#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব২৮
©জারিন তামান্না
সকাল ৭’০০ মিনিট।
মৃন্ময়ী…মৃন্ময়ী…উঠুন এবার। সকাল হয়ে গেছে তো। কোর্টে যেতে হবে তো আমাদের।
শেষরাতের দিকে ঘুম নেমে এসেছিল পলকের চোখে। কুয়াশাও ছিল বেশ। গাড়ির ভেতর জুবুথুবু হয়ে এক কোণায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে ছিল পলক। হঠাৎ, এমন আদুরে ডাকে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো সে। পুরোপুরি চোখ মেলতেই দেখলো সিফাত তার মাথায় হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে আছে খানিকটা। সম্ভবত তার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছিল তাকে। ঘুম ঘোরে সিফাতকে ওভাবে দেখতেই চমকে উঠলো পলক।হন্তদন্ত হয়ে সোজা হয়ে বসতে গেলেই সিফাত বললো,
_আস্তে মৃন্ময়ী। সময় আছে এখনো অনেকটাই। এমন হরবড়িয়ে উঠতে নেই ঘুম থেকে।
সিফাতের কথায় এবার পুরোপুরি হুঁশ হলো পলকের। মনে পড়ে গেল কাল রাতের ঘটনাটা। কাল রাত থেকে এই মানুষটাই আছে তার সাথে। সারা রাত জেগে ছিল তার জন্য। কতভাবে সামলেছে তাকে।আর এখনও তারা থানার বাইরে অবস্থান করছে। সব কিছু মনে পড়তেই পলক জিজ্ঞেস করলো,
_আপনি ঘুমোননি একটুও?
_ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল কিছুটা। তারপর আযান শুনে ঘুম ভেঙে গেছিল। পাশের মসজিদে গিয়ে নামায পড়ে এলাম কিছুক্ষণ আগে। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন বলে আর ডাকিনি। গাড়ি লক করে রেখে গেছিলাম। রশিদও ছিল বাইরে।ভাইয়াকে ১০ টায় কোর্টে নেওয়া হবে। আমরা তার আগেই যাবো। লয়ারের সাথে কথা বলতে হবে। আপনি বাসায় চলুন এখন। পরে না হয় ওখান থেকেই…
_না..আমি ভাইয়ার সাথেই যাবো। আপনি বরং চলে যান বাসায়। এখন তো আর রাত নেই,,সমস্যা হবে না। সারারাত অনেক কষ্ট হয়েছে আপনার। আপনি বরং গিয়ে রেস্ট নিন। হড়বড়িয়ে বললো পলক।
_ভিতরে চেপে বসুন তো একটু।
_হ্যাঁ?!
_আচ্ছা থাক।এখানেই থাকুন আপনি। বলেই গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিল সিফাত। তারপর, ঘুরে এসে অন্যপাশের দরজা খুলে উঠে বসলো গাড়িতে। রশিদকে বললো, মৃন্ময়ীর বাড়ি চলো।
পলক হতবাক সিফাতের এমন কান্ডে। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
_এটা কি হলো? আমরা বাসায় কেন যাচ্ছি। আমি বললাম তো আপনি চলে যান।আমি ভাইয়ার সাথে কোর্টে যাবো। তাহলে বাসায় কেন নিচ্ছেন আমাকে?
_কোর্টে আমিও যাবো মৃন্ময়ী। বাসায় চলো আগে। ফ্রেশ হয়ে বাকিদের নিয়ে একসাথে যাবো আমরা। চুপচাপ বসে থাকো এখন।কঠিন গলায় বললো সিফাত।
সিফাতের এহেন গলার স্বরে দমে গেল পলক।সিফাতের ফর্ম চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখান কিছু বলেও কোন লাভ হবে না। তাই রাগে,হতাশায় অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে রইলো পলক।
____________________________________
পলকদের বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে হালকা পাতলা নাস্তা করে নিয়েছে সিফাত।রশিদকে ডেকে তাকেও একই টেবিলে বসিয়ে খেয়েছে সিফাত।আমজাদ আলীর শরীর বিশেষ ভালো না। তাই ভিতর ঘরে শুয়ে আছেন তিনি।নিশাত প্রাপ্তির কাছে। পলক বাসায় এসেই গোসল সেরে ঝটপট তৈরী হয়ে নিয়েছে কোর্টে যাওয়ার জন্য।সিফাত ডাইনিং টেবিলেই বসা ছিল। চা খাচ্ছিল। তখনই হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে দ্রুত পায়ে পলক উপস্থিত হলো সেখানে।অস্থির গলায় সিফাতকে বললো, আপনার হলো? কখন যাবো আমরা?
_হ্যাঁ,,আমার তো হয়ে গেছে। তবে যাবো তখনই যখন মৃন্ময়ীর নাস্তা কমপ্লিট হবে। এই বলেই টেবিলের উপর রাখা নাস্তার প্লেটের দিকে ইশারা করলো সিফাত। পলক সেটা দেখে বিরক্তির সুরে বললো,
_উহ…হুউউ..এখন এসবের সময় নেই। আর তাছাড়া আমার খেতেও ইচ্ছে করছে না। আপনি চলুন তাড়াতাড়ি।
_আপনি ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট না করলে আমি কোথাও যাচ্ছি না,,আর আপনাকেও কোথাও যেতে দিচ্ছি না। So,do fast.
এবারে পলকের মেজাজ খিঁচে গেল,কান্নাজমা গলায় খানিক চেঁচিয়ে বললো,
_আপনি কেন বুঝতে পারছেন না। আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না এখন। ওদিকে আমার ভাইয়া কাল থেকে না খেয়ে আছে,,কি অবস্থায় আছে…কিচ্ছু জানি না আমি। আর আপনি সেই কখন থেকে জেদ করছেন… বলতে বলতেই কেঁদে দিল পলক। তা দেখে সিফাত কিছু বললো না। কেবল পলকের হাতটা ধরে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। খাবারের প্লেটটা তার সামনে এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
_ভাইয়া ঠিক আছেন মৃন্ময়ী। আর তার খাওয়াও হয়েছে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা করেছি। তাকে নিয়ে টেনশন করতে হবে না আপনার। আপনি ঝটপট নাস্তা করে নিন। কোর্টে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বলেই, নাস্তার প্লেটের দিকে ইশারা করলো পলককে খাওয়ার জন্য।
পলক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে। সেই অবস্থাতেই প্রশ্ন করলো তাকে,
_আপনি দেখা করেছেন ভাইয়ার সাথে?
_হ্যাঁ।
_কখখখন?
_আজ সকালে। আপনি ঘুমে ছিলেন তখন।
_আমাকে কেন ডাকেননি আপনি? অস্থির গলায় বললো পলক। তারপর কি একটা ভেবে উত্তেজিত গলায় বললো, এই,আপনি কিভাবে দেখা করলেন? ওরা তো দেখা করার পারমিশন দেয় না এভাবে!
পলকের কথায় সিফাত আলতো হাসলো। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
_টাকা থাকলে বাঘের দুধও পাওয়া যায় এদেশে।সামান্য কন্সটেবলকে ম্যানেজ করাটা আর এমন কি ব্যাপার! আপনি নাস্তা শেষ করে আসুন। আমি বাবার ঘরে যাচ্ছি কথা বলতে। আর হ্যাঁ,,নাস্তা পুরোটা কমপ্লিট হওয়া চাই।
Now, do fast. বলেই নিজের ব্লেজার ঠিক করতে করতে পা বাড়ালো সে আমজাদ আলীর ঘরের দিকে। আর পলক হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। মনে মনে বললো, মানুষটা আদতে কি, হ্যাঁ?!
___________________________________
সকাল ১১’০০ টা। কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পলক, সিফাত আর পলকের চাচা আরিফ হুসেইন।আজ সকালে ঢাকায় এসেছেন তিনি। আর কোর্টের সময় হয়ে যাওয়ার সরাসরি এখানেই এসেছেন। আমজাদ আলীর শরীর ভালো না হওয়ায় সিফাত বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসায়ই রেখে এসেছে তাকে। শাহনাজ বানু,নিশাতকেও রেখে এসেছে প্রাপ্তির জন্য। উকিলের সাথে কথা বলছিল সিফাত। পলাশের ডিভোর্সের কেসটা যিনি লড়ছেন তার নাম মি.শফিক। মি.জুনাইদও এসেছেন সাথে।পলাশকে পুশিলের কাস্টাডিতে রাখা হয়েছে একটা ঘরে। সবাই যখন কেস নিয়ে আলোচনা করছিল তখনই দূর থেকে শেফাকে আসতে দেখলো পলক। সাথের মহিলাটিকেও চিনে সে। শেফার মা তিনি। প্রচন্ড রাগ হলো পলকের তাদেরকে দেখে। সিফাত খেয়াল করেছে সেটা। আস্তে করে পলকের হাত চেপে ধরে, ফিসফিসিয়ে বললো, Don’t get so highper, Mrinmoyi. Wait for the end first .Now…let’s go.ভাইয়াকে নিয়ে গেছে ওরা।
সিফাতের কথায় বেশ অবাক হলো পলক। এত কনফিডেন্স কিসের এই মানুষটার? উত্তর জানা নেই তার।
__________________________________
পলাশকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে সেটাও নির্দোষ প্রামাণ করে। পলক জাস্ট ভেবে পাচ্ছে না যে এক রাতের মধ্যে এত কিছু কিভাবে ম্যানেজ করলো সিফাত। কেসটা সে এভাবে উল্টে দিবে ভাবতেই পারেনি কেউ। কোর্ট থেকে বেরোনোর সময় মি. শফিকে যখন ধন্যবাদ দিয়েছিল পলক, তখন তিনি বারবার বলছিলেন,আজকে সিফাত হেল্প না করলে একদিনেই এভাবে কেস ক্লোজ করা সম্ভব হতো না। তার জন্যই এত দ্রুত সব প্রমাণ হাতে পাওয়া গেছে।
আজকে কোর্টে কেস উঠার পর শেফার অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণ করা হয়েছে। সেই সাথে শেফার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ও মানহানির মামলা করা হয়েছে। শেফা নিজের অভিযোগে বলেছিল,
পলাশ তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো। জোর পূর্বক তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতো।গর্ভধারণের জন্য চাপ দিতো।কিন্তু,তার পুনরায় গর্ভধারণে সমস্যা থাকায় এবং গর্ভধারণ করতে না পারায় তাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট পলাশ।বংশ রক্ষায় ছেলে সন্তান চায় পলাশ ও তার পরিবার। নিজের পরিবারের কথায় পলাশকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য বলায় শেফা সেটায় অমত করে। আর সেই কারণেই, তাকে জোর করা হচ্ছে পলাশকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। সে ডিভোর্স দিবে না বলায় তাকে খুব মেরেছিল পলাশ।আর যোশরের বাড়িতে রেখে মেয়ে আর সব টাকা,শেফার গয়না নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে।তারপর, নিজেই ডিভোর্স পেপার সাইন করে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আর ফোন করে শেফাকে তাতে সাইন করার জন্য চাপ দিচ্ছে। সাইন না করলে মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকিও নাকি দিয়েছে পলাশ।
কোর্টে একেক পর এক এমনসব অভিযোগ শুনে যখন সবাই রীতিমত হতভম্ব, তখনই মি. শফিক তামাম সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে শেফার অভিযোগগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন।
পলাশের প্রতি মিথ্যা অভিযোগের প্রমাণ স্বরূপ তিনি পারিবারিকভাবেই শেফা আর পলাশের বিয়ে, শেফার ভাই সোহেলের সাথে পলকের বিয়ের ঘটনা, সোহেলের এরেস্ট হওয়ার ঘটনা, আর প্রাপ্তিকে জন্মের আগেই এবর্শন করে ফেলার হুমকি দিয়ে পলাশকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা খুলে বললেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার অক্ষমতার কারণে ডিভোর্সের অভিযোগের সাপেক্ষে তিনি শেফার নতুন পর্দা ফাঁস করলেন সবার সামনে। শেফার সত্যিই পুনঃরায় গর্ভ ধারণে সমস্যা রয়েছে। কারণ, প্রাপ্তির জন্মের আগে ৪ বার এবর্শন ও নিয়মিত জন্মনিরোধ পিল সেবন করার ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় জড়িয়ে গেছে শেফা। প্রাপ্তিকেও জন্ম দেওয়ার কোন ইচ্ছা শেফার ছিল না। কিন্তু ডাক্তার বলেছিল এবারে এবর্শন করলে শেফার লাইফ রিক্স হতে পারে তাই প্রাপ্তিকে গর্ভে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। প্রাপ্তিকে জন্ম দিতে গিয়েও বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়তে হয়েছিল শেফাকে।তাই প্রাপ্তির জন্মের পর ডাক্তার পুনঃরায় গর্ভধারণের জন্য নিষেধ করেছে শেফাকে। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্ব করতে বলেছে। এতবার এবর্শন আর বাকি সব শারীরিক জটিলতার কথাও পলাশ জেনেছিল প্রাপ্তির জন্মের সময়।কিন্তু,নতুন কোন অশান্তি চায়নি বলে চেপে গিয়েছিল ব্যাপারটা। তাই, শেফার সাথে বিগত ৩ বছরে কোন ধরণের শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়নি পলাশ। আসলে,,পরিবার থেকে তাকে ওভাবে আলাদা করার কারণে,আর প্রাপ্তির প্রতিও শেফার অযত্ন অবহেলা দেখে তার প্রতি মন উঠে গেছিল পলাশের। শুধুমাত্র প্রাপ্তির জন্যই একসাথে ছিল।
তবে, পলাশ যে সব জানে এটা শেফা জানতো না। এসবের সাক্ষী ও প্রমাণ হিসেবে শেফা ঢাকায় যে ডাক্তারকে দিয়ে এবর্শন করাতো তাকে আর প্রাপ্তির জন্মের সময় যার তত্ত্বাবধায়নে ছিল তাদেরকে হাজির করা হয়। সাথে সমস্ত মেডিকাল ডকুমেন্টস।আর মারধোরের অভিযোগও যে মিথ্যা সেটা প্রমাণ করতে প্রয়োজনে শেফার মেডিকাল চেকআপের জন্য আর্জি পেশ করা হয় কোর্টে। আর, যশোর থেকে আসার আগে শেফা তাকে নারী নির্যাতনের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয় সেটাও বলা হয় কোর্টে।
শেফা ভাবতে পারেনি ব্যাপারটা এত সহজে হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। সে শুনেছিল নারী নির্যাতনের মামলা করলে আসামীর কমপক্ষে সাত বছরের জেল হয় আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকাও পাওয়া যায়। তাই এত কিছু না ভেবেই কেস করে দিয়েছিল। ফলাফল কেস হেরে গেছে সে। মিথ্যা মামলার অভিযোগে এবং মানহানির মামলায় তাকে দুবছর করে চারবছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।ডিভোর্সের আবেদনটাও মঞ্জুর করা হয় একই সাথে। শেফার জেল হওয়ায় প্রাপ্তির কাস্টাডিও পলাশ পায়। সব মিলিয়ে কেসটা সম্পূর্ণ পলাশের পক্ষে চলে আসে। আর এক রাতের মধ্যে এত সব প্রমাণ সিফাত জোগাড় করিয়েছে তার এক বন্ধুকে দিয়ে যে কিনা পুলিশের বড় কর্মকর্তা। রাতেই তার সাথে যোগাযোগ করে কথা বলে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিল সে। কিন্তু পলক এসবের কিছুই জানতো না। কিন্তু,এত সব কিছুর মাঝে সে এটা ঠিক বুঝতে পারলো সিফাত নামের মানুষটি তার জীবনে আশীর্বাদ সরূপ।তাকে কষ্ট দেওয়া বা ঠকানোর দুঃসাহস করারও তার জন্য কল্পনাতীত হবে।
___________________________________
এত এত ঝড়ের পরে পলকের আজকাল বেশ সুখসময় চলছে। বিয়ের মাত্র দেড় মাস বাকি। সেটার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সবাই। বিথি তিয়ানের সাথেও নিয়মিত কথা হচ্ছে।দেখা হচ্ছে। পুরোনো স্মৃতিদেরও উল্টেপাল্টে দেখা হচ্ছে আবার। দূরত্ব, জড়তাও কাটছে একটু একটু করে। শপিংএও যাচ্ছে তারা একসাথে।তবে সিফাতের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় না পলকের। সিফাতের সাথে দেখা হওয়ার একমাত্র উপায় ভিডিওকল। নইলে ফোনের দুই চারটা কথাতেই ক্ষান্ত হতে হয় তাদের। অফিস,,ফ্লাইট সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় চলছে সিফাতেরও। বিয়ের সময়টা বেশ কিছুদিন ছুটিতে থাকবে তাই আগেই যতটা সম্ভব কাজ গুছিয়ে রাখছে।
এরই মাঝে একদিন রাতে বিথি গ্রুপ কলে কানেক্টেড করলো পলক আর তিয়ানকে। এই কথা সেই কথার পরে তাদের কথার প্রসঙ্গে এলো পহেলা ফাল্গুন নিয়ে।আর ১ দিন বাদেই পহেলা ফাল্গুন। অথচ এবার বিথি তার বরের থেকে দূরে। তাই মন খারাপ করে বললো,
_বুঝছোস দোস্ত,,,এই বিদেশ ভূইয়ে গিয়া দেশীয় সব উৎসব চঙ্গে উঠছে আমার। ওই সব কমিউনিটির রংঢং এর ফাংশন একটুও ভাল্লাগে না আমার। জামাইটা যাও ভ্যালেন্টাইনটা পালন করে,,এবার এইটাও হইবো না।
_তো এতে মন খারাপ করার কি আছে। এইবার তো দেশে আছিস। তুই আর পলক যা,শাড়ি টাড়ি পড়ে ঢাকা শহর ঘুরবি সারাদিন। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললো তিয়ান।
_আরেএ ধুর,,পলকের তো এইবার উনি জুটছেন একজন
আমার সাথে আর কি যাবে! দুই দিন তার উনার সাথে কাটাবে দেখিস। বলেই রসিকতা করে হাসলো বিথি।
_উহু,,এমন কিছু না।।উনি এসব নিয়ে বলেননি কিছু। ব্যস্ত উনি। ১৪ তারিখ ফ্লাইট আছে উনার লন্ডনের।
_ যাহ…বাবা! এইসব কি!বিয়ের আগে এইটাই তোদের ফার্স্ট আর লাস্ট ভ্যালেন্টাইন। এইটা সেলিব্রেট না কইরা উনি অন্য দেশে ক্যাম্নে উড়াল দিতে পারে ইইইয়ার!!!
বিথির এমন অহেতুক হু-হতাশ করা দেখে হেসে ফেললো পলক আর তিয়ান। তাদের হাসি দেখে মেজাজ খারাপ হওয়া স্বরে বিথি বললো,
_এই ফালিজের দল। হাসোস ক্যান এম্নে! আমি ভুল কি কইলাম!
_তুই ভুল কিছুই বলিশ নাই বিথু। বাট এটা তো পলক আর সিফাত ভাইয়ার ব্যাপার। তুই আমি আফসোস করলেই কি! যেখানে পলকেরই কোন আফসোস নাই। -তিয়ান বললো।
_হ,এইডাও কথা!
_তবে বললামই তো তোরা দুজন যা! ঘুরে আয়। আবার কবে না কবে আসবি বাংলাদেশে। আর পলকেরও এটা লাস্ট সিঙ্গেল ফাল্গুন। তারপরে তো উনিও বর নিয়ে ঘুরবে।বলেই ফিচলে হাসলো তিয়ান।তা দেখে বিথিও হাসলো একইভাবে। পলক ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল এতে। জীবন তার কদিন পরেই নতুন রঙ পেতে চলেছে।ভাবতেই অন্যরকম সুখ লাগছে তার।
_আচ্ছা,,,তাইলে এক কাজ করি। আমরা তিনজনই যাই চল ঘুরতে। এই তিয়ান তুই পাঞ্জাবী পড়বি আর আমরা শাড়ি ওকে?
_এইই তোদের মাঝে আমারে ক্যান টানতেছিস। দুইজন এঙ্গেজড মহিলা নিয়া আমি একা সিঙ্গেল ছেলে ঘুরতে যাবো নাকি! লোকে কি বলবে! বিস্মিত স্বরে বললো তিয়ান।
_বেশি পকপক করিস না তো। কাল আমরা শপিং এ যাবো, এটাই ফাইনাল। আর শপিংও তুই করে দিবি আমাদের।বিথি বললো।
_আচ্ছা যা,,দিবোনে। কাল তাহলে বিকেলে শপিং মলে চলে আসিস তোরা। আমি অফিস শেষ করে আসবো।
_আচ্ছা,,খুশি হয়ে বললো বিথি। কিন্তু,পলকের মন সায় দিলো না এসবে। এভাবে শাড়ি পড়ে ঘুরতে যাওয়ার অভ্যাস নেই তার। কিন্তু বিথি মন খারাপ করবে ভেবে নাও করতে পারলো। তাই রাজি হয়ে গেল বিথির আবদারে।
__________________________________
পলকের বাড়ির সামনে ওয়েট করছে তিয়ান।বিথি পলকের বাসায় গেছে তাকে নীচে নিয়ে আসতে।
আজ পহেলা ফাল্গুন। সকাল সকাল ফোন করে বিথি ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে তিয়ান আর পলককে। বলেছে সকাল বেলা না গেলে নাকি ফাল্গুনের কোন মজাই থাকে না। অগ্যতা তাদের ঘুম ছেড়ে তৈরী হতে হয়েছে বিথির সাথে যাওয়ার জন্য। গতকাল শপিং এ গিয়ে বিথি আর পলককে একই রকমের দুটো শাড়ি কিনে দিয়েছে তিয়ান। আর তাদের পছন্দে নিজের জন্য একই রঙ এর পাঞ্জাবীও কিনতে হয়েছে তাকে। পলক তিয়ানের দেওয়া শাড়িটা নিতে না চাইলেও তিয়ান যখন বললো,”বন্ধু হিসেবেই তো দিচ্ছি,,মানা কেন করছো? “আর বিথিও জোর করলো তখন আর পলক না করতে পারেনি। নিয়েছে শাড়িটা। আর সেই শাড়ি পড়েই কুচি ঠিক করতে করতেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল পলক। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল তিয়ান।গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা পলককে দেখে থমকে গেল সে। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পলককে সে ভালোবেসে প্রায় সময় “শ্যামকন্যা” বলে ডাকতো। আর আজ পলককে দেখে তার মনে হলো সরিষা হলুদ আর সবুজ মিশেল এই শাড়িতে যেন ‘শ্যামলতার’ প্রতিরূপ এসে হাজির হয়েছে তার সামনে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে পলককে।
তার মনে আছে আজও,,,তাদের সম্পর্কের শুরুতে প্রথম ফাল্গুনে তিয়ান আবদার করেছিল পলককে শাড়িতে দেখবে বলে। কিন্তু পলক লজ্জায় শাড়ি পড়েনি সেবার। তিয়ানের তাকে শাড়িতে দেখার ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রয়ে গেছিল। আজ সেই ইচ্ছেটাই যেন পূরণ হলো তার। তারই দেওয়া শাড়িতে সেজেছে তার শ্যামকন্যা। কি অপূর্ব লাগছে তাকে! চোখে মোটা করে কাজল টানা।চুলগুলো হাতখোপা করে একসাইডে করে রেখেছে। দুই একটা ফুলও গুঁজে রেখেছে তাতে। সামনের বেসামাল কিছু চুল বড্ড জ্বালাতন করছে তাকে। সেটা দেখে আলতো হাসলো তিয়ান। পলক কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তিয়ান নিজের অজান্তেই পলকের গালে হাত রাখলো। আলতো করে ছুঁয়ে সামনের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। তার চোখ মুখে অদ্ভুত ঘোর। যা দেখে ভড়কে গেল পলক। আর আচমকা তিয়ানের এমন কাজে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। তিয়ান এমন কিছু করবে মোটেও আশা করেনি সে। ঘোর লাগা চোখে আরও এককদম এগিয়ে এলো তিয়ান পলকের দিকে। পলকের অস্বস্তি লাগছে খুব এবারে। ধীর কন্ঠে তিয়ানকে ডাকলো একবার। বললো,
_তিয়ান….কিকিকিইই…কি করছো তুমি? সরে দাঁড়াও।
কিন্তু তিয়ানের কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না এতে। পলকের কথা যেন তার কানেই গেল না। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে মুগ্ধ নয়নে সে দেখছে তার শ্যামকন্যাকে। আস্তে আস্তে তিয়ানের আঙুল পলকের কানের পেছন থেকে নেমে ঘাঁড় ছুঁতেই চমকে উঠলো পলক। ছিটকে দু কদম পিছিয়ে গেল তিয়ানের থেকে। তা দেখে ঘোর কাটলো তিয়ানের। সেই সাথে বেশ অপ্রস্ততও হয়ে গেল সে তার এহেন কাজে। পলকের চোখে মুখে রাগ,বিস্ময়, বিভ্রান্তির সংমিশ্রণ খেলা করছে।তা দেখে তিয়ান বেশ বুঝতে পারলো কতবড় ভুল সে করেছে। তাই পলকে যেই না স্যরি বলতে যাবে,ওমনি পেছনকে বিথি চেঁচিয়ে বললো,
_এইই কি করিস তোরা। এখনো খাম্বার মতো দাঁড়ায় আছিস ক্যান। গাড়িতে ওঠ।বিথিকে খেয়াল করতেই তিয়ান দেখলো বিথি আর পলক একইভাবে সেজেছে। বেশ মিষ্টি লাগছে বিথিকে। তাকে দেখে মুচকি হাসলো তিয়ান। তার কাছাকাছি গিয়ে পলকের পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
_দেখতো তিনু,,কেমন লাগতেছে আমাদের দুইজনকে?
_মাশাল্লাহ! খুব মিষ্টি লাগছে তোদের।
_থ্যাংক ইউ। খুশি হয়ে বললো বিথি। তারপর,তাদের তাড়া দিয়ে বললো,এই চল চল। এম্নিতেই দেরি হয়ে গেছে। পরে আরও লেট হয়ে যাবে।
_হুম,,চল। এসো পলক। বলেই গাড়ির দিকে পা বাড়ালো তিয়ান।
সারাদিন তিন বন্ধু খুব ঘুরেছে। মজা করেছে। পলক যদিও মন থেকে উপভোগ করতে পারেনি কিছুই।সকালের ঘটনায় বেশ গুটিয়ে গেছে ভেতর ভেতর। বিথি না বুঝলেও তিয়ান সেটা ঠিক খেয়াল করেছে। তাই, বিথি যখন ফোনে কথা বলছিল তিয়ান চট করেই পলকের হাত ধরে একটু নিড়িবিলিতে নিয়ে দাঁড় করালো।পলক হকচকিয়ে গেল তিয়ানের এহেন কাজে। মেজাজও খারাপ হলো ভীষণ তার। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে,,তিয়ান শক্ত করে ধরে থামালো তাকে। তারপর বললো,
_Polok listen…I’m really sorry yrr….I’m don’t know what happened to me that time…I lost my control. I’m really sorry for my behaviour. plzz…pardon me.
_Its ok Tiyan. ছাড়ো এখন। কেউ দেখলে ভুল বুঝবে। চলো এখান থেকে।
_তুমি রাগ করোনি তো?
_না,, ঠিক আছে। ভুল হয়েছে,তুমি সেটা বুঝতে পেরেছো,,ওটাই এনাফ।
_Are u sure?
Yeah.
_okkk. চলো। আলতো হেসে বললো তিয়ান।
____________________________________
এয়ারপোর্টে বসে নিউজফিড স্ক্রল করছিল সিফাত। স্ক্রল করতে করতেই তার চোখে পড়লো একটা ছবির এ্যালবাম। পহেলা ফাল্গুনে তাদের একসাথে তোলা কিছু ছবি তিয়ান আর পলক আর কয়েকজনকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে বিথি। বিভিন্ন পোজ দিয়ে তোলা ছবিগুলো। সেগুলোর মধ্যে একটা ছবিতে পলক আর বিথিকে দুপাশে নিয়ে তাদের কাঁধে হাত রেখে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান। তিনজনেরই হাসি মুখ। ক্যাপশনে লেখা: “Sharies gifted by dear Tiyan .”
আরেকটা ছবিতে পলক কিছু একটা নিয়ে হাসছে। প্রাণখোলা এক হাসি। আর সামনে তিয়ান দাঁড়িয়ে।মুগ্ধ নয়নে সে হাসি দেখছে তিয়ান।তার মুখেও মুগ্ধতার হাসি লেপ্টে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যান্ডিড ক্লিক এটা। অন্য একটা ছবিতে পলক কোথাও একটা চলে যাচ্ছিল আর তিয়ান শাঁড়ির আচঁলে পেঁচিয়ে যাওয়া তার হাতটা ধরে রেখেছে।
আবার,বিথিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা ছবিও আছে তিয়ানের সাথে। আরও কয়েকজনের সাথেও বেশ কিছু গ্রুপ ফটো আছে। বন্ধু বোধয় তারা ওদের। পলককে মুগ্ধ হয়ে দেখলো সিফাত। সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল তাকে। বিথি আর সে একই রকম সেজেছে সেটা দেখেও আলতো হাসলো সিফাত। বিথির কথা শুনেছে সে নিশাতের কাছে। পলকের একমাত্র ক্লোজ ফ্রেন্ড সে। কিন্তু,,তিয়ান যে তাদের এত ভালো ফ্রেন্ড সেটা বোধয় নিশাতেরও জানা ছিল না। তাই সিফাতকেও বলেনি সে। তিয়ানকে তার খারাপ লাগে না। প্রথম পরিচয়েই ভালো লেগেছিল তাকে। তারপর পলককে তার বিপদের সময় যেভাবে হেল্প করেছে, তাতেও বেশ ভালো লেগেছিল তিয়ানকে তার। ডিসেন্ট, রেসপন্সিবল , কেয়ারিং একটা ছেলে। কিন্তু,,সে যেটা বুঝেছে,,পলক কি বোঝে সেটা? জানা নেই সিফাতের। লাস্ট দুদিন একবারও কল বা ম্যাসেজ করেছি সে পলককে। পলকও করেনি।সে অবশ্য এমনিতেও করে না খুব একটা। তারপরেও,,,এত সব আয়োজন এত কিছুর কোন কিছুই সে সিফাতকে বলেনি। আজকের দিনটাতেও একটা বার কল করেনি,,কিন্তু কেন করেনি?
স্পিকারে এনাউন্স হচ্ছে। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। যেতে হবে এবার। অনেক অনেক প্রশ্নের না পাওয়া উত্তরগুলো ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সিফাত। পা বাড়ালো প্লেনে চেক ইন করার উদ্দেশ্য।
চলবে..