#এক_কাপ_চা পর্ব ১২,১৩,১৪

0
710

#এক_কাপ_চা পর্ব ১২,১৩ ১৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

(৩৪)

“ভাবী, আপনি সম্পর্কে আমার ভাইয়ের স্ত্রী। এসব কথা কী বলছেন?আমি আপনাকে বিয়ে করবো কেন?”

“তবে আমার স্নেহা?”

“আমাদের কিন্তু কথা তেমন হয়েছিল না।”

“তুমি তোমার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে চাইছো?তোমার জন্য তোমার ভাই কী না করেছে?”

“আমি দায়িত্ব থেকে সরে আসছি না।কিন্তু আপনার প্রতি অনুরোধ। এমন কোনো প্রস্তাব আমাকে দিবেন না যা রাখা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে সম্মান করি।”

“তবে স্নেহাকে মেনে নিবে না?”

“কেন নিবো না?স্নেহা আমার ভাইয়ের মেয়ে।ও আমাদের কাছেই থাকবে।”

“আমি আমার মেয়েকে কাউকে দিবো না।”

“যদি আপনি এটাই ভেবে থাকেন তবে আমি পারবো না স্নেহাকে বাবার নাম দিতে।কারণ আপনি জানেন ইখুম ব্যতীত কাউকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর স্নেহাকে কাগজে কলমে আমার নাম দিতে হলে তার মায়ের নামে ইখুমের নামটাই থাকবে।”

“থাকবে না। তুমি কেন?”

রাশেদ দাঁড়ায়নি।প্রতিটি মানুষের সহ্যের কিছুটা সীমানা প্রাচীর থাকে। রাশেদের সেই প্রাচীরে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে।
তার প্রতি তার মা,ভাবীর এসব অন্যায় আবদার আজ তার গলায় কাটার মতোন বিঁধে আছে।
রাশেদ কিছু দূর আগাতেই ইখুমকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো।ইখুমের দুই চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। মুখে খেলা করছে কোনো এক আবেগের দ্যুতি। যাকে বাস্তবতা বদলে দিতে চাইছে। প্রাণপণে ইখুমের করা প্রার্থনা যেন অদৃষ্ট শুনতে পেয়েছিল।বিধাতা মুচকি হেসে আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ইখুমের ভাগ্যে। সে বুঝতে পারলো রাশেদকে তবে এতোদিন মানসিক ভাবে ভেঙে চলেছিল তার শাশুড়ি এবং সামিনা।বিয়ের কনে হিসেবে কিংবা বাড়ির বৌ হিসেবে কখনো তাকে মেনে নিতে চায়নি ভদ্রমহিলা। তিনি বলেছিলেন তাকে এতটা মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে যেন ইখুম নিজেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে।
তবে কী শুধু তাকে মানসিক কষ্ট দিতেই তার শাশুড়ি এতদিন ধরে রাশেদের সাথে এমন সাপলুডু খেলে চলেছেন?
ইখুম ভাবতে পারছে না। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। পাশের পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। সামিনার সামনে
রাশেদ দাঁড়ায়নি, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“যাবে আমার সাথে?এমন কোনো এক জায়গায়?যেখানে সকল কিছু থেকেই মুক্তি পাওয়া যায়?বিলাসিতা এনে দিতে পারবো না তবে হ্যাঁ না খাইয়েও রাখবো না। যাবে ইখুম?আমার সাথে?”

(৩৫)

“বিয়ে বাড়িতে এসে যদি মেয়েদের দিকে না তাকাও তবে কী করলে?”

মৌসুমির এমন কথায় তার দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইল তাশদীদ। স্নেহার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলো তাশদীদ। স্নেহার মুখ টিস্যু দিয়ে মুছিয়ে সে বলল,

“মেয়েরা প্রদর্শনীর বস্ত নয়। যে মেয়েরা নিজেদের প্রদর্শন করতে ভালোবাসে তারা আমার নজরে একটা স্লাট ব্যতীত কিছুই নয়।”

“স্লাট?সরাসরি বেশ্যা বানিয়ে দিলে?”

“তুই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ৷ বুঝে যাবি।আর হ্যাঁ মনে রাখিস পঁচা জিনিসে মাছি বসেই।”

মৌসুমি অপমান গায়ে মাখলো বলে মনে হলো না। সে চলে গেল স্টেজের দিকে।সাগরিকা তখন মুনিরের পাশে বসেছে। সবার আবদার হলো একটা গানের। মুনিরের ইশারায় একজন ছেলে গিটার দিয়ে গেল।
স্টেজের সামনে চেয়ারে বসে সাগরিকা গাইতে শুরু করলো,

sab se pehele hain pyaar, main or tum dono to ek hain.
uski bad aaye ashaye ki tum kon ho? or main kon hu?

পুরো ছাদ নির্জনতায় ছেয়েছে। গান শেষে স্নেহা হাত তালি দিয়ে বললো,

“পি পি পো পো। পিপ্পো?”

সাগরিকা গানটা গাওয়ার ধরণে মুগ্ধতা ছিল। তাজবীদ হেসে বলল,

“গানটা ডোরেমন সিরিজে ছিল।এবার তবে আরেকটা বিয়ে উপলক্ষে হয়ে যাক?”

সাগরিকা মাথা দুলিয়ে না করছিল কিন্তু তাশদীদ সামনে এসে বসে তার হাত থেকে গিটার নিয়ে গাইতে শুরু করেছিল,

“ম্যে রঙ শরবতো ক্যা, তু মিঠে গাট কা পানি।”

পুরো গানটায় সে তাকিয়ে ছিল সাগরিকার দিকে।সাগরিকার অনুভূতি গুলো ধীরেধীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো তার পেটে। সে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখতে৷
গানটা শেষ হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল তাশদীদ৷
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় শরবতের মতোন ঢকঢক করে গিলে ফেলতে এই মেয়েকে।কিন্তু হায় কপাল এমন তো হয় না।
এরপর রাত-ভর চলবে মদ্যপান এবং নাঁচ গান।
তাই তাজবীদ তার বাবাকে বলল সবাইকে নিয়ে ফিরে যেতে। তারা দুই ভাই থাকবে। তাশদীদ ব্যস্ত তাই তাকে এসে বলতে বলল।আর রাশেদ ও থাকছেই তাই বাকী কারোর থাকার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে মেয়েদের।
গাড়ি অবধি তাদের এগিয়ে দিতে যাচ্ছে তাশদীদ৷ রাত প্রায় দশটা। বিয়ে বাড়ির বাতি নিভছে জ্বলছে। সাগরিকার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সে এক হাতে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে সাগরিকার হাতে দিয়ে বলল,

“জানালা খোলা রাখবি না।আর বাড়ি গিয়ে সোজা ঘুম।অনলাইনে দেখলে! ”

“থাকবো না।প্রমিস।”

তাশদীদ কিছু না বলেই আলতো স্পর্শে নিজের বুকের সাথে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“মনে হচ্ছে এই তোদের সাথে আমার শেষ দেখা।যাইহোক না কেন নিজের খেয়াল রাখিস। মনে রাখিস। শোক যাই হোক না কেন, ব্যক্তিগত শোকের থেকে পরিবারের খুশির প্রাধান্য বেশি।”

(৩৬)

ইখুমের সামনাসামনি বসে আছে রাশেদ৷ সে বিয়ে বাড়িতে থাকেনি। ইখুমের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে সে। ইখুমের কি হলো সে নিজেও বুঝলো না।সে তেড়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি মার দিতে লাগলো রাশেদের শরীরে।
তার পরণের শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে। আচঁল গলিয়ে পড়েছে কাঁধ থেকে।
বাড়ির সবার কথা ভেবে জোড়ে কাঁদতেও পারছে না সে। রাশেদ তাকে বাধা দিচ্ছে না।পুরুষ মানুষ এক আজব প্রানীর নাম।
তারা চাইলে মেয়েদের মতোন কাঁদতে পারে না।
ইখুম শান্ত হয়ে এলে রাশেদ তার গায়ে আঁচল উঠিয়ে দিয়ে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
ইখুমের কোলে মাথা রেখে নিচে ফ্লোরে বসেছে রাশেদ। ইখুম তার চুলের মুঠি ধরে তার মুখ উঠিয়ে বলল,

“কেন করলে এমনটা?তুমি যত কথাই বলো না কেন আমাকে এত মানসিক কষ্ট দেওয়ার কিংবা আমার সন্তানকে মেরে ফেলার কথা বলার অধিকার তোমার নেই।আমি তোমাকে মাফ করবো না। কোনো দিন না।আমার গায়ে হাত তুলেছো, কী করোনি আমার সাথে? কেন? সামিনাকেই বিয়ে করে নাও এখন।ওর দায়িত্ব নিতে চাইছো না কেন এখন?তবে কেন কথা দিয়েছিলে?”

রাশেদ তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমার মা আমাকে শর্ত দিয়েছিল।স্নেহার দায়িত্ব নিতে হবে। যদি এমন দায়িত্ব না নিতে পারি তবে তোমাকে আনতে পারবো না।তোমাকে বিয়ে করার পূর্ব শর্ত
অনুযায়ী

#এক_কাপ_চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৩

(৩৭)
রাতের বেলা স্নেহার শরীর হঠাৎ করে খারাপ হলো।শ্বাস নিতে পারছিল না।জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েটা।
ইখুমের দুচোখ সবে মাত্র লেগেছিল। রাশেদ পাশে নেই। বেড সাইডের ল্যাম্প জ্বালিয়ে ইখুম উঠে বসে ফ্লোরে পা রাখার আগেই অনুভব করলো তার শরীর ভালো লাগছে না।মাথাটা ঝিম মেরে আছে। দরজা খোলা এতে মনে হলো স্নেহার চিৎকার বেশি জোড়ে শোনা যাচ্ছে।ধীর পায়ে বের হয়ে দেখলো রাতের বেলা সবাই জড়ো হয়েছে ড্রয়িং রুমে। তাশদীদের মা তখন স্নেহাকে কোলে নিয়ে হয়তো কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। সামিনা দাঁড়িয়ে আছে একটা পিলারের পাশে। সাগরিকার মা গা মুছিয়ে দিচ্ছে স্নেহার।
বমি করে অস্থির মেয়েটা। ইখুম কাছাকাছি যেতেই সে জিজ্ঞেস করলো,

“কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”

তাশদীদের মা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

“পালতে না পারলে পয়দা দিতে হয় না।আর পয়দা দিলে পালার ধৈর্য্য রাখতে হয়।”

বড় জায়ের মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো ইখুম।সে এমন ভাষা ব্যবহার করে না কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো বাচ্চারা তার প্রাণ। সবাইকে একা হাতে তিনিই মানুষ করেছে। তাদের কিছু হলে সে ক্ষেপে যায় সহজেই।
কিছুক্ষণ পর ইখুম জানতে পারলো স্নেহার রাতে ক্ষুধা লাগে। সে রাতে খায় বলে সব সময় তার জন্য খাবার রাখা থাকে।আজ সামিনা তাকে খাওয়ানোর সময় সে কিছুটা জ্বালাতন করছিল।তাই সে তার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিয়েছে। এতে স্নেহার গলায় খাবার আটকেছে। সাথে সাথে সে বমি করেছে। এদিকে চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে।

“এমন কেন করেন মেঝ ভাবী?আপনি ভুলে গেছেন? ওর হৃদরোগ আছে। হার্টে ছিদ্র আছে মেয়েটার। আপনি ভুলে কেন যান?”

রাশেদের কথায় সামিনা মুখ তুলে চাইলো। তার দুচোখে পানি টলমল করছে। মুখে ফুঁটে উঠেছে অসহায়ত্ব। কিছু বলার থাকলেও গলা দিয়ে বের হলো না কিছু। তার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে খাওয়ানোর মতোন আজ তার শক্তি ছিল না।কিন্তু তবুও উঠেছিল। মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছিলো যে রাগ উঠে যায় তার।

স্নেহার হৃদরোগের কথা শুনে চমকে উঠেছে ইখুম।ব্যকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“কবে? কবে জানলেন এসব?”

নিরুত্তাপ গলায় রাশেদ জবাব দিলো,

“আমাদের বিয়ের দিন রাতে। সে রাতেও স্নেহার গলায় খাবার আটকে গিয়েছিল।হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পুরো রাস্তা বমি করেছিলো।সে রাতে জানতে পারি ওর হার্টে ছিদ্র আছে।”

(৩৮)

তাজবীদ, মুনির স্টেজের পাশে বসে কথায় ব্যস্ত ছিল।ফুল ভলিউমে বাজছে বিভিন্ন গান।গান গুলো মোটেও স্বাভাবিক নয়৷ রগরগে হিন্দি গানগুলো।যে গানে তাল মিলিয়ে চলছে ছেলে-মেয়েদের নাঁচ।কেউ কাউকে তোয়াক্কা না করে নেঁচে চলেছে। আনন্দের থেকে বেহায়াপনা যেন বেশি ফুটে উঠেছে।
হঠাৎ ছেলেদের এক সাথে দেওয়া শীষ এবং করোতালিতে সে দিকে তাকালো মুনির এবং তাশদীদ। স্টেজে উঠেছে মৌসুমি।
গানের তালে চলছে তার কোমর৷ পাতলা শাড়ি সরে যাচ্ছে কোমর থেকে। সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো মুনির৷আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো শ’খানেক চোখ অনবরত কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বোনের দিকে। একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো মুনিরের। তার বাবার উচিৎ ছিল মেয়েকে শাসন করার কিন্তু সে যেন আরো বেশি খুশি।সবাই যে তার মেয়ের নাঁচের প্রশংসা করছে।

একজন তো বাবা কে এসে বলেই ফেলল মেয়েকে কেন অভিনয়ে দিচ্ছে না।

তাশদীদ বেরিয়ে আসছিল সেখান থেকে। মুনির বলল,

“চলে যাবি এখনি?”
“এখন না গেলে সকালে আসতে পারবো না।”
“রাত থেকে যা।”

বিনিময়ে একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে তাশদীদ আলিংগন করলো মুনিরকে।
এরপর ফিসফিস করে বলল,

“দৈত্যের প্রাণ ভ্রমরী তো টিয়াপাখির ভিতর। তাকে রেখে থাকা যায় না।”

“তুই শোধরাবি না। বলে দিলেই পারিস।কেন অযথা ইঁদুর বিড়ালের খেলা খেলছিস?”

“বলবো। তবে জোড় করে নয়। সম্পর্কটা হবে শিউলি এবং শরৎের মতোন।শরৎ এলেই কিন্তু শিউলি ফোঁটে। আমি কাছাকাছি থাকলেই যেন প্রেমে ভাসে।”

“আটকাবো না। যা তবে।”

তাশদীদ বাসায় ফিরে স্নেহার কথা শুনতে পেরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।ইখুম তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি সব’টা জানো তাই না বাবা?”

“হ্যাঁ।শুরু থেকেই।”

“তবে আমাকে কেন বলোনি?”

“বিষয়টা তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর আমি কী বলবো?”

“আমার ওয়ালিয়া তুমি।তবে কেন বলবে না?”

“যখন যখন তোমার ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হবে তখন তখন আমাকে পাশে পাবে। কিন্তু অন্যায়কে শেল্টার দিলে আমাকে পাবে না।”

“তুমি কী বলতে চাইছো?”

“পুরুষ মানুষকে শক্ত হতে হয়। স্ত্রী তার শরীরের অংশ নয় যে ইচ্ছে মতোন ব্যবহার করবে, স্ত্রী হচ্ছে আত্মার অংশ।বাকীটা তুমি বুদ্ধিমতি।”

তাশদীদ দাঁড়ায়নি। দ্রুত পা ফেলে উপরে উঠে এসেছে। ইখুম নিজেকে শক্ত করে নিচ্ছে কারণ সে অন্যায় মেনে নিতে পারবে না। রাশেদের মা তাকে পছন্দ করে না এটা তার দোষ নয়৷ স্নেহার বাবা মারা গেছেন এতেও তার কোনো হাত নেই। তবে সে কেন গুমরে গুমরে কেঁদে জীবন পার করবে?
রাশেদকে সে ছাড়বে না। এই সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে। যদি ছেড়ে দেয় তবে সে শাশুড়ির কাছে হেরে যাবে।তবে রাশেদকে মাফও সে করবে না। তার দেওয়া প্রতিটি মানসিক আঘাত তাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাশেদকে সে বুঝিয়ে দিবে প্রিয় মানুষের দেওয়া আঘাত কতটা যন্ত্রণার হয়ে থাকে। কতটা যন্ত্রণার।

(৩৯)

ঘুম থেকে উঠে সাগরিকার মনে হচ্ছে কেউ তার মাথার উপর শ’খানেক ওজনের কিছু একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বিছানায় উঠে বসতেই তার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে হলো গতকাল তাশদীদের বলা কথাগুলো।বাড়ি ফিরে মরার মতোন ঘুমিয়েছে। কিছুই মনে নেই। পরনের শাড়ি অবধি খোলেনি সে। তাশদীদ গতকাল।ও কথা বলছিল কেন?দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেল তাশদীদের ঘরে। ভয়, অস্বস্তি নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখলো তাশদীদ পুশআপ দিচ্ছে। সাথে হয়তো কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে। কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো সাগরিকার মনে। বেরিয়ে যাবে ঠিক তখন তাশদীদ ডাক দিয়ে বলল,

“চা কই আমার?সারাদিন মহিষের মতোন ঘুমাস কেন?”
“পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“৫ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে আমার জন্য চা নিয়ে আয়।”

কিন্তু তাশদীদের আর চা খাওয়া হলো না।কারো ডাকে সে সাগরিকার পিছু পিছু নিচে নেমে এলো।
ইখুম বসে আছে এক পাশে। রাশেদ দাঁড়িয়ে, তার হাতে ফোন, লাউড স্পিকার দেওয়া। অপর পাশ থেকে কথা বলছিল তাশদীদের দাদু। তার একটাই কথা ইখুম কেন এখনো বাড়িতে।
“ইখুম আমার স্ত্রী তাই এই বাড়িতে। আমার সন্তানের মা তাই এই বাড়িতে।”

“কিন্তু আমার কথার কোনো মূল্য নাই?চিনহার শইলড্যা খারাপ হইল কেন?ও তোর দায়িত্ব না?”

“স্নেহার শরীরের দায়ভার ওর মায়ের। আমার নয়।”

“কথা তো ওইডা আছিলো না।তুমি কিন্তু কোর-আনে হাত রাইখা কসম দিছো। চিনহার সব দায়িত্ব তোমার। এর লাইগা ইখুমের লগে বিয়ার পারমিশন আমি দিছি।যদি চিনহার দায়িত্ব না নিবার পারো তো ইখুমরে এখনি মুখে মুখে তালাক দিবা নইলে সামিনা কাইল রাইতে তোমারে যা কইছে তাই তুমি মাইনা নিবা।সিদ্ধান্ত তোমার।”

রাশেদ এক পলক তাশদীদের দিকে তাকালো নজর ফিরিয়ে ইখুমের দিকে তাকিয়ে তার মা কে বলল,

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”

চলবে (এডিট ছাড়া পর্ব)
#ছবিয়ালঃভিটামিনটি রিলোডেড

বি.দ্র. ত্রিধারের প্রচ্ছদ দেখেছেন তো?

#এক_কাপ_চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৪

(৪০)

“তাইলে সামিনার লগে বিয়ার ব্যবস্থা করতে বলো?”

রাশেদ তার মায়ের কথা শুনছিল কিন্তু দৃষ্টি ছিল ইখুমের দিকে। ইখুম নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দু গাল বেয়ে নোনাস্রোত নেমে আসছে৷ নিচের ঠোঁট কামড়ে শাড়ির আঁচল খামছে ধরে সে হয়তো অপেক্ষা করছে রাশেদের উত্তরের৷

“না।”

গমগম আওয়াজে রাশেদ স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলো তার মা কে।

“আপনি বরঙ সমস্ত সম্পত্তি থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দিন। হ্যাঁ আইনী ভাবেই আপনার সাথে আমার ডিভোর্স হবে আম্মা।
আপনি আমাকে ত্যাগ দিতে পারেন আমার আর কিছুই বলার নেই।”

“তুমি জানো না? রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী জাহান্নামে যাইবে?”

“ইখুমের পেটে থাকা সন্তান কী আমার রক্তের সম্পর্ক নয়?”

“এতিমের উপর থেইক্যা হাত তুইলা নিলে আল্লাহ সইবো না।”

“আমি চাইনি তুলে নিতে কিন্তু আমার সন্তানকে এতিম করতে পারবো না।”

“মায়ের কথার অমান্য করতাছিস?কার সাথে পেট বাজাইছে কে জানে?”

“থামুন আম্মা। আপনি ইখুমকে পছন্দ করেন না জানি তাই বলে আপনি কারী চরিত্রে কথা বলতে পারেন না।”

“তুই আমারে কসম দিছিলি। মায়ের থেকে ওই ছেরি আর ওর পেটেরটা বড়?তোর মায়ের থেকে বড়?”

“আপনি মা। আপনার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কিন্তু ও আমার স্ত্রী, আমার অনাগত সন্তান।তাদের প্রতি আর অন্যায় করা সম্ভব না।”

“এক্ষুণি বাইর হইয়া যাবি আমার স্বামীর বাড়িত থেকে।”

“ভালো থাকবেন আম্মা।আল্লাহ্ হাফেজ।”

রাশেদ ফোন রেখেই প্রথমে মুখোমুখি হলো তার বড় ভাইয়ের। অবনত দৃষ্টিতে বলল,

“আমার অনেক দোষ ভাইজান।আমি জানি, ইখুমকে আমার এই ঝামেলার জীবনে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি কিন্তু আমি পারছিলাম না ওকে ছাড়া থাকতে। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে সব শর্তে রাজি হতে হয়েছিল। তখন আম্মা বলেছিল স্নেহাকে আমার নাম দিতে হবে। আমি ইখুমকে চিনি। সে কখনোই না করবে না কিন্তু বিয়ের রাতেই স্নেহার যখন শরীর খারাপ করলো হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তখন আম্মা আমাকে তার মাথায় হাত রেখে কসম দিয়েছিল ইখুমকে আমি কিছুই জানাতে পারবো না। সে নিজ থেকে জেনে যদি আমার সংসার করে তবে করবে আমি নিজ থেকে জানালে আম্মা আমাকে তার সন্তান হিসেবে আর মানবে না।ত্যাগ করবে আমাকে। আমি পরিবার হারাতে চাইনি, না চেয়েছিলাম ইখুমকে হারাতে। কিন্তু আজ আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। আমি আর পারছি না। আমাকে মাফ করবেন। আমার এতটুক যোগ্যতা রয়েছে যে আমি আমার স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে পারবো।
আমাদের এবার যেতে হবে।”

ইখুমের পাশে বসে রাশেদ শুধু বলল,

“দ্বিতীয় সুযোগ বলতে কিছু হয় না।মাফ চাইলেও মাফ দেওয়া যায় না।কিন্তু তবুও বলছি তুমি কী যাবে আমার সাথে?তুমি না গেলেও আমি চলেই যাবো।থাকা সম্ভব নয় এখানে কিন্তু তুমিও প্লিজ এখানে থেকো না।তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। আটকে রাখার মতোন অধিকারের কোনো কাজ আমি করিনি কিন্তু এখানে আমাদের সন্তানের কোনো নিরাপত্তা নেই। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না বাচ্চাটা সুন্দর পৃথিবী না দেখেই চলে যাক।বাকীটা তোমার ইচ্ছে।”

“পৃথিবীটা কী আদৌও সুন্দর চাচ্চু?কই আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি না।কোথায় সৌন্দর্য? সব তো হিংসা, ঘৃণা আর কুটচালে সাজানো অধ্যায়। কী হবে তোমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ এর?আর স্নেহা?তোমরা যার জন্য এত কানামাছি খেলছো সে কী দেখতে পাচ্ছে নিত্যদিন?স্নেহার অসুখের কথা রাঙ্গামা কিংবা আমাদের কেন বলোনি?একই বাড়িতে রইলাম অথচ বাড়ির মেয়ের অসুখের কথা জানলাম না?”

সাগরিকার কথার জবাব দিলো সামিনা।খ্যাকখ্যাক গলায় বলল,

“সব কথাতেই তোমাদের এত থাকতে হবে কেন?স্নেহার ভালোর জন্যই তোমাদের কাউকে জানাইনি।কারণ তোমরা ওকে স্পেশাল ট্রিট করবে আমার সন্তানকে বিকলাঙ্গ করার ইচ্ছে আমার নেই।”

“বিকলাঙ্গ কেন হবে?নিজের সাথে মানিয়ে নিতো।বিকলাঙ্গ করার কথা না কী রাঙ্গামা কে কষ্ট দেওয়ার ধান্দায়?”

কথাটা বলেই চট করে সে ঘুরে দাঁড়ালো বড় চাচার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমার মা কে কিন্তু আমি ডিটারজেন্ট দিয়ে ওয়াশিং মেশিনে ধুবো।আমি থাকতে তোমাদের মা লাগবে?তোমাদের মা বলে এমন অন্যায় মেনে নাও?আমি কিন্তু নিবো না।রাঙ্গামা না থাকলে আমিও এক কাপড়ে বের হয়ে যাবো।তারপর তোমার মা কে এনে বসিয়ে রেখো আসন পেতে।”

তাশদীদ বাবার পিছন থেকে একটু হেলান দিয়ে সাগরিকাকে এক পলক দেখলো।পরনে এখনো গতকালের শাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো।চায়ের কাপ রেখে তাশদীদ দাঁড়িয়ে বলল,

“ব্যবসাটা আমরা সবাই মিলে দাঁড় করিয়েছি। বাড়ির প্রতিটি ইট আমাদের সবার পরিশ্রমের টাকা দিয়ে করা।তাই বাড়িটা আমাদের সবার। এখানে তুমি থাকবে তোমার অধিকারে। দাদুর সাথে আমি কথা বলে নিবো। চিন্তা করো না।”

(৪১)

গোসল সেরে বেরিয়ে সাগরিকা বিছানায় একটা কালো রঙের প্যাকেট দেখতে পেলো।আজ তাদের বিয়েতে যাওয়ার কথা। কিন্তু কী পরবে এটা নিয়ে চিন্তায় ছিল।আজ ড্রেসকোড দেওয়া হয়েছে সাদার মধ্যে। কিন্তু তার কোনো সাদার রঙের পোশাক নেই।কারণ তার মা সাদা পোশাক তাকে কিনে দেয় না।দাগ লাগিয়ে নষ্ট করে ফেলে। দেখা যাবে খেতে বসে দাগ লাগবে না হলেও লিপস্টিক।

তাই সে ভেবেছে কালো জামাটা পরবে সাথে সাদা ওড়না।ওই জাত রক্ষা হলেই হলো।কিন্তু মৌসুমির যা স্বভাব। কিছু না বললেই হলো।আনমনে প্যাকেট হাতে নিতেই বেরিয়ে এলো সাদা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি।শাড়িটা বেশ ভারী ছিল। সাদার মাঝে গোলাপি রঙের দ্যুতি না কি গোলাপির মাঝে সাদার দ্যুতি বুঝে উঠছিল সে। শাড়িটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতেই বেরিয়ে এলো বাকী সব। শাড়ির সাথে বাকী সব দেখে সে বেশ অবাক হলো কারণ আন্ডারগার্মেন্টস গুলোও ছিল তার মাপের। তখন সে মনে মনে ধরেই নিয়েছে এটা ইখুম এনেছে।

তাজবীদকে দেখে দুই ঠোঁট গোল করে শীষ বাজালো সাগরিকা আর তুলি।আজ তাকে দারুণ লাগছে। হাসির ছলে সাগরিকার মা বলল,

“আজ তাজবীদের প্রেম পাক্কা।দেখিস বেয়াইন-টেয়াইন পাস কি না।পছন্দ হলে বলবি। একদম তুলে নিয়ে আসবো।”

চাচীর কথায় তাজবীদ একগাল হেসে বলল,

“পছন্দ তোমাদের সামনেই আছে। সময় হলেই জানবে।”

তাজবীদকে দেখে শীষ বাজালেও তাশদীদকে দেখে হৃদ স্পন্দন থেমে গেল সাগরিকার। চুল ঠিক করতে করতে নেমে আসছিল সে৷ তার দিকে তাকিয়ে থাকা কতটা ভয়ংকর সব জেনেও বেহায়া চোখ তাকেই দেখে যাচ্ছে।তাশদীদের গলার দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল সে৷ঠোঁট কামড়ে পেটে মোচড়াতে থাকা অনুভূতি গুলোকে ধমকে দিয়ে চুপচাপ এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।কিন্তু কী আর হবে?তাকে তো যেতে হবে তাশদীদের সাথেই।

(৪২)

বিয়ে বাড়ির হৈচৈ দেখে মন খারাপ হয়ে এলো সাগরিকার। তাশদীদ, তাজবীদ সমেত বাকী ছেলেরা মেয়ে পক্ষের সাথে চুটিয়ে তামাশা করছে।কিন্তু তাদের বলা হয়েছে কোথাও যেন না যায়।
তুলি সাগরিকার কানে কানে বলল,

“ওয়াশরুমে যাবো আপু।মামীকে বলো।”

সাগরিকা তার মা কে বললে ভদ্রমহিলা তাদের দুজনকে নিয়ে গেল কনের ঘরের পাশের ওয়াশরুমে।ওদের রেখে সে আবার ফিরে এলো সবার কাছে।
কিছুক্ষণ পর যখন তারা ফিরেছে ততক্ষণে হট্টগোল বেধেছে।
মৌসুমির বাবা তখন রেগে আগুন।কারণ বিয়ের কনে পালিয়েছে এবং মৌসুমির কথা মতো পালাতে সাহায্য করেছে সাগরিকা।

রেগেমেগে মৌসুমির বাবা তখন ভরা মজলিসে তাশদীদের বাবাকে শাসিয়ে বলল,

“যেহেতু আপনার ভাইয়ের মেয়ে বৌ পালাতে সাহায্য করেছে তাই ভরপাই আপনার ভাইয়ের মেয়েই করবে। সাগরিকার সাথেই এখন মুনিরের বিয়ে হবে। হবে মানে হবেই।”

চলবে (এডিট ছাড়া পর্ব)

#ছবিয়ালঃ Pixamania

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here