লোকটাকে। নিশাতকেও দেখতে পেলো বাসার দরজা চাপিয়ে ভিতরে চলে যেতে। মনে কৌতূহল নিয়েই বাসায় এলো সে। ড্রয়িংরুমে বসে আগে কাপড়গুলো ভাজ করলো পলক।ওগুলো যার যার রুমে দিয়ে নিশাতের কাপড় ওর ঘরে দিতে গিয়ে বেশ অবাক হলো সে। নিশাতের বিছানায় রিয়া,দিয়া, মিলি,নাজু আপা আর নিশাত।পরের দুদিন ছুটির দিন থাকায় সেদিন অনুষ্ঠানের পরে ফুপু আর চাচী থেকে গেছিলেন।ফুপা, মামা -মামী ফিরে গেলেও রিয়া দিয়া যাবে না বলে জেদ করায় তাদেরকে রেখেই চলে গেছে। তাই গত দুদিন ধরে তারা সবাই এই বাসাতেই আছে।
পলক দেখলো সব গোল হয়ে বসে আছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে কি যেন দেখছে। ব্যাপারটা কি বুঝতেই এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। দেখতে পেল অনেকগুলো ছবি।সবাই এক এক করে সে সব দেখছে। একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল পলকের। বিছানা থেকে হাতে তুলে নিল ছবিটা। ছবিটায় সিফাত আর সে পাশাপাশি বসে আছে।আর মাঝে ইয়ানা।মাঝে বসে দুপাশ থেকে তাদের দুজনের দুই হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে তার ছোট্ট কোলের ওপর রেখেছে। পলক আর সিফাত দু দিক থেকে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।মাঝে বসে খিলখিলিয়ে হাসছে মেয়েটা।ইশ!কি মিষ্টি হাসি মেয়েটার। ছবির দৃশ্যটা দেখে একটা সুখী পরিবারের মত লাগছে। এটা ভাবতেই একটা মৃদু সুখানুভূতি এসে ছুঁয়ে গেল পলককে। আর ছবি গুলো দেখেই পলকের বুঝতে বাকি রইলো না যে এগুলো তার পানচিনি অনুষ্ঠানের ছবি।
সবাই প্রায় কাড়াকাড়ি করে ছবি দেখছে। বেশি কাড়াকাড়ি হচ্ছে রিয়া দিয়ার মধ্যে। কিন্তু নাজু আপা সাথে থাকায় তারা নিরবেই এই কাড়াকাড়ির যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পাছে বুঝতে পারলে নাজু আপার বকার কবলে পড়তে হবে তাদের এই ভয়ে। হঠাৎ পলককে খেয়াল করে নাজিয়া বললো,
_এই সাজি,দাঁড়ায় আছিস ক্যান? বস এখানে। ছবি দেখ তোর পানচিনির।
_ছবিগুলা কই পাইলা ? নাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো পলক।
_ভাইয়া পাঠায়ছে। তাদের যে ক্যামেরাম্যান আসছিল ছবি তুলতে তাকে নাকি ভাইয়া বলে দিছিল ওয়াস করার পর একসেট যেন তাদের আর একসেট আমাদের বাসায় দিয়ে দেয়। তাই একটু আগে ছবিগুলো ডেলিভারি দিয়ে গেছে। -পাশ থেকে নিশাত বললো। ছবি দেখে চট করেই পলকের মাথায় একটা প্রশ্ন উদয় হলো। এই যে পানচিনি হলো কিন্তু তার অজান্তে এত সব প্ল্যানিং, এরেঞ্জমেন্টস কখন করলো ওরা? সেদিন এই প্রশ্নটা তার মনে হলেও কাউকে এটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি তার। আর গত দুদিনের হৈ হট্টগোলে এই ব্যাপারটা তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিল। তাই আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি কাউকে। কিন্তু এখন তো জিজ্ঞেস করাই যায়। আর এই প্রশ্নের উত্তর নিশাতের থেকে ভালো করে আর কেউ দিতে পারবে না তাকে। তাই বুদ্ধি করে নিশাতকে এখন থেকে সরানোর ব্যবস্থা করলো সে। নাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
আ..আব…হ্যাঁ। দেখবো তো। তার আগে একটু চা নাস্তা নিয়ে আসি কেমন? তারপর সবাই চা খেতে খেতে একসাথে বসে ছবি গুলা দেখবো।
_আচ্ছা,যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি করবি। -নাজিয়া বললো।
_হ্যাঁ। এই তো যাবো আর আসবো। সাথে নিশাতকেও নিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি হবে তাইলে।-এই বলেই নিশাতকে তাড়া দিল সে।
_এই নিশু চল, চা বানায় নিয়া আসি।
নিশাত প্রচন্ড বিরক্ত হলো পলকের এই কাজে।এই সময় আসর ছেড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু নাজু আপা যখন বলছে চা করে আনতে, তখন না গিয়ে উপায় নাই। তাই খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে পা বাড়ালো কিচেনের দিকে। আর তার পিছু পিছু পলকও গেল কিচেনে। উদ্দেশ্য নিশাতের কাছ থেকে সব প্রশ্নের উত্তর উদ্ধার করা।
চলবে…