#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা পর্ব ৯
#আফসানা_মিমি
কোন একটা নাটকে দেখা। সেখানে অভিনেতা বলেন কোন একজন মানুষকে ঘুম থেকে জাগ্রত করার সময়ে, “আমি ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে জাগ্রত করতে পারি কিন্তু জাগ্রত মানুষকে শত ডেকেও জাগ্রত করতে পারব না।
রুপ এই নিয়ে পাঁচ বার নাদিফকে ডেকেছে। নাদিফের কোন হেলদোল নেই। রুপের কোলে শুয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে নাদিফ। রুপের কাঁপা কাঁপা হাত বিরাজ করছে নাদিফের ঘন কালো কেশবে। প্রায় দশ মিনিট হয়েছে রুপ নাদিফের কামরায়। নাদিফ বর্তমানে রুপের কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। একটা মানুষ কীভাবে এতো ঘুমাতে পারে! রুপ ভাবছে,”নাদিফ হয়তো রুপকে আয়েশা আজাদ ভেবেছে এজন্যই সহজেই কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। নয়তো আমাকে স্বচক্ষে এখানে দেখলে পানি ছাড়া আস্তো গিলে ফেলতো। যা তেজ এই ছেলের।”
আরো কিছু সময় অতিবাহিত হলো। রুপ আস্তে করে নাদিফের মাথা নিজের কোল থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রাখে। নাদিফ নড়েচড়ে উঠে অপরপাশে ফিরে আবারও ঘুমিয়ে যায়। নাদিফের নড়াচড়া দেখে রুপ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। এক প্রকার দৌঁড়ে কামরা থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে রুপের ওড়নার সাথে বেঁধে দরজার পাশে টেবিলের উপর রাখা কাঁচের শো-পিস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রুপ আবারও ফিরে আসতে চেয়েও আসেনি। বর্তমানে এখান থেকে পাড়াপাড় হলে’ই বাঁচে রুপ।
এদিকে রুপ চলে যেতেই নাদিফের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। অপরপাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে ফিরে চোখ খুলে। জমিনে পড়ে থাকা টুকরো কাঁচগুলো দেখে বলে উঠে,
” এমন হাজারো কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হোক। এমন হাজারো সময় যেন আমার ঘুমের ঘোরে আসে। আমি এমনভাবে হাজারবার নিদ্রাহীনতার অভিনয় করতে প্রস্তুত অপরুপ!”
———
প্রেম নীড়ের সদর দরজার কলিং বেল অনবরত বেজে চলছে। এমনটা কোন সময় হয় না। পরিচিত সকলের নিকট সদর দরজার তালার চাবি আছে। আর অপরিচিত কেউ হলে দারোয়ান অবশ্যই আগে জানাবে আজাদ সাহেবকে।
সোফায় বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছিলেন আজাদ সাহেব। বার কয়েকবার কলিং বেলের আওয়াজে বিরক্ত হলেন খুব। রান্নাঘরে, সিঁড়ি দিকে কিয়ৎক্ষণ উঁকি ঝুঁকি মেরে কোন কাজ হলো না আজাদ সাহেবের। টেবিলের উপর শব্দ করে খবরের কাগজ ফেলে দরজা খুলে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলো। আজাদ সাহেবের বর্তমান মেজাজ এতোটাই বিরক্ত যে দরজার অপরপাশে যে আছে তাকে কয়েকটা বকে দিয়ে দিবে।
সদর দরজা খুলতেই দুইজন তরুন-তরুণীর হাস্যজ্বল মুখশ্রী ভেসে আসে। আজাদ সাহেব মনে করতে চেষ্টা করছেন এরা আজাদ সাহেবের কোন ভাই-বোনের বাচ্চা-কাচ্চা কিন্তু মনে করতে পারেননি। কেননা এদের একজনের চেহারার সাথে আজাদ সাহেবের ভাই-বোনের চেহারার সাথে এদের মিল নেই।
” কাকে চাই বাচ্চারা? আমার তো কোন স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে নেই। তোমরা কি চাঁদা নিতে এসেছো?”
প্রেম নীড়ের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল এবং ফাল্গুনী। ফয়সালের গণিতে সমস্যা হয়েছে তাই দর্পণ কোচিং সেন্টার থেকে রুপের বর্তমান ঠিকানা নিয়ে ফাল্গুনীকে শতক হু’ম’কি দিয়ে এখানে নিয়ে আসা। ফয়সালদের সামনে আজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে মুখে কিছুক্ষণ আগের করা প্রশ্নের উওর পাবার আশা।
” রুপ ম্যাডামের নিকট এসেছি। পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করতে। আমরা ভদ্র বাচ্চা চাঁদা নেই না।”
আজাদ সাহেব জিহ্বা কাটলেন। মনে মনে নিজেকে শ’খানেক বকা দিলেন মুখ বেশি চলার কারণে।
ফাল্গুনী ফয়সালের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ফয়সাল আজ রুপকে প্রপোজ করবে এজন্য ফাল্গুনীকে নিয়ে এসেছে। আজাদ সাহেব ফয়সাল, ফাল্গুনীকে সোফায় বসতে বলে চলে গিয়েছেন। ফয়সাল ফিসফিস করে ফাল্গুনীর সাথে কথা বলছে,
” আজ আমি সফল হবো দেখিস। ইতিহাসে আমার আর রুপ ম্যাডামকে নিয়ে লিখা হবে। লাইলি, মজনুর বদলে ফয়সাল,রুপকে নিয়ে লিখা হবে।”
ফাল্গুনীর কান শুনছে ফয়সালের কথা কিন্তু আঁখি জোড়া ঘুরছে পুরো বাড়িতে। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ফাল্গুনী অবাক হয়ে যায়। লাল ঢিলেঢালা টি শার্ট পরিহিত সুদর্শন পুরুষকে দেখে। ফাল্গুনী মনে মনে ভাবছে,
” এত সুন্দর ছেলে রুপ ম্যাডামের বাড়িতে থাকে। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কিছু কানেকশন আছে! ওরে ফয়সাল রে! তোর কপাল পুড়েছে। তোর কপালে মনে হচ্ছে আমার মত অবলা নারীই রয়েছে।”
নাদিফ এসে সোফায় ফয়সাল, ফাল্গুনীর অপরপাশে বসলো। শব্দ করে আয়েশা আজাদের নিকট কফি চাইলো।
ফয়সাল একবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার নাদিফের দিকে তাকাচ্ছে। চিকন গড়নের ফয়সালকে দেখে রোগা পাতলা একজন ক্যান্সারের রোগী মনে হচ্ছে। আর ফয়সালের সম্মুখে বসারত লম্বা, স্বাস্থ্যবান নাদিফকে সুদর্শন সুপুরুষ মনে হচ্ছে।
আয়েশা আজাদ অবগত ছিলেন না রুপের ছাত্র-ছাত্রীর ব্যপারে। নাদিফের জন্য কফি নিয়ে এসে চোখ যায় ফয়সাল ফাল্গুনীর দিকে।
” তোর কফি বাবা! এরা কারা? তোর বন্ধু নাকি?”
নাদিফ মায়ের কথায় বিরক্ত হয়। ফয়সাল, ফাল্গুনীর মতো হাঁটুর বয়সী বাচ্চারা নাকি নাদিফের বন্ধু হবে! ইহা হাস্যকর।
” দেখো তোমার নাতি-পুতি হবে হয়তো।”
নাদিফ কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। নাদিফের সামনে যে দুইটা এলিয়েন বসা সেদিকে তার খেয়াল মাত্র নেই। আয়েশা আজাদ ছেলের বেপরোয়া স্বভাবে রেগে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” তোর বাবার তো প্রেম নীড় ছাড়াও আরো ইট্টু,গিট্টু নীড় রয়েছে। যেখানে হালি হালি বাচ্চা পালে। একদম বাজে কথা বলবি না নাদিফ। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
” তো যাও, নিষেধ করেছে কে?”
আয়েশা আজাদ হতাশ। ছেলে যে বাবার পাগল তা আয়েশা আজাদের জানা। পৃথিবীতে ছেলেরা নাকি মায়েদের ভালোবাসে, আর মেয়েথা বাবাদের। কিন্তু নাদিফের বেলায় ভিন্ন। তামিল চলচিত্রের মতো নাদিফ বাবার পাগল। বাবাকে নিয়ে কিছু বললে যেন তার কলিজায় লাগে। অগত্যা আয়েশা আজাদ ই হাসিমুখে ফয়সাল, ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কার কাছে এসেছো তোমরা?”
ফয়সাল,ফাল্গুনী এতক্ষণ মা ছেলের কাহিনী দেখছিলো। আয়েশা আজাদের কথা শুনে ফয়সাল ফট করে বলে উঠে,
” আপনাদের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া রুপ! তার কাছে এসেছি।”
নাদিফ ফয়সালেরকথা শুনে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। নাদিফের সম্মুখে বসে থাকা ছেলেটা রুপের থেকে কম হলেও চার পাঁচ বচরের ছোট হবে। রুপকে নাম ধরে ডাকছে!
” সম্পর্কে তোমরা কি হও?”
নাদিফের থমথমে প্রশ্ন।
ফাল্গুনী এবার দাঁত দ্বারা নোখ কেঁটে যাচ্ছে। এবার ফয়সাল কি উওর দিবে ভেবেই কলিজায় পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
” আমার প্রেমি,,,,
ফয়সালের কথার মাঝেই রুপের আগমন ঘটে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই ফাল্গুনীর উদ্দেশ্যে বলে,
” তোমরা হঠাৎ বাড়ি এলে যে? আমি তো বিকালে পড়াতে যাবো। কোন বিশেষ প্রয়োজন ছিলো কি?”
রুপ এতক্ষণ নাদিফকে দেখেনি। রুপ উদ্বিগ্ন হয়ে কথা বলছিলো। নাদিফকে দেখে আগের মত চুপ হয়ে গেলো। এদিকে নাদিফ ফয়সালের আধো কথা বুঝতে পারে। রুপের প্রেমিক হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করছে ছেলেটা ভেবেই রাগ লাগছে নাদিফের।
” এরা তোমার ছাত্র-ছাত্রী?”
নাদিফ রুপের চোখাচোখি হলো। রুপ ভীত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। নাদিফ রূপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। লতার ন্যায় কেশব পেঁচিয়ে ঢিলেঢালা খোঁপা করে রেখেছে কলম দ্বারা। তারমানে রুপ এতক্ষণ পড়ছিলো। দুষ্টু কেশব পড়ায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য শাস্তি স্বরূপ কলম দিয়েই আটকে রেখেখে রুপ। রুপের চোখে চশমা, ললাটের উপরও কিছু অবাধ্য কেশব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ফয়সালও হা করে রুপকে দেখছে। হঠাৎ চোখ যায় নাদিফের দিকে। নাদিফ যে রুপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বুঝতে পেরে খানিকটা কেশে উঠে।
এদিকে রুপ কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কথা ভাবছে আর লজ্জা পাচ্ছে। নাদিফকে কি উওর দিবে ভাবছে,
” হ্যাঁ বিকেলে ওদের পড়াই।”
নাদিফ এবার একটু জোরেই ‘আচ্ছা’ বলল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে তাকালো।
” তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের উপরে নিয়ে যাও। আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি।”
আয়েশা আজাদের কথায় সকলে নড়েচড়ে উঠে। রুপ মাথায় সায় জানিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। পিছনে ফয়সাল, ফাল্গুনীও রওনা হয় রুপের সাথে।
” তোমার ছাত্রটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। এখানে থাকুক। আমি একা বসে বোর হয়ে যাচ্ছি। আমাকে সময় দিক। তুমি তোমার ছাত্রীকে নিয়ে উপরে যাও। চিন্তা করিও না, তোমার ছাত্রের সাথে দু চারটে কথা বলবো মাত্র।
নাদিফ শুরুর কথাগুলো হেসে খেলে বললেও শেষের কথাগুলো ফয়সালের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে। এদিকে ফয়সাল শুকনো ঢোক গিলে নাদিফের কথা শুনে। পিছনে ফিরে ফাল্গুনীর দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। ফাল্গুনী মাথা নাড়িয়ে ঠোঁটে বিড়বিড় করে বলে,
“চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আমি এখন আর কিছুই করতে পারব না। তুই আমাকে নিয়ে এসেছিস, তুই ঝামেলা পাকিয়েছিস, এবার তুই ঠিক কর।
রুপ, ফাল্গুনী চলে গেলো। বসে রইলো ফয়সাল, নাদিফ। নাদিফ কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে। উঠে দাঁড়ালো। নাদিফের দাঁড়ানো দেখে ফয়সালও আপনা আপনি দাঁড়িয়ে গেলো। নাদিফের ঠোঁটে বাঁকা হাসি রেখা বিদ্যমান। ফয়সালের কাঁধে হাত রেখে একপ্রকার জোর করে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।
” চলো তোমাকে রংধনু দেখাই। বাহারি রংয়ের রংধনু। যেদিকে তাকাবে সেদিকেই লাল, নীল,কালো,সবুজ রং দেখতে পারবে।”
কেমন রংধনু হবে নিশ্চয়ই সকলে বুঝতে পারছেন! দোয়া করেন সবাই ফয়সালের জন্য।
চলবে…..
[সন্ধ্যায় আরেক পর্ব পাবেন ইনশাআল্লাহ]