#মনের কোণে পর্ব ৭
#আফনান লারা
.
নাবিল আজও মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হবার পর নিজের জুতাটা উধাও পেলো।সবার আগে লিখির কথাই মাথায় এসেছে।হনহনিয়ে চন্দ্রাহাটে এসে ফোন করলো ওর নাম্বারে।লিখি তখন গোসল করছিল।মাথায় তোয়ালে বেঁধে বের হয়ে ফোন কানে ধরতেই নাবিল এক গাদা ঝাড়ি দিয়ে বললো পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওর জুতা ফেরত দিয়ে যেতে।
‘আশ্চর্য!আমি আপনার জুতা কেন নিব?আমি আজকে চুরি করতে বের হইনি,বিকালে বের হবো’
‘একদম মিথ্যে বলবেনা,আমি জানি আমার জুতা তুমিই নিছো”
‘আমি নিই নাই।এবার কি পেটের নাড়িভূড়ি বের করে দেখাবো?’
‘ইয়াক!!!’
নাবিল ফোন কেটে কোমড়ে হাত দিয়ে চারিদিকে চোখ বুলালো।বাবার দেওয়া জুতাটাই চুরি হতে গেলো শেষমেষ।এবার জুতাটা ফিরে ফেলে তুলে রেখে দিতে হবে।
‘আর পরে বের হবোনা কোনোদিন।এই জায়গায় সব চোর।আইডিয়া!!’
নাবিল লিখিকে আবারও কল করলো।লিখি মুখে পাউডার লাগাচ্ছিল সেসময়ে।নাবিলরে নাম্বার দেখে রেগে মেগে রিসিভ করে বললো,’ কি সমস্যা!! একটা কথা কানে যায়না আপনার?আমাকে কেন বিশ্বাস করেন না আপনি?বললাম তো জুতা আমি নিই নাই’
‘তুমি যেহেতু চোর,অন্য চোরের সাথে নিশ্চয় তোমার ভীষণ খাতির?’
‘তো?’
‘তো এক্ষুনি এখানে চলে আসবে।খুঁজে দেবে আমার জুতা চোরকে।’
‘আমার বয়ে গেছে।এখন আমি খেতে যাব।বাই’
‘আচ্ছা আমি খাওয়াবো তাও আসো’
‘আসবোনা।আমাদের হোস্টেলে খাবার পাওয়া যায়’
‘আসবেনা?’
‘না’
‘টাকা লাগবেনা?’
‘কিসের টাকা?ওহ হো!আপনাকে ধরিয়ে দেবার টাকা?এত জলদি ম্যানেজ হয়ে গেছে?ওকে আমি আসছি এখনই’
লিখি গায়ে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে।নাবিলের কথামতন চন্দ্রাহাটে এসে পৌঁছেও গেছে।
মানুষের এত ভীড় যে কোথাও নাবিলের মতন কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।আপন মানুষ খুঁজতেও রফাদফা হয়ে যাবে যে অবস্থা।বাধ্য হয়ে ফোন বের করে কল করলো সে।
‘আমি তোমার পেছনে’
লিখি পেছনে তাকিয়ে নাবিলকে দেখে বললো,’কই আমার টাকা?’
‘আগে আমার জুতা খুঁজে দাও’
‘এই টাকা দিয়ে হাজারটা জুতা পাবেন।তাও সারাদিন জুতা জুতা।আপনার কি সব কিছুতেই মায়া লেগে থাকে?কোনো কিছু হারিয়ে গেলে সেটা ফিরে পেতেই হবে??
মানুষ পায়না!
হারানো জিনিস পায়না কেউ!এটা আপনাকে বুঝতে হবে’
‘আমার কাছে সহজ মনে হয় আমি চাইলেই হারানো জিনিস ফিরিয়ে আনতে পারবো,আমার সেই ইচ্ছাশক্তি আছে।’
‘আমি যদি না থাকতাম তবে কি করে খুঁজতেন?কার সাহায্যে?’
“দেখেছো?তুমি আছো।না থাকলে তখন দেখা যেত”
নাবিলের সাথে কথায় পেরে ওঠা যায়না।লিখি বাধ্য হয়ে হাঁটা ধরলো।অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো লিখি।
নাবিল চোখ বুলিয়ে গোটা দোকানটা দেখছে।যত নামিদামি সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা আছে সব ঝুলানো।ঘঁষামাজা করে নতুনের মতন করে রাখা সবগুলোকে।নাবিল এরই মাঝে নিজের জুতাটা খুঁজে পেলো।হাত দিয়ে ধরতে যেতেই দোকানদার মন্টু ওর হাত সরিয়ে বললো,’আমার দোকানের জিনিস কেউ কেনা ছাড়া ছুঁতে পারেনা।নিবেন কিনা বলেন তবেই নামামু’
লিখি ব্রু কুঁচকে বললো,’এটাই কি সেটা?’
নাবিল মাথা নাড়ালো।লিখি টান মেরে জুতাটা নিয়ে উল্টা পাল্টে ফিসফিস করে বললো,’মসজিদের বাহিরে থেকে তুলে এনেছিস তাইনা?’
মন্টু ও ফিসফিস করে বললো,’হুমম।দাম দুই হাজার বলি?এই জুতার দাম সম্পর্কে কিছু জানো?’
লিখি মুখের ভেতরের চুইংগামটা চিবাতে চিবাতে বললো,’পাঁচ চা।আমাকে ৫০% দিবি।’
মন্টু হালকা কেশে বললো,’ভাই নিবেন কিনা বলেন।আমি কিন্তু ৫হাজারের কমে দিবনা;আমার দোকান একদরের দোকান’
নাবিল কব্জি কচলাচ্ছিল।মন্টু জুতাটাকে প্যাকেটে ভরতে ভরতে বললো,’আমার দোকানের প্রথম কাস্টমার আপনি,আপনার চেহারায় কি যে মায়া!!আইচ্ছা যান দুইশ টাকা কম দিয়েন।চার হাজার আটশতে নাহয় ছাইড়া দিলাম।কি আর করার প্রথম কাস্টমার তো।দিয়া দেন’
নাবিল দুম করে ঘুষি একটা মেরে দিলো।মন্টু নাক ধরে ধপাস করে নিচে পড়ে গেছে।লিখি মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকলো।নাবিল জুতাটা নিয়ে পায়ে পরতে পরতে বললো,’যত্তসব আজাইরা লোকের ছড়াছড়ি এই এলাকায়।বাপের ছায়া থেকে না বের হলে এত বিনোদন নেওয়া হতোনা আমার।জীবন একেবারে ধন্য ‘
লিখি মন্টুকে ধরে দাঁড় করালো।মন্টু নাকের ব্যাথায় কিছু বলতেও পারছিলনা।লিখি আবার ফিসফিস করে বললো,’আরে জুতাটা এই লোকেরই।আমার গলায় ছু*রি ধরে এতদূর আনিয়েছে’
‘ও আগে বলবানা।নিয়ে যাও এখান থেকে’
নাবিল হাঁটা ধরেছে।লিখি ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’আমার টাকাটা তো দিলেননা।একদম আপনার বাপরে ফোন করে দেবো’
নাবিল পকপট থেকে পোস্টারটা বের করে লিখির মুখে ছুঁড়ে মারলো।লিখি পোস্টারটা ভালভাবে দেখে জিভে কামড় দিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে সেটাকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ড্রেনে ফেলে দিয়েছে
নাবিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,’ফটোকপি করা আছে পাঁচ কপি।’
‘আচ্ছা টাকা লাগবেনা,দোয়া দিয়েন আমি আসি’
‘নাবিল আবারও ওর ওড়না ধরে ফেললো।লিখি ভয়ে কি করবেনা না করবে ভাবছিল।
‘আমার ফোন তো ফিরিয়ে দিলেনা’
‘বললাম তো কিছু জিনিস হারালে মাটি খুঁড়েও পাওয়া যায়না।ওটাও সেরকম।উত্তরবঙ্গ চলে গেছে’
‘তো চলো উত্তরবঙ্গে।আমি এখানে থাকছিনা,বাবার লোকেরা এসে যাবে যে কোনো মূহুর্তে আর যতদূর জানি তোমারও এই এলাকায় থাকা টাফ,পালানো ও হবে, সাথে আমার ফোনটাও পাওয়া হয়ে যাবে’
‘আপনার ফোনের জন্য আমি এতদূর যাব?’
‘তোমাকে সাথে আনায় জুতা ব্যাক পেলাম,ফোন ও নিশ্চিত পেয়ে যাব।এই রিস্ক তোমায় নিতে হবে নাহলে এই যে পোস্টার দেখছো?তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবো তোমার বর্তমান ঠিকানা সমেত।আর আমার বাবাকে আমার ঠিকানা জানিয়েও লাভ হবেনা,কারণ আমি গা ঢাকা দিতে পারবো খুব সহজেই,কিন্তু তুমি একটা মেয়ে।তুমি গা ঢাকা দিতে পারবেনা এত জলদি।’
লিখি ওড়না ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’চ্যাংড়ার শখ কত’
‘রংপুরে গিয়েছিলে তাহলে?’
‘সব চুরির জিনিস ওখানেই আগে যায়।বসের বাড়ি ওখানে’
‘তবে আর কি।তোমাকে তো তবে যেতেই হবে।তৈরি হও’
—
নাবিল কেমন স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বললো আর চলেও গেলো।হাহ!!মগেরমুলুক পেয়েছে?আমার বাবা ভুলেও গেছে আমি যে তার মেয়ে।উনি নাকি আসবেন দেড় বছর পর আমায় খুঁজতে?অসম্ভব !আমার এত দরকার পড়ে নাই এমন নাছোড়বান্দা একটা ছেলের সাথে এতদূর পথ পাড়ি দপওয়ার।হুহ!’
ভেংচি কেটে হোস্টেলে ফেরত চলে আসছিল সে।পথের লম্বা দেয়ালটাতে নতুন লাগানো পোস্টার দেখে থামতে হলো।
ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে একটু কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ওখানে ঠিক কার তথ্য দেওয়া।
যেটা নিয়ে ভয় ছিল সেটাই হলো।বাবা এতদিন চুপ থেকে হঠাৎ আবারও বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
মাথায় হাত দিয়ে লিখি কোনোমতে হোস্টেলে চলে আসলো।হেনা বাহিরে থেকে ছুটে এসে বললো,’লিখি তোর ছবি তো এলাকার সবার হাতে হাতে।দেখেছিস?’
‘হুম’
‘তুই এত বড় একজন মানুষের মেয়ে,আগে তো বললিনা।’
‘বলার কি আছে এতো?’
‘পালিয়ে আসলি কখন সেটাই তো মাথায় নিতে পারছিনা,এতদিন কথাটা আমার থেকে লুকিয়ে গেলি?’
লিখি চুপচাপ ব্যাগে জামাকাপড় পুরছে আর হেনার বলা কথা গুলো শুনছে।হেনা কথার মাঝখানে বলে উঠলো তার অনেক পড়া বাকি।পড়তে হবে।সে ব্যস্ত হয়ে গেছে পড়া নিয়ে।লিখি নিজের কয়েকটা জামা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি ব্যাগে পুরে ওড়না মাথায় দিয়ে বললো,’আমি কদিনের জন্য মামার বাড়ি যাচ্ছি’
‘মামা?কেমন মামা?দেড় বছর ধরে তো আমি এটাও জানতাম না আদৌ তোর পরিবার বলে কিছু আছে কিনা’
‘এখন হুট করে মনে পড়লো তাই যাচ্ছি।রাস্তার পোস্টার গুলো বৃষ্টির পানিতে পানসে হয়ে গেলে কল করে জানিয়ে দিবি, আমি সেদিন ফিরবো’
লিখি চলে গেলো।হেনা ভাবছে ঠিক কতদিনে পোস্টার পানসে হয়।ভাবতে ভাবতে একটা বিক্রিয়া মাথায় আসলো।রেডি হয়ে নিলো ফরেনসিক ল্যাবে যাওয়ার জন্য।
চলবে♥