#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩১+৩২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“এই যে পাশের বারান্দা তুমি এতো লজ্জা পাও কেন?? লজ্জায় তো তুমি লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছো।”
নির্বানের কথায় আরশির লজ্জা আর অস্বস্তির পরিমাণ যেন দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। রৌদ্র এবার কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠেই বলল-
“নির্বান এভাবে কাউকে বিব্রত করা ঠিক না। তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস তবু্ও কেন অবুঝের মতো করছিস!!”
নির্বান এবার থেমে গেল। স্বাভাবিক হয়ে শালীন কন্ঠে বললো-
“আচ্ছা সরি। আচ্ছা পাশের বারান্দা এখানে কি করছে??”
রৌদ্র গম্ভীরমুখে বলল-
“তোর এতো কিছু জানতে হবে না। তুই এখানে কেন এসেছিস তা বল।”
নির্বান শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে আরশির বরাবর চেয়ারটায় বসে পড়লো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বলল-
“পাশের বারান্দা এখানে তাই হয়তো চলে এসেছি মনের টানে। কেমন আছো পাশের বারান্দা??”
আরশি এতোক্ষনে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও নির্বানের কথায় ভ্রু কুচকে ফেললো। সংকুচিত হয়ে বলল-
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু বার বার আমাকে পাশের বারান্দা বলছেন কেন?”
রৌদ্র নির্বানের পাশের চেয়ারে গাঁ এলিয়ে বসে পরল। নির্বানের উত্তর দেওয়ার আগেই রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“কারন আপনি পাশের বারান্দায় থাকেন। এই সহজ ব্যাপারটাও বুঝতে পারছেনা আপনি!”
আরশি রৌদ্রর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-
“তা খুব করেই বুঝতে পারছি তবে পাশের বারান্দায় থাকি বলে কি আমাকে পাশের বারান্দা বলে ডাকবে না-কি অদ্ভুত!!”
নির্বার সোজা হয়ে টেবিলের উপর হাত রেখে আরশির দিকে সরু চোখে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“তোমার সাথে নামটা খুব মানায় তাই ডাকি। কিন্তু তুমি তো দেখছি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের মুড চেঞ্জ করে ফেল। কিছুক্ষণ আগে লজ্জায় লাল হচ্ছিলে আর এখন রাগে লাল হচ্ছো। তোমার রূপ পরিবর্তন দেখে আমি তো আবার ক্রাশ খেলাম তোমার উপর।”
আরশি বিষম খেল। কাশতে কাশতে নির্বানের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। নির্বানের মুখে দুষ্টু হাসি লেগে আছে। আরশি মনে মনে বলল- “এই ছেলে তো নীলের থেকেও বড় বদেরহাড্ডি। বার বার আমাকে কিভাবে লজ্জা দিচ্ছে। বড় ভাইয়ের সামনে এসব বলতে কি একটুও লজ্জা করছে না এই ছেলের??”
“এইইইই পাশের বারান্দা কি এতো ভাবছো??”
নির্বানের আর্কষণ কাড়া ডাকে আরশির ধ্যান ভাঙলো। আরশি নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো-
“নাহ কিছু না। ডক্টর আমি বাসায় যাবো।”
আরশি লাস্টের কথাটা রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল-
রৌদ্র আরশির কথায় কোনো প্রতিত্তোর দিল না। নির্বানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আজ হঠাৎ করে তুই এখানে আসলি কি মনে করে?? মামি পাঠিয়েছে না-কি!!”
“এমনি ইচ্ছে হলো তোমার সাথে দেখা করতে তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।”
“আচ্ছা তাহলে বাসায় চল। আজ আমার সাথেই না হয় থাকবি।”
নির্বান একটা দুষ্টু হাসি দিল৷ আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“হুম ভালোই হবে। রাতে আমরা সবাই মিলে পাশাপাশি বারান্দায় থেকে আড্ডা দিব। বাই চান্স ক্রাশের নতুন কোনো রূপ থাকলে সেটাও দেখে ফেলতে পারবো।”
রৌদ্র চোখ গরম করে নির্বানের তাকালেই নির্বান চুপসে যায়। আরশি চুপচাপ ওদের দুজনের কথা শুনছে। নিজেকে এখন সমুদ্রে ডুবন্ত থাকা এক মানুষের মতো মনে হচ্ছে। অস্বস্তির সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে আরশি। এই দু’জন মানুষের কাছ থেকে দূরে গেলেই হয়তো স্বস্তির শ্বাস নিবে।
“আচ্ছা মিস আরু চলুন এখন। নির্বান তুইও চল।”
আরশি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। নির্বান কিছুটা অবাক হয়ে সন্দেহের গলায় বললো-
“ছিঃ ভাই তুমি এখনো পাশের বারান্দাকে আপনি করে বলছো!! এভাবে কথা বললে প্রেম হবে কিভাবে!!! তোমাকে আমি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি যে এতো বোকা তা তো জানতাম না।”
আরশি বিস্ফোরিত চোখে নির্বানের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রৌদ্র দিকে তাকালো। রৌদ্র দাঁড়িয়ে ডান হাতে নিজের চুল গুলো ঠিক করে বলল-
“কিছু কিছু জিনিস সবার থেকে আলাদা অন্যরকম থাকাই খুব ভালো। সাধারণের চেয়ে অসাধারণ কিছুই মানুষের মনে গভীরভাবে জায়গায় করে নেয়।”
আরশি কিছু বুঝতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নির্বান প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে রৌদ্রর কাধ জড়িয়ে ধরে কানে কানে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“ভাই তুমি সত্যিই পাশের বারান্দাকে পছন্দ কর??”
রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“বাসায় চল তারপর সব জানতে পারবি।”
রৌদ্র আর নির্বান একসাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আরশিও তাদের পেছন পেছন চুপচাপ যাচ্ছে। গাড়িতে সারা রাস্তা কেউ কোনো কথা বলেনি। নির্বান তার মুখ খুললেই রৌদ্রর রামধমক খেয়ে আবার চুপ হয়ে যায়। বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথেই আরশি কোনো কথা না বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়। নির্বান জানালা দিয়ে মাথা বের করে খানিকটা চেচিয়ে বলল-
“ভাবি রাতে কিন্তু বারান্দায় আড্ডা দিব। মনে থাকে যেন।”
আরশি নির্বানের দিকে একপলক তাকিয়ে বাসায় চলে যায়। রৌদ্রর কল আসায় কিছুক্ষণ কথা বলার পর বলল-
“কাল একটু ব্যস্ত আছি। তবে আপনারা চাইলে আজ বিকেলেই দেখা করতে পারি।”
অপরপ্রান্তের মানুষটার সাথে কিছুক্ষন কথা বলেই রৌদ্র ফোন কেটে দিল। নির্বান কিছুটা নিরাশ৷ হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কোথায় যাবা ভাই? আমি কি একা একা থাকবো নাকি তোমার বাসায়??”
রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-
“বেশিক্ষণ না এক দেড় ঘন্টার জন্য যাবো।”
—————————
ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে বসে আছে রৌদ্র। তার ঠিক সামনের দুই চেয়ারে বসে আছে নীল আর কাসফিয়া। নীলের চোখমুখ শক্ত। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ স্পষ্ট। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রৌদ্রর দিকে। কাসফিয়া জোড়ালো শ্বাস ফেলে একবার নীলের গম্ভীরতা পরক্ষ করছে আবার রৌদ্রর হাসিমুখের দিকে তাকাচ্ছে। এই প্রথম রৌদ্রর হাসি দেখে কাসফিয়া কিছুটা অবাক হলো৷ তবে অবাকের চেয়ে বিরক্তির পরিমান দ্বিগুণ। এই মুহূর্তে রৌদ্রর এই মুচকি হাসিটাই হয়তো নীলের গম্ভীরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাসফিয়া একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল-
” আসলেই আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা ছিল।”
রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“হুম তা শোনার জন্যই তো আমার এখানে আসা। বলো কি বলবে তোমরা।”
নীল টেবিলের উপর দু’হাত উঠিয়ে গম্ভীরতার সাথে জিজ্ঞেস করল-
“আপনি আশুকে পছন্দ করেন আর বিয়ে করতে চান কথাটা কি সত্যি??”
রৌদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-
“নাহ কথাটা পুরোপুরি সত্যি না।”
নীল আর কাসফিয়া চমকালো। দুজনের চোখে কৌতুহলের তারা খেলে গেল। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল নীল।
“তাহলে সত্যি কোনটা??”
রৌদ্র নীলের দিকে তাকালো। দুহাত ভাজ করে শীতল কন্ঠে বললো-
“আমি আরুকে শুধু পছন্দ করি আর বিয়ে করতে চাই কথাটা এমন না। আমি আরুকে ভালোবাসি প্রচন্ড ভালোবাসি। আর বিয়ে করে সারাজীবন আরুকে আগলে রাখতে চাই।”
রৌদ্রর এমন ভ্রুক্ষেপহীন কথা শুনে কাসফিয়া কিছুটা লজ্জা পেল। নীলের মাঝেও পরিবর্তন হলো। গাম্ভীর্যের ছাপ মুছে গিয়ে এখন শান্ত শীতল চাহনিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ ছাড়াই আরশিকে ভালোবাসার কথা বলেছে তা শুনে কিছুটা মুগ্ধ হলো নীল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে গম্ভীরতা এনে জিজ্ঞেস করল-
“সত্যিই আশুকে ভালোবাসেন না-কি আপনার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই আশুকে বেছে নিয়েছেন!! আজ থেকে একটা কথা মাথায় ভালো করে গেঁথে রাখুন। আশু হয়তো নিজেকে ব্যর্থ বলে দাবি করে তবে ব্যাপারটা এমন না। তাই আশুকে ব্যর্থ মনে করে যদি ভেবে থাকেন আপনি আশুকে দয়া করবেন তাহলে এটা কখনো আমরা কেউ মেনে নিব না।”
নীলের কথায় রৌদ্রর চোখ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। দু হাত মুষ্টি বদ্ধ করে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করলো। নীল আর কাসফিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। দু’জনেই রৌদ্রর উত্তরের অপেক্ষা করছে। রৌদ্রর নিজের ঠোঁটে এক কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলল-
“প্রথমত, আরু আমার ভালোবাসা, কোনো পন্য দ্রব্য নয় যে আমি ওকে আমি বেছে নিব। আরু আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। আমার একমাত্র ভালোবাসা আরু। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চাই বেছে নিতে চাই না। দ্বিতীয়ত, আমি আরুকে কখনো ব্যর্থ মনে করিনি। আমি আরুকে ভালোবেসে আপন করতে চাই দয়া করে না। তোমরা দু’জন নিশ্চয়ই আরুকে অনেক ভালোবাস তা-ই না!!”
নীল আর কাসফিয়া মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো।
“তোমরা যদি সত্যিই আরুর ভালো চাও তাহলে আমি এখন যা বলবো তা কখনো তোমরা আরুর কে বলতে পারবে না। কি!! রাজি তো আমার কথায়!!”
কাসফিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে নীলের দিকে তাকালো। নীল চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই কাসফিয়া নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“কি কথা বলুন।”
রৌদ্র পেছনের দিকে হেলান দিয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল-
“আমি আরুর সমস্যাটা নিয়ে ডক্টরের সাথে অনেক আগেই কথা বলেছিলাম। ডক্টর বলেছে আরুর তেমন কোনো প্রব্লেম নেই হরমোনের প্রব্লেম আছে আর সেই কারনেই হয়তো গর্ভধারণের ক্ষমতা একটু কম। তবে আরুর মা হওয়ার চান্স আছে হয়তো রিক্স আছে কিন্তু চিকিৎসা করলে সেটা ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা-ই বেশি। আর আমি যতটুকু বুঝলাম আরু ভেবেই নিয়েছে ও কখনো মা হতে পারবে না। নিজেকে সবার কাছে ব্যর্থ বলে দাবি করছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এই সুন্দর জীবন থেকে। শুধু মাত্র ভবিষ্যতে মা হতে না পারলে আশে পাশের মানুষ কষ্ট পাবে, সমাজের মানুষ তিক্ত কথা বলবে সেই ভয়ে।”
রৌদ্র থেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থাকা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে নীলের দিকে তাকালো। দুজনের চোখে প্রচন্ড আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে রৌদ্রর কথা বলার জন্য।
“আমি যখন আরুকে বিয়ের কথা বলি তখন আমাকেও এইসব নানানরকম কথা বলে বিয়ের জন্য না করে দিয়েছিল। তবে কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েই কথাটা বলেছিল। আর আমি তখনই বুঝে গেছি আরু নিজের মনে একটু হলেও আমাকে জায়গা দিয়েছে। আর এইজন্যই আমাকে প্রত্যাখ্যান করার আগে নিজের মনকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমার প্রতি কোনো প্রকার অনুভূতি অনুভব করতে। আরুর চুপ থাকার মধ্যেও অজস্র কথা লুকিয়ে থাকে সেটা আমি বুঝতে পারি। অনুভব করতে পারি আরুর চুপ থাকা। আর আমাদের দুজনের ভালোর জন্যই আমি আরুকে ঠকাচ্ছি।”
নীল অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“ঠকাচ্ছেন মানে?? কিভাবে ঠকাচ্ছেন আশুকে!!”
চলবে….
[দুঃখিত অসুস্থতার জন্য গতকাল গল্প দিতে পারিনি। আজও দিতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু আপনারা অপেক্ষা করবেন তাই দিয়ে দিলাম। জানিনা কেমন লিখেছি হয়তো অগোছালো হয়েছে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর হ্যাঁ অবশ্যই আপনাদের মন্তব্য জানাবেন। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা। ❤️]
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“হ্যাঁ আমি আরুকে ঠকাচ্ছি তবে এতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ আমার নেই।”
রৌদ্র কফির মগ তুলে এক চুমুক দিয়ে শান্ত চোখে নীল আর কাসফিয়ার দিকে তাকালো। তাদের চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ। চোখে ফুটে উঠেছে জানার তীব্র আগ্রহ। রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“আমার যতটুকু ধারন আরু অন্য কারও কষ্টের কথা শুনলেই অস্থির হয়ে পরে। এমনকি অন্য কারও মন খারাপে আরু নিজেও মন খারাপ করে ফেলে। তাই আমি জানতাম আমি বাবা হতে অক্ষম এই কথা শুনে আরু মন খারাপ করে ফেলবে। আমার জন্য কষ্ট পাবে এমনকি আমার এই কথাটা নিয়ে এতটা-ই মন খারাপ করবে যে আরু এটাও যাচাই করবে না আমি সত্যি বলেছি নাকি মিথ্যা।”
রৌদ্রর কথা শুনে নীল আর কাসফিয়া দুজনের চোখ বিস্ময়ে গোলাকৃতি হয়ে গেল। নীল জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেস-
“আপনি আরু মানে আমাদের আশুকে মিথ্যা কথা বলেছেন??”
রৌদ্র সহজ গলায় উত্তর দিল-
“এটা ছাড়া আর কোনো উপায় রাখেনি আরু।”
কাসফিয়া কিছুটা নেড়েচেড়ে বসলো। খানিকটা ইতস্ততভাবে বলল-
“আপনি নিজেকে নিয়ে এত বড় মিথ্যা কথা বলেছেন কেন?? আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কতো বড় একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেছেন??”
রৌদ্র ঠোঁটের কোণে এক তৃপ্তিদায়ক হাসির রেখা টেনে বলল-
“এটা তেমন কোনো বড় কথা না। আমার কাছে ফাস্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে আমার ভালোবাসা। আর আমার ভালোবাসা মানেই আরু। তার মানে আরু হচ্ছে এখন আমার জীবনের ফাস্ট প্রায়োরিটি। আরুর মনে আমার জন্য অনুভূতি আছে সেটা জেনেও কিভাবে আমি ওর প্রত্যাখ্যান গ্রহণ করি তোমরাই বল!! আরু মা হতে পারলো কি পারলো না এই তুচ্ছ কারনে আমি আমার ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাবো ওতটা কাপুরষ এই রৌদ্র নয়। আমি জানি প্রতিটি মেয়েই চায় মা হতে। একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো নিজের সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে পারা। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আরুও সেই সুযোগটা পাবে। আরু নিজের সমস্যাটাকে যতটা বড় করে দেখছে সমস্যা পুরপুরিই তার উল্টো৷ সামান্য চিকিৎসার মাধ্যমেই এই প্রব্লেম ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাই হোক আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। এখন তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ আমার এই কথা গুলো যেন আমাদের তিনজনের মধ্যেই থাকে।”
রৌদ্রর কথা শুনে কাসফিয়ার চোখ পানিতে চিকচিক করে উঠলো। কাসফিয়ার বলা সেই রাজকুমারকে এখন নিজের সামনে দেখে খুশিতে চিকচিক করে উঠেছে তার চোখ। কাসফিয়া রৌদ্রর চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরশির প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। এইটাই সেই রাজকুমার যে কি-না সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়েই আরশিকে তার রাজকুমারীর করে নিয়ে যাবে। নিজের কাল্পনিকতাকে এভাবে বাস্তবিক রূপ পেতে দেখে কাসফিয়ার খুশি উপচে পরতে চাইছে সুখের অশ্রুপাত হয়ে। নীল চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে রৌদ্রর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুটা ভ্রু কুচকে নীলের দিকে তাকাতেই নীল ঝড়ের বেগে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরলো। রৌদ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীল এভাবে হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরবে সেটা রৌদ্র বুঝতে পারেনি। নীল খানিকটা আবেগী কন্ঠে বললো-
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের আশুর জীবনে আসার জন্য। আশুকে আপনার থেকে বেশি আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না তা আমি বুঝে গেছি। আমরা সবাই আশুকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র ভয় নেই। আমার বিশ্বাস আপনি আশুকে সারাজীবন আগলে রাখবেন।”
রৌদ্র মুচকি হেসে নীলের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় মেরে বলল-
“এবার তোমরাও আমাকে একটু হেল্প কর। তোমাদের ফ্রেন্ড তো খুব পাজি মেয়ে। আমার কাছে নিজেকে ধরা দিতেই চায় না।”
নীল রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টামি করে বলল-
“আপনি আশুকে পটানোর কাজ চালিয়ে যান। আর আপনাদেরকে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
কথাটা বলেই নীল উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। নীলের সাথে সাথে রৌদ্র আর কাসফিয়াও তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের চারপাশের টেবিলের কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ তাদের তাকিয়ে আছে। কাসফিয়া আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে নীলকে চাপা কন্ঠে বললো-
“নীল হাসি বন্ধ করে চুপচাপ বসে পর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।”
কাসফিয়া কথা শুনে রৌদ্র আর নীল হাসি থামিয়ে চারদিকে এক নজরে চোখ বুলিয়ে নিল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে। রৌদ্র আর নীল একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে আবারও নিজেদের জায়গায় বসে পরলো।
————————
শেষ বিকেলের শান্ত শীতল পরিবেশ। পশ্চিম আকাশে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পরা সূর্যের রক্তিম আভা। কিছুটা সময় পরপর বয়ে যাওয়া ধমকা হাওয়া সব মিলিয়ে আরশির মন বার বার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলছে। একাকিত্বের সময় এই প্রকৃতিই তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। কাসফিয়া বাসায় না থাকায় আরশি একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির মুগ্ধতার মাঝে। নিঃস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে আরশির চারপাশে। পাখিগুলোও আজ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে, কোনো কিচিরমিচির শব্দ করছে না। আরশি এক মনে তাকিয়ে পশ্চিমা আকাশের এই রক্তিমা আভা গুলোর কালো হয়ে যাওয়া দেখিছে।
“এই পাশের বারান্দা এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি করছো??”
আচমকা নির্বানের কন্ঠ শুনে আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আরশি গোলগোল চোখ চোখ দিয়ে নির্বানের দিকে তাকাতেই নির্বান বলল-
“উফফফ.. পাশের বারান্দা আমাকে এতো ভয় পাও কেন বলো তো!! আমি রোদ ভাইয়ের মতো এতো গম্ভীর আর রাগী না তাই আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে নিজের ফ্রেন্ড মনে করতে পারো।”
আরশি ভ্রু কুচকে নির্বানের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“এভাবে আচমকা ডাক দিলে তো ভয় পাবোই।”
“তুমি নিজেই তো গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলে তাই আমার উপস্থিতি টের পাওনি এটা কি আমার দোষ!!”
আরশির ভ্রু জোড়া আগের চেয়েও কিছুটা কুচকে এলো। নির্বানের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল-
“আপনি-ও আপনার রোদ ভাইয়ের মতো কথা প্যাচান। যাই হোক এসব বাদ দিয়ে আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন পরিচিত হই।”
নির্বান একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল-
“বাহহহ ভাবি না মানে তুমি তো দেখছি আমার স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছো। ভালো লাগলো দেখে। আমি নির্বান হাসান নীড়। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আর রোদ ভাইয়ের একমাত্র মামাতো ভাই। এবার মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। এবার তুমি বলো।”
নির্বানের কথায় আরশি বিস্মিত হয়ে বলল-
“কিহহ আপনি মাস্টার্স ফাইনাল দিবেন!!”
নির্বান মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। আরশি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার বয়সি হবেন। আপনার কথাবার্তা আর চালচলন দেখে তো মনে হয় আপনি আমার থেকে-ও ছোট।”
নির্বান সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমাকে দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি বাচ্চা মেয়ে।”
নির্বানের কথা শুনে আরশি হেসে দিল। আরশির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বানও হাসতে লাগলো।
————————
“আচ্ছা তাহলে এখন আপনার কি প্ল্যান রৌদ্র ভাই?? আশুকে কিভাবে লাইনে আনবেন?”
নীলের কথায় রৌদ্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললো-
“তোমাদের ফ্রেন্ড লাইনে না আসলেও ওকে লাইনে কীভাবে আনতে হবে তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কালকের দিনটা শুধু অপেক্ষা করবো তারপর সব আমার মতো হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে।”
কথা গুলো বলেই রৌদ্র একটা রহস্যময় হাসি দিল। কাসফিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল-
“মানে কি করবেন?”
“আজ সময় নেই৷ পরে সব জানিয়ে দিব৷ তোমরা দুজন শুধু আমাকে একটু হেল্প করো তাহলেই হবে। বাকি আমি ম্যানেজ করে নিব।”
নীল রৌদ্রকে আস্বস্ত করে বলল-
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার কথা মতোই সব কাজ করবো।”
“আচ্ছা তাহলে আজ উঠছি।”
রৌদ্র নীল আর কাসফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কাসফিয়া চিন্তিত গলায় নীলকে জিজ্ঞেস করল-
“দোস্ত রৌদ্র ভাই কি করবে রে??”
“যা-ই করুক না কেন এতটুকু বিশ্বাস রাখ আমাদের আশুর কোনো ক্ষতি হবে না। বুঝলি গাধি!!”
নীলের ভ্রুক্ষেপহীন প্রতিত্তোর শুনে কাসফিয়া অবাক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালো। নীল কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“উফফফ এতো চিন্তা করিস না তো কাসফি। ওনার বলা কথা গুলো মনে মনে ভাব সব চিন্তা এমনিতেই গায়েব হয়ে যাবে।”
কাসফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
“আচ্ছা চল এখন। আশু বাসায় একা।”
——————————
আরশি নির্বানের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর রৌদ্র আবছা আলোয় আরশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। আরশিকে আগে কখনো তার সামনে এতটা হাসিখুশি থাকতে দেখেনি। সব সময় লজ্জায় আর না হয় অস্বস্তিতে চুপটি মেরে থাকতো। কিন্তু আজ কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। অবশ্য নির্বানের মতো পাজি ছেলের সামনে কেউ-ই চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না। আরশি রুম থেকে কয়েকটা চকলেট এনে নির্বানের দিকে ছুড়ে মারলো। নির্বান একটা চকলেট রৌদ্রর দিকে এগিয়ে দেয় কিন্তু রৌদ্র এখনো মুগ্ধ হয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।
“এই যে মুগ্ধ প্রেমিক একটু ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসুন।”
নির্বানের কথায় রৌদ্র আর আরশি দুজনেই কিছুটা লজ্জা পেল। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-
“তুই দিন দিন অনেক ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস নির্বান।”
নির্বান কিছু ভাব নিয়ে বলল-
“আমি একদম পারফেক্ট আছি। কিন্তু তুমিই দিন দিন বয়ষ্ক মানুষদের মতো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছো। আমি ঠিক বলেছি না পাশের বারান্দা???”
নির্বান আরশির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি একটা মুচকি হাসি বলল-
“হুম এই জন্যই তো ওনার নাম এ্যাংরি বার্ড রেখেছি।”
“ভাবি তুমি তো খুব ভালো নাম রাখতে পারো। ভাইয়ের সাথে একদম মিলে গেছে।”
কথাটা বলেই নির্বান ঝংকার তুলে হাসতে লাগলো। আরশিও ঠোঁট চেপে হাসছে।
“নির্বান তুই কিন্তু এখন আমার হাতে মাইর খাবি ফাজিল কোথাকার।”
রৌদ্রর রাগী কন্ঠ শুনে নির্বান দৌড়ে রুমে চলে গেল। রৌদ্র আরশি দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করুক আমি আসছি।”
রৌদ্র কথা বলে এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্বানের পেছনে ছুটে গেল। আরশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের যাওয়ার পথের দিকে।
চলবে…
[ সামনে ধামাকা আসতে চলছে অপেক্ষা করুন সবাই। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️]