বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️ ২
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২
সুহানার নিকট হতে কোনো জবাব না পেয়ে শহুরে ছেলেটি কালবিলম্ব না করেই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি ওমর মোল্লার বাড়ি চিনেন?”
সুহানা জবাব দিলো না। কুঞ্চিত ভ্রুজুগল সহিত ছেলেটির দিকে নিমিষের জন্য চাইলো। সে এই ভেবে অবাক হলো, শহুরে এই ছেলেটি তার বাবাকে কেনো খুঁজছে? তার বাবার নামই তো ওমর মোল্লা। কিন্তু তার জানামতে তার বাবার সাথে কোনো শহুরে মানুষের উঠাবসা নেই। তাহলে এরা কারা? সুহানা এ সম্পর্কে ছেলেটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হলো। কিন্তু এর পূর্বেই পিছন হতে আরেকটি শহুরে গোছের ছেলে হাঁক ছেড়ে ডাকলো,
” নাজ, চলে আয়। ঠিকানা পেয়ে গিয়েছি। ”
পশ্চাত হতে চাচাতো ভাই তন্ময়ের ডাকে নাজ চট করে পিছনে ফিরে চাইলো। হাত উঁচিয়ে বললো,
” ওয়েট। আসছি আমি। ”
এই বলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পুনরায় সুহানার পানে চাইলো। অকস্মাৎ সুহানার ডান গালে তার দৃষ্টি আটকে গেলো। গৌরবর্ণের এ মুখশ্রীতে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে।
সুহানার গালে এরূপ আঙুলের ছাপ দেখে আঁতকে উঠলো নাজ। সে কৌতূহলী চাহনিতে সুহানার দিকেই চেয়ে রইলো। এদিকে নাজের দৃষ্টি অনুসরণ করে ক্ষণিকের জন্য সুহানা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। কিন্তু তৎক্ষনাৎ সে নিজের পরনের ওড়না দিয়ে গাল ঢেকে ফেললো। তার অকস্মাৎ এ কাজে নাজ সম্বিৎ ফিরে পেলো। মুহূর্তেই সে দৃষ্টি হটিয়ে নিলো। কিন্তু সুহানার গালে ফুটে উঠা আঙুলের ছাপের উপর তার কৌতূহল যেনো রয়েই গেলো। ফলশ্রুতিতে সে ভাবনাচিন্তা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে বসলো,
” আপনার গালে এমন দাগ কেনো?”
নাজের এমন কণ্ঠে সুহানা কিছুটা সংকুচিত হয়ে এলো। তবে আগন্তুকের সাথে কিরূপ কথা বলা উচিত তা তার জানা আছে। ফলে সে নিজেকে সামলে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” অপরিচিত মানুষের কাছে এতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা অনুচিত। ”
নাজ আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ পেলো না। সুহানার মিষ্টি কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি তার কানে ঝংকার তুললো। চারিধারে বহমান শীতল হাওয়া, বৃক্ষের পত্ররাজির এলোমেলো ছুটে চলা, কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম বর্ণের পত্র বিলিয়ে দেওয়া, পুকুরের পানিতে উৎপন্ন হওয়া ক্ষুদ্রতর ঢেউয়ের ধ্বনি, সকল ধ্বনির মিশ্রিত সুরের সহগমনে মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠস্বরে নাজ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলো। সে যেনো মধুর এক মন্ত্রে আটকা পড়েছে। কিন্তু তার এ মধুর মন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ ঘটলো তন্ময়ের তীক্ষ্ণ স্বরের হাঁকে।
” ঐ নাজ। ওভাবে হ্যাবলার মতো ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আমার কথা কি কানে যায়নি তোর? ঠিকানা পেয়ে গিয়েছি আমরা। দ্রুত চল, যেকোনো মুহূর্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়বে। ”
তন্ময়ের নিকট হতে ‘হ্যাবলা’ উপাধি পাওয়ায় নাজের মেজাজ চটে গেলো। ইশ, মেয়েটার সামনে তার প্রথম ভালো প্রভাবটাই নষ্ট করে দিলো তন্ময়! অন্য কোনো নামে কি তাকে ডাকতে পারতো না তন্ময়? চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে মনে মনে এক প্রকার পণ করে বসলো নাজ, আজ তন্ময়কে একা পেলো ইচ্ছেমতো পেটাবে সে।
নাজ আর সেখানে অবস্থান করলো না। সুহানার পানে এক পলক ফেললো। নিমিষের মাঝেই সুহানার মুখশ্রীর রূপরেখা নিজ মস্তিষ্কে মুদ্রিত করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো নাজ। এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে সে ঘাট পার হয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে তন্ময়ের নিকট চলে এলো৷ তন্ময়ের সাথে রয়েছে আরো কয়েকটি ছেলে। তারা প্রত্যেকেই সম্পর্কে একে অপরের কাজিন। তন্ময়ের নিকট এসেই নাজ তন্ময়ের পিঠে মোটামুটি জোরেশোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে বললো,
” আজ বাড়ি চল। তারপর দেখ তোর সাথে কি কি করি।”
নাজের নিকট হতে এহেন কথা শুনে তন্ময় ভ্রু জুগল কুঞ্চিত করে নাজের পানে চাইলো। স্বগোতক্তি করে বললো,
” আমি আবার কি করলাম?”
নাজ তন্ময়ের প্রশ্ন শুনলো। তবে কোনো জবাব দিলো না। বরং বাকিদের সাথে পা বাড়িয়ে সে স্থান হতে প্রস্থান করলো।
এদিকে নাজের এহেন কিম্ভূতকিমাকার আচরণ দেখে ভীষণ বিস্মিত ও বিরক্ত হলো সুহানা। সে কুঞ্চিত ভ্রু জুগল নিয়ে চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
” অদ্ভুত মানুষ তো! চাহনি কেমন অদ্ভুত! অপরিচিত মানুষের সাথে কি করে কথা বলতে হয় তাও জানা নেই না কি? কোথায়, আমার দেখা শহুরে মানুষগুলো তো এমন নয়৷ তাহলে এ শহুরে প্রাণিটা এমন কেনো?”
সুহানা নাজ ও তার ভাইদের যাওয়ার পানে দৃষ্টি স্থাপন করেই কথাগুলো বললো। অতঃপর ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেঙচি কেটে বললো,
” হুহ, ফালতু ছেলে কোথাকার৷ না জানি, কি উদ্দেশ্যে আব্বাকে খুঁজছে। আব্বা এদের…..”
সুহানার কথার মাঝেই অঘোষিতভাবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। মুহূর্তেই প্রবল বর্ষনে চারিপাশ কুয়াশার ন্যায় শুভ্রতায় ছেয়ে গেলো।
দূর গগনে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ধূসর কালো গগন ধীরমাত্রায় উজ্জ্বল ধূসর বর্ণে পরিণত হচ্ছে। বহুদিনের বর্ষনের পর ধরার ধুলোগুলো সিক্ত হতে আরম্ভ করেছে। মাটির সোঁদা ঘ্রাণে পরিবেশ ম-ম করছে। আহা, কি দারুন সে ঘ্রাণ! বৃক্ষরাজির পত্রপল্লবসমূহ বহুদিন পর নিজেদের রূপ ফিরে পেয়েছে। যে রূপ পুরু ধুলোর স্তরে ঢাকা পড়েছিলো সে রূপ আজ বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। ঝকঝকে শ্যামল হরিদ্বর্ণে বৃক্ষরাজি মুখরিত হয়ে আছে। পুকুরের পানিতে টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সে বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে রিনঝিন একটি মধুর ধ্বনি সৃষ্টি করছে। সুহানা স্থির দাঁড়িয়ে রয়ে কান পেতে সে ধ্বনি শুনছে। প্রবল বর্ষনে সে ভিজে চুপচপে হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির শীতল পরশে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। তার পাতলা ঠোঁটজোড়া অল্পবিস্তর কাঁপছে। কিন্তু এদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ব্যস্ত বৃষ্টির ধ্বনি শুনতে। এ ধ্বনির মাঝে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে অপ্রকাশিত কিছু কথা, অপ্রকাশিত কিছু কষ্ট, অপ্রকাশিত কিছু স্বস্তি।
কৃষ্ণচূড়ার লাল লাল পত্রপল্লবে ছেয়ে উঠা পুকুরের পানি স্নিগ্ধ রূপে রাঙায়িত হয়েছে। বিস্তর পুকুরে বহমান ক্ষুদ্রতর ঢেউয়ের তালে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুচ্ছ নেচে বেড়াচ্ছে। এপাশ হতে ওপাশে তারা দুলছে। সুহানা নেত্রজুগল মেলে পুকুরের পরিবেশে দৃষ্টিপাত করলো। কি দারুণ চলমান এ দৃশ্য! মন চাইছে এ রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ছোঁয়ায় ছেয়ে উঠা লালাভ পুকুরে সর্বাঙ্গ ভেজাতে। তো বাঁধা কিসে? এ জলরাশিতে সর্বাঙ্গ ভেজাতে মন উদ্যত হতেই সুহানা ধীর পায়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে পুকুরে নেমে পড়লো। কাঁধ অব্দি পুকুরে নিমজ্জিত রেখে রুদ্ধ নেত্রজুগল দ্বারা বহমান ধ্বনি কর্ণগোচর করলো সুহানা। প্রবল বর্ষনের সাথে বহমান হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঝরে ঝরে পরছে। তেমনই দু চারটি কৃষ্ণচূড়া সুহানার ললাট ও মুখশ্রীতে লেপ্টে রয়ে গেলো। কিন্তু সুহানার সেদিকে ধ্যান রইলো না। সে এ মুহূর্তে বর্ষন উপভোগ করতে ব্যস্ত। কি মনোরম এ পরিবেশ! ইশ, যদি এ বর্ষন না থামে তাহলে কি উপভোগ্য হবে পরিবেশটি!
এদিকে প্রবল বর্ষনের সম্মুখীন হয়ে দ্রুত একটি সেঁচ ঘরে অবস্থান করেছিলো নাজ ও তার ভাইয়েরা। সেচ ঘরের মাথার উপর টিনের চাল ব্যতিত চারিধারে কিছুই নেই। বাঁশ দিয়ে চারকোনা আকৃতির উন্মুক্ত একটি ঘর। সে ঘরেই অবস্থান করে গ্রামীণ পরিবেশের প্রবল বর্ষন দেখছে সকলে। চারপাশের স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে করতে নাজ এর দৃষ্টিজোড়া বন্দি হয়ে গেলো সুহানার পানে। সেচ ঘর হতে পুরো পুকুরঘাটসহ একাংশ দৃষ্টিগোচর হয়। সে দৃষ্টিগোচরকৃত অংশেই কৃষ্ণচূড়ায় আবৃত সুহানার মুখশ্রী নাজ এর দৃষ্টি কেড়ে নিলো।
®সারা মেহেক(সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইলো❤️)
গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ
#চলবে
( লেখাগুলো কল্পনায় আনলে কেমন অনুভূত হয় জানিয়েন তো সবাই।❤️)