পর্ব তেত্রিশ এতো বড় লেখা হওয়ার জন্য অনেকেই ফেসবুক লাইট দিয়ে পড়তে পারছে না। সেজন্য লেখাটা দুই ভাগে ভাগ করে পোস্ট করলাম।
#অপূর্ব প্রাপ্তি। পর্ব ৩৩
#নাফিসা নীলয়া!
শিহাবের একগুঁয়ে জেদের কাছে নীরা কিছুই বলতে পারলো না। সে জানতো শিহাব এরকমই একরোখা,জেদী। তবে এতোটা সেটা জানতো না। তবে তবুও তার মন খুঁতখুঁত করছে। ভালো লাগছে না। শপিং খাওয়া দাওয়া শেষে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলে সবাই যে যার বাসায় চলে গেল। নীরা বাড়িতে এসে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলো চুপচাপ।
রেজাউল নীরার ঘরের সামনে এসে দাড়ালেন। নীরা চলে যাবে ভেবেই তার কষ্ট হচ্ছে। পরশুই নীরার বিয়ে। এই মেয়েটার জন্য মনে এতো ভালোবাসা ছিলো সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি। অন্তর পুড়ে যাচ্ছে নিজের মেয়ের জন্য। নীরার ঘরে ঢুকে কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছেন না। দোনামোনা করতে করতে তিনি নীরার ঘরে ঢুকেই পরলেন। কাশি দিয়ে আওয়াজ করলেন। নীরা টের পেয়ে উঠে বসলো। তার বাবাকে দেখে অবাক হলো এবং সেইসাথে খুশিও হলো। রেজাউল বললেন
-বিরক্ত করলাম তোমাকে?
নীরা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো।
-একদম না। বসো তো আব্বা।
রেজাউল যথেষ্ট দুরত্ব রেখে বসলেন। রেজাউল সবসময় নীরাকে অবহেলা করলেও নীরার আচরণে মনে হতো যে রেজাউল নীরাকে খুব ভালোবাসেন। যেমন এখনো সেরকমই আচরণই করছে। রেজাউল বারবার ক্ষমা চাইতে চান নীরার কাছে তবে পারেন না। কোথাও যেনো বাঁধা পান। নীরাও বোঝে তবে সে ও কিছু বলে না। রেজাউল চুপচাপ বসে ছিলেন। নীরা হুট করে নিজেই এগিয়ে এসে রেজাউলের কোলে মাথা রাখলো। রেজাউল চমকে গেলেন। বুকটা ধ্বক করে উঠলো অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি ঝরলো। নীরা রেজাউলের কোলে শুয়েই বললো।
-তুমি এখনো আমার থেকে দূরে দূরে থাকো কেন আব্বা? এখন তো আগের মতো নেই তুমি। আমি জানি তুমি কষ্ট পাও,তুমি খুবই অনুতপ্ত। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কাছে তোমার ক্ষমা চাইতে হবে না। নিজেকে আর শাস্তি দিয়ো না। অনুতাপের আগুনে পোড়ার চেয়ে আর বড় কোনো শাস্তি হয় না। আর কষ্ট পেয়ো না আব্বা। আমি তোমার আচরণে কষ্ট পেতাম ঠিক। তবে যখন থেকে দেখলাম তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো৷ আমাকে শক্ত রাখার জন্যও নিজে কাছে এসে স্নেহ করোনি তখন থেকে আর কষ্ট পাই না। তুমি আর আম্মা আমার দুনিয়ার অর্ধেক। আমি কি করে তোমার ওপর নিরাশ হয়ে থাকি বলো!
নীরার কথা শুনে রেজাউল স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। বহু কষ্টেও কথা বের করতে পারছেন না। শুধু চোখে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। নীরা আবার বললো।
-মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো আব্বা।
রেজাউল চুপচাপ তাই ই করলেন। নীরা চোখ বুঝে বাবার স্নেহ অনুভব করছে। বহু বছরের পিপাসা আজ মিটছে। খানিকক্ষন পর রেজাউল কাঁপা স্বরে বললেন।
-আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।
নীরা রেজাউলের কথা শুনে আরো কোল ঘেসে রইলো।
-আমাকে শুধু এখন থেকে অনেক অনেক ভালোবাসো। অনেক অনেক স্নেহ করো তাতেই হবে আব্বা। আমি আর কিছু চাই না। তোমার আর ক্ষমা চাইতে হবে না।
রেজাউল আর কিছু না বলে নীরার মাথায় হাত বুলিয়েই দিয়ে গেলেন। খানিকক্ষন পর নীরা বললো।
-আজকে আমি তোমার কোলেই ঘুমাবো আব্বা। কিছু বলতে পারবে না কিন্তু।
রেজাউল কাঁপা স্বরে বললেন।
-অবশ্যই মা,আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ছেড়ে। আমার ছোট্ট মেয়েটা কতোটা বড় হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তোমাকে বুকের মধ্যেই রেখে দেই। আর যেতে না দেই।
নীরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো।
-কে চায় যেতে। আমাকে রেখে দাও তোমার কাছে। আমি যেতে চাই না কোথাও।
রেজাউল হেসে ফেললেন মেয়ের কথা শুনে। বললেন।
-পাগলী মেয়ে আমার।
দরজার সামনে দাড়িয়ে বাবা-মেয়ের মধুর ভালোবাসা দেখছেন মালিহা আর তারও চোখে পানি চিকচিক করছে। শুধু একটাই আফসোস এই ভালোবাসা কেন আগে উপলব্ধি করা হলো না।
মিলা আজকে নীরার কাছে শুতে চাইছিলো। তার আপা চলে যাবে ভেবেই তার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেজন্য সে নীরার সাথে ঘুমাতে এসেছিলো। এসে দেখলো মালিহা দরজায় দাড়িয়ে কাঁদছেন। মিলা অবাক হয়ে কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু তার আগেই ভেতরের দৃশ্য তার চোখে পরলে সে ব্যপারটা বুঝতে পারলো। তারও কান্না পেলো। সে একদম কেঁদেই ফেললো। মালিহা আওয়াজ শুনে পিছে ফিরে দেখলেন মিলা কাঁদছে। তিনি মিলাকে চুপ করতে বললেন। মিলা চুপ না করেই ঘরে ঢুকে গেল। মালিহাও গেলেন। মিলা কেঁদে কেঁদে রেজাউলকে বললো।।
-আপা চলে যাবে কেন আব্বা?
মিলার কান্নার আওয়াজে নীরা উঠে বসে চোখ মুছলো। রেজাউলও চোখ মুছলেন। মিলা এসে কাঁদতে কাঁদতে নীরাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-আমি কি করে থাকবো তোমাকে ছাড়া?
মালিহা বিরক্ত হলেন মিলার আচরণে। এই মেয়েটারও কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। সে আছে নিজের চিন্তায়। মালিহা একটু ধমকে বললেন।
-রাত বিরেতে কি শুরু করলি মিলা?
নীরা মালিহাকে বললো৷।
-আম্মা ওকে বকো না তো। ও তো বোঝে না। সেজন্যই এমন করে। আর শোন আমি তো একেবারে চলে যাচ্ছি না। সবসময় আসবো। কাঁদার কিছু হয়নি বুঝেছিস?
মিলা নীরার কথা শুনে থামালো। এবং সাথে সাথেই নতুন ড্রামা শুরু করলো। রেজাউলের দিকে তাকিয়ে বললো।
-আব্বা শুধু আপাকে আদর করলে চলবে? আমার কথা কি মনে নেই তোমার?
রেজাউল হাসতে হাসতে বললেন।
-মনে থাকবে না কেন তুই তো আমার ছোট মা।
মিলা তবুও মুখ ফুলিয়ে রাখলো। রেজাউল হাত বাড়িয়ে দিলে মিলা হাসি দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর নীরার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো।
-আপা যদি আব্বাকে জড়িয়ে ধরতে চায় তাহলে আমার কোনো আপওি নেই। আপা ধরতে পারে।
মিলার কথা শুনে মালিহা,রেজাউল আর নীরা সমস্বরে হেসে ফেললো। রেজাউল নীরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে নীরা ও গিয়ে রেজাউলকে জড়িয়ে ধরলো। মালিহার চোখ জুড়িয়ে গেল বাবা-মেয়েদের এই ভালোবাসা দেখে। এতো খুশি এই জীবনে প্রথম অনুভব করলেন তিনি। মিলা আবার মজা করে বললো।
-আম্মা যদি চায় তাহলে আমাদের সাথে জয়েন করতে পারে। আমার কোনো আপওি নেই।
মিলার কথা শুনে মালিহা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন।
-দাড়া ফাজিল মেয়ে। কাল থেকে সব রান্না তোকে দিয়েই করাবো।
মালিহার এই কথা শুনে মিলা রেজাউলকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে না বলে উঠলো।
নীরা এসব দেখে হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেললো। তার চোখে আনন্দঅশ্রু। এতো শান্তি বহুদিন পর হলো।
দেখতে দেখতে রাত কেটে গেল। একটা নতুন মিষ্টি দিনের আগমন ঘটলো। সকাল সকাল তিতলি আর রেহান জহুরার সাথে হলুদের আয়োজন করছে। শিহাব হলুদও করতে চায়নি। কিন্তু তিতলি আর রেহান ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে রাজি করিয়েছে। রেজা সাহেব ও হাসিখুশি সব দেখভাল করছেন। অবশেষে ছেলের মুখে তিনি খুশির ছাপ দেখতে পারছেন। এতোদিন শিহাব মুখে হাসি ধরে রাখলেও সেটা মনের হাসি ছিলো না। কিন্তু আজকে যেই হাসিটা সে হাসছে তা হলো প্রশান্তির হাসি। ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার হাসি। তিনি নিজে ভালোবেসে ঠকেছেন। কিন্তু শিহাব যাকে ভালোবেসেছে তাকে ভালোবেসে ঠকার প্রশ্নই আসে না। নীরার মতো কেউই শিহাবের খেয়াল রাখতে পারবে না। নীরাই শিহাবের জন্য বেস্ট। সেটা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন।
তিতলি কাজ করতে করতো রেহানকে বললো।
-ভাবির বাসায় গেলে কেমন হয়? ভাবিকেও না হয় হলুদ দিয়ে আসলাম।
তিতলির কথা শুনে রেহান বললো।
-কিন্তু ভাবিরা তো আয়োজন করেনি।
তিতলি রেহানকে গাট্টা দিয়ে বললো।
-রুমা আপু,আর মিলা আপুর সাথে কথা হয়েছে আমার। ওরা সব ছোটখাটো আয়োজন করবে ভাবিকে লুকিয়ে। কারন ভাবি জানলে রাজি হতো না। আর ভাবিকে একটা সারপ্রাইজও দেওয়া হবে।
রেহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো।
-কই আমি তো জানতাম না।
-এখন তো জানলি। এবার চল বকবক না করে।
-চল পেত্নী।
তিতলি রেগে গিয়ে রেহানের চুল টেনে বললো।
-আজ ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এরপরে আর ছেড়ে দিবো না।
বলেই তিতলি চলে গেল। রেহান ও বিড়িবিড় করে বকতে বকতে তিতলির পিছে গেল।
সন্ধ্যার দিকে দেখা গেল মিলা,রুমা, আর সাইফ এসে গেল শিহাবকে হলুদ মাখিয়ে দিতে। শিহাব ভেবেছিলো কোনোরকমে হলুদ দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। মিলা আর তিতলি মিলে শিহাবকে জোর করলো পাঞ্জাবি পরতে । শিহাব বাধ্য হয়ে তাই সি গ্রীন কালারের পাঞ্জাবি পরলো। তারপর সবাই মিলে শিহাবকে টেনে বসালো। শিহাবের ওপর হলুদের বর্ষন সৃষ্টি করলো। জহুরা ও বাদ গেলেন না। শিহাব প্রথমে থতমত খেয়ে বসে রইলো। তারপর জহুরার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো জহুরা হাসলেন শিহাবের অবস্থা দেখে। শিহাব ভাবতেই পারছে না তার সাথে এসবও হতে পারে।
মিলা হাসতে হাসতে বললো।
-ভাইয়া একদম আপার মতো। এখান থেকে গিয়ে যখন আপাকে এভাবে হলুদ মাখাবো তখন আপারও এমনই রিয়্যাক্সন হবে।
সাইফ হাসতে হাসতে বললো।
-না বাবা না আমি নীরাকে হলুদ দিয়ে ভূত বানাতে পারবো না। নইলে আমার হাড্ডি আজ একটাও আস্ত থাকবে না।
সবাই হাসাহাসি করে শিহাবকে হলুদ মাখালো। রেজা সাহেবও হাসছেন ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে।
রেহান এই ফাঁকে সুযোগ খুঁজছিলো মিলাকে জব্দ করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই পারলো না। তারপর ভাবলো ওই বাড়িতে গিয়ে সে ইচ্ছেমতো মিলাকে মজা চাখাবে আজ।
মিলা, সাইফ আর রুমা তাড়াহুড়োয় এসেছিলো শিহাবকে হলুদ মাখাতে। ওরা নীরাকে জানিয়ে আসেনি। নীরাকে নূরজাহান বেগমের কাছে ছেড়ে এসেছে। নূরজাহান বেগম আর মালিহা অনেকখন জোর করছেন নীরাকে শাড়ি পরাতে। কিন্তু নীরা বলেছে পরবে না। সে জানতোও না যে তার হলুদ হবে। নূরজাহান বেগম যখন তার ঘরে এসে বললেন হলুদ শাড়ি পরে নিতে। তখন সে অবাক হয়ে গেল। হচ্ছে টা কি এমন তো কোনো কথা ছিলো না। সে মালিহাকে বললো।
-আম্মা এমন তো কথা ছিলো না। হলুদের জন্য তো কিছু কেনাও হয়নি৷ তাহলে কিভাবে কি! আম্মা জানো তো আমি শাড়ি পরতে পারি না তবুও।
মালিহা বুঝলেন মেয়েকে। তিনি বললেন।
-আচ্ছা তাহলে হলুদ সালোয়ার কামিজ কিনে রেখেছে মিলা তোর জন্য। ওটা পর।
নীরা মালিহার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। বললো।
-মানে? আমার পিঠপিছে এতোকিছু আর আমিই জানি না।
এবার নূরজাহান বেগম রাগ হয়ে বললেন।
-বাঙালি মেয়ে তুই। আর তোর বিয়েতে কিনা হলুদ হবে না। আমি আদেশ করছি নীরা তুই এখনই হলুদ সালোয়ার কামিজ পরবি। আর এখনই তৈরি হবি। শাড়ি বাদ তুই ওটা পরেই হলুদ দিবি। তাও দিবি। এটাই আমার শেষ কথা।
নূরজাহান বেগমের ধমক শুনে নীরা আর কিছু বলতে পারলো না। সে কাঁচা হলুদ আর সাদা রঙের মিশেলের সালোয়ার কামিজ পরে আসলো। নূরজাহান বেগম আর মালিহা নীরাকে দেখে হাসলেন। মালিহা এসে নিজ হাতে নীরার চুল খোপা করে দিলেন। চোখে কাজল দিয়ে দিলেন। মাথায় সুন্দর করে হলুদ ওড়না দিয়ে দিলেন। নীরা খুশি হলো তার আম্মা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে বলে।
রেজাউল ঘরে ঢুকে নীরাকে দেখে খুশি হলেন। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন।
-রুমা ফোন করেছিলো। তিতলি আর রেহানও ওদের সাথে এখনই আসছে নীরাকে হলুদ দেওয়ার জন্য।
নীরা অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে আজ। তার পিঠপিছে যে আজ কতো কি হয়ে যাচ্ছে! সব কয়টা প্ল্যানিং করেই তাহলে মাঠে নেমেছে।
শিহাবকে হলুদ দেওয়া শেষ হলে সবাই মিলে নীরাদের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শিহাব ভেবেছিলো সে ও যাবে। কিন্তু পরে চিন্তাটা বাদ দিলো। এটা তো একদমই ঠিক হবে না। এমনিতেই সে যা যা করেছে সেগুলো তার চরিএের সাথে একদম যায় না। আর সবার সামনে এভাবে গেলে নীরা তাকে একদম চিঁবিয়ে খাবে।
মিলা,তিতলি,রেহান সাইফ আর রুমা বেড়িয়ে গেল। শিহাব দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলো কেউ একটু সাধলোও না! সাধলেও তো হতো। এসব ভেবেই তার রাগ লাগলো। সে রেগে ঘরে চলে গেল।
নীরা মুখ গোমড়া করে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। মালিহা তাকে জোর করে বসিয়ে রেখেছেন। তার এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। বোর হয়ে যাচ্ছিলো সে। এ কি হচ্ছে সে যা চাইছিলো না তাই ই হচ্ছে। কিন্তু নীরা বেশি কিছুও বলতে পারলো না। সবারও তো একটা শখ ছিলো ওদের বিয়ে নিয়ে। সবাই আনন্দ করুক নীরা এটাই চাইছে। তাই আর বেশি কিছু বলা হলো না তার। নীরা এসব চিন্তা করতে করতেই সবাই হাজির হয়ে পরলো। মিলা,তিতলি,রেহান,সাইফ আর রুমা হইহই করতে করতে আসলো। সবাই এসে নীরাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে প্রচন্ড খুশি হলো। নীরা চাইলেও আর রাগ করে থাকতে পারলো না। সবার হাসিখুশি মুখ দেখে তারও খুব ভালো লাগলো। মিলা নীরার কাছে এসে বললো।
-স্যরি আপা সব প্ল্যান করাই ছিলো। কিন্তু তোদের দুজনের কথা অনুযায়ী খুব বেশি হইহুল্লোড় কিন্তু না। আমরা আমরাই। দেখ সবাই আমরা ম্যাচিং ম্যাচিং পরেছি আজ।
নীরা সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো মিলা,তিতলি রুমা হলুদ সাদার শাড়ি পরেছে। রেহান আর সাইফ পরেছে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি।
নীরা সবাইকে পর্যবেক্ষন করে হাসলো। নীরার হাসি দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সব আয়োজন শেষে নূরজাহান বেগম,মালিহা,রেজাউল আগে নীরাকে হলুদ মাখালেন। তারপর সাইফ আর রুমা মাখালো। সাইফ হাতে মুঠো করে হলুদ নিয়ে নীরাকে মাখাতে চাইছিলো। কিন্তু নীরা চোখ গরম করে তাকালে সেই চিন্তা বাদ দিলো।
রুমা সেটা দেখে হাসতে হাসতে বললো।
-আহ্ জীবন ধন্য। এট লিস্ট নীরাকে তো ভয় পায় সাইফ।
রুমার কথা শুনে সাইফ রুমার দিকে তেড়ে গেল। মিলা নীরার গালে কপালে হলুদ মাখাতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। নীরা মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো। তা দেখে রেহান বললো।
-একটা বালতি টিলা বেয়াইনের চোখের সামনে রাখলে পুরো বালতিই ভরে উঠবে।
এই কথা শুনে মিলা তেড়ে গেল রেহানের দিকে। রেহানও সুযোগ ছাড়লো না। মিলাকে ইচ্ছে মতো হলুদ মাখিয়ে দিলো। মিলাও রেহানকে ভূত বানিয়ে ছাড়লো।
তিতলি নীরার কাছে বসে বললো।
-থ্যাংক ইউ ভাবি আমাদের জীবনে আসার জন্য।
নীরা মিষ্টি হেসে তিতলিকে জড়িয়ে ধরলো। বিয়ে উপলক্ষে নীরাদের কাছের আত্নীয়রাও এসেছেন। তারাও হলুদ দিলেন। এভাবেই হইহই করে সবাই হলুদ দেওয়া শেষ করলো। রেহান আর তিতলি খেয়েদেয়ে বিদায় নিলো।
রাত হলে মিলা,রুমা আর নীরার গুটিকয়েক কাজিন মিলে মেহেদী দিতে বসলো। নীরা মিলা আর রুমাসহ কয়েকজনকে নিজেই দিয়ে দিলো। আর নীরার ডান হাতে মিলা মেহেদী দিয়ে দিলো। বাম হাতে দিয়ে দিলো রুমা। সবার যন্ত্রনায় নীরার ফ্রেশ হওয়াও হলো না। মেহেদী দিতে দিতে সারাদিনের হইহুল্লোড়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরলো।
মালিহা ডাকতে এসে দেখলেন নীরা মেহেদী হাতে বারান্দায় একা বসে আছে। তিনি বিড়বিড়ি করতে করতে নীরার কাছে গেলেন।
-তোকে ফ্রেশও হতে দেয়নি? এতোক্ষন কি করছিলো এরা?
নীরা হাসতে হাসতে বললো।
-পাগলিদের আমিই আগে দিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নিজে দিবো না। কিন্তু শেষমেষ ওরা ছাড়লো না।
-আচ্ছা এবার তো চল ফ্রেশ হয়ে নে গিজার অন করে নিস। নইলে ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসবি। নইলে চল আমিই সাহায্য করছি।
নীরা দেখলো সারাদিনের পরিশ্রমে মালিহার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। তাই সে আর তার আম্মাকে বিরক্ত করতে চাইলো না। বললো।
-আমিই পারবো। মেহেদী শুকিয়ে গেছে। তুমি যাও। সারাদিন অনেক কাজ করেছো।
-আরে চল আমি একদম ক্লান্ত নই। চল তো।
নীরা এবার কপট রাগ দেখালো।
-আম্মা তোমাকে যেতে বলেছি আমি। গিয়ে চুপচাপ ঘুমাও। যাও।
নীরার কথা শুনে মালিহা বললেন।
-ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। তুইও এখনই যা।
নীরা মিষ্টি হাসলো। মালিহাও নীরার কপালে চুমু দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
নীরা বারান্দা থেকে ঘরে চলে আসলো। ফোন চার্জে ছিলো। সে ফোন নিয়ে সময় দেখলো। রাত দেড়টা বাজে। আর সে এখনো সেভাবেই আছে। ভেবেই মাথা চক্কর দিলো। গায়ে হলুদের প্রচুর গন্ধ। মুখটা ধুয়ে নিলেও হলুদ রয়েই গেছে। তার বারান্দাতে এতো সময় কাটানো ঠিক হয়নি। মেহেদী না শুকিয়েই ফ্রেশ হওয়া উচিত ছিলো। ভাবলো নীরা। বিছানায় তাকিয়ে দেখলো মিলা আর রুমা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ওদের কান্ড দেখে হাসলো সে। তারপর দুজনের গায়ে ভালোভাবে কাঁথা টেনে দিয়ে জামা কাপড় বের করলো ওয়্যারড্রব থেকে। তখনই নীরার ফোন বেজে উঠলো। সে বিরক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলো। মিলা আর রুমার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওদের কোনো হেলদোল নেই। ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নীরা।
তারপর দেখলো শিহাব ফোন করেছে। সারাদিনে শিহাবের সাথে নীরার কথা হয়নি। তাই নীরাও আর ফোন কাটলো না। ফোন কানে নিয়ে বললো।
-বলো।
-বারান্দায় আসো তো।
-কেন?
– আচ্ছা থাক। তুমি এক কাজ করো। সেদিনের মতো বাইরে এসো। ওইযে কয়েকমাস আগে এসেছিলে না? সেভাবেই এসো।
-কিহ্!
নীরা হতভম্ব হয়ে বারান্দাতে গিয়ে দেখলো শিহাব বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোতে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে অবাক হয়েই বললো।
-মানে সিরিয়াসলি? আমাদের না কালকে বিয়ে? মানে সত্যিই? এসব কান্ড থেকে কি তুমি কখনো বিরত থাকবে না?
শিহাব হাসতে হাসতে বললো।
-কখনো না।
-দেখো তুমি তো জানো আমার পায়ে সমস্যা। আর আজকে ব্যথাও করছে। আসতে পারবো না। আর বাড়িতে সবাই আছে রিলেটিভ আত্মীয় কম ও না। কি ভাববে! তুমি চলে যাও।
নীরার পায়ে ব্যথা শুনে শিহাব অস্থির হয়ে পরলো।
-কিহ্! পায়ে ব্যথা মানে? এমন সেনসিটিভ একটা বিষয়। আর তুমি এখন বলছো। আমি আসছি ওয়েট। তারপর আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো। দাড়াও তুমি।
নীরার এখন দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে। সে তো জানতো শিহাব একটা ঘাড়াত্যাড়া পাগল। তাও সে কেন বললো এটা। নীরা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো।
-শিহাব আমার পা জন্ম থেকেই এমন। বেশি ব্যথা করছে না। আজকে বেশি হাটাহাটি করেছি বলে এমন হয়েছে। তুমি যাও।
-আমি আসছি তুমি দাড়াও। কোনো কথা শুনবো না।
নীরা দেখলো শিহাব সত্যি সত্যিই আসছে। সে এবার একটু জোরে বললো।
-না,আচ্ছা দাড়াও দুই মিনিট দাড়াও। আমি লিফ্ট ইউজ করছি। পায়ে বেশি ব্যথা নেই। ওখানেই দাড়াও তুমি।
শিহাব আর কোনো কথা না বলেই চুপচাপ দাড়ালো। নীরা আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসলো। কখনো কি সে ভেবেছিলো শিহাবের মতো একটা ঘাড়ত্যাড়ার পাল্লায় পরে তার এই দিনও দেখতে হবে। নীরা চারদিকে তাকাতে তাকাতে আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে আসলো। নীরা বের হওয়ার সময় দেখলো দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে একটু ভয় পেয়ে গেল। দারোয়ান অমায়িক হেসে বললেন।
-চিন্তা করো না। শিহাবের সাথে আমার কথা হয়েছে। ও কিছুক্ষন আমার সাথে গল্প করেই ওদিকে গিয়ে তোমাকে ফোন করেছে।
নীরা একটু লজ্জা পেলো। তারপর হেসে বললো।
-ধন্যবাদ চাচা।
দারোয়ান চাচাও হাসলেন
নীরা গেটের বাইরে আসার পর শিহাব দ্রুত হেটে নীরার কাছে আসলো। তারপর হাত ধরে বললো।
-চলো।
নীরা হতভম্ব হয়ে বললো।
-কোথায়?
-ডাক্তারের কাছে চলো।
নীরা নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে বললো।
-আর ইউ ম্যাড??রাত দেড়টা বাজে আমি এখন ডাক্তারের কাছে যাবো?
শিহাব বললো।
-অবশ্যই দ্রুত চলো। কাছের হসপিটালটাতেই যাবো।
নীরা হতাশ হয়ে বললো।
-আমি মিথ্যে বলেছি শিহাব। আই এম ওকে। আমার পায়ে ব্যথা করছে না। তোমাকে চলে যাওয়ার জন্য বলেছিলাম।
শিহাব নীরার দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হুট করে নীরার পায়ের কাছে বসে নীরার পায়ে হাত দিতে ধরলো। নীরা যথাসম্ভব ছিটকে গিয়ে বললো।
-তুমি আসলেই পাগল হয়ে গেছো শিহাব। উঠো। আমার পায়ে ব্যথা নেই। সত্যিই নেই। দয়া করে পাগলামি করো না।
নীরার কথা শুনে শিহাব উঠে দাড়ালো। তারপর বললো।
-সত্যি?
-তিন সত্যি। হে আল্লাহ্ এই ঘাড়ত্যাড়া পাগল স্বামীই জুটবে আমার কপালে!
নীরার আফসোস করা দেখে শিহাব হেসে ফেললো। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকালো। এতোক্ষন নীরার পায়ে ব্যথা শুনে সে তাকানোর সুযোগ পায়নি। আর এখন সুযোগ পেয়ে চোখ সরাতে পারছে না। নীরার গায়ে এখনো হলুদ হালকা রয়ে গেছে। হলুদ সাদার সালোয়ার কামিজ ও বদলানো হয়নি। মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া। চোখের কাজল ঘেটে গেছে। শিহাব মুগ্ধ হয়ে দেখলো। এভাবে তাকানোতে নীরার অস্বস্তি লাগলো। সে শিহাবকে বললো।
-আমি ফ্রেস হইনি। দয়া করে এখন যাই। প্লিজ।
নীরার কথা শুনে শিহাবের ঘোর কাটলো। সে বলে উঠলো।
-তোমাকেই দেখতে এসেছিলাম। তোমাকে দেখা কখনো শেষ হবে না যদিও। কিন্তু যেতে তো হবে।
শিহাবের এমন কথা শুনে নীরা কিছু বললো না। শিহাবই আবার বললো।
-ফাইনালি কাল আমাদের বিয়ে। স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আমার অমূল্য রত্নকে আমি আমার করে পাবো আজীবনের জন্য।
নীরা লাজুক হেসে বললো।
-হুম এবার যাই?
শিহাব নীরার হাত ধরলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাতের মেহেদী উঠিয়ে ফেললো। তারপর শিউলি ফুলের মালা বের করে নীরার হাতে পেঁচিয়ে হাসতে হাসতে বললো।
-কষ্ট কমিয়ে দিলাম। এবার যাও।
নীরার মালাটার দিকে তাকিয়ে অজান্তেই চোখ থেকে এক ফোটা পানি পরলো। সে ও হাসতে হাসতে বললো।
-অনেক ধন্যবাদ মাই ডিয়ার হাজবেন্ড।
শিহাব একটু অবাক হলেও বললো।
-মাই প্লেজার। শোনো এখন গিয়ে ফ্রেস হয়েই ঘুমিয়ে পরবে। আর খেয়েছিলে?
-খেয়েছি। তুমি?
-খেয়েছি।
-আচ্ছা এবার যাই।
শিহাব হেসে নীরাকে বিদায় দিলো। নীরা ভেতরে চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষন দাড়ালো। তারপর চলে গেল। নীরা ঘরে চুপিচুপি ঢুকে দেখলো কেউ টের পায়নি। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর ফ্রেস হয়ে শুয়ে পরলো।
চলবে