#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩৬

0
830

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুকপর্ব৩৬
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

গাঢ় গোলাপি বাগানবিলাসে ঠাসা পুরো বারান্দা। রেলিংয়ের বাইরে পর্যন্ত এসে পড়েছে কিছুটা। পনেরো তলা বিল্ডিং এর অন্য কোনোকিছু নজর কাড়লো না রাত্রির। হাতের তর্জনী উঁচিয়ে সেই বারান্দা ধরে ফ্লোর গুনতে গুনতে বারো নম্বরে যেয়ে ঠেকলো। নিভ্রান সিটবেল্ট খুলে দিচ্ছিলো। রাত্রিকে আঙ্গুল দিয়ে গুনতি করতে দেখে হেসে ফেললো সে,
—“কি করছো?”
রাত্রি একবার ঘাড় ফিরালো। আবারো নজর দিলো সেদিকে। সূর্যের আলো সরাসরি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে গাল মুখ। বেগুনী রশ্নির প্রভাবে তাকাতে না পেরে চোখ কুঁচকে গেছে। পিটপিট করে চিনদেশীয় মানুষের মতো করে তাকাচ্ছে সে। ছোট্ট নাকের ডগা টা রক্তশোভিত লাল। ঠোঁটের উপর ঘামের কণা। নিভ্রান রুমাল বের করলো। পাতলা করে ভাঁজ করে খুব সাবধানে ঘাম গুলো মুছিয়ে দিলো। ঠোঁটে মেরুণ রংয়ের লিপস্টিক দেয়া, হাত লেগে গেলে ছড়িয়ে যাবে। রাত্রির এই রংয়ের লিপস্টিক ছিলনা। আসার পথে কিনে দিয়েছে।
গলার উল্টে যাওয়া লকেটটা সোজা করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দরজার লক খুলে দিলো সে। রাত্রি কপালের কাছে হাত দিয়ে রোদের আলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করে বললো,
—“ওই বারান্দাটা কি সুন্দর তাইনা? আপনারা কোনটায় থাকেন?”

নিভ্রান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। কয়েকসেকেন্ড চেয়ে থেকে চাপা গলায় বললো,”ওখানেই থাকি….মানে থাকতাম।” রাত্রি বুঝলো নিভ্রানের স্হির চোখের ভাষা। চুপ করে গেলো সে। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বললো,”চলুন, যাই।”
নিভ্রান সোজা হয়ে বসলো। গাড়ির চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরলো। বের হয়ে পিছের সিট থেকে রাত্রির নিয়ে আসা ব্যাগগুলো একসাথে তুলে নিলো। অত:পর রাত্রির পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে। ছোট্ট করে বললো,” কুঁচি নেমে গেছে, সাবধানে।”

রাত্রি একহাতে কুঁচি উপরে টেনে ধরলো। নিভ্রানের হাত আঁকড়ে নেমে দাড়ালো। ভারি শাড়িটায় একশো একটা সেফটিপিন ঢুকিয়ে এসেছে তবু নেমে যাচ্ছে। নেহাতই বেশ সুন্দর লেগেছিলো সেজন্য কিছু না ভেবেই এটা পরে ফেলেছিলো। আগে থেকে এতো বিড়ম্বনা জানলে কস্মিককালেও এর ধারে কাছে যেতোনা।

দুপুর তখন দুইটা সাইত্রিশ।
নওশাদ সাহেব সকালে খবরের কাগজ পড়তে পারেননি। নাহিদা ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছে। এই ফাঁকে তিনি সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাতে ধরা কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছেন। কাপের তলের শেষ অংশটুকু গলার ভেতর চালান করে দিয়ে হাঁক ছাড়লেন তিনি,”আরেক কাপ দাওতো নাহিদা।”
নাহিদা চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। গরম কন্ঠে বললেন,
—“তোমার এই চা খাওয়ার অভ্যাস যাবেনা? এইযে দুইদিন পরপর প্রেশার হাই হয়ে কাঁপতে থাকো। সব তো এই চায়ের জন্যই। এই চা ই মারবে তোমাকে। আমি বলে দিলাম।”

—“আহা! চায়ে করি দোষ প্রেশারের সাথে ওর কি সম্পর্ক?”

—“তুমি..”তার কথার মাঝেই কলিংবেল বাজলো। নাহিদা থেমে গেলেন। একপলক নওশাদ সাহেবর দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মনে মনে গজগজ করলেন কিছুক্ষণ। মানুষজন সব অসময়ে আসে।
রাত্রি সামনে দাড়িয়ে আছে। পিছে নিভ্রান। নাহিদা দরজা খুলে থ বনে গেলেন অকস্স্যাৎ। হাত থেমে গেলো। পা ধরে আসলো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন বারকয়েক। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। তিনি কি সত্যি দেখছেন? ঠোঁটের মাঝে ফাটল ধরলো অজান্তেই। রাত্রি মিষ্টি হেসে বললো,”আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

নাহিদা আবার পলক ঝাপটালেন। অনাকাঙ্খিত আনন্দগুলো ধারণ করার চেষ্টা করলেন। তার ছেলে এসেছে? সত্যি? এতগুলো বছর পর?
চোখ খুশিতে খুশিতে কানায় কানায় ভরে উঠলো। টলমল করলো ঠোঁট। রাত্রি নিজেই একটু সাইডে সরে দাড়ালো। নাহিদা কেঁদে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে নিভ্রানকে ধরলেন। নিভ্রান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
—“কান্নাকাটি করছো কেনো?”

এই দুপুরবেলা কান্নাকাটির শব্দ শুনে নওশাদ সাহেব মুখের উপর থেকে কাগজটা সরিয়ে এদিকে ঘাড় ফিরালেন। নিভ্রান আর রাত্রিকে দেখে একাধারে চেয়ে রইলেন কতক্ষণ। মুখের কোথাও একটা সুপ্ত আনন্দ। চোখের কোঁণে চাপা হাসি থেকে জন্মানো ভাঁজ। রাত্রি তাকে সেখান থেকেই সালাম দিলো। নওশাদ সাহেব হাতছানি দিয়ে ডেকে সহাস্য মুখে বললেন,”আসো আসো, ভেতরে আসো।” রাত্রি সাইড দিয়েই ঢুকে গেলো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে এসে তার মাথার হাত বুলালেন। স্নিগ্ধ চোখে দেখে বললেন,” মাশআল্লাহ….কেমন আছো মা?”

নাহিদার কান্নাকাটি থেমেছে। বহুকষ্টে আচঁল দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। নিভ্রান একপা দু’পা করে ভেতরে ঢুকলো। চোখ বুলালো বড় ড্রইংরুমটায়। বাসায় আসেনা আজ কতবছর। কতকিছু বদলেছে। ল্যান্ডফোনের পাশের লাল শোপিস টা নেই। বেসিনের উপরের কাঁচটা বদলেছে। ড্রাইনিং টেবিলটা নতুন। তার রুমটা কি এখনও আগের মতোই আছে? নাকি ধুলোমাটি জমে ফিকে ঝন্জালের স্তুপ হয়ে গেছে? খুব গোপনে একা অসহ্যকর দীর্ঘ: শ্বাস বেরিয়ে এলো। নিভ্রান ঢুকতেই নওশাদ সাহেব রাত্রিকে বসতে বলে নিশব্দে ভেতরে চলে যেতে উদ্যত হলেন। কেন যেনো অসস্তি লাগছে। খুব অসস্তি। নিভ্রান একনজর তার দিকে তাকালো। অত:পর সোফায় ব্যাগগুলো রেখে বললো,”তুমি থাকো রাত, আমি সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবোনে।”
রাত্রি না না করে উঠলো। খপ করে ধরে ফেললো নিভ্রানের বাহু। তড়িঘড়ি করে বললো,”নাহ্, আপনি কেনো যাবেন? আপনিও থাকবেন।”

নিভ্রান শান্ত গলায় বললো,”জেদ করেনা। আমি এসে নিয়ে যাবো সন্ধ্যায়।”

রাত্রি হাতের চাপ দৃঢ় করলো। কিছু একটা ভেবে চোখমুখ অসহায় করে কাতর গলায় বললো,”প্লিজ..”

নিভ্রান নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো। মেয়েটা জানে এমন করলে সে মানা করতে পারবেনা। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। সম্মতি দিয়ে বললো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”

নাহিদা ব্যস্ত গলায় বললেন,”জানিয়ে আসবিনা? আমিতো তেমন কিছুই রান্না করিনি। হায় আল্লাহ।”

নিভ্রান সোফায় বসতে বসতে বললো,” এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা খেয়ে এসেছি। তুমি এসে বসোতো সামনে।”

—“ধুর, চুপ কর। তা কি হয়? আমি যাই। তুই কি খাবি বল। রাত্রি তুমি কি খাবে?”
রাত্রি উওর দেবার আগেই ধুম করে দরজা খোলার শব্দ হলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিশাদ। চোখমুখ ফুলে মনে হচ্ছে মৌমাছি কামড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। পরণের টি-শার্ট কুঁচকে কুঁচকে আছে। চুল উদ্ভ্রান্তের মতো। দু’হাতে চোখ ডলতে ডলতে সে বললো
—“সমস্যাটা কি? বললাম আমি আজকে একটু ঘুমাবো। ছুটির দিন, হাউকাউ করোনা। নাহ্, দুপুর না গড়াতেই মাছের বাজার বসে গেছে। আর বাসায় কাকে না কাকে ঢুকিয়েছো পুরো ভাইয়ার মতো গলা।”

—“ওটা আমিই নিশাদ। আমার মতো গলা আবার কার হবে? আর এই ভরদুপুরে কিসের ঘুম? একটুপর বিকাল হয়ে যাবে।”

নিশাদ চকিতে তাকালো। চোখের ঘুম উড়ে ছাঁই। মনিগুলো বড়ো বড়ো করে বুকে থুতু ছিটিয়ে সে বললো,
—“মা, সোফায় বসা মানুষটাকে কি তুমিও দেখতে পাচ্ছো? নাকি শুধু আমিই দেখছি। হরর কিছু নয়তো? ভাইয়ার মতো সেজেছে কেনো? দেখি, ধরা যায় নাকি।” বলেই এগিয়ে এসে নিভ্রানের চোখ মুখ হাতালো সে।
নিভ্রান চেঁচিয়ে উঠলো,
—“হুরর, কি করিস?”

রাত্রি ফিক করে হেসে ফেললো। হাসলো নাহিদাও। ইশশ…ঘরটা যেনো আলোয় আলোয় ঝলসিয়ে যাচ্ছে।

_______________

রুমটা সেই আগের মতোই গোছানো। বিছানা ঝাড়া। ফ্লোর মনে হচ্ছে আজই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে।
বাগানবিলাসের গোলাপী স্তুপের ছায়ায় ব্যালকনির দরজাটা পর্যন্ত গোলাপী আভায় সুসজ্জিত। পর্দার নিচ দিয়ে কেমন অদ্ভুত আভাযুক্ত রশ্নি সাদা ফ্লোরে বিছিয়ে আছে। নিভ্রান অবাক চোখে দেখলো সব। সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন করলো,
—“এ ঘরে থাকে কেউ?”

নিশাদ মৃত গলায় উওর দিলো,
—“তুই নাই কে থাকবে ভাই?”

—“সব এত গোছানো কেনো? তালাও দেয়া ছিলোনা।”

নিশাদ কিছু বলতে যেয়েও আটকে ফেললো যেনো। কি একটা জানি অভিদের মতো লুকিয়ে ফেললো। রাত্রি যেয়ে পর্দা সরালো। ব্যালকনির দরজাটা খুলতেই প্রাণখোলা হাসিতে ভরে গেলো ঠোঁট। বাগানবিলাসের রাজ্য যেনো। সে হাত বাড়িয়ে দুটো পাতা ছিঁড়লো। নিশাদ গলা ঝেঁড়ে এড়িয়ে গিয়ে বললো,”ভাবি, তাহলে নিয়েই আসলেন ভাইয়াকে। আ’ম ফিলিং প্রাইড অফ মি।”

রাত্রি ঘুরে বললো,”কেনো?”

—“আমি দেবর বলেইতো আপনি অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারলেন।”

রাত্রি হাসলো কেবল। উওর দিলোনা। নিভ্রান কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলো বিছানায়। ইচ্ছা হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে আবার পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে। এখানেই থেকে যেতে আজীবন। কিন্তু নাহ, ওইযে ইগো। ইগো জিনিসটাই বারবার আটকে দিচ্ছে। কাঁটাতার বিছিয়ে রেখেছে গলায়, মনে, সবখানে।

খানিকবাদে নিভ্রান ওয়াশরুমের জন্য সেখান থেকে যেতেই রাত্রি হুড়মুড় করে বললো,
—” এবার আমাকে বলেন জলদি। সব এতো গোছানো কেনো? আমি দেখেছি আপনি কিছু লুকাচ্ছেন।”

নিশাদ হেসে ফেললো। মেয়েটা এতটুকুন হলেও বেশ বিচক্ষণ। সবদিকে খেয়াল আছে তার। ওর কাছে লুকানোর মতো কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে সে হাসতে হাসতেই বললো,”বাবার কড়া আদেশ আছে ভাবি। ঘরের কোনো জিনিসে যেনো একফোঁটা ধুলোও না জমে। সেজন্যই মা রোজ সকাল সকালই খালাকে দিয়ে এই সবকিছু পরিষ্কার করিয়ে রাখে। ঘর অগোছালো হবে কি করে?”

রাত্রি আকাশ থেকে পড়ে বললো,
—“বাবা? উনার আর বাবার মধ্য না রেশারেশি?”

নিশাদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
—“সে তো বাইরে বাইরে। ভেতরে ভেতরে দেখেন গিয়ে দুজনেই বেরধক ভুগছে।”

রাত্রি অবাক হয়ে হতাশভাবে বললো,
—“আপনি উনাকে বলে দিতেন বাবার কথা। এসব শুনলে, একটু হলেও অভিমান কমতো। রাগ ভেঙে যেতো।”

—“আর বাবা এদিকে আমাকে ভেঙে দিতো। এসব কোনোকিছু যাতে ভাইয়ার কানে না যায় এ ব্যাপারে আগে থেকেই কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে তার।”

~চলবে~

[কালরাতে গল্প পুরোটা লিখে ফোনটা একটু সাইডে রেখে শুধু চোখটা বন্ধ করেছি। ভেবেছি যে পাঁচমিনিট পর উঠে এডিট করে পোস্ট দিবো। এরমাঝেই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি টেরই পাইনাই। সকালে উঠে দেখি ফোন ওভাবেই আছে, আমি গল্পও দেইনাই। যাইহোক, এটা কালকের পর্ব। আজকের পর্ব রাতে পাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here