#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ২৩
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
নিশিথীনির স্তব্দতা ফুঁড়ে প্রবল জলধারার ঝমঝম শব্দ এখন অবধি প্রবহমান।বৃষ্টি থামেনি।
বৃষ্টিমূখর ঝিমানো আবহাওয়ায়ও রাত্রির চোখে ঘুম নেই।বরং অস্থিরতায় কাঁতরাচ্ছে সে।উৎকন্ঠা,রুদ্ধশ্বাসে পার হচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ড।বারবার ঘাম দিয়ে উঠছে শরীর।ওড়নার আচঁল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বামহাতটা ক্লান্ত।
তখন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটাই বেজে গেছিলো।রাতের খাবার রান্না করা ছিলোনা।গোসল সেড়ে,ভাত-তরকারি রান্না করে খেয়েদেয়ে সব গুছিয়ে বিছানায় আসতে আসতে প্রায় বারোটা বেজে গেছিলো।মায়ের সাথে গতপরশু কথা হয়েছে।গতকাল হয়নি,ফোনে টাকা ছিলোনা।আজ আগেভাগেই টাকা ভরে এনেছিল রাতে ফোন দিবে বলে।কিন্তু তখন ফোন হাতে নিয়ে দেখেছে মামার নাম্বার থেকেই পাঁচটা মিসকল।লাস্ট ফোনটা এসেছিলো ঘন্টাখানেক আগে।
সেই থেকে এখন রাত দুইটা পঁচিশ।এইযে ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভই হচ্ছেনা।না জানি কোন বিপদ হয়েছে?মামা নামক লোকটার উপর একরত্তিও বিশ্বাস নেই।টাকার জন্য সব করতে পারে।একটা বিশ্রি মনমানসিকতার সর্বোত্তম উদাহরণ এই মামা।
রাত্রি আবার ফোন দিলো।রিং হয়ে একপর্যায়ে কেটে গেলো ফোন।দুশ্চিন্তায় মাথা ফেঁটে যাচ্ছে।ব্যাকুলতায় রগগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে বোধহয়।রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।ফোন রেখে উঠে দাড়ালো রাত্রি।বারকয়েক এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করলো।মায়ের কিছু হলো নাতো?আল্লাহ সহায় হও।
রিং বাজলো গুনে গুনে আধঘন্টা পর।রাত্রি এলোমেলো হাতে কানে তুললো।শ্বাস গলায় আটকে বললো,
—“হ্যালো?মা?”
ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা গেলোনা।শোনা গেলো মামির রাগি কন্ঠ,
—“মা আইবো কোথ থেইকা?মা রে তো ফালায়া শহর চইড়া বেড়াইতেছো।যত বোঝা আমাদের ঘাড়ের উপর।”
রাত্রির মেজাজ বিগরে গেলো।
—“ফালতু কথা বলবেন না খবরদার।মা কোথায়?ফোন ধরছিলেননা কেনো?মা কে দিন আমি কথা বলবো।”
—“মাইয়া বানাইছে একটা বেয়াদব…”
—“চুপ করোতো..”মামার আবছা কন্ঠস্বর।ফোনটা বোধহয় মামির কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো।রাত্রি বুঝলো কিছু একটা তো হয়েছে।মামা কিছু বলার আগেই সে কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,”আমিতো বললাম মা কে দিন।দিচ্ছেননা কেনো?”
ওপাশ থেকে মামার আমতা আমতা শোনা গেলো।রাত্রি আবারো চিৎকার করতেই সে ধমকে বললো,
—“বুবু হাসপাতালে।একটু অসুস্থ হয়ে পড়ছে।ডাক্তাররা দেখতেছে।এত চিল্লাচিল্লির কি আছে..”
রাত্রি থমকে গেলো।চোখ দিয়ে পানি পড়লেও গলায় দরাজ ভাব,
—“কি হয়েছে মার?অসুস্থ নাকি আপনারা কিছু করেছেন?মামা,দেখুন ভালো হবেনা কিন্তু..”
—“আমরা কেন কিছু করমু?আমি তো আরো হাসপাতালে নিয়া আসলাম।এমনেই হাসপাতালের খরচ দিতে যাইয়া হিমশিম খাইতেছি,তোমাকে তহন এতবার ফোন দিলাম।কিছু টাকা পাঠাও।সব চিকিৎসার খরচ কি আমরাই দিমু নাকি?”
রাত্রি দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিলো,
—“আপনার টাকা দিতে হবেনা।আমিই দিবো সব।দয়া করে টাকার জন্য আবার হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আইসেন না।দোহাই লাগে।…মা কে দিন আমি কথা বলবো একটু..”
—“বুবু এখন কথা বলতে পারবোনা।জ্ঞান নাই।”পাশ থেকে কেউ একজন বললো,”আপনাদের না বললাম রক্তের ব্যবস্থা করতে।পেশেন্টের অবস্থা খারাপের দিকে।”
রাত্রি সজোরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“আমার মার কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়বোনা কিন্তু…।”
ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেলো।হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে উঠলো রাত্রি।আবার ফোন করে শুধু বললো,”দয়া করে সকাল পর্যন্ত একটু খেয়াল রাখেন মামা।আমি এখনি রওনা দিচ্ছি।আমি আসলে আপনার আর কিছু করতে হবেনা।দোহাই লাগে ততক্ষণ একটু খেয়াল রেখেন।”
রাত তখন তিনটা।।তার উপর বৃষ্টি।বাড়িভাড়ার জন্য রাখা পাঁচহাজার টাকা আলমারি থেকে বের করে ব্যাগে ভরলো রাত্রি।মাথায় শুধু চলছে মায়ের কাছে যেতে হবে।সে ছাড়া তার মাকে দেখার কেউ নেই।আর ওই লোকটার ভরসায় তো একদমই না।
কাপড় টাপরের ঝামেলা করলোনা।শুধু হ্যান্ডব্যাগে টাকা,ফোন নিয়ে গেট তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।বেল বাজালো বাড়িওয়ালার দরজায়।খুললো রাহেলা।চোখে ঘুম ঘুম প্রচন্ড বিরক্তিভাব।রাত্রিকে দেখেই তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো সে,
—“পাগল টাগল হইয়া গেসো তুমি?এতরাতে এমন পেরেশানির মানে কি?”
রাত্রি গায়ে মাখলোনা।বিনীত কন্ঠে বললো,”আন্টি আমি বের হবো।মেইন গেটের তালাটা খুলতে হবে।আংকেলকে বলুন একটু খুলে দিতে।”
—“পাগল হইসো?এই মাঝরাতে মাইয়া মানুষ একলা একলা কই যাইবা তুমি?”
—“মা খুব অসুস্থ আন্টি।মাত্র খবর পেলাম।এখনই রওনা দিতে হবে।চট্রগ্রাম দূরের রাস্তা।পৌছাতে খুব দেরি হবে।আপনি আংকেলকে ডেকে দিন।আমি উনার অনুমতি নিয়েই যাবো।”
—“তোমার আংকেল ঘুমে।শরীর ভালোনা উনার।তোমার এই রাতে যাওয়া লাগবোনা।সকালে যাইয়ো।এখন ঘরে যাওগা।”
বিনীত স্বর বদলে গেলো রাত্রির,”বলছিতো আমি এখনি যাবো।আপনি রহমান আংকেলকে ডাকুন না।”
রহমান সাহেবকে ডাকতে হলোনা।তিনি নিজেই উঠে এলেন।তিনি আসতেই যেনো একটু ভরসা পেলো রাত্রি।সব খুলে বলতেই রহমান সাহেব বললেন,
–আচ্ছা,চলো।তোমারে বাস স্টান্ডে পৌছায় দিয়াসি।একলা কেমনে যাইবা?চলো।”
রাহেলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।গরম কন্ঠে রহমান সাহেব কে বললো,”খবরদার তুমি বৃষ্টির মধ্য বাইর হইবানা।শরীর ভালোনা তোমার।এই মাইয়া কোন ঝামেলায় ফালাইবো কে জানে?গেট খুইলা দাও।যাওগ্গা।”
রহমান সাহেব আপত্তি করে কিছু একটা বলতে নিচ্ছিলেন।রাত্রি তাকে থামিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,”সমস্যা নেই আংকেল।আমি একাই পারবো।আপনি শুধু গেটটা খুলে দিন।দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
তিনটা পয়তাল্লিশ।
রিকশায় করে বাসস্ট্যান্ডে পৌছালো রাত্রি।ভাড়া মিটিয়ে মাথায় ছাতা ধরে ডুবো পানিতেই পা নামিয়ে দিলো।রহমান আংকেল ছাতা দিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গে।রিকশাও তিনিই ঠি ক করে দিয়েছিলেন।রাস্তা সুনসান।একটু দূরে কয়েকজনকে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে বাসের জন্য।রাত্রির মুখে ভয়ের ছিঁটেফোটাও নেই।মাঝেমধ্য অবশ্য চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।তবে পানি গড়ানোর আগেই মুছে ফেলছে সে।ভেঙে পড়লে চলবে না।
কিছুদূর এগিয়ে টি কি ট কাটার জন্য কাউন্টারে যেতেই মাথা রীতিমত ঘুরে উঠলো।চট্রগ্রামের বাস নাকি আসতে দেরি হবে।ভোর পাঁচটার মতো বেজে যেতে পারে।এমনেই ঝড় বৃষ্টি তারউপর কোনো একটা কারণে বাস আটকা পড়েছে কোথাও।রাত্রি চুপচাপ সরে আসলো কাউন্টারের সামনে থেকে।একহাতে মাথা চেপে ধপ করে বসে পড়লো পাশের বেন্চিতে।এখন কি করবে?কিভাবে যাবে?এখানে অপেক্ষাই বা করবে কিভাবে?চরম অসহায়ত্বে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়লো।মাথা নিচু করে আশেপাশের সবার থেকে তা আড়াল করে নিলো।মানুষজন কাঁদতে দেখলে সুযোগ পেয়ে যাবে।দূর্বল ভেবে ফেলবে।
শেষমেষ নিরুপায় হয়ে নিভ্রানকে ফোন দিলো রাত্রি।এতক্ষণ নিভ্রানের কথা মাথায় আসলেও অযথা তাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিলো না।নিজের কাজের জন্য অন্যকে বিরক্ত করা তার পছন্দ না।
প্রথববারেই রিসিভ হলো ফোন।ওপাশ থেকে নিভ্রানের আদরমাখা ঘুমজড়ানো কন্ঠ,
—“হ্যালো রাত,এত রাতে ফোন দিলে যে?তুমি ঠি ক আছো?”
রাত্রি ডুঁকরে উঠলো।শক্তপোক্ত মেয়ের আদলে লুকিয়ে থাকা মায়ের চিন্তায় বিধস্ত,ভাঙাচোরা মেয়েটা বেরিয়ে এলো।নিভ্রানের ঘুম ছুটে গেলো মুহুর্তেই।ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে,
—“কাঁদছো কেনো?কি হয়েছে?..রাত,কথা বলো।”
রাত্রি ভাঙা স্বরে বললো,”আপনি একটু বাসস্ট্যান্ডে আসতে পারবেন?”
—“বাসস্ট্যান্ডে?তুমি এতো রাতে ওখানে কেনো?হ্যালো?”
রাত্রির কান্না বেড়ে গেলো।এই মানুষটার সামনে নিজেকে লুকাতে পারেনা সে।
—“মা খুব অসুস্থ।বাড়ি যেতে হবে।এখানে বাস নেই।আমি..”
নিভ্রান পুরো কথা শুনলোনা।গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বললো,”আচ্ছা,আমি আসছি।কাঁদেনা,আমি আসছি।”
নিভ্রান পৌছালো খানিকবাদেই।ঝড়ের বেগে গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে।রাত্রিকে সহি সালামত বেন্চির এককোণায় বসে থাকতে দেখেই বুকভরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।রাত্রি জবুথবু হয়ে চুপচাপ বসে আছে ছাউনির নিচে।নিভ্রান কাছে গেলো।আশেপাশে দেখে নিয়ে হাত ধরে গাড়িতে নিয়ে বসালো।মেয়েটার চোখমুখ ফুলে আছে।নিভ্রান শ্বাস ফেললো।ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললো,
—“আমাকে আগে বলবা না রাত?এভাবে একা একা কেউ আসে?যদি কোনো বিপদ হয়ে যেতো?”
এই নরম স্বরের বিপরীতে নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা রাত্রি।এতক্ষনের সব কষ্ট যেনো এক ধাক্কায় বেরিয়ে এলো চোখ ফেটে।নিভ্রান একহাতে তাকে বুকে টেনে নিলো।রাত্রি তখনো কাঁদছে।এই একটা মানুষই তো আছে যার কাছে সে কাঁদতে পারে!
~চলবে~
[বানান ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।রি-চেইক করতে পারিনি]