মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৬)

0
465

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৬)
সায়লা সুলতানা লাকী

লাবন্যকে দলের সাথে ছাড়তে এসেছে রেশমা আর লিখন। একটা নির্দিষ্ট বাস স্টপে জমা হয়েছে সবাই, বাস কাউন্টার ভরা শুধু লাবন্যের বন্ধুদের পরিবার দিয়ে।সবাই এসেছে মেয়েকে বাসে তুলে দিতে। লাবন্যসহ অন্য সবার মনেও চলছে দারুন উন্মাদনা। এই প্রথম পরিবার ছাড়া সম্পূর্ণ নিজেদের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। এর অনুভূতি কেউই প্রকাশ করতে পারছে না। সবার বাবা মা’ই মনে মনে বেশ চিন্তিত তা তাদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চিন্তা নাই শুধু লাবন্যের আব্বুর। তার কথা মেয়ে বিদেশে পড়তে গেলে একা ছাড়তে হতো, সেরকমই এখন দেশের ভিতর একা ছাড়লে সমস্যা কী? এই বয়সে এডভেঞ্চার করবে নাতো কী বুড়ো বয়সে গিয়ে করবে?

সবাই বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। রাত এগারোটায় গাড়ি ছাড়ার কথা এখন দশটা চল্লিশ বাজে। হঠাৎ করেই লাবন্যের খুব কাছের বন্ধু তুবা চিৎকার করে উঠল “ভাইয়া” বলে। আর সাথে সাথে সবার চোখ গিয়ে পড়ল হিমেলের উপর। লাবন্যের বিশ্বাস হচ্ছে না, ও এই সময়ে এখানে আসলো কী করে তাই ভাবছিল ওর দিকে তাকিয়ে।

“কিরে তুই আবার আসলি কেন? তোর না পরীক্ষা? আপা জানে? ” রেশমা বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।

“ইয়ে মানে খালামনি, তোমরা আসছো তাতো আমি জানি না। আমি আরও ভাবলাম ট্যুর ম্যানেজারের সাথে একটু কথা বলে যাই।তাই আসলাম।”

“গুড, ভেরি গুড। আমিও মনে মনে তোমাকেই চাইছিলাম। আব্বু যাও তুমি কথা বলে আসো। একটু বুঝিয়ে বলো লাবুর বিষয়টা।”

“জি খালুজি বলে ” হিমেল আর দাঁড়ালো না। কাউন্টারের কাছে চলে গেল কথা বলতে। বেশ কিছু ক্ষন পর ফিরে এসে দেখে রেশমা আর লিখন অন্য অভিভাবকদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।

“তুমি আসবা তাতো ভাবি নাই?”

“সব তোর ভাবনা মতো হবে তা ভাবিস কেন?”

“খালামনি জানলে কপালে তোমার শনি আছে বলে দিলাম।”

“শনিতো আমার কপালে বহু আগে থেকেই লেগে আছে, নতুন করে আর ভয় দেখিয়ে লাভ কি? ”

“এখনও রেগে আছো?”

“তা জেনে তোর লাভ কি? তাতে তোর কিছু যায় আসে?”

“একবার বলো না যেতে, দেখো কি করি!”

“তোর মতো এত সাহস আমার নাই।”

“ভয়ে কুঁকড়ে খোলসের ভিতর ঘুটিয়ে হয়তো জীবিত থাকা যায় কিন্তু কেন জানি মনে হয় ওভাবে বেঁচে থাকা যায় না। আমি স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। যে সময় টুকু আমাকে দেওয়া হয়েছে আমি তা আমার মতে করে বাঁচতে চাই। বলো এটা কি আমার দোষ?”

“কখন বললাম তোর দোষ।”

“তাহলে রেগে আছো যে।”

“নে এইটা রাখ, লাগতে পারে।” বলে পকেট থেকে একটা খাম আর পাওয়ার ব্যাংক বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিল।

“কি টাকা? লাগবে না আব্বু দিয়েছে। বিলিভ মি পকেট মারিনি। তবে পাওয়ার ব্যাংকটা দাও। এটা কাজে লাগবে।”

“নিজের কেয়ার রাখিস।ফ্রী হলে কল দিস।”

“জানো তুমি এসেছো, তাতে আমার —-”
আর বলতে পারল না লাবন্য রেশমা আর লিখন এসে দাঁড়ালো সামনে। মনের আনন্দ মনেই রয়ে গেল তারপরও বিশ্বাস হিমেল ওর মন দিয়ে পুরেটা বুঝে নিবে।গাড়ি চলে এসেছে।সবাই ব্যস্ত নিজেদের ব্যাগ তুলতে। এরই মধ্যে রেশমা দুইজন মহিলাকে ডেকে লাবন্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তারাও এই ট্যুরের সঙ্গী। দুই মহিলাকে পেয়ে রেশমা মনে অনেক সাহস পেল। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে গেল। হিমেল আসায় আর লিখন গাড়িতে উঠে মেয়েকে সীট পর্যন্ত পৌঁছে দিল না। ওরা দুজনই নিচে দাঁড়িয়ে রইল। হিমেল লাবন্যের সাথে উপরে উঠে সীট পর্যন্ত আসল। হিমেলকে পেয়ে লাবন্যের বন্ধুরা খুব মজা নিয়ে গল্প জুড়ে দিতে চাইল কিন্তু লাবন্য সেই সুযোগ দিলো না।হিমেলকে জোর করে নামিয়ে দিল বাস থেকে। হঠাৎ খেয়াল করল ওর গাল ছুয়ে গেল হিমেলের হাতের আঙ্গুল। আলতো একটু ছোঁয়ায় মনকে আন্দোলিত করে গেল। যেই আন্দোলনে সাড়া না দেওয়ার মতো শক্তি লাবন্যের নাই। হিমেল নেমে যেতেই মনে হল মনটা বুঝি শূন্যতায় ছেয়ে গেল কি যেন একটা কাছে ছিল এখন নাই। মনটা হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠল সাথে সাথে বাসের জানালা গ্লাস টেনে সরিয়ে নিজের মাথাটা বের করে নিচে হিমেলকে খোঁজ করতে লাগল।সামনেই ওর আব্বু আম্মুর পাশে মুচকি একটু হাসি দিয়ে লাজুক লাজুক চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে হিমেল। কি মনে হল তাৎক্ষণিকভাবে সব ভুলে গেল, জোরে ডেকে উঠল।

“এই” আর কিছু বলতে পারল না। গলা আটকে গেল।

“লাবু, কি করছিস? গ্লাস লাগা। বোকা মেয়ে একটা, সাবধান এভাবে মাথা বের করবি না।” লিখন চিৎকার করে উঠল। লাবন্য বাধ্য হয়ে সীটে বসে পড়ল। বাস স্টার্ট দিল। সবাই হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে। সেদিকে লাবন্যের মন নেই ওর দৃষ্টি আটকে আছে হিমেলের চোখে। হিমেলের এই মুচকি হাসিতেই ওর মন আটকে আছে। যেখান থেকে ও হয়তো কোনদিনও বের হতে পারবে না।

গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। ট্যুর সঙ্গীরা বেশ আমুদে মেজাজে আছে তার মধ্যে সমবয়সী ষোলজন সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুনী হঠাৎ করেই নিজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে একা পথ চলতে পা বাড়িয়েছে।একদিকে আছে ভুল না করার প্রত্যয় অন্যদিকে জীবনকে ভোগ করার অতৃপ্ত বাসনা। সবাই ব্যস্ত নিজেদের মাঝে শলাপরামর্শ করা নিয়ে কীভাবে কি করবে কে কার সাথে রুম নিবে ইত্যাদি আলোচনায় লিপ্ত। কিন্তু লাবন্যর মন পড়ে আছে মুচকি হাসির ওই লাজুক চোখ জোড়ায়।যে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার আনন্দে ভাসছে। লাবন্য হঠাৎ করেই ফিক করে হাসল আর আনমনে বলল “লাভ ইউ, লাভ ইউ জান।”

মাঝপথে গাড়ি থামালো। লাবন্যরা দল বেঁধে একসাথে নিচে নামল ওয়াসরুম ঘুরে সবাই একসাথে বসে চা খেয়ে নিল এরপর আবার গাড়িতে উঠল। এরপর আর কিছু বলতে পারে না। সব ঘুমে কাবু ছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন ওরা টেকনাফ। সবাই গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের লাগেজ বুঝে নিল। এখানে তেমন বড় কোন হোটেল নাই তারপরও যা আছে তাতেই মেনেজ করে নিল। লাবন্য খেয়াল করল কেউ কোন অবজেকশন করছে না। যা পাচ্ছে তাতেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ চা পরোটা ডিমভাজি দিয়েই ষোলজন নাস্তা সারলো। এখন অপেক্ষা সিপে ওঠার জন্য। যেখানেই যাচ্ছে সব দল বেঁধে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট গাইডের ছেলেটা বেশ ভাল। সবসময় এসে এসে ওদের খোঁজ নিচ্ছে, কার কি লাগবে তা জিজ্ঞেস করছে আর তাতে মেয়েরা খুব মজা পাচ্ছে। একটা সময় সিপে ওঠে গেল ওদেরকে সিট বুঝিয়ে দিতেই ওরা একসাথেই বসল। কিন্তু যখনই সিপ ছুটে চলল সাগর পাড়ি দিতে তখনই মেয়েরা সিট ছেড়ে কার্নিশ ঘেষে সিগার্ল গুলোর খেলা উপভোগ করতে লাগল। সকালের মিষ্টি রোদে সমুদ্রের পানিগুলোকে কাঁচা সোনা বলে মনে হল। একেবারে চকচক করছিল।
সেন্টমার্টিনের ঘাটে এসে থামল সিপ।ট্যুর মেম্বাররা সব একে একে নামল। বারোটায় ওদের রুম খালি করার কথা ছিল কিন্তু এখনও কিছু রুম খালি হয় কিন্তু নাই। তাই একটু অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তুবা হাসতে হাসতে বলল “দেখ একদিনেই আমাদের কত চেঞ্জ, আমরা কেউ বিরক্ত হচ্ছি না। আব্বু আম্মুর সাথে আসলে এতক্ষণে কতবার বলতাম এটা এমন কেন ওটা টাইম মত কেন দিচ্ছে না। এখন অপেক্ষা করতেও বিরক্ত লাগছে না মনে হচ্ছে এটা জীবনেরই একটা অংশ।”

লাবন্য ওর কথার সাথে সুর মিলালো, “আসলেই আমরা ডিপেন্ডেবল প্রজাতি। ডিপেন্ড করতে করতে নিজের ক্ষমতা ভুলে যাই একটা সময়।”
লাবন্যের কথা শুনে বাকি মেয়েরা হেসে উঠল।

কিছুক্ষণ পর রুম পেল তবে পুরোপুরি পরিস্কার পেতে আরও সময় লাগবে। তাই ব্যাগ লাগেজে রুমে রেখে বেরিয়ে পড়ল সমুদ্র স্নান করতে। বীচে এসে দেখল ওদের সাথে আরও অনেকেই আসছে। লাবন্য সবার সাথে মিলে হৈ-হুল্লোড় করতে গিয়ে বাসায় কল দিতে বেমালুম ভুলে গেল। বন্ধুরা মিলে মজা মস্তি করে রুমে এসে খেয়াল হল যে পৌঁছেছে তা বাসায় জানানো হয় নি। একটু ফ্রেশ হয়ে ওর আম্মুর মোবাইলে কল দিল। গতরাতেই কথা হয়েছে অথচ কলটা রিসিভ করতেই ওর আম্মুর কন্ঠ শুনে মনে হল কতদিন ধরে তিনি তার মেয়েকে দেখা না। নানান বারন উপদেশ দিতে দিতে বিশ মিনিট শেষ করল। ইচ্ছে করেই লাবন্য কিছু বলল না। চুপচাপ মায়ের উপদেশ গ্রহণ করল। ওর প্রতি ওর মায়ের এই অস্থিরতা কেনজানি খুব আপন লাগছিল। মায়ের সাথে কথা শেষ করে হিমেলকেও কল দিল কিন্তু কোন কথা হল না। মোবাইল বিজি পেল লাবন্য আর দেরি করল না গ্রুপের সাথে বের হয়ে গেল লাঞ্চের জন্য। উফফ কুড়কুড়ে মুড় মুড়ে ফিশ ফ্রাই, এটার জন্যই মনে হয় বারবার এখানে ছুটে আসে লাবন্য। বাসায় রেশমা বহুবার এমন ফ্রাই করে দিয়েছে কিন্তু তাতে ওর মন ভরে না।
খাওয়া শেষ করে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল নারকেল পাড়া ঘুড়ে বেড়ানোর জন্য। ঘন্টা ভিত্তিক এক একটা সাইকেল নিয়ে যখন দল ছুটে চলল তখন আশেপাশের সবাই খুব মজা নিয়ে ওদের অবস্থা দেখতে লাগল।

সন্ধ্যার পর সব মিলে চা খেয়ে চলে এল বীচে। সমুদ্রের গর্জনের সাথে মিলেমিশে যেতে লাগল তরুনীদের আনন্দ উল্লাস।
রাতে খেয়ে ওরা রুমে ফিরল।
সবাই ক্লান্ত, হঠাৎ করেই এতটা স্বাধীনতা ওদেরকে অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করতে শিখিয়ে দিলো। প্ল্যান ছিল গভীর রাত পর্যন্ত সৈকতে আড্ডায় মাতবে সবগুলো প্রান। কিন্তু নিজেদের সেইফটি যখন নিজের মগজে তখন সেদিকটাতেই প্রাধান্য দেওয়া হল। রুমে এসে একে একে সবাই নিজের বাসায় সারাদিনের কার্যক্রম রিপোর্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাবন্যও খুব অল্প পরিসরে রেশমাকে সব জানিয়ে দিল কারন ততক্ষণে ঘুম এসে ভর করেছিলো চোখে। ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর হিমেলের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পাড়ল না।

সকালে ঘুম ভাঙল রিংটোন শুনে। কলটা রিসিভ করতেই শুনলো
“ওখানে কি ঘুমাতে গিয়েছিস? এখনও বিছানায় কেন গাধা?”

“এত সকালে বের হওয়াটা কি ঠিক হবে?”

“তোর কাছে এত সকাল, বীচে গিয়ে দেখ মানুষের বিশাল সমাগম পাবি। আর তুই কি একা যাবি নাকি পুরো দল নিয়ে যাবি। সূর্য উদয়ের সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে নিয়ে আসিস।”

“তুমি ঘুমাও নাই? এই সময়ে উঠলে কীভাবে?”

“ঘুমোলেতো উঠবো? ”

“সারারাত পড়ো কীভাবে?”

“আজতো পড়াই হলো না।”

“ইন্না-লিল্লাহ, কি বলো? কেন?”

“তুইতো তাই চাইছিস ঠিক না? না হলে এমন করে উড়াধুড়া প্ল্যান কেউ করে? পরীক্ষার পর একসাথে সবাই মিলে যাওয়া যেতো না? একটু যদি তড় সয় তোর, কী করব সবই ভাগ্য। মানা করলেওতো তুই শুনতি না।”

“মানা তুমি করছো একবারও? করে দেখতা?”

“তুই যদি মুখের উপর রিফিউজ করতি তবে মনে অনেক কষ্ট পেতাম।”

“তোমরা এমন কেন? ভয়ের রাজ্যেই তোমাদের জীবন শেষ। তোমরা কোনদিনও তোমাদের মনকে শান্তি দিবা না। সবসময় মানিয়ে নাও মেনে নাও বলেই তাকে কষ্ট দিবা। আমারতো মনে হয় তোমাদের মতো মানুষের কোন মনই থাকা উচিৎ না৷ যারা মনের কদর দিতে জানে না তাদের আবার মনের কী দরকার?”

“শুরু হল আবার লেকচার–”

“তুমি কি সারাজীবন তোমার মনের কথাগুলো মনেই চেপে রাখবে? কোনদিনি কি তা মুখে আনতে পারবে না?”

“মুখে আনার কি দরকার? কেউ যদি নিজের তাগিদে আমার মনকে বুঝে নেয় তাতেই কাজ চলবে।”

“যদি সে তার মন মতে করে তোমার মনকে বুঝে নেয়, নিজের সুবিধা মতো করে তোমার মনকে চালায়?”

“হাহাহা, এতসব কথা বলতে বলতে সূর্য তোর উদয় হয়ে অস্তও চলে যাবে। আমি কল কাটলাম। এখন ঘুমাবো। সাবধানে থাকিস।” বলেই হিমেল কলটা কেটে দিল৷ আর তখনই দরজায় নক করা শুরু হল। সবাই জেগে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ল।

সবাই রেডি হয়ে ঘাটে অপেক্ষা করছে স্প্রিডবোটের জন্য, এখন সবাই যাবে ছেড়া দ্বিপে। লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিল সবাই সেইফটির জন্য। সমুদ্রের মাঝ দিয়ে সাই সাই করে ছুটে চলল বোট। দুই পাশে পানি জাপটে উঠে বারবার, আর তাতে একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে মেয়ে গুলো। যখনই একটা বাড়ি খায় ঢেউয়ের সাথে তখনই মেয়েগুলো সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে। এক অন্য রকম এডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে ওরা পৌঁছে গেল ছেড়া দ্বিপে।
এক অপরুপ দৃশ্য চোখের সামনে। স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই যেনো বেশি আনন্দ। নীল আকাশের সাথে সমুদ্রের সাদা নোনা ফেনার যেন রয়েছে এক বিশাল মিতালি। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে চায় না তাইতো কোন এক প্রান্তে দুজন দুজনকে জরাজরি করে মিলেমিশে আছে। দিগন্তপানে চোখ মেলে যেন সবাই তাই সেই সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ছেঁড়া দ্বিপের ডাব এমন এক পানিয় যা সবাইকে টানে। এমন কেউ মনে হয় না আছে যে এখানে আসে কিন্তু ডাব খায় না! ইয়া বিশাল বিশাল ডাব।তাই নিয়ে বসে পড়ল সবাই। পানি শেষ করতেই ডাব ভেঙে তার ভিতরের নরম নারকেল খাওয়ার ধুম পড়ে গেল। আরও কিছুক্ষন ওখানে থাকার ইচ্ছে থাকলেও থাকা গেলো না। দলের সাথে থাকা সিনিয়ার সিটিজেন কয়েকজনের আবার ডায়াবেটিস আছে। তাদের ওয়াসরুমের দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু হায় এই খানে এখনও একটাও ওয়াসরুম তৈরী হলো না। পর্যটক যারা আসেন তারা সৌন্দর্যের টানেই আসেন।এখানে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নাই। ফেরার পথে পাওয়া গেল সেই মাইক সম্মিলিত ব্যানার। মসজিদের জন্য দান বাক্স। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঠকিয়ে খাওয়া এক শ্রেনীর ভন্ড নামধারী মুসলমান। আল্লাহর ওয়াস্তে ছেঁড়া দ্বিপে একটা আল্লাহর ঘর নির্মানের জন্য চাঁদা তুলছেন একজন। একে দেখেই লাবন্যের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মনটা চাইল একবার তার কাছে গিয়ে বলতে “আর কত কাল ধর্মের লেবাসে ধর্ম বিক্রি করে খাবেন?” নিজেকে সংযত করে নির্ধারিত বোটের কাছে চলে এল। অন্যরা সবাই যে যার মতো চাঁদা দিয়ে বোটে উঠল।

ছেঁড়া দ্বিপ থেকে ফিরে আর কেউ রুমে ঢুকল না সরাসরি বীচে চলে এল। এখন জোয়ারের সময়।সকালে যেখানটায় ছেলেরা ফুটবল ক্রিকেট খেলেছে এখন সেখানেই সমুদ্রস্নানে মেতে উঠেছে। গাইডরা বিপদজনক এলাকা চিহ্নিত করে দিলেন সহজ ভাষায় বলে দিলেন ওখানে যাওয়া যাবে না। মেয়ের দল তাই মেনে নিল। সীমিত এরিয়া জুড়েই চলল মেয়ের আনন্দ উল্লাস। লাবন্য খুব অবাক হল এর আগে যতবার এসেছে বাবা মায়ের সাথে তখন এর চেয়ে বেশি মজা মাস্তি করেছিল কিন্তু তখনকার তৃপ্তি এখনকার তুলনায় কম এর কারনটা কি তা নিয়ে অন্য কেন সময় ভাববে বলে মনে মনে হাসল৷ এখন এসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার নাম বোকামি।

বিকেলে চলল শপিং। যদিও এখানে কেনাকাটা করার মতে তেমন কিছুই নাই। তারপরও ঘুরতে বের হল পুরো সেন্টমার্টিনে কোথায় কি আছে তা দেখার জন্য। বিশাল এক টীম আসছে আজ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কোন এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষাসফর টিম এইটা। সবার গায়ে এক রংয়ের গেঞ্জি পরা। সাথে লগোও বর্ষ লেখা। ইচ্ছে করই লাবন্য এগিয়ে গিয়ে কী লেখা তা দেখল না। শরীর দুর্বল লাগছিলো। পা ব্যথা নিয়ে আর হাটল না একটা ভ্যান নিয়ে হোটেলে চলে এল। একটু রেস্ট দরকার। রাতে বার বি কিউর প্রোগ্রাম আছে বীচের গা ঘেঁষে। আজ ভরা জোছনায় সবাই রাতে জেগে পার্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু টিমের সাথে ঢাকা দুইটা ফ্যামেলির অবজেকশনে তা নাকচ হয়ে গেল।

রাতে সমুদ্রের বুকে চাঁদের আলো খেলা সাথে ঢেউয়ের আছড় পড়া শব্দ শুনতে সত্যিই খুব ভালো লাগছিল। লাবণ্যের মনটা আনচান করতে লাগল হিমেলের জন্য। এই মানুষটা কি আদৌ সাহস করে ওর হাত চাইতে পারবে ওর আব্বুর কাছে? নাকি ওর বাসায় ওর নিজের মায়ের মুখোমুখি হতে পাড়বে কখনও? এক মন বলে পারবে, ওকে পারতেই হবে। আবার আরেকমন বলে ও কোনদিনই পারবে না। লাবন্যকে নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে হয়তো একদিন ওর মায়ের মতো হিমেলে কাছে এমনি এমনি চলে আসতে হবে। কারন হিমেল কোনদিনই লুকিয়ে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন। ওর দাদু যত সহজে ওর আম্মুকে মেনে নিয়েছিলেন হিমেলের মা কি তা পারবে? যদি না পারে তবে কি হবে? হিমেল কি তবে ওর জীবনে শুধুই অলীক হয়ে থাকবে। আর ভাবতে পারল না। চোখ ভিজে উঠল। সবার আনন্দের ভীড়ে লাবন্যের চোখের জল নিরবে ঝরে পড়তে লাগল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here