#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ১৪

0
615

#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ১৪
#নাফিসা নীলয়া!

আজ তিনদিন হলো সাইফ আর রুমার বিয়ে শেষ হয়েছে। নীরার সাথে শিহাবের শেষ দেখা হয়েছে রুমা আর সাইফের রিসেপশনের দিন। তিনদিন শিহাব নীরাকে দেখেনি। রিসেপশনের দিন ও শিহাবের প্রতি নীরার ব্যবহার ছিলো এড়িয়ে যাওয়ার মতো। এটা রুমার বিয়ের দিনের ঘটনার ফল। শিহাব নীরার সাথে ওরকম ব্যবহার করতে চায়নি। তবে নীরার কথা শুনে তার মাথায় ধপ করে রাগ চেপে বসেছিলো। সে এমনিতেই রাগী। কথায় কথায় রেগে যায়। আর তখন নীরা এমন সব কথা বলেছিলো যাতে শিহাব আরো রেগে গিয়ে ওমন ব্যবহার করে ফেলেছে। দেখতে গেলে নীরার দিক থেকে ওরকম কথা বলার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারন আছে। তবে শিহাব মানতে পারেনি। এখন সে অনুতপ্ত তার কাজের জন্য। এখন তার নীরার সাথে কথা বলা দরকার স্যরি বলা দরকার। এসব ভেবেই অফিস থেকে দ্রুত বেড়িয়ে পরলো শিহাব। উদ্দেশ্য নীরার স্কুলে যাওয়ার।
****

-রেজাউল এবার নীরার বিয়ের জন্য পাএ দেখি কি বলো?

মালিহার এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন নীরার বাবা। মালিহা যে এমন একটা কথা বলবেন। তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি মালিহাকে প্রশ্ন করলেন।

-হঠাৎ এসব বলছো? তুমিই তো চাইতে নীরা নিজেকে প্রমান করুক প্রতিষ্ঠিত হোক।

রেজাউলের কথা শুনে মালিহা বিরক্তবোধ করলেন। তার মেয়ে তো যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাকরির পাশাপাশি সে একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার ও। আর সবারই জীবনে একজন সঙ্গী প্রয়োজন। এমন না যে মেয়েদের জীবনে বিয়ে মানেই সব। কিন্তু একটা জীবন কাটাতে গেলে তো সঙ্গীর ও প্রয়োজন। নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এটা তিনি মানেন।

-হ্যা বলেছিলাম। এখন আমার নীরা প্রতিষ্ঠিত। এখন সে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে। আর ওর বিয়ে করার বয়স টাও পেরিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা হিসেবে আমাদের তো দায়িত্ব ওকে সঠিক ছেলের হাতে পাএস্থ করা। দেখো এক জীবনে আর কতো একা চলা যায়? ভেবে দেখো। কখনো তো মেয়ের কথা ভাবোনি। তুমি নীরার বাবা যেমনই হও বাবা তো। তাই তোমারও একটা দায়িত্ব আছে।

মালিহার শেষের দিকের কথা শুনে কষ্ট পেলেন রেজাউল। তার অপরাধের জন্য মালিহা তো তাকে ক্ষমা করেনইনি উল্টো প্রায়ই তাকে এসব নিয়ে ঠেস মেরে কথা বলেন। রেজাউল বিনাবাক্যে মেনে নেন। কারন তার বলার মতো কিছু নেই।

-বউমা ঠিক বলেছে। এবার নীরার জন্য ছেলে দেখ। মানুষের হায়াত মউতের কথা বলা যায় না। মানছি মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়ে আমিও নীরাকে অনাদর করেছি। তবুও বলছি। নীরার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ওর এখনই বিয়ে করার সময়।

নীরার দাদী ঘরের বাইরে এসেছিলেন। একটু হাটাহাটি করতে। তখনই মালিহা আর রেজাউলের কথা তার কানে আসলো। মা আর স্ত্রীর একই কথা শুনে কিছু বলতে পারলেন না রেজাউল।

-নীরার মতামত থাকলে অবশ্যই ওর বিয়ের কথা ভাবা হবে তার আগে না।

এতে নীরার দাদী খুশি হলেন। তিনি ভাবলেন নীরাকে মালিহাই রাজি করাতে পারবে। তিনি নিশ্চিন্ত মনে বাইরে গেলেন একটু হাটাহাটি করতে।

তবে মালিহা দুঃশ্চিন্তায় পরে গেলেন। তিনি বলে তো দিয়েছেন নীরার বিয়ের কথা। তবে নীরা কি মানবে! ছোট থেকে মেয়েটা সবসময় শুনে আসতো ওর নাকি কখনো সংসার হবে না। স্বামী হবে না। একটু বড় হওয়ার পর সবই বুঝতো নীরা। মুখ ফুটে কাউকে কিছু না বললেও নীরা যে এসব কথায় কষ্ট পাচ্ছে তা বুঝতেন মালিহা। আর সমাজ অনেক উন্নত হলেও এখনো শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের বিয়ে নিয়ে অনেক কথা হয়। কেউ কেউ তো মুখের ওপর রিজেক্টই করে দেয়। তিনি মা হয়ে নীরাকে আর কতো কষ্ট পেতে দেখবেন। যদি আবার রিজেক্ট হয় নীরা। তাহলে তো মেয়েটা ভেতরে ভেতরে শেষই হয়ে যাবে তবে কাউকে বুঝতে দিবে না। তখন কি করবেন তিনি! কিন্তু জীবনে সত্যিই একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আর কতো একা চলা যায়। তারা তো আর চিরকাল থাকবেন না। মিলাও বড় হচ্ছে। যেই মেয়েকে তিনি বুকে করে মানুষ করেছেন তার একটা নিশ্চিন্ত জীবন দেখতে চান তিনি। যেই জীবনে নীরার একার কোনো দুঃশ্চিন্তা থাকবে না। সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায় মালিহার। আর ভাবতে পারেন না কিছু। রেজাউল ও মালিহার অবস্থা বুঝতে পারেন তবে তার কিছুই বলার থাকে না।

***
-টিলা এই টিলা।

মিলা ক্লাস শেষে বের হতে যাচ্ছিলো। টিলা ডাক শুনে থেমে গেল। এই ডাক কে ডাকতে পারে তা ভালো করে জানা আছে মিলার। রেহান যে কখনো শুধরাবে না। সেটাও বুঝে গেছে মিলা। বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকালো মিলা। রেহান দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছে এখন। আজব ছেলে তো! মিলা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলো। রেহান না বলতেই মিলা পানি বের করে দেওয়ায় হাসলো রেহান। পানি খেয়ে ধাতস্ত হলো সে। পানির বোতল ফেরত দিতে দিতে সে মিলাকে প্রশ্ন করলো

-কেমন আছো টিলা?

-রেহান তুমি এইজন্য এমন দৌড়ে এসেছো? ভালো আছি কিনা জিজ্ঞেস করতে?

মিলার কথায় রেহান ইনোসেন্ট মুখ করে মাথা দোলালো। মিলা কিছু কঠিন কথা বলতে গিয়েও বললো না।

-ভালো আছি এবার যাই?

-এই না,না আরেকটা কথা ছিলো।

-বলো।

বিরক্ত মুখে জবাব দিলো মিলা।

-তিতলি নীরা আপু আর তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। ওর নাকি তোমাদের কথা খুব মনে পরছে। এজন্য আমাকে বললো।

-বেশ তো তিতলিকে নিয়ে আসো আমাদের বাড়িতে। এটা আবার বলতে হয়। তিতলির যখন খুশি চলে আসবে।

মিলার কথায় হেসে ফেললো রেহান।

-ও তোমাদেরও নিয়ে যেতে বলেছে।

-আগে ও আসুক। তারপর আমরা যাবো বলে দিও ওকে। আর নিয়ে এসো।

-ঠিক আছে।

-তো এবার আমি যাই?

রেহান আবার দাঁত কেলানো হাসি দিলো। একটু দূরে গিয়ে বললো

-তোমাকে আজ একটুও সুন্দর লাগছে না টিলা। বাই বাই।

রেহানের এমন আচরনে কিছুক্ষন কিছুই বলতে পারলো না মিলা। তারপর রেগেমেগে রেহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। রেহান ততক্ষনে দৌড়ে চলে গেছে।
এই ছেলে কখনো কোনোদিনও শুধরাবে না ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিলা।

নীরার স্কুলের সামনে অনেকক্ষন যাবত দাড়িয়ে আছে শিহাব। ভেতরে যাওয়ার সাহস করতে পারছে না সে৷ সে এতো ভীতু কবে থেকে হয়ে গেল। ঠিকই আছে তার সাথে এমনই হওয়া উচিত। ওইদিন খুব বাহাদুরি করেছিলো সে। তার ফল তো এখন ভোগ করতে হবেই। নিজের সাথে নিজেই বোঝাপড়া করে ভেতরে ঢুকে পরলো শিহাব৷ ঘড়িতে সময় দেখলো সে। এখন ব্রেক টাইম নীরার নিশ্চয়ই এখন ক্লাস নেই। সে এদিকওদিক ঘুরতে থাকলো। বাচ্চাদের খেলা করা দেখতে থাকলো। ইস কি করবে সে এখন। সে কি সোজা টিচার্স রুমে ঢুকে যাবে। না না এ কি কথা ভাবছে শিহাব। সে কি এতো ম্যানারলেস নাকি! ওইদিনের সেই জিনিয়া মেয়েটাকেও পাচ্ছে না শিহাব। হঠাত দেখলো একজন পিয়ন এদিকে আসছে। শিহাব ঠিক করলো একেই নীরার কথা বলতে হবে।

-শুনুন।

লোকটা ব্যস্ততার সাথে যাচ্ছিলো। শিহাবের ডাক শুনে থেমে গেল।

-হ্যা বলুন।

শিহাব আমতা আমতা করে বললো।

-নীরাকে ডেকে দেওয়া যাবে প্লিজ?

লোকটা কপাল কুঁচকালো যেনো শিহাবের মতো বিরক্তকর মানুষ আর দুটো নেই। শিহাবের খারাপই লাগলো।

-নীরা মাহমুদ ম্যাম?

-ইয়েস নীরা মাহমুদ ম্যাম।

-উনি এখন কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না। উনি কিছু কাজ করছেন। কাউকে বিরক্ত করতে না করেছেন।

মুখের উপর না বলে দিলো লোকটা। তারপর চলে গেল। আর শিহাব দাড়িয়ে রইলো। সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।

-দেখো নীরা দেখো তোমার জন্য আমার কি কি করা লাগছে। মানুষের বিরক্তের কারণও হয়ে উঠলাম।

এসব বলতে বলতেই সে জিনিয়াকে দেখলো। আরে একেই তো খুঁজছিলো সে ও নিশ্চয়ই না করবে না। ভাবলো শিহাব।

-এক্সকিউজ মি!

জিনিয়া আগেই দেখেছে শিহাবকে। সেদিনও নীরার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। তাই সে এগিয়ে গেল।

-নীরা মাহমুদ কে দরকার আর্জেন্ট। প্লিজ না করবেন না। অনেক দরকার।

শিহাবের এমন তাড়াহুড়ো কথায় হকচকিয়ে গেল জিনিয়া।

-কিন্তু ম্যাম তো এখন বিরক্ত করতে না করেছেন। ম্যাম কিছু স্পেশাল চাইল্ডদের হিস্ট্রি নিয়ে স্টাডি করছেন। এসব ব্যপারে খুব স্ট্রিক্ট ম্যাম।

শিহাবের মন চাচ্ছে নিজের মাথা নিজে ফাটাক সে। এখানে কি নিজের মাথা ফাটানোর মতো সরঞ্জাম আছে? প্রশ্ন করতে চাইলো শিহাব। তারপর দেখলো তার সামনেই দেয়াল আছে। সে ওখানে মাথা ফাটাতে পারবে। নিজের এমন উদ্ভট চিন্তায় প্রচুর বিরক্ত হলো শিহাব। তাও একটা শেষ চেষ্টা করলো সে।

-প্লিজ ওকে খুব দরকার। আমার নাম বললেই হবে প্লিজ।

শিহাবের এমন করুন মুখের অনুরোধ ফেলতে পারলো না জিনিয়া। সে নীরাকে ডাকতে রাজি হয়ে গেল। শিহাব একটা ছোট্ট হাসি দিলো।

নীরা কিছু বাচ্চাদের আচার আচরণ হিস্ট্রি নিয়ে স্টাডি করছিলো। যদিও সে এসবে খুব এক্সপার্ট। তবুও বাড়তিভাবে অনেককিছু নিজে থেকে শিখে নেয় নীরা। যা পরবর্তীতে খুব কাজে লাগে। সে স্পেশাল চাইল্ডদের প্রতি খুবই যত্নশীল। তার কাজের এতোটুকু ত্রুটি সে রাখতে চায় না। তাই সে বসেছিলো ব্রেক টাইমে। তাকে যেনো অতি প্রয়োজন ব্যতীত বিরক্ত না করা হয় তাও বলেছিলো সবাইকে। ওই মুহূ্তেই জিনিয়া এসে নক করলো। নীরা বিরক্ত হলো। তবুও জিনিয়াকে ভেতরে আসতে বললো।

-ম্যাম ওইদিনের সেই লোকটা দেখা করতে এসেছে। কি যেনো নাম বলছিলো। হ্যা শিহাব রেজা। খুব নাকি দরকার তার। অনেক আর্জেন্ট।

জিনিয়ার কথা শুনে নীরা কাজ থামিয়ে দিলো।

-ওনাকে ফিফটিন মিনিট্স ওয়েট করতে বলো। আমি আসছি।

জিনিয়া চলে গেল। নীরা পুনরায় কাজ করতে থাকলো। কোনো আর্জেন্ট দরকার না জানে নীরা। ওইদিনের রাগ সে এখনো চেপে রেখেছে। সে ভাবছিলোই শিহাবের সাথে দেখা করে সব সল্ভ করবে আজকালের মধ্যেই। শিহাবই এসে গেছে। যাক এখন দাড়িয়ে থাকুক। সে তার কাজ একদম শেষ করেই যাবে। রুমা বিয়ে উপলক্ষে এখনো স্কুল জয়েন করেনি। যদি দেখতো শিহাব স্কুলে এমন যাওয়া আসা করছে তবে ঠিকই ধরে ফেলতো। যাক বাঁচা গেছে তাহলে। এখন শিহাব দাড়িয়ে থাকুক যতক্ষন পারে। তার আজকে আর কোনো ক্লাস নেই বিধায়ই সে স্টাডি করতে বসেছে এই লাইব্রেরিতে। এখানে নিড়িবিলি আছে। নীরার কাছে তার বাচ্চারাই বড়। তাই আধা কাজ শেষ করে সে যাবে না আজকে। পুরোটা করেই যাবে।

এদিকে শিহাব জিনিয়ার কথা শুনে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করেছে। তারপর ও নীরা আসেনি। সে ভাবলো ফোন করবে নীরাকে তবে ফোন করতে পারলো না। সে কতক্ষন বসে রইলো তারপর হাটাহাটি করলো তারপর আবার বসে রইলো। কিন্তু নীরার আসার কোনো নাম নেই। সে বাইরে উঁকি দিলো। জিনিয়াকে খুঁজলো। কিন্তু আর পেলো না। তখনকার সেই বিরক্তকর পিয়নটাকে পেলো। বাধ্য হয়ে তার কাছেই গেল শিহাব। শিহাবকে দেখেই সেই লোকটা আবারও কপাল কুঁচকালো। শিহাব বুঝতে পারছে না। তাকে দেখলেই এই লোক এতো বিরক্ত হয় কেন! সে কালো ঠিক আছে। কিন্তু সে তো অত ও অসুন্দর না। যাক এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে আবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো।

-নীরার কাজ কি শেষ হয়নি? আর কতক্ষন লাগবে?ওকে ডেকে দিন তো।

লোকটা বিরক্তমুখে জবাব দিলো।

-নীরা ম্যাম খুব স্ট্রিক্ট তাকে যেহেতু বিরক্ত করতে না করেছেন তার মানে বিরক্ত করা যাবে না। ম্যামের কাজ শেষ হলেই উনি বেড়োবেন। আপনি ওয়েট করতে না পারলে চলে যান।

এই বলেই লোকটা তার কাজে চলে গেল। শিহাবের এবার সত্যি সত্যি ইচ্ছে করলো নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। সাথে এই লোকটারও। সাথে নীরার ও। না এ কি ভাবছে সে নীরার মাথা সে কি করে ফাটাবে। ওইদিন নীরার হাতে ব্যথা দেওয়ার পর থেকেই তার হৃদয় জ্বলছে। সে রাতে ঘুমাতে পারছে না। আর মাথা ফাটানো দূরে থাক হাতে ব্যথা দেওয়ার কথাও সে ভাববে না।

শিহাব এবার অপেক্ষা করতে করতে বিশাল মাঠের এক কোণায় গেল। এদিকওদিক তাকালো। নাহ্ কেউ নেই। এতক্ষনে স্কুল ও ছুটি হয়ে গেছে। এখন সে স্মোকিং করবে। তার ভীষণ চিন্তা হলে রাগ হলে খারাপ লাগলেই সে স্মোকিং করে। পকেটে হাত দিয়ে দেখলো সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দুটোই আছে। অপেক্ষা করতে করতে রাগে দুঃখে ক্ষোভে সে খেয়াল করলো না এটা স্মোকিং করার জায়গা না। তার সামনের বিশাল বড় লেখাটাও তার চোখে পরলো না। নো স্মোকিং ইট্স এ ডেঞ্জার স্পেশালি ফর চাইল্ড। এমন একটা স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুলে স্মোকিং করার ফলে যে কি হতে পারে তার মাথায় একবারো আসলো না। সে অল্পতেই রেগে যায়। এখনো রেগে গেল নীরার ওপর। আর ভুলভাল কর্মকান্ড করতে থাকলো।

নীরা বের হলো ঠিক তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট পর। সে সেই পিয়ন লোকটাকে সামনে পেয়ে ডাক দিলো।

-জাহিদ শিহাব নামে একটা লোক এসেছিলো দেখা করতে। উনি নিশ্চয়ই চলে গেছেন। তাই না?

-না তো ম্যাম উনি তো মাঠের ওদিকটায় এখনো আছেন।

কথাটা শুনে নীরা ভয়াবহভাবে চমকে গেল। এতক্ষন পর ও শিহাব রয়ে গেছে। নীরা নিজেই ভাবতে পারেনি তার এতোটা লেট হবে। নইলে সে কখনোই অপেক্ষা করতে বলতো না। আর নীরা এটাও ভাবেনি যে শিহাব এতক্ষন অপেক্ষা করবে। সে ভেবেছিলো শিহাব চলে গেছে। স্কুল ও তো ছুটি হয়ে গেছে। মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত হলো সে। তারপর স্কুলের মাঠের দিকে পা বাড়ালো।

শিহাব একমনে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। হঠাত সামনে ফিরে দেখলো নীরা এসে দাড়িয়েছে। তার দিকে কেমন চোখে যেনো তাকিয়ে আছে। শিহাব বুঝতে পারলো না। রাগ করার কথা তো তার। তাহলে নীরা কেন এমনভাবে তাকিয়ে আছে। সামহাউ তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট অপেক্ষা করানোটা কি কম মনে হচ্ছে নীরার কাছে।

নীরা আসতে আসতে ভাবছিলো শিহাবকে স্যরি বলবে। কিন্তু এসে যা দেখলো সেটা সে বিশ্বাস করতে পারলো না। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবশ্যই স্মোকিং করা শিহাবের ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু এরকম একটা জায়গায়। যেটা স্কুল স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল। সেখানেও সে স্মোকিং করবে। শিহাবকে সে আর যাই হোক একজন গুড সোল ভেবেছিলো। তবে আজ এমন কান্ডে তার এখন কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

শিহাব এখনো ওভাবেই দাড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না কিছু। নীরা শিহাবের সামনে এগিয়ে গেল।

-আপনার হাতের সিগারেট টা কি এখন ফেলা যাবে? ওইদিকে তাকান লেখাটা পড়ুন দয়া করে।

নীরার এমন কথায় শিহাব হকচকিয়ে গেল। পেছন ঘুরে লেখাটা পরলো। নিজের ভুল বুঝতে পারলো। সে তাড়াহুড়ো করে সিগারেট নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষলো। নীরা শিহাবের পুরো কর্মকান্ড দেখলো।

-হাত দিয়ে সিগারেট টা ওঠান শিহাব। তারপর ডাস্টবিনে ফেলুন। এটা আপনার পার্সোনাল কোনো প্রপার্টি না যে এখানে এসে আপনি সিগারেট খাবেন। এটা আমাদের স্কুল। বিশেষ করে এটা স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল। এতটুকু কথা আপনার মনে রাখা উচিত ছিলো। আপনার পেছনে ও বড় করে সতর্কবাণী লেখা। কেউ এখানে স্মোক করে না। সবার ভেতরে মানবতা আছে। আপনার দেখছি সেটাও নেই। আপনি জানেন না এটা কতোটা ক্ষতিকর?

নীরার এমন ভয়াবহ অপমানে শিহাব খুব আহত হলো। সে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। নীরার কথাগুলো তীরের মতো বুকে বিঁধেছে। তবে সে এর পরিপেক্ষিতে কিছু বলতে পারবে না। সে চুপচাপ ডাস্টবিনে সিগারেট ফেললো। নীরা এখনো চোখমুখ শক্ত করে আছে। শিহাবকে কিছু না বলেই হাটতে থাকলো সে। শিহাব ও কোনো উপায় না পেয়ে নীরার পেছনে হাটতে থাকলো। স্কুলের গেটের বাইরে আসলো দুজনই।

-আপনি আর কখনো আমাদের স্কুলে আসবেন না। আমি চাই না আপনার জন্য আমাদের বাচ্চাদের ক্ষতি হোক।

নীরার এই কথা শুনে এবার আর শিহাব চুপ করে থাকতে পারলো না। সে শক্ত গলায় বললো।

-তুমি এটা বলতে পারো না নীরা। একে তো একটা মানুষকে তিনঘন্টা দাড় করিয়ে রেখেছো। রাগেই আমি এমন একটা কাজ করে ফেলেছি। তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারো না। আমার মানবতা যথেষ্ট আছে।

-ও তাই? আপনার রাগ আপনার কাছে এতোই জরুরি যে আপনি রাগের মাথায় এমন একটা জায়গায় স্মোকিং করে ফেললেন? রাগে দেখলেন ও না যে সেখানে বড় করে এলার্ট করা হয়েছিলো। আপনি জানেন না এটা কতোটা সেনসিটিভ জায়গা? সবসময় নিজের রাগকে বড় করে দেখলে চলে না শিহাব। আপনার রাগের কারনে অপরজনের ক্ষতিও হতে পারে। সেটা মাথায় রাখবেন।

এরপর নিজের সাফাই গাওয়ার জন্য আর কিছু বলা চলে না। তবুও তাকে দাড় করিয়ে রাখার বিষয়টা বাদ দিতে পারলো না শিহাব।

-তুমি যে একটা মানুষকে এতক্ষন দাড় করিয়ে রাখলে তার বেলায়? তখন তোমার মনে হয়নি কাজ পরেও করা যেতে পারে।

-না মনে হয়নি। আপনাকে আমি দাড়িয়ে থাকতে বলিনি। জাহিদ আর জিনিয়া নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে আমার কাজ শেষ হলেই আমি বের হবো তার আগে নয়। তারপর ও যখন দেখলেন আমি বের হচ্ছি না আপনার চলে যাওয়া উচিত ছিলো। আপনাকে আমি থাকতে বলিনি। আমি ফিফটিন মিনিট্স ওয়েট করতে বলেছিলাম। আপনার তারপরেই বোঝা উচিত ছিলো আমার দেরি হবে। আর রইলো কাজ পরেও করা যেতো কিনা। না কখনোই না। এক্ষেত্রে আমার কাছে আমার বাচ্চারাই ফার্স্ট প্রাইয়োরিটি।

নীরার কথার বাণে শিহাব খেই হারিয়ে ফেললো। নীরার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ে যে এতোটা রেগে যেতে পারে তা কখনো ভাবেনি শিহাব। শিহাব আরো গম্ভীর হয়ে গেল। আজকে যেই কথাগুলো নীরা তাকে শুনিয়েছে তা সে কিছুতেই হজম করতে পারছে না। না চাইতেও নীরার ওপর রাগ জন্মালো তার।

-আপনি কিছু বলবেন? আমিই আপনার সাথে দেখা করতাম। আপনার সাথে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করার ছিলো। আপনি স্কুলে আসবেন না। আমি আপনার সাথে আগামীকাল দেখা করবো আপনার সমস্যা আছে?

যেই জন্য যার জন্য শিহাব তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট অপেক্ষা করলো সেই বলছে কাল দেখা করবে। রাগে ক্ষোভে কিছু বলতে পারলো না শিহাব। এবার আর রাগ প্রকাশ ও করতে পারলো না। কারন ইতিমধ্যে নীরা তাকে এটা নিয়েও কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সে শুধু বললো

-আচ্ছা!

-আমি আপনাকে সময় আর স্থান টেক্সট করে বলে দিবো।

অতঃপর নীরা একটা রিকশা ডেকে তার সামনে দিয়েই চলে গেল। শিহাব দাড়িয়ে রইলো তিন ঘন্টা পনেরো মিনিটের অপেক্ষার অবসান এভাবে ঘটবে ভাবেনি সে।

–চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here