মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব-০৪,০৫

0
491

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব-০৪,০৫
সায়লা সুলতানা লাকী
০৪

লাবন্যকে নিয়ে টেনশন করতে বারন করেছে হিমেল। ও নাকি লাবন্যের সাথে কথা বলবে একটু সময় গুছিয়ে নিয়ে। সেই ভরসাতেই বসে আছে রেশমা। ভেতর থেকে শান্তিটা শুধু ফুরুৎ ফুরুৎ করে ওড়াল দিতে চাইছে, কি যে এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগছে মনটা তা কাউকে বোঝাতে পারছে না ও। অপেক্ষা করছে হিমেল কখন কল দেয় মেয়েকে। একটা সময় অপেক্ষার প্রহর ফুরলো, সন্ধ্যার দিকে ঠিকই টের পেল হিমেলের কলটা এসেছে মেয়ের মোবাইলে। মেয়ে বেশ গদোগদো হয়ে কথা বলছে তাতেই বুঝলো। যদিও অন্য কোন সময় লাবন্যের কথায় কান পাতে না, আজ যেন কি হল ওর। সব নিয়মনীতি ভুলে মেয়ের রুমে কান পাতল–

” হ্যা বলো! কি মনে করে কল দিলে? তুমিতো আবার একজন বড়োওওও ব্যস্ত মানুষ, কেউ কল দিলেও রিসিভ করো না। তা হঠাৎ কি এমন দরকার পড়ল যে কল দিয়ে সময় নষ্ট করছো নিজের?”

“তুই থামলে আমি কিছু বলতে পারতাম।”

“হুমম, বলো। কে ধরে রেখেছে তোমাকে? শুনছিতো!”

” ঢাবিতে এডমিশন টেস্টে দিবি না কেন?”

“কি লাভ? আমি চান্স পেলে ভর্তি হব। কিন্তু তুমিতো ততদিনে আউট হয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে কী করবো?”

“মানে? আমার থাকা না থাকার সাথে তোর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সাথে সম্পর্ক কী?”

“আমি ভেবেছিলাম তুমি দেশেই থাকবে, মাস্টার্সের পর ফারদার ডিগ্রির জন্য ভার্সিটিতেই থাকবে। তাই এডমিশন টেস্টের কঠিন পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হয়েছিলাম। কিন্তু তুমিতো দেশে থাকছো না। আমেরিকায় চলে যাচ্ছো।সোওওওওও এত কষ্ট উঠানোর কি দরকার? প্রাইভেটে ভর্তি হলেই ভালো আমার জন্য। একটাই জীবন, কেন অযথা প্যারা নিব। ”

“এটা কোন কথা হল? আমি থাকলেই বা কি? তুই কি ওখানে আমার জন্য যাবি? তুইতো ওখানে পড়াশোনা করতে যাবি, বিষয়টা তাই না?”

“ঘোড়ার ডিম, পড়াশোনা করতে মানুষ যায় ওখানে। আমি কি কোন মানুষ?

আমি এক মুক্ত বিহঙ্গ ,
দুই পাখা মেলে মনের আকাশে
সারাদিন ওড়ে বেড়াতে চাই।
আকাশের নীল রংয়ের মাঝে সাদা মেঘের ভীড়ে একটা ছোট্ট নীড় গড়তে চাই।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।

আমি স্বচ্ছ পানিতে
সাঁতার কাটা এক স্বাধীন মৎস্যকন্যা।
সারাদিন লেজ নেড়ে নেড়ে ছুটবো,
সাঁতার কাটবো, জলকেলি করব,
কখনও মুখ উঁচিয়ে তেজোদৃপ্ত সূর্য স্নান করব আবার কখনও অতল গভীরে দিব ডুব।
ক্ষমতা সব মনের, সে করবে যখন যেমন সে চায় ।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।

আমি দখিনা হাওয়া।
এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক বইতে চাই,
কখনও সোনালী রোদ্দুর
কখনও জোছনার আলোয় সিক্ত হতে চাই।
কখনও ফুলের সুবাস মেখে মন রাঙাব।
কখনও উত্তরের হাওয়ায় নিজেকে হিমায়িত করব।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।

আমি কেবলি আমার প্রেমিকের মনের
তীব্র ক্ষুধা হতে চাই।
যে ক্ষুধা মিটবে না তার আজীবন।
যে ক্ষুধায় প্রেমিক শুধু আমাকেই খুঁজবে,
আমি ছাড়া অন্য কেউ তার বুভুক্ষু মনকে
তৃপ্ত করতে হবে ব্যর্থ ।
সে শুধু আমায় কাছে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছটফট করবে,
আমি তার চোখে এক সাগর ভালোবাসার
রঙিন স্বপ্নে ডুবতে চাই।
আমি শুধু এক পসলা বৃষ্টি হতে চাই
যে বৃষ্টি মেটাবে আমার প্রেমিকের তৃষ্ণা।
আমি শীতের সকালের বিন্দু বিন্দু শিশির হতে চাই
যে শিশির শুধু ভেজাবে প্রেমিকের মন।
আমি শুধু আমার জীবনে সেই প্রেমিক রুপে
তোমাকে চাই শুধুই তোমাকে চাই।।”

“থামলি কেন? চালিয়ে যা অনন্ত কাল। আমাকে জ্বালানো এত অল্পতেই শেষ করলি ? আমার পরীক্ষা, আমার মাথাটা খারাপ করার জন্য আর কি চাই তোর?”

” দাঁড়াও! আম্মু দরজার ওপাশে, আচ্ছা আম্মুকি তোমাকে কল দিতে বলছে আমাকে?”

“মানে?”

“রাখো, পরে বলছি” বলে মোবাইলটা বিছানার উপর রেখে কুটকরে লকটা ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে হিহিহি করে হেসে উঠল লাবন্য যেনো কোন চোরের চুরি ধরে ফেলেছে সে। রেশমাও চোর ধরা পড়ার মতো মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইল যেনো মুখে কোন কথা নাই তার। চোখে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে রেশমার অস্থিরতার ছাপ। সবটা ফুটে উঠেছে দিনের আলোর মতো চকচক করে। হঠাৎ করেই লাবন্যর মনটাও খারাপ হয়ে গেল। নিজের মায়ের এমন অসহায় ভাবটা কোন সন্তানের মনকেই আনন্দ দিতে পারে না। মুহুর্তেই মুখের হাসিটা নিভে গেল। মায়ের চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলল

“ডিয়ার আম্মু, এত টেনশন নিচ্ছো কেন? টেক ইট ইজি। আমি এমন কোন আবদার করিনি যে তোমাকে এত টেনসড হতে হবে? আর কখনও এমন কিছু করব না যার জন্য তোমাকে কারউ কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমি ঠিক আছি। মাথা ভরা শুধু প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ , তাই তোমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করি। তুমি কেন এত ভয় পাচ্ছো হঠাৎ করে তাই শুধু বুঝতে পারছি না।”

“বুঝবি, সময় হোক, একদিন ঠিকই বুঝবি।” বলে রেশমা আর দাঁড়ালো না নিজের রুমে চলে এল।

লাবন্য আবার দরজা আটকিয়ে মোবাইল হাতে বিছানায় বসে পড়ল। এখন আর ওর মায়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাইলো না। হিমেলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এদিকে রেশমা নিজের রুমে আসতেই ওর ভেতরের গুমোট হয়ে থাকা অস্থিরতাগুলো একসাথে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে রুপ নিল, বিছানার এককোনে বসে একটা সময় ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজের কাছে নিজে অনেকটা ছোট হয়ে গেছে বলে মনে হল। এতটা নিচু মন মনসিকতা হলো কবে ওর ? আগেতো এমন ছিলো না! হঠাৎ করেই আমূল পরিবর্তনের কারন কি? মেয়ের ঘরে কেন আড়ি পাতলো ও? তেমন কিছুইতো শুনতে পায়নি, লাবন্যের কিছু কথা ছাড়া। ওর মনে কিসের এত ভয় কাজ করছে তাতো বুঝতে পারছে না নিজেই। কেন জানি আজ বারবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। তিনি একদিন বলেছিলেন রেশমাকে, “যেই কষ্ট, যেই অপমান, যেই লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছিস তুই আমাদেরকে তা কেবল সেদিনই বুঝবি যেদিন তুই নিজেও ঠিক এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়বি। কোন কর্মই তার প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে ভুল করে না।দুদিন আগে আর পরে, কিন্তু ঠিকই প্রতিদান দেয়।”
আজ মায়ের সেই কান্নাজড়িত কন্ঠটা খুব মনে পড়ছে প্রথম যেদিন রেশমা লিখনের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ফোন থেকে বাসায় কল দিয়ে মায়ের সাথে বলা বলেছিল। মা সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল আর কোন কথাই বলতে পারেননি তিনি।

তখন রেশমার চোখেমুখে ছিল রঙিন স্বপ্ন, ভালোবাসার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিল পুরো চিন্তা চেতনা ওর। নিজের মনকে ছাড়া আর কিছুই তখন চোখে পড়ত না। মনে তখন অনেক সাহস ছিল।কাউকে ভয় পেতো না। ভালোবাসার উপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে চোখ বুঝে বাবা মা ভাই বোন সব ছেড়ে লিখনের কাছে চলে এসেছিল। আজ এতবছর পর ওর সেই বিশ্বাস কোথায় হারালো? কেন আজ ওর মনে এত ভয় ভালোবাসা হারানোর। দিনদিন বিশ্বাস পোক্ত হয় মানুষের কিন্তু ওর কেন কমেছে? আর ভাবতে পারছে না। শরীর কাঁপিয়ে শুধু কেঁদেই চলছে। কত স্বপ্ন বুকে জমিয়ে রেখেছে ছেলে মেয়েকে নিয়ে। আজ মেয়েটা এমন মনমানি করাতে কিসের আশংকায় কাঁপছে হৃদয়? এর উত্তর আজ খুঁজতেও ভয় অনুভব করছে খুব ।

লাবন্য আর রুম থেকে বের হয়নি। হিমেলের সাথে কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রেশমাও ডাকেনি আর ওরও ঘুম ভাঙেনি। রাতে যখন কয়েকবার ডোর বেল বেজে উঠল তখন লাবন্যের ঘুম ভাঙল। একটু ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে জানতে পারল ওর আব্বু ফিরেছে বাসায়। খুব অবাক হল মনে মনে, এমনতো কখনও হয়নি আগে। ওর আব্বু একটা বেল দিতেই দরজা খোলা হয়। কারন সেই সময়টাতে রেশমা অপেক্ষায় বসে থাকে। আজ হঠাৎ কি হল মায়ের যে ওর আব্বুর দুই তিনবার ডোরবেল বাজাতে হল? এত বেশি চিন্তা ভেতরে পুশে রাখা ওর স্বভাব না। তাই মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল বিষয়টা জানতে। দরজার কাছে গিয়ে থমকে গেল। ভেতরে আব্বু আম্মুর কথপোকথন শোনা যাচ্ছে, ওর পা আটকে গেল —-

“রেশমা তোমার কি হয়েছে আমাকে একটা বার বলো। তুমি এভাবে কেন কাঁদছো আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না? আমার কোন ভুল হয়েছে? ”

” বললামতো আমার কিছু হয় নাই, এমনিতেই মনটা খারাপ ছিলো তাই তোমার আসার সময়টা খেয়াল করতে পারিনি।”

“রেশমা আমি রুশ না, তুমি আমাকে আবোল তাবোল বলে বোঝানোর চেষ্টা করো না। প্লিজ তুমি আমাকে বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে বলোতো কোন বিষয়ে তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছো যে এভাবে কাঁদছো?”

“লিখন আমিতো শুধু তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম, আর কোন কি পাপ করেছিলাম? যাতে আমাদের কোন পাপ না হয় তাই দুজনে বিয়ে করে নিয়েছিলাম। বাবা মা ওই বয়সে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলো না বলেই আমাকে সব ছেড়ে ওভাবে চলে আসতে হয়েছিল। বলো আমি কি ভুল বলছি?”

“না তুমি কোন ভুল বলোনি। কিন্তু এসব কথা তুমি এখন কেন তুলছো? তা এখন আমাদের পাস্ট। আমরা ফিউচার নিয়ে ভাববো আর প্রেজেন্টে বাস করব। এমনটাইতো কথা হয়েছিলো দুজনের তাই না?”

“কিন্তু পাস্টতো বড় কঠিন সত্য, কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না। ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে হানা দিচ্ছে। মায়ের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে।” বলতে বলতে আবারও ফুপিয়ে উঠল রেশমা।

“তাদের একটা দাবি তো অবশ্যই তোমার উপর ছিল, তা কেউ অস্বীকার করিনি তখনও এখনও। কিন্তু তারা যদি সেদিন তোমার মন বুঝে তোমার বিয়েটা আমার সাথে নিজেদের মতো করে দিয়ে দিত তবেতো কোন সমস্যাই হত না। তারাতো তাদের দায়িত্বটা ঠিক মতো পালন করেনি। তুমি কেন বারবার সব দোষ নিজের কাঁধে নিচ্ছো?”

“লিখন আমাদের লাবন্য যদি আমার মতো এমন করে একদিন চলে যায়—-”

“প্রশ্নই উঠে না এমন হওয়ার। তার আগেই আমি ওই ছেলেকে ডেকে তোমার সাজানো স্বপ্নের মতো করে ধুমধামে কন্যাদান করবো।”

“সত্যি বলছো? তোমার কষ্ট হবে না, মেয়ে যদি তোমার পছন্দের দাম না দেয়? মেয়ে যদি কোন ভুল পছন্দ করে বসে?”

“শোনো রেশমা, জীবনটা লাবন্যের, জীবন সঙ্গী নির্বাচনে ওর মতামতটাই প্রাধান্য পাবে। ধর্মীয় মতেও তাই করতে বলেছে।তাহলে আর আমার তোমার অসুবিধা কোথায়? তবে হ্যা, মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সে ভুল আর শুদ্ধের পার্থক্য বুঝতে পারে। বাবা মা হিসেবে তুমি আমি বড়োজোর ওকে বোঝাবো তুমি যা করছো তা ভুল আর ভুলটা কেনো ভুল তাও বুঝিয়ে দিব।ডিসিশনটা হবে লাবন্যের নিজের। আর তাই মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলো যাতে ও সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারে। ওর সুখেই আমাদের সুখ।ওর খুশিতেই আমাদের খুশি।”

“আজ আমি তোমার জন্য রেডি হয়ে অপেক্ষা করিনি বলে কি তুমি আমায় দেখে তোমার ভূবণ ভোলানো হাসিটা হাসতে ভুলে গেলে?”

“মোটেও কারন তা না, তুমি যখন রেডি হয়ে থাকো তখন মনে হয় আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ। তোমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে আমার বসবাস, আমায় খুশি করতে তোমার সব আয়োজন দেখে মনে হয়, আমার চেয়ে ভাগ্যবান আর কে আছে ? কিন্তু আজ যখন রুমে ঢুকলাম দেখলাম আমার বৌটা রুম অন্ধকার করে বিছানায় বসে কাঁদছে। মুহুর্তেই মনে হল আমি বুঝি পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় ভিক্ষুক, একেবারে দেউলিয়া। এখন বলোতো একজন দেউলিয়ার মুখে সুখের হাসিটা আসে কোত্থেকে? তোমার হাসি আমার সম্পদ, তোমার সব আয়োজন আমার জীবনের প্রেরনা, তোমার মন আমার কাছে অমূল্য রত্ন। তেমনি তোমার কান্না আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে শূন্য করে দেয়, নিঃস্ব করে দেয়, মনে হয় আমি বুঝি ব্যর্থ তোমাকে সুখী করতে। তুমি কি তা জানো না?”

লাবন্যের চোখ ছলছল হয়ে উঠলো। ওর ধারনাকে মিথ্যে করে দিয়েছে ওর আব্বু। তিনি সত্যি সত্যিই ওর মা’কে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আজ রেশমা না সেজেও তার স্বামীর ভালোবাসা পাচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে। ভালোবাসায় একে অপরকে সাপোর্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। লাবন্য আর দাঁড়ালো না ফিরে এল নিজের রুমে।

চলবে।

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৫)
সায়লা সুলতানা লাকী

ঘুম ভাঙলো সকালে রিংটোন শুনে। অনবরত রিং বেজেই চলছে। একবার চোখ খোলে দেখে নিল নাম্বারটা তারপর আবার চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। কয়েকবার বেজে থেমে গেল। এবার বেশ আয়েশি মুডে শুয়ে রইল চোখ বুজে যা চেয়েছে তা হয় কি না দেখার জন্য লাবন্য। হুমম বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওর আম্মু এসে হাজির ওর রুমে।

“এই লাভ, লাভু ওঠ, ওঠ বলছি, কি অবস্থা! একেবারে একটা বন্য হয়ে গেছে মেয়েটা! বড়পা এতক্ষণ কল দিলো ধরলি না কেন ইডিয়ট মেয়ে? ওঠ বলছি!”

“উফফ আম্মু সকালে এমন বকাবকি করে ঘুম থেকে না ওঠালেই কি নয়? সকালে বাচ্চাদেরকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠাতে হয়। তোমাকে আর কত শিখাবো, বলোতো?”

“ওরে আমার পন্ডিতরে! এবার দুইটা থাপ্পড় দেই পাছায়, তাহলে আরও জ্ঞান আসবে মাথায়।” বলতে বলতে লাবন্যর কাছে যেতেই লাবন্য হুড়মুড় করে ওঠে বসল।

“আম্মু মুখের কথায় কাজ হলে আবার হাত চালানোর দরকার কি? এইতো ওঠলাম।”

“বড়পা এত রেগে আছে কেন? কি করছিস তুই ? ”

“তাইতো বলি ম্যাডাম সক্কাল বেলা সক্কালে এত খুশি কেন? বোনের কল পেয়ে আনন্দে গদগদ করছে একেবারে। ”

“বোন কল দিলে, খুশিতো হবই। কিন্তু বোন আমার এত চ্যাঁতা কেন? কি করছিস?”

“তাতো জানি না। বোন তোমার এমনি সবসময় চ্যাঁতে থাকে এ আর নতুন কি? ”

“মোটেও না বড়পা খুব মায়াবতী মানুষ।শুধু শুধু রাগেন না। আচ্ছা শোন তোকে দেখা করতে বলছে আপা। নাস্তা করে দেখা করে আসিস। ”
কথাটা শেষ করে রেশমা চলে গেল নিজের কাজে। লাবন্য বিছানায় বসে মায়ের খুশি খুশি মুখটা চোখ বন্ধ করে আরেকবার মনোচক্ষু দিয়ে অবলোকন করল। নানা বাড়ির কেউ ওর আম্মুর সাথে একটু যোগাযোগ করলেই ওর মায়ের সেদিনটা খুব আনন্দের হয়। এটা ও যেদিন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছে সেদিন থেকেই চেষ্টা করে এই আনন্দটা মা’কে দেওয়ার জন্য। হঠাৎ মনে পড়ল খালামনিকে ঠান্ডা করতে এখনোই যেতে হবে। খালুজি চলে গেলে স্বার্থ সিদ্ধি হবে না, আর তা ভাবতেই দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।

“আসসালামু আলাইকুম খালামনি, কেমন আছো?আমাকে দেখা করতে বলছো?”

“ওয়ালাইকুম আস সালাম, তোর যন্ত্রণায় কি আর কারো ভালো থাকার জো থাকে? তুই কাউকে শান্তিতে থাকতে দেস?”

“আহ রেহেনা! বহুদিন তোমাকে বলছি সকালে তোমার এই ক্যাটক্যাট শুনতে ভালো লাগে না। একটু বোঝো আমার কথাটা! পারলে থামো।”

“খালুজি খালামনিতো এখনও শুরুই করেননি, আর আপনি থামতে বলছেন!”

“এক চড় দিব বেয়াদব মেয়ে। মায়ের শিক্ষা না পেলে মেয়ে এমনই বেয়াদব হয়। হ’তি যদি আমার মেয়ে শিখতি আদবকায়দা কি জিনিস?”

“ওওও কে তুমিই শিখিয়ে দাও আদব কায়দা, ঠিক আছে গুরু।”

“ইচ্ছে করতেছে এখন সত্যি সত্যিই একটা চড় বসিয়ে দেই গালে অসভ্য মায়ের অভদ্র মেয়েটাকে।”

“রেহেনা আগে নিজে কিছু শিখো পরে মেয়েটাকে শিখাও।”

“আচ্ছা আচ্ছা, সব বাদ এখন বলো কেন ডাকছো?”

“এই তুই হিমেলের কাছে টাকা চেয়েছিস কেন?”

“কারন ভাইয়া আমাকে চুরি করতে বারন করেছে। আর চুরি না করলে আমি টাকা পাব কোথায়? ”

“টাকা দরকার হলে তোর আব্বুকে বলবি, আমার ছেলের কাছে চাইবি কেন? ও টাকা পাবে কোথায়। ”

কি আশ্চর্য খালামনি, তা আমি জানি কি? ভাইয়া আমাকে বলছে যা লাগে তা চেয়ে নিতে, তাইতো চেয়েছি। এখানে দোষটা কোথায় পাচ্ছো আমার?”

“তোর আব্বু কি মরে গেছে যে তুই অন্যের কাছে টাকা চাচ্ছিস?”

“আল্লাহ মাফ কর! কি যে বলো না খালামনি তুমি? আব্বুর কাছে এই মুহুর্তে টাকাটা কিভাবে চাই? দুদিন পরে এমনতেই ভর্তির জন্য কয়েক লাখ টাকা লাগবে।এর মধ্যে আবার এই কয়টা টাকা চাই কীভাবে?”

“তাই বলে তুই আমার ছেলের কাছে চাইবি? ও দিবে কোত্থেকে? আর এই কয়টাকা বলছিস কি? পাঁচ হাজার টাকা কি কম?”

“পাঁচ হাজার না তো? পাঁচ হাজার সাতশো টাকা। কি করবো খালামনি বলো তোমরা ছাড় আর কে আছে আমার? আমিতো আর সরাসরি খালুজির কাছে টাকাটা চাইতে পারি না, আগে কখনও চাইনি। একটু লজ্জাতো করতেই পারে তাই না খালুজি? আর তুমিতো জীবনও আমাকে এক টাকাও দিবা না।তো আর বাকি থাকে কে? হিমেল ভাইয়া। তাই তার কাছেই চাইছি, আর সে-তো বলছে লাগলে চেয়ে নিতে।”

“আমার সহজসরল ছেলের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার ইচ্ছে ভুলে যা। হিমেল তেকে কোনো টাকা দিতে পারবে না। সাবধান করে দিলাম ওকে টাকার জন্য জ্বালাতন করবি না।”

“আচ্ছা করবো না।”

“এখন যা বাসায় যা। তোর মা’কে বলিস তোকে একটু আদবকায়দা শিখাতে, নিজের সমস্যা নিজের ঘরেই মিটাতে হয় অন্যের কাছে হাত পাতার অভ্যাস ছাড়। ”

লাবন্য সুবোধ বালিকার মতো সবটা বুঝেছে তেমন একটা ভাব নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে এল মাথা নিচু করে। হিমেলকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। ও পড়ছে পড়ুক। যে কাজের প্ল্যান করেছিল তা এতক্ষণ পর্যন্ত সুন্দর মতো ধারাবাহিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এখন বাকিটা কি হয় তা দেখার অপেক্ষায় রইল।

বাসায় ফিরতেই রেশমা নানান জেরা শুরু করল কিন্তু লাবন্য বিশেষ কিছুই বলল না। মুখটা ভার করে নিজের রুমে ঢুকে গেল, কারন ওর ধারনা হিমেল কিছুক্ষণ পরেই একটা কল দিবে। অন্তত ওর সিক্স সেন্স তাই বলছে। এই সময়তে মায়ের ঝারি খেতে মায়ের পাশে দাঁড়ালেই বিপদ। সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে, তাই কোন রকমে কেটে পড়ল। এতদিনে এতটুকু বুঝেছে মা’কে কীভাবে নরম করা যায়। মেয়ের মলিন মুখটা রেশমাকে কাবু করে ফেলে। তাই মেয়ে প্রয়োজনে সেটাই কাজে লাগায়। আগে এমনটা করতো না ইদানীং করে, কিন্তু কেন করে তা প্রায় সময়তেই ও বোঝে না।

কিছুক্ষণ পর ঠিকই হিমেলের কল এল। লাবন্য তড়িঘড়ি করে রিসিভ করল
“হ্যালো”

“টাকা দিয়ে কি করবি?”

“ট্যুর দিব।”

“মানে?”

“এত মানে মানে করো কেন? আমার বুঝি মনে শখ থাকতে পারে না? আমরা বন্ধুরা এক সাথে ট্যুরে যাওয়ার একটা প্ল্যান করেছি। একটা ট্যাভেল এজেন্সি আছে ওইটা বেশ বিশ্বস্ত। তাদের সাথে যাব।একসাথে বারো বছর থাকলাম এখন কে কোথায় ভর্তি হই, কার কি ঠিকানা হয় তা কে জানে? তাই উলোটপালোট হওয়ার আগে একটু ঘুরে আসি বন্ধুরা মিলে।”

“তা কোথায় যাচ্ছিস?”

” আপাতত সেন্ট মার্টিন। ”

“তোর মাথা খারাপ হয়েছে? খালামনি একা একা তোকে ওখানে যেতে দিবে না কি?”

“ইন্না-লিল্লাহ আঠাস জনের এক টিম যাচ্ছে সেখানে বলে কি না আমি বলে একা একা যাচ্ছি।”

“তোর মাথা ঠিক আছে? আমাকে আর জ্বালাইস নাতো। পরীক্ষার সময় এত টেনশন নিতে পারব না।
এইসব ট্যুরের ভুত মাথা থেকে ঝেরে ফেল। এগুলোতে অনেক সময় অনেক রিস্কও থাকে।”

“মোটেও কোন রিস্ক নাই। আমার বন্ধুদের বড় আপু ভাইরা প্রায় সময় এসব ট্যুরে যায় তাদেরই পরিচিত এই টিম। খুব ভালো করে জেনেই পথ বাড়িয়েছি। দুইটা ফ্যামেলী যাচ্ছে আমাদের সাথে।তারাও আমাদের পরিচিত। ”

“অসহ্য, যা খুশি তাই কর। বাসায় এসে টাকা নিয়ে আমাকে মুক্ত কর। আব্বু আমার কাছে রেখে গেছেন।”

“আমি এখন ব্যস্ত, তুমি এসে দিয়ে যাও।”

“তোর মতো এত গিরিঙ্গি বুদ্ধি আমার নাই যে কোন একটা খাটিয়ে এখন বাসা থেকে বের হব। তোর আছে তুই এসে নিয়ে যা। ওরে বাপরে কি বুদ্ধি খাটিয়ে টাকা মেনেজ করলি!”

“এক্সকিউজ মি, কোন কষ্টই করতে হয়নি আমার, তুমিই বলছো তুমি গোসলে গেলে খালামনি তোমার মোবাইল চেক করেন। ব্যস আমি সেই সুযোগে মেসেজ দিছি টাকা চেয়ে। আর তাতেই কাজ হয়ে গেছে।” বলে হিহিহি করে হেসে উঠল লাবন্য ।

“দিনদিন কি হচ্ছিস তুই তা কি জানিস?” বলেই রেগে গিয়ে হিমেল কলটা কেটে দিল।

“হ্যালো হ্যালো, আসল কথাটাইতো বলা হলো না। আরে শোনোওওওও।”
মোবাইলটা হাতে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল।মেইন কাজটাতো বাকি রয়ে গেল। এখানে যদি ঘাপলা
থেকে যায় তবেতো সব কষ্টই নষ্ট হয়ে যাবে। রেগে কলটাতো কেটে দিল এখন তারে বাকি বুদ্ধিটা জানাই কি করে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে পথ একটা বের করল। যা যা হিমেলকে বলার তা ভয়েস রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিল। একটু সময় অপেক্ষা করে রেকর্ড সীন হতেই নিজের লাইন বিজি করে ফেলল বন্ধুদের কল দিয়ে সব কনফার্ম করতে, যাতে হিমেল কল দিলে আর ওকে ফ্রী না পায়।

রাতে লিখন আর রেশমা যখন খেতে বসল। ঠিক তখনই লাবন্য রুম থেকে বের হয়ে তাদের দুজনের সামনে এসে বসল।

“কিরে কিছু বলবি?”

“জি আব্বু। ”

“বলে ফেল, শুনলাম তোর মুড নাকি অফ ছিল সকালে।কিছু উত্তমমাধ্যম সয়েছিস না কি?”

“আব্বু সমস্যা সেখানে না সমস্যা তোমার আর আম্মুকে নিয়ে। আমি –”

লাবন্যের কথা শুনে রেশমার হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠল। মনে মনে বলল মেয়ে কি বলতে চায়?

“সরাসরি বলে ফেল, আব্বু আম্মুর কাছে বলবি নাতো কার কাছে বলবি?”

” তাইতো! সেই ভরসাতেইতো সবাইকে জানিয়ে দিলাম। কিন্তু এখন ভয় হচ্ছে যদি তোমরা রাগ কর—”

“আহা লাভ, এত ভনিতা না করে আসল কথা বল।”

“আম্মু রেগে যাচ্ছো কেন? তাহলেতো ভয় পাই।”

“আচ্ছা বল, ভয়ের কিছু নাই। তোর আম্মু কিছু বলবে না।”

“হিমেল ভাইয়ার পরিচিত একটা টিম আছে, যারা দেশের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটগুলোতে নিজেদের গাইডে ট্যুরের ব্যবস্থা করে —”

” হুমম, হুম এমনটা আমিও শুনেছি। আমার পরিচিতও কয়েকটা টিম আছে। তা ওই ছেলে কি ওর পরীক্ষা রেখে সেরকম কোন টিম নিয়ে কাজ শুরু করল নাকি?”

“আরে নাহ আব্বু, তার এত সাহস আছে না কি? সে ব্যস্ত তার পরীক্ষা নিয়ে। তবে সে একটু সাহস করেছিল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। নিজের যাওয়ার জন্য একটা সীট বুকিং দিয়েছিল। কিন্তু তারতো সাহস কম তাই ভয়ে এখন সেই কথা কাউকে বলতে পারছে না। এখন আমাকে বলছে তার ওই সীটে ট্যুরে চলে যেতে। কারন সে ফুল পেমেন্ট করে ফেলেছে আর সে টাকাটা আর ফেরত তুলতে পারবে না। আমি না গেলে তার টাকাটা নষ্ট হয়ে যাবে। খুব আকুপাকু করে বলল– লাবন্য আমারতো পরীক্ষা, তাই আমার হয়ে তুই ঘুরে আয়, কোন রিস্ক নাই। মেয়েদের জন্য প্রচন্ড রকমের সেইভ। আর তোরতো এখন পড়ার চাপও নাই।তাছাড়া এমন সুযোগ আর পাবি না, ভর্তি হয়ে গেলে জীবনে শুধু প্যারাই প্যারা পাবি। এখনই সময় একটু ঘুরে আয়।”

“কিন্তু তুই একা—-”

“আরে নাহ আব্বু, ভাইয়া আমাকে অফারটা দিতেই আমি আমার বন্ধুদের জানিয়েছি। আমি যাবো শুনে সব আন্টিরাই পারমিশন দিয়ে দিয়েছেন। আমরা মোট ষোলজন। সবাই একসাথে ওয়ান থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছি একসাথে। এরপর কে কোথায় ভর্তি হয় কার জীবন কেন দিকে মোড় নেয়, এসব ভেবে সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি।”

“এগুলো কতদিন যাবৎ চলছেরে লাভ?”

“এইতো মাত্র চারপাঁচ দিন ধরে। ”

“বড়পা এইজন্যই ডেকেছিলেন?”

“আম্মু তুমি এত কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করছো তাতেতো আমার কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ”

“আহা রেশমা! এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন? এই বয়সটাইতো এমন! হিমেল যেখানে সব ঠিক করে দিয়েছে সেখানেতো কোন সমস্যা থাকার কথা না। তারপরও আমি হিমেলের সাথে কথা বলে দেখছি। ওরা ষোলজন যাচ্ছে। ব্যাপারটা কিন্তু সহজ না। এত বড় টীম, কোথায় যাচ্ছে, কি ব্যবস্থায় যাচ্ছে সব খবর নিয়েই পারমিশন দিব। শুধু শুধু মেয়ের পিছনে লেগো না। আমি একটু সময় নিচ্ছিরে লাবু।”

“জি আব্বু, তুমিতো তা নিবেই, আমি তা জানি। এই নাও ওই গ্রুপের কার্ড।” বলে হাতের কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে এল। জোরে একটা শ্বাস নিল। সম্পূর্ণ কাজটা সুন্দর মতো প্ল্যান মোতাবেক শেষ হল । এখন আব্বু ভালো মতো জেনে পারমিশনটা দিলেই হল। তবে বিশ্বাস দিবে কারন হিমেল ভালো মতো বুঝিয়ে বলবে লাবন্যকে যেতে দিতে সেই বিশ্বাস হিমেলের উপর ওর আছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here