#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat
রুম থেকে আসা বিকট শব্দে রৌদ্র হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটে আসলো। অস্থির হয়ে পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও আরশিকে দেখতে পেল না৷ হঠাৎই বারান্দা থেকে চাপাকান্নার আওয়াজ রৌদ্র কানে ভেসে আসলো৷ সাথে সাথেই মনের মধ্যে ভয় ঝেঁকে বসলো। মাথার মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরেছে- তার রুদ্রাণীর কিছু হয় নি তো! রৌদ্র ভয়ে দ্রুত বারান্দায় দিকে ছুটে গেল। বারান্দায় এসেই রৌদ্র থমকে দাঁড়ালো। কৌতুহলী চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি মেঝেতে বসে আছে। ঠিক সামনেই রৌদ্র রুদ্রাণী নামক পাখি দুটোর খাঁচাটা পরে আছে। পাখি গুলো খাঁচায় নেই৷ রৌদ্রর আর বুঝতে বাকি রইলো না আরশির কান্নার কারণ কি হতে পারে। রৌদ্র ধীর পায়ে আরশির কাছে এসে বসে পরলো। আরশির কাধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল-
“মন খারাপ করো না আরু। যা যাওয়ার তা চলে গেছে। সেটা নিয়ে এখন কান্নাকাটি করে নিজেকে আর তুলতুলকে কষ্ট দিও না। তুমি কষ্ট পেলে আমাদের তুলতুলও কষ্ট পাবে ভুলে যেও না।”
রৌদ্র নানানভাবে আরশিকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। তার নিজেরও বড্ড কষ্ট হচ্ছে তবে প্রকাশ করছে না। পাখিগুলো তার খুব প্রিয় ছিল। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পাখিগুলোর সাথে। পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ তার কাছে গানের মতো মনে হতো। রৌদ্র আরশির অগোচরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আরশির কান্না থেমেছে। তবুও মন খারাপ করে রেখেছে। রৌদ্র আর তেমন কিছু বলল না। খাঁচাটা বারান্দার এক পাশে রেখে আরশিকে নিয়ে রুমে চলে আসে। সারাদিন আরশি মলিন মুখেই ছিলো৷ চোখের সামনে শুধু পাখিগুলো ভেসে উঠছে। আর কানে বাজছে পাখির কিচিরমিচির ডাক। পাখিগুলো ছাড়া কেমন যেন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
বিকেলের শেষ সময়। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে ক্লান্ত সূর্যের রক্তিম আভা। ক্লান্ত কাক গুলো বেসুরে গলায় ডাকছে। কাকের ডাক গুলোতে ক্লান্তি আর হতাশা। রাস্তায় দেখা যাচ্ছে ক্লান্ত মানুষ। সারাদিনের পরিশ্রমে সবাই যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পরেছে। আরশি বেশ কিছুক্ষন ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র ঘুমচ্ছে। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর ফলেই এই অসময়ে ঘুম হচ্ছে। রুম থেকে রৌদ্রর ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। রৌদ্রর ঘুম ভেঙে যাওয়ার আশংকায় আরশি দ্রুত রুমে চলে আসলো। কিন্তু রৌদ্রকে রুমে দেখতে পাচ্ছে না। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। হয়তো ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে গেছে। আরশি বিছানা থেকে রৌদ্রর ফোনটা হাতে তুলে নিলো। স্কিনের উপর ধ্রুবর আম্মুর নাম্বার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আরশি হাসি মুখে ফোন রিসিভ করলো। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ধ্রুবর মা কান্নারত অবস্থায় জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল-
“হঠাৎ করেই ধ্রুবর বুক ব্যথা প্রচন্ড বেড়ে গেছে রৌদ্র। খুব অসুস্থ হয়েছে পড়েছে। আমার ধ্রুবটা ছটফট করছে বুক ব্যথা। শ্বাস নিতে পারছে না ও। এখন হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। বাবা রৌদ্র তুই একটু আসবি হসপিটালে! আমি কিছু বুঝতে পারছি না কি করবো। আমার খুব ভয় করছে রে। আমার ধ্রুব বাঁচবে তো রৌদ্র?”
পাশ থেকে ধ্রুবর গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধ্রুবর মা ফোন না কেটেই ছেলে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আরশির কোনো কথা বলছে না। ফোন কানে নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুবর মার আহাজারি শুনতে পাচ্ছে-
“বাবা খুব কষ্ট হচ্ছে তোর তাই না! আর একটু অপেক্ষা কর এইতো হসপিটালের কাছেই এসে পড়েছি। তুই ভয় পাস না ধ্রুব তোর কিচ্ছু হবে না। তোর মা তোকে কিচ্ছু হতে দিবে না।… ”
রৌদ্র রুমে এসে আরশিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে। মিহি কন্ঠে পর পর দুবার ডাক দিয়ে কোনো সাড়াশব্দ পেল না। আরশির আগের মতোই ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র কৌতূহল নিয়ে আরশির কান থেকে ফোন ছিনিয়ে নেয়। স্কিনে ধ্রুবর মা’র নাম্বার দেখে তৎক্ষনাৎ নিজের কানের কাছে ফোন ধরলো। শুনতে পেল ধ্রুবর আর্তনাদ আর তার মা’র আহাজারি। রৌদ্রর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। আরশি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে তার। শরীর কাঁপছে। রৌদ্র আরশিকে ঝাঁকিয়ে বলল-
“আরু আমাদেরকে এখনই যেতে হবে। সময় নেই। তাড়াতাড়ি চল।”
আরশি কিছু বলল না। রৌদ্র আরশির হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর আরশি নির্বাকের মতো রৌদ্রর সাথে সাথে যাচ্ছে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই হসপিটালে এসে পৌঁছালো। আরশি পুরো রাস্তা কোনো কথা বলেনি। হসপিটালে ধ্রুবর কেবিনের কাছে আসতেই ধুব্রর মা’কে দেখতে পেল। চেয়ারে বসে মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে। রৌদ্রকে দেখতেই অস্থিরতার সাথে রৌদ্রর কাছে আসলো। রৌদ্রর দু হাত ধরে উত্তেজিত হয়ে বলল-
“রৌদ্র তুই আমার ছেলেকে বাঁচা। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিছু কর তুই। যে করেই হোক আমার ধ্রুবকে বাঁচা। আমি তোর কাছে হাত জোর করে বলছি।”
রৌদ্র দ্রুত ধ্রুবর মা’র হাত ধরে ফেলে। ওনাকে জড়িয়ে ধরে অপ্রস্তুত হয়ে বলল-
“এসব কি করছো আন্টি! শান্ত হও তুমি প্লিজ। আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি শান্ত হয়ে বসো এখানে।”
রৌদ্র ধ্রুবর মা’কে বসিয়ে দিয়ে আরশির কাছে আসলো। আরশি নির্লিপ্ততার সাথে তাকিয়ে দেখছে সব কিছু। এই মুহূর্তে আরশির ভাবাবেগ বোঝার ক্ষমতা কারও নেই। নির্বাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“নিজের খেয়াল রেখো আর আন্টিকে একটু ভরসা দিও। আমি এখন যাচ্ছি ডক্টরদের সাথে কথা বলতে হবে। কান্নাকাটি করবে না একদম। ঠিক আছে!”
আরশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রৌদ্র দ্রুত পায়ে চলে গেলে ডক্টরদের কাছে। আরশি কেবিনের দরজার কাচের জায়গাটা দিয়ে ধ্রুবর দিকে এক ঝলক তাকালো। ঘুমিয়ে আছে ধ্রুব। হয়তো ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। হাল্কা নীল রঙের হসপিটালের ড্রেস পড়ানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে আছে। হাতে, বুকে আরও অনেক কিছু লাগিয়ে রেখেছে যেগুলোর নাম আরশি জানে না। আরশি তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলো ধ্রুব থেকে। ধীরে ধীরে এসে ধ্রুবর মার কাছে এসে বসলো। কি বলে সান্ত্বনা দিবে তাকে! সন্তানের এই অবস্থায় একজন মা’কে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় তা আরশির জানা নেই।
———————
“উফফ মা থামবে তুমি!! আমার এসব কান্নাকাটি একদমই পছন্দ না।”
প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলল ধ্রুব। দু’দিনে ধ্রুব কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। বুক ব্যথা তেমন নেই। শ্বাস নিতেও আর কষ্ট হচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে পারে এখন। কিছুক্ষণ আগেই ডক্টর পারমিশন দিয়েছে ধ্রুবর সাথে কথা বলার। সেই থেকেই শুরু হয়েছে তার মা’র কান্না। ধ্রুবর পাশে বসে নিঃশব্দে কান্না করেই যাচ্ছেন তিনি। আরশি কেবিনে এসেছে। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। দুদিন আগেই রৌদ্র কাছেই সব জেনেছে আরশি। সব কিছু শোনার পর এই দু’দিন খুব কান্না করেছে। রৌদ্রর অনেক বোঝানোর পর আরশি নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। ধ্রুবর সামনে তো কোনো মতেই কান্না করা যাবে না তার। তাহলে যে ছেলেটা ভয় পাবে। আরশি কষ্ট পাবে, কান্নাকাটি করবে বলেই তো ধ্রুব তার কথা লুকিয়ে রেখেছিল। আরশিকে দেখে ধ্রুব দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দেয়। আরশি ধ্রুবর বেডের পাশে এসে ধ্রুবর কান টেনে ধরে। সাথে সাথেই ধ্রুব চেচিয়ে উঠলো। আরশির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আকুতি মিনতি করে বলল-
“আহহ.. আরুদি ব্যথা পাচ্ছি তো। আমার কান ছাড়ো প্লিজ ব্যথা পাচ্ছি খুব। আমার কান ছিড়ে যাচ্ছে তো আরুদি।”
আরশি রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
“অনেক বড় হয়ে গেছিস তাই না!! আমার কাছে কথা লুকিয়ে রাখিস! এতোটা বড় হয়ে গেছিস যে আমি কষ্ট পাবো তা চিন্তা করিস তাই না!।
“আরু দি প্লিজ ছাড়ো। আর কখনো তোমার কাছে কিছু লুকিয়ে রাখবো না প্রমিজ করছি।”
আরশি ধ্রুবর কান ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে শক্ত গলায় বলল-
“এবার কানটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু নেক্সট টাইম আর ছাড়াবো না। কান ছিড়ে কাকদের বিলিয়ে দিবো।”
ধ্রুব মলিন মুখে বলল-
“তাহলে তো তোমার ভাইয়ের বউ পাওয়া যাবে না। কানকাটা ছেলেকে তো কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে না।”
ধ্রুবর কথা শুনে আরশি ফিক করে হেসে দেয়। ধ্রুবর মা-ও এখন কান্নাকাটি থামিয়ে তাদের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসছে। ধ্রুবও হাসছে। তাদের এই সুন্দর মুহুর্তটা দরজার বাহির দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখছে একজোড়া চোখ। চোখ দুটো চিকচিক করছে মানুষটার। সেই মানুষটা আর কেউ নয় ধ্রুবর বাবা। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন তিনি। টাকা টাকা করে সে নিজের ফ্যামিলিকে অবহেলা করেছে সব সময়। নিজেকের ছেলেকে সময় দেয়নি। ধ্রুব কখনো তার সাথে এভাবে হেসে হেসে কথা বলেছে বলে তার মনে পড়ে না। কখনো তার সাথে আড্ডা দেয়নি। অবশ্য সে নিজেই তো তার ছেলেকে সময় দেয়নি তাহলে কিভাবে দেখবে এসব? আফসোসের সাগরে ডুবে যাচ্ছে ধ্রুবর বাবা। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। বাবা হিসেবে সে ব্যর্থ। কি লাভ হলো এত টাকা কামিয়ে? যে টাকা দিয়ে সে নিজের ছেলের জীবনটাই রক্ষা করতে পারছে না! বুক চিড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার। দরজার কাছ থেকেই উল্টো পথে হাঁটতে লাগলেন তিনি। কেবিনে যাওয়ার সাহস তার নাই। তিনি খুব ভালো করেই জানেন এই মুহূর্তে তাকে দেখে ধ্রুবর হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠবে। তাই তিনি চায় না ধ্রুবর হাসি মুখটা কেড়ে নিতে।
হাসাহাসির মাঝেই হঠাৎ করে আরশির পেইন শুরু হলো। ব্যথা কুকিয়ে উঠলো আরশি। ধ্রুব আরশির অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে পরেছে। ধ্রুবর মা দ্রুত আরশির কাছে আরশিকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। চিৎকার করে ডক্টরদের ডাকতে লাগলেন। নার্স এসে আরশিকে অন্য কেবিনে নিয়ে গেল। রৌদ্র নিজের কেবিনে রোগী নিয়ে ব্যস্ত। রৌদ্রর কাছেও দ্রুত খবর দেওয়া হলো। রৌদ্র আরশির কথা শুনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। ড.শৈলী আরশিকে চেকআপ করছে। আরশির কেবিনে এসে রৌদ্র ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে আরুর? এখন কেন পেইন শুরু হয়েছে? ডেলিভারি ডেট তো আরও অনেক পরে।”
ড.শৈলী চিন্তিত গলায় বলল-
“আরশির অবস্থা বেশি ভালো দেখাচ্ছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিজার করতে হবে। আপনি সিজারের সকল ব্যবস্থা করুন ড.রৌদ্র।”
রৌদ্রর উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। ভয়াতুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
“আরুর কিছু হবে না তো ডক্টর? তুলতুল ঠিক আছে তো!”
“এখন কিছু বলতে পারছি না। তবে তাদের সিচুয়েশন খুব ভালো মনে হচ্ছে না। এমনিতেই হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি তার উপর আবার ন’মাসের শুরুতে পেইন উঠেছে। বুঝতেই পারছেন আপনি খুবই ক্রিটিকাল সিচুয়েশন।”
চলবে…..
[মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে লিখেছি। একটু অগোছালো হয়েছে আর ছোট হয়েছে পর্বটা। দুঃখিত। রিচেক করা হয়নি ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]