#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ৪৮
#নাফিসা নীলয়া!
আসমা তিশাকে সুস্থ দেখে খুশিতে কেঁদে ফেললেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকবার ক্ষমা চাইলেন। তিশা তখন বললো।
-অন্যায় যা করার আমি করেছি মা। তুমি বরং আমাকে সত্যিটা বুঝিয়েছো। আমাকে বারবার বুঝিয়েছো তবু লাভ হয়নি। যা করেছি নিজে করেছি। সম্পূর্ণ নিজের দোষে সব হয়েছে। তুমি আর নিজেকে কষ্ট দিও না।
তিশার কথা শুনে আসমা শান্ত হলেন। তিশার বাবাও মেয়েকে সুস্থ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে যে তার অনেক আদরের। মেয়েকে সুস্থ দেখে তার প্রাণ যেনো ফিরে এলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেন তিনি।
সবাই একে একে তিশার সাথে কথা বললো। জায়মাও নিজেকে দুষছিলেন। তিশা ওনাকেও বুঝিয়ে বলেছে। সবশেষে আসাদ দেখা করতে এলে তিশা আসাদের দিকে তাকালো। একদিনেই চোখমুখের হাল বেহাল করে ফেলেছে আসাদ। আসাদকে দেখে তিশার খুব কষ্ট হলো। আসাদ তিশাকে জিজ্ঞেস করলো।
-এখন কেমন আছো?
তিশা আসাদের দিকে তাকিয়ে বললো।
-এখন তো ভালো আছি। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন?
আসাদ এর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। নীরা এরমধ্যে এসে পরলে ওরা আর কথা বললো না। নীরা ওদের একসাথে দেখে বললো।
-কথা বলো। আমি আসছি।
তিশা নীরাকে বারন করলো।
-না আপা তেমন কিছু বলছিলাম না। তুমি শিহাব ভাইকে ডেকে দিবে? ওর কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া হয়নি। আসলে কোনমুখে ওর সামনে দাড়াবো সেটা নিয়েও আমি খুবই কষ্টে আছি। আচ্ছা শিহাব ভাই আমাকে ক্ষমা করবে তো? তুমি কি ওকে বোঝাবে?
নীরা তিশার কথা শুনে বললো।
-অবশ্যই করবে। তবে এখন তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আগে তুমি সুস্থ হও। তারপর সবকিছু ভাবা যাবে।
নীরার কথায় আসাদও সায় দিলো।
-নীরা একদম ঠিক বলেছে। আগে সুস্থ হও তারপর সব ভাববো আমরা।
তিশা আর কিছু বললো না।
নীরা ওদের কথা বলতে বলে বেড়িয়ে আসলো। বাইরে এসে শিহাবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।
-দেখা করতে গেলে না?
শিহাব একটু ভেবে বললো।
-পরে দেখা করবো।
নীরা শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো।
-ও সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তোমার কাছে ক্ষমাও চাইবে।
শিহাব মুখে বললো।
-হু বুঝেছি। তুমি এখন বাসায় চলো। অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছো। আর এখানে থাকতে হবে না।
নীরা শিহাবকে বললো।
– আচ্ছা চলো।
শিহাব আর নীরা একসাথে হেটে হসপিটালের বাইরে গেল। গাড়িতে ওঠার পর নীরা শিহাবকে বললো।
-এখনো তোমার মনে কোনো প্ল্যানিং থাকলে সেটা বাদ দাও। কারন তিশা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
নীরার কথা শুনে শিহাব বিষম খেলো। নীরা দ্রুত শিহাবকে পানি দিলো। শিহাব পানি খেয়ে নীরার দিকে অবাক চোখে তাকালো। নীরা শিহাবের চাহনি দেখে বললো।
-এতোদিন যাবত একসাথে সংসার করছি। আর আমার স্বামীর স্বভাব জানবো না? সে কখন কি করতে পারে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি তাকে চিনি। তিশার ওই সামান্য কান্ডের পর তুমি যে মুখে বললেও ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে না তা আমি জানি।
শিহাব আবার নিজের আগের রূপে ফিরে গেল। গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বললো।
-তারমানে একসাথে শুধু সংসার করেই চিনেছো?
নীরা ভ্রু কুুঁচকে বললো।
-মানে?
শিহাব নীরার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বললো।
-আমাকে ভালোবেসে চেনোনি?
নীরা সেকথার জবাব দিতে চাইলো না। কিছু কথার জবাব সবসময় দিতে নেই। সে তবুও বললো।
-তোমার কি মনে হয়?
শিহাব আগের গলাতেই বললো।
-বাদ দেই।
নীরা একটু হেসে শিহাবের গালে আলতো হাতে ছুঁয়ে বললো।
-তুমি কি এতোই বোকা নাকি বোকা হওয়ার অভিনয় করো? সবকিছু প্রকাশ করতে হবে কেন?
নীরার কথা শুনে শিহাবের মুখেও তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। সে আলগোছে তার এক হাত দিয়ে নীরার হাত মুঠোবন্দি করলো।
তিশা মোটামোটি সুস্থ হলে তাকে কয়েকদিন পরে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দেয়া হলো। তারপর তিশা নিজের বাবা-মায়ের সাথেই থাকতে শুরু করেছে। নিয়ম করে সবকিছু করার চেষ্টা করছে। আগে সে পরিবারকে সময় দিতো না। নিজের মতো থাকতো। পরিবার যে কতো বড় নেয়ামত সে তখন বুঝতো না। একা থাকতে গিয়ে যখন একাকীত্ব অনুভব করলো তখন বুঝতে পারলো। তাই এখন সে তার সমস্ত সময় পরিবারকে দিচ্ছে। বাবা-মায়ের সাথে গল্প করা ছোট ভাইয়ের সাথে খুনসুটি বন্ধুদের সাথে আড্ডা এভাবেই তার দিন যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে নীরার স্কুলে গিয়ে নীরার সাথেও সে দেখা করে আসে। তবে শিহাবকে সে এখনো স্যরি বলতে পারেনি হিজিটেশনের জন্য। আবার আসাদকে নিয়েও সে অনেক ভাবে। আসাদের সাথেও রেগুলার যোগাযোগ হয়। কিন্তু তাদের সম্পর্কটাকে কোনো পরিনাম তারা এখনো দিতে পারছে না। শুধু বন্ধুত্বর নাম দিয়েই রেখেছে।
তিতলি কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবে ড্রঢিংরুমে বসেছে। তখনই বেল বেজে উঠলো। তিতলি গিয়ে দরজা খুলে দেখলো ডেলিভারিম্যান পার্সেল নিয়ে দাড়িয়ে। সে পার্সেল রিসিভ করলো। প্রায়ই তার নামে পার্সেল আসা শুরু করেছে। বাড়িতে এখনো বিষয়টা সে আর জহুরা ছাড়া কেউ জানে না। তার দুই ভাই আর ভাবিমনি জানলে নির্ঘাত সন্দেহ করবে। তিতলি জানে পার্সেলগুলো তাকে নির্বানই পাঠায়। বিভিন্ন জিনিস আর চিরকুট পাঠায়। তিতলি মনে মনে ভাবে এখনো বাইরে গেলো না তাতেই এই। বাইরে গিয়ে কি করবে। কি জানি বাইরে গিয়ে বদলেও তো যেতে পারে। মানুষের মনের ঠিক নেই। সেজন্যই তিতলি নির্বানকে নিয়ে যথাসম্ভব না ভাবরই চেষ্টা করে। তিতলি পার্সেল নিয়ে চুপিচুপি নিজের ঘরে গিয়ে খুললো। খুলে দেখলো সুন্দর কাঠের নকশা করা একটা চুলের কাঠি আর একটা মাথার টিকলি। সাথে সুন্দর হাতের লেখার চিরকুট। চিরকুটে লেখা।
“আমার চোখের তারা”
সম্বোধন দেখে ঘাঁবড়াবেন না। পরে কোনো একদিন বলবো কেন এই সম্বোধন। এখন শুনুন সামনের সপ্তাহেই আমার ফ্লাইট। যাওয়ার আগে আমি আপনাকে আরো একবার আমার চোখের সামনে দেখে যেতে চাই। আমি আপনার সব কথা শুনেছি। আপনি কি আমার এই একটা কথা রাখতে পারবেন না? রাখতে পারলে জানাবেন। নিচে আমার নাম্বার দিয়ে রাখলাম। একটা ছোট্ট মেসেজ দিলেই চলবে। নিজের খেয়াল রাখবেন। ভালোভাবে পড়বেন অনেক বড় হতে হবে আপনাকে।
ইতি
আপনি জানেন আমি কে।
তিতলি চিরকুট টা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রেহান তিতলিকে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে। সেজন্য তিতলি দ্রুত চিরকুটসহ গিফ্টস লুকিয়ে ফেললো। রেহান এসে দেখলো তিতলি দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে আছে এবং ঘরেই আছে তবুও সায় দিলো না বলে রেহানের রাগ হলো। সে কতোক্ষন যাবত তিতলিকে ডেকে যাচ্ছে। এগিয়ে এসে সে তিতলিকে একটা গাট্টা মারলো। বললো।
-কতোক্ষন যাবত ডাকছি গাঁধি শুনতে পাস না?
তিতলি মাথায় ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। রেহানের বাহুতে চাপড় মেরে বললো।
-আজ যদি ভাবিমনিকে বিচার না দিয়েছি তবে আমার নামও তিতলি নয়।
রেহান তিতলি ভেঙ্চি কাটলো। তিতলি দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
-আই সোয়্যার ছোট ভাই মিলা আপুর কাছে তোর নামে এমন চুগলি করবো যে তুই উঠতে বসতে তার রাগান্বিত আগুনরঙা চোখের সম্মুখীন হবি।
রেহান হতভম্ব হয়ে গেল তিতলির কথা শুনে। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে বললো।
-যা চুন্নি যা যতো পার চুগলি কর। ওই টিলা এমন কি যে ওর কথা বা চোখ রাঙানোতে আমার আসবে যাবে।
তিতলি রেহানকে ভেঙ্চি কেটে দৌড় দিয়ে যেতে যেতে বললো।
-দেখা যাবে। তখন তোদের এই সামান্য প্রেমও ফু হয়ে যাবে।
রেহান তিতলির যাওয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার বোন যে এতো ধুরন্ধর তা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।
মিলা আর রেহান দুজনেরই কয়েকদিন আগেই ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দুজনেরই এখন অবসর সময়। মিলা নিজের মতো মেক আপের বিভিন্ন এক্সেসোরিজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দিন কাটায়। একাউন্টিং নিয়ে অনার্স পড়েও তার এদিকেই বেশি আগ্রহ। নীরা সহ সকলেই তাকে উৎসাহিত করে। কারন মিলা সত্যিই এসবে খুব এক্সপার্ট। ইতিমধ্যে সে একটা কোর্স ও করে ফেলেছে এসবের।
রেজাউল রাতে খাওয়ার সময় মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
-প্রফেশনও কি এসবেই চুজ করবে?
রেজাউলের কথা শুনে মিলার খাওয়া থামালো। আড়চোখে মালিহার দিকে তাকালো। মালিহা ইশারায় বোঝালেন ভয় না পেয়ে বলতে। মিলা সাহস জুগিয়ে বললো।
-আই লাভ দিস আব্বা। তাছাড়া আপাও বলেছে আমার শান্তি যেখানে সেখানেই থিতু হতে।
মিলার কথা শুনে রেজাউল খানিকখন চুপ থাতলেও নূরজাহান বেগম থাকলেন না। তিনি উচ্চস্বরে বললেন।
-তাই বলে বিউটি পার্লার দিবি ভবিষ্যতে? এজন্য এতো কষ্ট করে পড়িয়েছি তোকে? তাহলে আর পড়ালেখার কি দরকার ছিলো? একটা কোর্স করেই ক্যারিয়ার দাড় করাতি।
নূরজাহান বেগমের চিৎকার শুনে মিলা ভয় পেয়ে গেল।
মালিহার দিকে তাকালো সে। মালিহা মিলার দিকে একবার তাকিয়ে নূরজাহান বেগমকে বললেন।
-সমস্যা কি আম্মা! আপনি জানেন এখন প্রফেশনাল বিউটিশিয়ানদের কতো কদর। তাছাড়া মিলা শুধু মেক আপটাই বেছে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি পার্লারও দেয় তবে সমস্যা কি!
মালিহার কথা আমলে নিলেন না নূরজাহান। নিজের মনে কথা বলতে বলতে ঘরে চলে গেলেন। মিলা নূরজাহান বেগমকে যেতে দেখে বলেই বসলো।
-কে কি ভাবলো আই ডোন্ট কেয়ার। আমার আপা আমাকে কি বলেছে সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপা আমার সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে। সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট।
মিলার কথা শুনে রেজাউল হেসে ফেললেন। মালিহা রেজাউলকে হাসতে দেখে অবাক হলেন। তিনি কিছু বলার আগেই রেজাউল নিজেই বললেন।
-আচ্ছা মিলা এতো হাইপার হতে হবে না। তোমার আপার কথা ফেলতে পারে এমন সাধ্য এই পরিবারের কারো নেই। আমার যদিও এখন তোমার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্যা নেই। আর রইলো তোমার দাদী তাকেও নীরা বুঝিয়ে দিবে দেখো।
রেজাউলের কথা শুনে মিলা আর মালিহা একত্রে হেসে ফেললো। মিলা বললো।
-আই এম গোয়িং টু বি এ মোস্ট পপুলার আর্টিস্ট ইনশাআল্লাহ্! আপা বলেছে আমি চাইলে নিজের সবটা দিয়ে করলে পারবো।
মিলার কথা শুনে রেজাউল আর মালিহা প্রসন্ন মুখে হাসলেন।
রাতের খাওয়া শেষে মিলা নীরার ঘরে গেল। আজ সে তার আপার ঘরে ঘুমাবে। আপাকে সে মিস করছে। যদিও এখনই আপার কাছে যেতে চাইলে যাওয়া যায়। মিলার ভাইয়াকে বললেই সে নিজে এসে মিলাকে নিয়ে যাবে। তবে সবসময় এভাবে যাওয়া মিলার নিজের কাছেই ভালো মনে হয় না তাই আর গেল না। তার আপার বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো সে। এখানে তার আপা ভাইয়ার সাথে কথা বলতো। এখানে দাড়িয়েই রাতের পর রাত স্বপ্ন বুনতো। আপা এখানে দাড়ায়েই ভাইয়াকে দেখতো। ভাইয়া নিচে দাড়িয়ে ফোন করে হুমকি দিতো নিচে গিয়ে দেখা না করলে ভাইয়া নিজেই ওপরে চলে আসবে। ভাইয়ার ধমক শুনে মিলার আপাও ভয় পেয়ে জলদি চুপিচুপি নিচে গিয়ে দেখা করতো। ফিরে আসতো ভাইয়ার জন্য এক সমুদ্র মুগ্ধতা নিয়ে। আবার কখনো বা বকুল ফুলের মালা কখনো বা শিউলি ফুলের মালা নিয়ে! মিলা সবই টের পেতো। সবই দেখতো। মিটিমিটি হেসে তাদের এই খুনসুটি ইনজয় করতো। আপাকে সে বিব্রত করতে চাইতো না। তাই কখনো হাতেনাতে ধরা হয়নি। আজ এই মুহূর্তে মিলার মনে হচ্ছে দুজনকে একদিন সে হাতেনাতে ধরলে কতো মজা হতো! ইশ। এতো ভালো বোন তাকে কে হতে বলেছিলো! একটু মজাও করতে পারলো না।
আপনমনে এসব ভেবেই মিলা নিজে নিজেই হেসে ফেললো। তারপর হাতের মুঠোফোনের দিকে হঠাত নজর গেলে মিলার ধ্যান ভাঙলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রেহান ফোন করেছে। রেহানের নাম দেখেই মিলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রেহান বললো।
-কি করো মিস টিলা?
মিলা মনে মনে আজ অন্য ফন্দি এঁটেছে। আজ ঝগড়া করে না রেহানকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একটা সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করবে। এটা তার অনেকদিনের শখ। সেই উদ্দেশ্যে মিলা রেহানকে মিষ্টি স্বরে বললো।
-বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশ দেখছি। তুমি কি করছো?
মিলার এমন স্বাভাবিক মিষ্টি স্বরে রেহান হতভম্ব হয়ে গেল। মিলা মাঝেমধ্যে একটু স্বাভাবিক স্বরে কথা বললেও এভাবে কখনো কথা বলে না। রেহান দ্রুত বিষয়টা হজম করে ভাবলো সে একটু রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করবে। সেজন্য রেহানও জলদি নিজের বারান্দায় গেল। গিয়ে মিলাকে বললো।
-আমিও আকাশ দেখি। যেই আকাশ মিলার!
খুবই সাধারণ একটা কথা অথচ মিলার খুবই ভালো লাগলো। সে ফোনের ওপাশেই মিষ্টি করে হাসলো। তারপর সোজা বললো।
-আচ্ছা শোনো না রেহান।
রেহান মিলার এমন গলা শুনে মোহাচ্ছন্নের মতো বললো।
-হুম বলো না।
মিলা ফোন সরিয়ে এবার ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর আবার ফোন কানে নিয়ে বললো।
-আজ এই মুহূর্তে তুমি আমার বাড়ির সামনে আসবে। আসবে মানে আসতেই হবে। কোনো কথা শুনবো না আমি।
এতোক্ষন যাবত সুন্দর করে কথা বললেও এই পর্যায়ে মিলার কথা শুনে রেহান রীতিমতো লাফিয়ে উঠলো। দ্রুত ঘড়ি দেখলো। ঘড়িতে প্রায় একটা বেজে গেছে। এই মুহূর্তে মিলা ওদের বাড়ির সামনে যেতে বলছে। মানে কি! লোকে কি ভাববে। সে দ্রুত মিলাকে বলে উঠলো।
-মিলা কি বলো এসব! লোকে কি ভাববে। এতোরাতে আমি কিভাবে যাবো? ভাবিমনি আমাকে বলেছে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে। রাত না জাগতে আর তুমি বলছো তোমাদের বাড়ির সামনে যেতে। বাড়ির সবাই যদি জেনে যায়।
রেহানের ভয়মিশ্রিত কন্ঠ শুনে মিলা ফোনের এপাশে খিলখিল করে হেসে ফেললো। যেই হাসির আওয়াজ শুনে রেহান মুগ্ধ হয় সেই হাসির আওয়াজ শুনেই আজ সে ভয় পাচ্ছে। মিলা হঠাত হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললো।
-তুই কি এই মুহূর্তে আসবি? নাকি আমি অন্য পন্থক অবলম্বন করবো? এসেছে ভাবিমনির একান্ত নিষ্পাপ ভদ্র বাচ্চা!
রেহান মিলার থ্রেট শুনে ভয় পেলো। মিলা যা ডেঞ্জারাস সত্যিই যদি কোনো ডেঞ্জারাস উপায় বের করে রেহানককে অপদস্ত করে তখন কি হবে! এসব ভেবেই রেহান সায় দিলো। কোনোরকমে বললো।
-আচ্ছা আসছি আমি। কিন্তু এভাবে তুই তুকারি তো বন্ধ করো।
মিলা মুখটিপে হেসে বললো।
-এইতো গুড বয়! আর শোনো। আসার সময় যেকোনো ফুল নিয়ে আসবে৷ প্রেমিক হতে শেখো। শুকুর করো তোমার ওই ইউনিক ঠাটাওয়ালা প্রোপজাল রিজেক্ট করিনি।
মিলার কথা শুনে রেহান আঁতকে উঠে বললো।
-এতো রাতে ফুল কই পাবো?
এরপর একটু অসহায় গলায় বললো।
-একটু কনসিডার করা যায় না?
মিলা একগুঁয়ো গলায় বললো।
-না যায় না। তুমি এখনই রওনা দাও দ্রুত।
ফোন কেটে দিলো মিলা। রেহান ফোন কান থেকে নামিয়ে নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মারলো। তারপর দ্রুত চুপিচুপি বেড়িয়ে পরলো।
মিলা ফোন কেটে দিয়ে কয়েকদফা হাসলো। আজকে পুনরায় কাহিনী রিপিট হবে। শুধু মিলার সাহসী ভাইয়ার জায়গায় থাকবে মিলার ভাইয়ারই ছোট ভাই মিলার ভীতু প্রেমিক। আর তার আপার জায়গায় থাকবে সে নিজে। উফ! ভাবতেই মিলার মনে আনন্দ লাগছে। এইটক যে তার বহুদিনের শখ। মিলার এসব ভাবনার মাঝেই তার ফোনে কল আসলো। মিলা দেখলো রেহান ফোন করেছে। সে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রেহান ভীতু স্বরে বললো।
-ইয়ে মানে টিলা একেবারে তোমার বাড়ির সামনে যেতে হবে?
মিলা একগুঁয়ে গলায় বললো।
-অবশ্যই। আমি আপার বারান্দায় আছি তুমি দ্রুত এসো। আমি ওপর থেকে দেখছি।
রেহান বাইকে করে এসেছিলো। মিলাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থামিয়েছিলো। এখন আবার একেবারে সামনে যেতে হবে! ভেবেই রেহানের বিরক্ত লাগলো। তবু কিছু বললো না। ফোন কেটে দ্রুত বাইক নিয়ে একদম বাড়ির সামনে গেল। নীরা হালকা আওয়াজ পেয়ে বারান্দা থেকে নিচে তাকালোম আর সাথে সাথে রেহানের বাইক দেখতে পেলো। ওইতো বটল গ্রীন রঙের টি-শার্ট পড়া সুদর্শন ছেলেটা বাইক দাড় করিয়ে নিজে নামলো। মিলা তা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো। চোখেমুখে ভর করলো মুগ্ধতা। তার পরপরই মুখে উপচে পরলো খুশি মিলা ঝটপট মোবাইল ফোনে যথাসম্ভব মুহূর্তটা ক্যাপচার করে নিলো। রেহান নিচে দাড়িয়ে মিলাকে আবার ফোন দিলো। মিলা তখন ভাবলো একই বারান্দায় আজ সে দাড়িয়। একই জায়গায় রেহান দাড়িয়ে। ঠিক এভাবেই তার ভাইয়া নিচে দাড়িয়ে আপাকে ফোন দিতো। তার আপা ঠিক এভাবেই ঠিক মিলার মতো বারান্দাতে দাড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতো। উফ! ভাবতেই মিলাকে আনন্দরা এসে গ্রাস করলো। মিলা রেহানের কল রিসিভ করলো। রেহানকে একনাগাড়ে থ্যাংক ইউ বললো।
-থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সো মাচ।
রেহান হতভম্ব হয়ে বললো।
-কিহ্! কিন্তু কেন?
মিলা খুশিয়াল গলায় বললো।
-অনেকদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে বলে। তুমি জানো? ভাইয়া ঠিক এভাবেই আমাদের বাড়ির সামনে আসতো। ঠিক এভাবে নিচে দাড়িয়ে আপাকে ফোন দিতো। একই জায়গায় দাড়াতো। আপাও ঠিক এই বারান্দতেই দাড়াতো। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো এই দৃশ্যটা রিপিট করার একদম সিনেমার মতো। শুধু সেখানে আপা আর ভাইয়ার বদলে আমরা থাকবো। এন্ড ফাইনালি আজ সেটা পূরণ হয়েছে।
মিলার কথা শুনে প্রথমে রেহান হতবাক হয়ে গেলেও পরবর্তীতে হেসে ফেললো। সে একটা পাগলের প্রেমে পড়েছে। এখন তো পাগলাতি সহ্য করতেই হবে। মিলা আবার বললো।
-শুধু পার্থক্য হলো আমার ভাইয়া সাহসী। আর তুমি একটা ভীতু। ভাইয়া নিজেই আসতো আর তোমাকে আমার বলে বলে নিয়ে আসতে হয়েছে। দুই মিনিট দাড়াও আমি নিচে নামছি।
রেহান কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়লো। ঠিক দুই মিনিটের মাথাতেই মিলা নিচে নামলো। বিল্ডিংএর দারোয়ানের ঘুমের সুযোগ নিয়ে মেইন গেট দিয়ে বেড়িয়ে রাস্তার সামনে আসলো। রেহান দূর থেকে হালকা আলোয় দেখলো কমলা রঙের কামিজ পড়া এক অসম্ভব রূপবতী মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে মিলা রেহানের কাছে এগিয়ে আসলো। রেহানের ধ্যান ভাঙলো। সে আবার টেনশনে পড়ে গেল কেউ দেখে ফেলেছে কিনা। রেহানের মুখ দেখে মিলা নিজেই বললো।
-কেউ দেখবে না। এতো টেনশনের কিছু নেই। আমার ফুল কই?
রেহান মুখে হাসি ফুটিয়ে গোলাপ ফুল বের করে দিলো। মিলা ফুলতুলো নিয়ে বললো।
-কিন্তু আমার ভাইয়া তো ফুলের মালা আনতো। আর আপা কি সুন্দর সেটা হাতে পরতো।
মিলার এই কথা শুনে রেহানের ইচ্ছে করলো সে পানিতে ঝাপ দিক অথবা ওইতো বিদ্যুৎ এর খাম্বা। সেটার সাথে নিজের মাথায় একটা বাড়ি মারলে কেমন হয়! এতো রাতে যে বহু কষ্টে এই হোলাপ যোগাড় করেছে এই ই তো বেশি। আর মিলাও তো তাকে বলেনি মালা আনতে। সেজন্য সে মিলাকে বললো।
-টিলা তুমি আমাকে একবারও বলোনি ফুলের মালা আনতে। শুধু বলেছো ফুল আনতে। আর এতো শখ হলে তোমার ভাইয়াকে বলো সে তোমাকে একটা ফুলের মালা কেন একশটা ফুলের মালা এনে দিবে। আমার এটা যোগাড় করতেই জান কোরবান হয়ে গিয়েছিলো।
রেহানের কথা শুনে মিলা হেসে ফেললো। ফুলগুলো আগলে ধরে বললো।
-তোমার মতো ভীতু যে এসেছে এতেই তো আমার ধন্য হওয়ার কথা। থ্যাংক ইউ।
রেহানকে বারবার ভীতু বলার কারনে রেহান রেগে যাচ্ছিলো। কিন্তু মিলার প্রসন্ন মুখ দেখে তার রাগ পরে গেল। মিলা রেহানের হাত ধরে বললো।
-চলো কিছুদূর হাটি।
রেহানও বিনাবাক্য ব্যয়ে মিলার সাথে হাটতে শুরু করলো। একই রাস্তা একই জায়গা। শুধু পার্থক্য দুটো মানুষের। এই রাস্তায় আগে শিহাব আর নীরা হেটেছিলো। আজ রেহান আর মিলা হাটছে। মিলার খুব খুশি লাগছে! জীবন এতো সুন্দর কেন!
-চলবে!
(সবাইকে পবিত্র ইদ উল ফিতরের শুভেচ্ছা। ইদ মুবারক। ভালোবাসা রইলো।❤️)