#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ২১
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
ঘুম ভাঙলো দেরি করে।।জানালার বাইরে একটা কাক বিচ্ছিরি গলায় ডাকছে।কা কা কা।রাত্রি উঠে বসলো।একহাতে চোখ কচলে বড় করে হাই তুললো।লম্বা ঘুম দিয়ে বেশ ভালো হয়েছে।একরাতেই গায়ের ব্যাথার অস্তিত্ববিনাশ।শরীর হাল্কা লাগছে।চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে এসে আলমারি খুললো সে।দুদিন যাবত কাপড় ধোঁয়া হয়নি।আধোঁয়া জামাগুলো চেয়ারের উপর গুঁটলি পাকিয়ে আছে।দীর্ঘকায় হতাশ শ্বাস বেরিয়ে এলো।।তার স্টুডেন্টদের মধ্য একজন আছে খুব ছোট।এ বছর সবে ক্লাস থ্রি তে উঠেছে।আজকে জন্মদিন।ওর মা গতকাল আসার সময় বলে দিয়েছে সে যেনো অবশ্যই যায়।বাসায় একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান হবে।বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর মানা করতে পারেনি।এখন বিপত্তি জামাকাপড় নিয়ে।ভার্সিটির বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয়না।তাছাড়া জামাকাপড়ের পিছে অহেতুক টাকা খরচ করার মানেও নেই।তাই আলমারিতে কয়েকজোড়া সুতি কামিজ আর মায়ের দু’তিনটে সাদামাটা শাড়ি ছাড়া তেমন কিছু নেই।শাড়িগুলো সে এনেছিলো সেই চারবছর আগে।একা একা থাকবে তাই স্বৃতি হিসেবে মায়ের শাড়ি নিয়ে এসেছিলো সঙ্গে করে।যেন মন খারাপ হলে শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলতে পারে,”মা তো সাথেই আছে।”
উদাসীন হয়ে উঠলো মনটা।সাত পাঁচ না ভেবে হাল্কা হাতে একটা শাড়ি বের করে নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ।মাকে মনে পড়ছে।বাবার একটা শার্টও আছে আলমারিতে কিন্তু সেটা ধরার সাহস হয়না এখন।কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলবে যে!কি দরকার?
শাড়িটা পড়ে নিয়ে ভার্সিটির ব্যাগ গুছিয়ে ঘরের দরজা আটকে বেরিয়ে গেলো সে।মুঠোফোনটা অযত্নে পড়ে রইলো পড়ার টেবিলের অগোছালো কোঁণে।
ল্যাপটপের কি-বোর্ড এফোড়ওফোড় করতে করতে কফিতে চুমুক দিচ্ছে নিভ্রান।মস্তিষ্কের এককোঁণে জটলা পাকিয়ে আছে চাপা রাগগুলো।মেজাজে খারাপ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।এত অসহনীয় কেনো এই অবহেলা?মেয়েটা একটাবার কলব্যাক অন্তত করতে পারতো?কিন্তু নাহ,সেটা করারো কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি।ভেবেছে হয়তো,”উনি তো আছেই।ভালো তো বাসবেনই।”
কফির কাপটা শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলো নিভ্রান।চোখে তখন ক্রোধের দাবানল!
________________
মেঘ ডাকছে।গুড়ুম গুড়ুম।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হাল্কা পাতলা।রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাটতে চোখ রাঙিয়ে আকাশ দেখলো রাত্রি।মনে মনে বললো,”আজ আর জল ঝাঁপিয়ে কি লাভ?কালতো হাজার আকুতিতেও মন গললোনা।মেঘবালক সঙ্গে নেই অথচ মেঘেরা ঝরতে প্রস্তুত।কি অমিল!”একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেলো।প্রায় গায়ের উপর দিয়ে।রাত্রি দ্রুত চেপে গেলো।অদ্ভুত!গাড়ি চালানোর সময় খেয়াল থাকেনা নাকি?হাহ্!
আজকে নিভ্রান নিতে আসেনি।হয়তো কাজ আছে।যদিও তাকে নিতে আসাটা কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম না তবু রাত্রির অবচেতন মন আজকাল এটাই চায়।টিউশনি থেকে বের হয়েই নিভ্রানকে দেখবে।তার জন্য অপেক্ষা করে আছে মানুষটা।শুধু তার জন্যই।আহা!মন ঠান্ডা করে দেয়া অনুভূতি।রাত্রি হেসে ফেলল।হাঁটতে হাঁটতে কুঁচির নিচটা এলোমেলো হয়ে গেছে।উবু হয়ে কুঁচিগুলো গোছাচ্ছে হঠাৎই সাঁই করে একটা গাড়ি থামলো একেবারে কাছ ঘেঁষে।সোজা হয়ে দাড়ানোর আগেই একটা হাত হ্যাচকা টানে তাকে গাড়ির পিছনের সিটে ছুঁড়ে মারলো।পিলে চমকে উঠলো রাত্রির।ভয়ে ফর্সা চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মুহুর্তেই।হৃদস্পন্দন থেমে গেলো যেনো।কোনো বিপদ হবে নাতো?
তার একসেকেন্ডে গড়ে উঠা সকল ধ্যান-ধারনা কে ভস্ম করে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো নিভ্রান।চোখমুখ আশ্চর্য্য লাল।মুখের হাড় শক্ত।একটা রাগী-গা কাঁপিয়ে দেয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চুপসিয়ে গেলো রাত্রি।নিভ্রান ঝুঁকে এলো।পেছনে হাত ঘুরিয়ে দরজাটা ভেতরে থেকে লক করে দিলো।রাত্রি পেছালো।লোকটার কি হলো হঠাৎ?এমন ব্যবহার তো কক্ষনো করেনা।আজ কি হলো?
জানলার সাথে মাথা লেগে যেতেই কানের পাশটায় একহাত ঠেস দিলো নিভ্রান।রাত্রি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই সে ভরাট গলায় বললো,
—“ফোন ধরোনি কেনো?”
রাত্রি শূন্য মস্তিষ্কে পলক ফেললো।চোখের পাতা সঙ্কুচিত করে বললো,”জি?”
নিভ্রানের ক্রোধের পারদ সীমা লঙ্ঘন করে গেলো।জানলার কাঁচটায় বিকট শব্দে আঘাত করে সে চিৎকার করে উঠলো,”তোমাকে কতবার ফোন করেছি কালরাতে?কোনো হিসেব আছে?আমার কোনো দাম নাই তাইনা?কোনো মূল্য নাই আমার কথার?বিরক্ত করি?পিছে পিছে ঘুরি বলে সস্তা হয়ে গেছি?আনসার মি ড্যাম ইট।খবরদার!চুপ করে থাকবা না রাত।আমি কিন্তু…নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারো বিকট জোরে বারি মারলো নিভ্রান।কপালের রগগুলো বোধহয় এক্ষুণি চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসবে।
নিজের সত্তাটা আর নিজের মধ্য নেই।
রাত্রি মাথা নিচু করে ফেললো।ভয়ে হাত কাঁপছে।এ কোন রুপ?নিভ্রান তো কখনো তার উপর রাগ দেখায় না।
এহেন অচেনা রুপ,ভয়ংকর গলার স্বর আর অপ্রত্যাশিত রূঢ় ব্যবহারে স্হির থাকতে পারলো না আদুরে প্রেমিকার মেয়েলি মন।কোলের দিকে তাকিয়েই ফুঁপিয়ে উঠলো সে।গাল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে ভেজা কন্ঠে বলল,
—“আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
নিভ্রান আরো জোরে ধমকে উঠলো,
—“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?কেনো ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
রাত্রি কাঁদতে কাঁদতেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মোছার নিষ্ফল চেষ্টা করলো।বললো,
—“আপনিই তো বলেছিলেন।”
নিভ্রান চুপ হয়ে গেলো।ভ্রু কুচকে মনে মনে স্বগতোক্তি করলো,”আমি বলেছিলাম?ওহ হ্যাঁ,আমিই তো বলেছিলাম।”
নিজের বোকামোর স্পষ্ট হয়ে উঠতেই শান্ত হয়ে পড়লো সে।রাত্রি তখনো সশব্দে ফুঁপিয়ে চলেছে।নিভ্রানের থেকে এমন ব্যবহার সে কখনোই আশা করেনি।কখনো না।মানছে,লোকটার রাগ অনেক তবুও,তাকে এভাবে ধমকাবে?
নিভ্রান দু’চোখ বুজে রাত্রির কাঁধে কপাল ঠেকালো।এই সহজ বিষয়টা তার মাথায় ঢুকেনি?সে তো নিজেই কাল বলে এলো ঘুমিয়ে পড়তে।তার উপর মেয়েটার শরীর খারাপ ছিলো।ঘুমের ঘোরে হয়তো শুনতে পায়নি।তার তো বোঝা উচিত ছিলো।
কাঁধে কপাল রেখেই ধীর গলায় বললো নিভ্রান,
—“ফোন কোথায় তোমার?কলব্যাক করলেই তো পারতে।”
রাত্রি অশ্রুসিক্ত গলায় বললো,
—“ফোনতো বাসায়।আমি ফোন নিয়ে বেরোইনা।চুরি টুরি হয়ে গেলে পরে।আর সকালে দেরি করে ঘুম ভেঙেছিলো,ফোন দেখার সময় পাইনি।তাছাড়া আমার ফোনে তেমন কেউ কল দেয়না।শুধু মার সাথে কথা বলার জন্য ফোনটা কিনেছি।”
নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো।এটা কি করলো সে?মেয়েটার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে ফেললো?এভাবে কাঁদিয়ে দিলো?ভয় পাইয়ে দিলো?
রাত্রি ফোলা ফোলা চোখে চাইলো।নিভ্রান তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছে।তবে শরীরের ভর ধরে রেখেছে।নতুবা সে সহ্য করতে পারতোনা।নিভ্রান নির্বিকার।রাত্রি আলতো করে তার পিঠে হাত রাখলো।কান্না থেমে গেছে।একহাতে পিঠ আঁকড়ে ধরে নিচু গলায় বললো সে,”আপনি এতো রেগে যান কেনো?”
নিভ্রান নিশ্চুপ।মুখে কিছু না বলে আস্তে করে হাত উঠিয়ে রাত্রির গাল,চোখ মুছিয়ে দিলো।মাথার হাত বুলিয়ে দিলো।রাত্রি বুঝতে পারছে লোকটা শরীর ছেড়ে দিচ্ছে।তার উপর ভর দিচ্ছে।শ্বাস -প্রশ্বাস খুব ঘন।
—“কি হয়েছে?”রাত্রির আতঙ্কিত গলা।
নিভ্রান উঠে গেলো।একহাতে মাথার ঝাঁকড়া চুল পিছের দিকে চেপে ধরে এলোমেলোভাবে বললো,”কোলে একটু মাথা রাখি?”
রাত্রি আবার ধাক্কা খেলো।লোকটা এভাবে কথা বলছে কেনো?কন্ঠ কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে।ভ্রুর মাঝখানে গাঢ় একটা ভাঁজ।উনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?সে সম্মতি দেয়ার আগেই সিটে সটান হয়ে শুয়ে কোলে মাথা রেখে চোখ বুজলো নিভ্রান।রাত্রি পা আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করেই বসে ছিলো বিধায় সমস্যা হলোনা।
গা শিরশির করে উঠলো।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসতেই নিভ্রান অষ্পষ্ট স্বরে বললো,”নড়োনা।”
থেমে গেলো সে।আলতো করে ঝাঁকড়া চুলে হাত গলিয়ে বললো,
—“আপনার মাথা ব্যাথা করছে?”
নিভ্রান উওর দিলোনা।রাত্রি নিজ থেকেই কপালে হাত রাখলো।ম্যাসেজ করে দিলো।চুল টেনে দিলো।খানিকবাদে নিভ্রান কিছুটা ধাতস্থ হলো।ব্যাথা বোধহয় কমেছে।কপালের ভাঁজ গুলো মিলিয়ে গেছে।চোখের পাতা শান্ত।
হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে সে বললো,
—“আমার রাগটা একটু বেশি রাত।তুমি সামলাতে পারবেনা?”
মানুষটা যে এতক্ষণ যাবত তাকে ‘তুমি’ বলে ডাকছে বিষয়টা এখন মনে আটকালো।কি মধুর,আপন একটা ডাক!রাত্রি ছোট্ট করে উওর দিলো,”পারবো।”
বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে।এত প্রতীক্ষার বৃষ্টি।রাত্রি চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে জানলার বাইরে চেয়ে রয়েছে।
পুরো পৃথিবীর কাছে সে শক্তপোক্ত একটা মেয়ে হলেও এই মানুষটার কাছে এলে কেমন আদুরে হয়ে যায়।
নরম শরম ছোট্ট একটা মেয়ে।প্রেমিকের কাছে এলে পাথর গলে পানি।
বৃষ্টির মাতাল তরঙ্গ কর্ণকুহরে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই নিভ্রান ডাকলো,
—“রাত?”
—“হু”।
—“বৃষ্টি হচ্ছে।”
—“হু”।
—“ভিজবে না?”
—“হু?”
নিভ্রান মাথা বাঁকিয়ে তাকালো।চোখে চোখ রাখতেই লাজুক মেয়েটার ফোলা ফোলা চাহনী নজরে এলো।কেঁদে যেনো রুপ বেড়ে গেছে।লাল মায়া ছড়িয়ে পড়েছে।ঠোঁট লাল,গাল লাল,চোখ লাল,নাকের ডগা লাল।
নিভ্রান হেসে ফেললো।রাত্রি দৃষ্টি লুকিয়ে ফেললো।কাঁধের আচঁল টেনে ঠি ক করলো।
এতক্ষণে মেয়েটার দিকে পূর্ণদৃষ্টি পড়লো নিভ্রানের।চোখের মনি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।চাহনী ভিন্ন হয়ে উঠলো।অন্যরকম গলায় শুধালো সে,
—“শাড়ি পড়েছো রাত?ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তো!”
~চলবে~