বিবি পর্ব (২)

0
660

বিবি পর্ব (২)
#রোকসানা_রাহমান

অনড়ার বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন ভালো ছিল না। একটুতেই তর্কে জড়িয়ে পড়ত দুজন৷ কথা কাটাকাটি থেকে মারামারি! রান্না বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, কথা বন্ধ থাকত প্রায়শই। এমন অবস্থায় জন্ম হয় অনড়ার। তার জন্মের পর এই ঝগড়াঝাঁটি বেড়ে হয় দ্বিগুণ। অনড়ার বয়স যখন দুই বছর তখন তার মা রাগ করে বাপেরবাড়ি চলে আসে। অনড়ার বাবা সেই রাগ না ভাঙিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এ খবর শোনার পর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি অনড়ার মা। কয়েকদিন চুপচাপ থেকে নদীর জলে নিজেকে বিসর্জন দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও অনড়ার বাবা দেখতে আসেনি। মেয়ের খোঁজ-খবর নেয়নি। তারপর থেকে নানি জমিলা বেগমের কাছে বড় হচ্ছে অনড়া।

জমিলা বেগম দরিদ্র মানুষ। হা-ভাতের সংসার। ধাইয়ের কাজ করে যা পান তাই দিয়ে নিজের পেট চালাতেন। তন্মধ্যে নাতির দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ায় বৃদ্ধ বয়সে কাজ নেন মোল্লাবাড়িতে। ছোট্ট অনড়াকে সঙ্গে নিয়েই সে বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে নানান কাজে সাহায্য করতেন। মোল্লাবাড়ির একমাত্র মেয়ে কোমল। সকলের আদুরের এই মেয়েটির আদর গিয়ে পড়ল অনড়ার উপর। কোমলের কোনো ভাই-বোন না থাকায় এই বাচ্চা মেয়েটি হলো তার খেলার সঙ্গী, ছোটবোন। ভাব একটু গভীর হতে বুবু ডাকা শেখাল। বইপত্র কিনে দিয়ে পড়ানো শুরু করল। জমিলা বেগমের দায়িত্বের বোঝাও যেন একটু কমল। প্রসূতিসদনে ডাক পড়লে কোমলের কাছে রেখে যেতেন নিশ্চিন্তে। কোমলও সুযোগে বড়বোনের মতো খায়িয়ে-দায়িয়ে নিজের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিত। আজও তাই ঘটেছিল। দূরপাড়া থেকে জমিলার ডাক পড়লে অনড়াকে কোমলের কাছে রেখে যান। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলেও তার ফেরার নাম নেই। পড়া শেষ করে খেয়ে নিয়েছে অনড়া। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ বলল,
” তুমি ছেলেকে দেখেছিলে? ”

কোমল দরজায় সিটকানি টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল,
” কোন ছেলে? ”
” তোমাকে দেখতে এসেছিল যে। ”
” না। ”
” আমি দেখেছি। মাথায় চুল নেই অথচ ঠোঁটের উপর ইয়া মোটা গোঁফ। ভালো হয়েছে বিয়ে ভেঙে গেছে। তোমার সাথে একটুও মানাত না। ”

কোমল বিছানায় উঠল। অনড়ার পাশে শুয়ে কাত হলো। কৌতূহলীভঙ্গিতে বলল,
” একটুও মানাত না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” দেখতে ভালো না তাই। ”
” দেখতে ভালো না হলে মানায় না? ”
” সবাই তো তাই বলে। ”
” ভুল বলে। ”

মাত্র কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি কোমলের কথার ভাবার্থ ধরতে পারল না। বলল,
” তোমার কম চুল, মোটা গোঁফ পছন্দ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” তোমার কেমন ছেলে পছন্দ? ”
” আমার পছন্দ শুনে কী করবি? ”
” ছেলে খুঁজে আনব। ”
” তাই? ”

অনড়া মাথা নাড়ে। কোমল একটু ভাবার ভঙ্গি করে বলল,
” যে ছেলের মন সুন্দর আমার তাকে পছন্দ। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” যে ছেলের ব্যবহার সুন্দর আমার তাকে পছন্দ।

আরেকটু থেমে বলল,
” যে ছেলের চরিত্র সুন্দর আমার তাকেও পছন্দ। ”

অনড়া চোখ বড় বড় করে বলল,
” তুমি তিনটা ছেলেকে বিয়ে করবে? আমি তিনজনকে দুলাভাই ডাকব? ”

কোমল শব্দ করে হেসে ফেলল। তার এই হাসির কারণ ধরতে পারল না অনড়া। জিজ্ঞেস করল,
” হাসছ কেন? ”

কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে হাসতেই থাকল। অনড়া মুখ কালো করে ফেললে সে বলল,
” এই তিনটি গুণ তিনজন আলাদা ব্যক্তি কেন? একজনের মধ্যে থাকতে পারে না? ”

অনড়া একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল,
” পারে তো। ”
” তাহলে সে ছেলে ধরে নিয়ে আয়। বিয়ে করে ফেলি। ”

অনড়া ভীষণ খুশি হলো। উৎসাহি কণ্ঠে বলল,
” সুন্দর মন, সুন্দর ব্যবহার, সুন্দর চরিত্রের ছেলেটিই হবে আমার বুবুর সুন্দর বর। ”

অনড়ার গাল টেনে ধরে কোমল বলল,
” উহু, উত্তম ব্যবহার, উত্তম মন ও উত্তম চরিত্রের ছেলেটিই হবে তোর বুবুর উত্তম বর। ”

_______________
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে নিবিড়। দু’মাস হতে চলল পরিবার থেকে দূরে। প্রিয়জনদের মুখ দেখছে না। যোগাযোগ রাখছে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে। রাত-দিন এক করে টানা পড়ার গতি আরও বেড়েছে আজ। কাল তার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম ত্যাগ করে একনাগাড়ে পড়ছে। ঠোঁটের সাথে হাতও চলছে তাল মিলিয়ে। লিখতে লিখতে হঠাৎ কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় কলম খুঁজছিল। তখনই একটি সোনার কানের দুলে চোখ পড়ে। মুহূর্তেই চঞ্চল দৃষ্টি আচঞ্চল হয়। অস্থির ঠোঁট জোড়া স্থির হয়। নিবিড় পড়া ভুলে, ধ্যান হারায়। অচেতনতায় দুলটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গভীর মোহ, মুগ্ধতা। শুষ্ক ঠোঁটদুটিতে লাজুক হাসি। সন্ধ্যার মায়া ঠেলে আবির্ভুত হয় দুটি চোখ। কী মায়া সে চোখে! কী নেশা তার পলকে! নিবিড়ের হৃদয় পুলকিত হয়। উন্মত্ত হয় চাওয়া-পাওয়া। সেসময় কেউ একজন ছোঁ মেরে দুলটি নিয়ে গেল। নিবিড় পাগলপ্রায় অবস্থায় পেছন ঘুরে। ব্যাকুল হয়ে বলল,
” দুলাল ভাই, দুলটা দেন। ”

দুলাল হলো নিবিড়ের রুমমেট। বয়সে বড় হওয়াই ভাই সম্বোধন করে নিবিড়। শ্রদ্ধাও করে। তার ছোট-খাটো প্রয়োজন দুলালভাই মিটিয়ে দেয়।

দুলাল ভাই দুলসহ ডানহাতটা পেছনে মুড়ে নিয়ে বললেন,
” আগে বল এর রহস্য কী? ”
” কোনো রহস্য নেই। ”
” আছে। অবশ্যই আছে। কেউ মারা গেলেও তোকে পড়ার টেবিল থেকে উঠানো যায় না। অথচ এই সামান্য দুলটা শুধু পড়া না, দুনিয়াটাই ভুলিয়ে দেয়। এর কারণ কী? কী আছে এতে? ”

নিবিড় উত্তর দিতে পারে না। চুপও থাকতে পারে না। অস্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলাল গভীরভাবে জরিপ করেন নিবিড়কে। সন্দিহানে বললেন,
” প্রেম করছিস? ”

নিবিড় লজ্জা পেল। দৃষ্টি নত করল। অস্থিরভাব দমিয়ে রাখার পুরো চেষ্টা চালালেও সফল হলো না। দুলাল ভাই ধরে ফেললেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
” নাম কী? ”
” জি? ”
” দুলকন্যার নাম কী? ”

নিবিড় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। খানিক্ষন ইতস্ততায় ভুগে ধীরে বলল,
” কোমল। ”

দুলাল বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
” তুই সত্যি প্রেম করছিস? ”

নিবিড় তড়িঘড়িতে বলল,
” একদম না। ”
” তাহলে? ”
” পছন্দ করি। ”

দুলাল জিজ্ঞাসা পর্ব শেষ করতে পারল না। মধ্যপথে একটি চিঠি এসে পৌঁছাল নিবিড়ের হাতে। ঠিকানা দেখে জানাল,
” বাড়ি থেকে এসেছে। ”
” চিঠি পড়ে শেষ কর। খেতে যাব। ”

নিবিড় অনুমতি পেয়ে চিঠির খাম খুলল। এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে আমচকা বলল,
” তোমার কাছে একশ টাকা হবে, দুলাল ভাই? ”
” একশ টাকা? কেন? ”
” বাড়ি যাব। ”
” চাচা-চাচির কিছু হয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

নিবিড়ের উত্তর দেওয়ার সময় নেই যেন। চটপটে শার্ট গায়ে দিয়ে বলল,
” এখন বলার সময় নেই। এসে বলব। টাকা থাকলে দেও। ”

দুলাল টাকা বের করতে করতে বলল,
” এখনই যাবি? কাল না তোর পরীক্ষা? ”
” সে পরে দেখা যাবে। ”

দুলালের দিতে হলো না। নিবিড় নিজেই একশ টাকার নোটটি নিয়ে দরজার দিকে ছুটল। দুলাল পেছন থেকে বলল,
” পরীক্ষাটা না দিলে তোর স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ”

নিবিড় চোখের আড়াল হতে হতে বলল,
” এখন না গেলে আমার ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবে। ”

________________

নিবিড় বাড়িতে পৌঁছাল মাঝরাতে। কুলসুম নাহার শঙ্কিত গলায় বললেন,
” তুই? এতরাতে? ”

নিবিড় মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। মায়ের পেছনে দাঁড়ানো বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি কোমলকে বিয়ে করব, বাবা। আজ, এখনই। ”

মতিন মিয়ার চোখ জ্বলে উঠল। স্ত্রীর পেছন থেকে সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” গাঞ্জা খাইছস? ”
” না, বাবা। ”
” তাইলে মদ খাইছস। ”
” আমি কিছু খাইনি, বাবা। ”
” তাইলে তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। ”

নিবিড় শান্ত থাকতে পারল না। অধৈর্য্য হয়ে বলল,
” এসব কেন বলছ, বাবা? আমার মাথা ঠিক আছে। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। মাথা ঠিক থাকলে কি তোর থেকে ছয় বছরের বড় মাইয়ারে বিয়া করতে চাইতি? ”

মতিন মিয়া স্ত্রীর দিকে ঘুরে আবার বললেন,
” তোমার পোলার মাথা নষ্ট হইয়া গেছে। জলদি সামলাও। নাহলে আমাগো পেটে লাথি মারব। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here