#এক_কাপ_চা পর্ব ৩৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(১০৩)
দুপুরের খাবারের আগে মাছের মাথা খাওয়া নিয়ে একদফা কথা শুনতে হলো সামিনাকে। স্নেহা ইদানিং কারোর সাথেই কথা তেমন বলে না। চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে থাকে কিংবা শুয়ে থাকে।কখনো তার দৃষ্টি টিভির দিকে থাকে আবার কখনো সে অযথাই মাথা নিচু করে বসে থাকে। আজ সকাল বেলা বাজার থেকে বড় একটা কাতল মাছ আনা হয়েছে। মাছটা যখন রান্না ঘরে রাখা হলো তখন স্নেহাও পিছন পিছন রান্না ঘরে এসে দাঁড়ায়।মাছ কাটা থেকে শুরু করে পরিষ্কার করার পুরো সময় সে রান্না ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিল।মাছের মাথা যখন রান্না করা হচ্ছিলো তখন কাজের মহিলা তাকে রান্না ঘর থেকে নিয়ে চলে আসে।
ঘরে ফিরে এসে সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“মা আজ মাছের মাথাটা আমায় দিবে?”
দীর্ঘ একমাস পর মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে সামিনার কান্না গলায় আটকে গিয়েছিল।নিজেকে সামলে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে সে উত্তরে বলেছিল,
‘অবশ্যই মা।তুমি খেতে চেয়েছো আর কেউ না করবে?এটা হয় না কী? তুমি তোমার কাকীদের বলতে। যে কেউ আগে তোমাকে খেতে দিয়ে নিতো।”
“না তুমিই খাইয়ে দিও।”
“আচ্ছা দিবো।”
স্নেহা মাছের মাথা দিয়ে ভাত খাবে বলে সকাল সকাল গোসল করে নিয়েছে। নিজেই নিজের মাথার চুল আঁচড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন মাছ রান্না শেষ হবে।এর মাঝে দুই বার রান্না ঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়েছে সে।
মাছ রান্না শেষ হতেই দৌড়ে এসে মা কে বলল,
“মা রান্না শেষ। তুমি নিয়ে আসো না। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
সামিনা অসুস্থ শরীর নিয়েই নিজেকে বিছানা থেকে টেনেটুনে তুলল।রান্নাঘরে গিয়ে একটা প্লেটে ভাত বেড়ে তাশদীদের মা কে বলল,
“ভাবী স্নেহা মাছের মাথা খাবে। আমি মাছের মাথাটা নেই?”
তাশদীদের মা সরাসরি তার মুখের উপর না করে দিয়ে বললেন,
“তুই মাছ দেখেছিস?একবার ঢাকনা তুলে মাছের মাথার সাইজটা দেখ। এতবড় মাথা ও খেতে পারবো না। অযথা নষ্ট করবে।”
“আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো।নষ্ট হবে না।ও খেতে…..
সামিনা কথা শেষ হওয়ার আগেই তাশদীদের মা বলল,
” এত কথা কেন মেঝ?ও খেতে পারবে?তুই নিজের বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা কর তো। আর তাছাড়া মাথাটার কথা তোর মিয়াভাই আগেই বলছে।মানুষটা সারাদিন কাজের পর এসে যদি দেখে যে মাছের মাথার আশায় আছে সেটা নাই তার খারাপ লাগবে না?”
সামিনা চোখ তুলে চাইতে পারলো না।সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যাবে এমন শক্তিও যেন তার নেই।লজ্জায়, অসহায়ত্ব তাকে এতটা কুঁজো বানিয়ে ফেলল যে সে মাথা নিচু করে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না তাশদীদের মা তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে এক পিস মাছ তুলে দিলো তার প্লেটে।
প্লেট হাতে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে ফিরে আসার সময় দেখল স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে রান্না ঘরের দরজায়।
সে তার মায়ের আগে আগে রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সামিনার কান্নাগুলো তখন দুচোখ বেয়ে খাবারের প্লেটের উপর পড়ছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে তাকে ডাকলেন।মায়ের ডাকে স্নেহা উঠে বসল।
“আমি ভাত খাবো না।”
“শুনো মা কী হয়েছে জানো?এত বড় মাছের মাথার কাটা গলায় বিধলে কী কান্ড হবে তুমি জানো?”
“আর সবাই তো খায় ওদের হয় না।আমার কেন হবে?বড় মা কেন দিলো না।”।
” তুমিও বড় হলে খাবে মা।এখন মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নাও।”
“মা! আব্বু থাকলে আমায় মাছের মাথা এনে দিতো তাই না?”
সামিনা কোনো জবাব দিতে পারলো না।জ্বর জ্বর শরীরেই মেয়েকে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে বলতে লাগলো,
“যার কেউ নেই তার আল্লাহ্ আছে মা।আল্লাহ্কে ডাকো।”
(১০৪)
স্নেহা দুপুরে আর খাবার খায়নি।মায়ের বুকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। মেয়েকে বুকে নিয়ে ক্লান্ত সামিনাও ঘুমিয়ে কাঁদা।
কথায় আছে,
“কান্না হচ্ছে সেরা ঘুমের মেডিসিন।”
দুপুরে খাবার টেবিলে বসে সাগরিকার পাতে যখন তাশদীদ নিজ প্লেট থেকে মাছের টুকরো তুলে দিচ্ছিলো তখন সাগরিকা বলল,
“এই মাছ আমি খাবো না।”
সাগরিকার কথা শুনে তার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“মাছ খাবে না কেন?তবে কী খাবে?তোমার মা ডিম ভেজে এনে দিবে?”
“বাবা ছোটো বেলা থেকেই তো দেখেছি আমার জন্য তোমাদের প্রত্যেকের প্লেটে মাছ, মাংসের টুকরো থাকে। ছোটো বেলা থেকেই তাশদীদ ভাই নিজে না খেয়ে আমার জন্য মাছ রাখে। এ বয়সে আমি কত মাছের মাথা নষ্ট করেছি, খাইনি,একটু খেয়েছি,ফেলে দিয়েছি৷ তাই বলে কখনো তো আমার জন্য মাছ আনা বা মাছের মাথা রাখা বাদ যায়নি।এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি বলেছি বলে পদ্মার ইলিশ মাছ আনা হয়েছে রাত দুটোর সময়।”
সাগরিকার কথা শুনে তাশদীদের বাবা বলল,
“মা, মাছের মাথা খাবি বললেই হয়।তোরা খেলেই আমাদের খাওয়া। এটা বুঝিস না?”
এরপর তিনি তার স্ত্রীকে বললেন,
“মাথাটা সাগরিকার প্লেটে তুলে দাও।”
“আমি খেলে তোমার খাওয়া হয়। স্নেহা যদি খেতো তবে তোমার খাওয়া হতো না?”
“কেন হবে না?স্নেহা আর তুই দুজনেই আমাদের কাছে সমান।”
“তবে কেন আজ স্নেহা এই মাছের মাথাটার জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে?অসুস্থ মেয়েটা কারোর সাথে কথা বলে না।পাঁচ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে আজ আবদার করলো মাছ খাবে। মাছের মাথা খাবে অথচ তাকে দেওয়া হলো না কারণ সে পুরোটা খেতে পারবে না। নষ্ট করবে বলে।”
এত সময় পর খাবারের প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে তাশদীদ বলল,
“কী হয়েছে?”
সাগরিকা কথাগুলো বলার সময় কাঁদছিল। তাশদীদ সাগরিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“কাঁদিস না।যা স্নেহাকে নিয়ে আয়। আমরা বাহিরে খাবো আজ।”
তাশদীদের কথায় সাগরিকা সামিনার ঘরের দিকে চলে গেল।
তাশদীদ বসে রইল খাবার টেবিলে।আজ
কারোর গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না।তাশদীদের বাবা তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমার ভাইটা আজ দুনিয়াতে নাই।আজ এই যে বড় মাছের মাথা রান্না করে নিজ স্বামীর জন্য তুলে রেখেছো এটা রাখতে পারতে না যদি ওই মেয়েটার বাবা বিদেশ না যেত। পরিবারের দুঃসময়ে বাহির থেকে টাকা আয় না করতো। আর তুমি এই কাজ……
ও না খেতো,ফালিয়ে দিতো। যা ইচ্ছা করতো। যেখানে ওই মেয়েটা খেতে চেয়েছে আর কোনো কথা থাকার দরকার ছিল না।
আজ তোমাদের ব্যবহারে আমার মনে হচ্ছে আম্মা এই দিনের কথা চিন্তা করেই স্নেহার দায়িত্ব দায়িত্ব করতো।আমি বেঁচে থাকতেই এমন?মরে গেলে তো ওদের বের করে দিবে তোমরা।”
(১০৫)
সাগরিকা,স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়েছে তাশদীদ। স্নেহা চুপচাপ বসে আছে সাগরিকার গলা ধরে। সামিনাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু সামিনার শরীর আসলেই খারাপ।বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে তাই আর জোর করেনি। আগামীকাল ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবে তাশদীদ। সামিনা যেহেতু ঠিক করেছে সে আর বিয়ে করবে না, স্নেহাকে আগলে থাকবে তবে তাই হোক।তাদের ভালো মন্দ আর অন্য কারোর হাতে ছাড়া যাবে না।তাশদীদ কে অন্য মনস্ক দেখে সাগরিকা স্নেহাকে বলল,
“টুংকু যাদু দেখবে?”
স্নেহা মাথা দুলালেই সাগরিকা সজোরে চিমটি মারলো তাশদীদের কোমরে। ওমনি জোড়ে ব্রেক কষলো তাশদীদ। সাগরিকার দিকে চোখ গরম করে তাকালেও ওদিকে পাত্তা না দিয়ে স্নেহাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে৷
“যাদু না?এক সেকেন্ডে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছি।তাই না?”
“হুম।”
তাশদীদ কিছু না বলে পুনরায় চলতে লাগলো।কারণ শয়তানের সাথে লাগলে শয়তান কোমর বেধে নেমে যায় শয়তানি করতে। এজন্য তাকে ইগ্নোর করাই শ্রেয়। খাওয়া শেষ করে তারা স্নেহাকে নিয়ে গেল একটা ঘড়ির দোকানে। স্নেহার জন্য ঘড়ি কিনবে।পাশাপাশি বসে এত লোকের মাঝে তাশদীদ একটা কাজ করে বসলো,
কিছুক্ষণ পর পর সে আলতো চিমটি দিচ্ছে সাগরিকার কোমরে। দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই।কিন্তু তাশদীদের প্রতিটি স্পর্শে সাগরিকার পেটে যেন হাজার খানেক প্রজাপতি উড়তে লাগলো।
চলবে (এডিট ছাড়া।অনেক দিন পর ধীরে ধীরে ফিরছি।এর মাঝেও যদি পোস্ট করলেই রিপোর্ট আসে তাহলে আমি কোথায় যাবো? যারা গল্প পড়েন তারা অনুগ্রহ পূর্বক একটু রেসপন্স করবেন।”
#ছবিয়ালঃচিত্রময়ী