#তাসনিম_তামান্না
#প্রেমপ্রলয়
পর্ব-২৩ [শেষ পর্ব]
সামি আর জিমি বেঞ্চের মুখোমুখি বসে আছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা মালাই চা। সামি জিমির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। জিমি পিচের রাস্তার সাদা রংয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। আসলে জিমি ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করা উচিত। আজ বাসা থেকে বের হবার সময় লিলি জিমিকে শুধু বলেছে ‘আর যায় করিস আমার মেয়ের সংসারটা ভাংগিস না আর আমার মুখটা পুরাস না’
জিমি জানে সে যতক্ষণ না বিয়েতে হ্যাঁ বলবে ততক্ষণ লিলি বিয়ের কথা আগাবে না।
নিরবতা ভেঙে সামি বলল
-‘ কি হয়েছে তোমার? এমন অদ্ভুত বিহেব করছ কেনো?’
জিমি ভনিতা না করে চট করে বলল
-‘ আপনি না-কি আমাকে বিয়ে করতে চান?’
সামি সোজাসাপটা উত্তর দিলো
-‘ হ্যাঁ।’
-‘ কেনো? আমাকেই কেনো বিয়ে করতে হবে বাংলাদেশ কি মেয়ের অভাব পড়েছে না-কি?’
-‘ উহুম। কিন্তু আমার তুমিটার খুব অভাব!’
জিমি সামির কথায় লজ্জা পেয়ে সামির অপর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সামি হেসে বলল
-‘ বাহ! আপনি তো দেখছি লজ্জাও পান’
জিমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
-‘ মটেও না। আমি যদি আপনাকে বিয়ে না করি তখন কি করবেন? ‘
-‘ অপেক্ষা করবো!’
-‘ অপেক্ষা কিন্তু কঠিন জিনিস সময়ের ব্যাপার যদি ধৈর্য্য হারা হয়ে যান’
-‘ তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিবো’
জিমি এবার ভারি অবাক হলো। সামির কথার জন্য মটেও প্রস্তুত ছিল না। গলা ঝেড়ে বলল
-‘ একদম জে’লে পুরে দিবো’
সামি হাসলো। জিমি সে হাসির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল
-‘ যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তাহলে কিছু নিয়ম মানতে হবে’
সামি বিষময় নিয়ে বলল
-‘ মানে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি?’
-‘ হ্যাঁ কিন্তু আমি বিয়ের পরে চাকরি ছাড়তে পারবো না আর মাঝে মধ্যে আমার রাতেও বাসার বাইরে থাকতে এগুলো যদি আপনি মানতে পারেন এটাতে যদি আপনি রাজি থাকে তো বলেন আমি বিয়েতে রাজি আছি’
জিমি কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো সামি খুশিতে জিমিকে জড়িয়ে ধরে বলল
-‘ রাজি রাজি সব শর্তে রাজি থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ সো মার্চ আমি যে কতটা খুশি হয়েছি তোমাকে যে কিভাবে বলবো?’
জিমি সামিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সরে দাড়িয়ে বলল
-‘ নিজের লিমিট ক্রস করবেন না লিমিটের মধ্যে থাকুন’
-‘ আসলে সরি খুশিতে বুঝতে পারি নাই’
-‘ ইট’স ওকে আসছি’
পিছিয়ে ফিরে জিমি মুখ টিপে হাসলো। সামিও মাথা চুলকে বিল মিটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো।
___________________
-‘ আম্মু আমি বিয়েতে রাজি’
লিলি বেগম অবাক করে জিমির দিকে তাকিয়ে বলল
-‘ তুই ভেবে বলছিস তো?’
জিমি খেতে খেতে বলল
-‘ হ্যাঁ’
-‘ তুই সত্যি বলছিস? তাহলে আমি ওদের হ্যাঁ বলে দিয়ে আসি ওরা যে কি খুশি হবে’
লিলি আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না রুমে গিয়ে ফোন লাগালো জুলি বেগমর কাছে। জিমি তাকিয়ে দেখলো শুধু তার বিয়েতে তার মা এতো খুশি? তার হ্যাঁ বলাতে তার জীবনটা বদলে যাবে? সে কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিলো?
_________
জিমি আর সামির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। জিমি মনে মনে ভয় পাচ্ছে সামি বিয়ের পর আদেও চাকরি করতে দিবে তো না-কি পাল্টি খাবে। খুব দ্রুত জিমি আর সামির বিয়ের দিন চলে আসলো। সব রিচুয়াল মেনেই ওদের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েটা খুব সাদা মাটা ছিল। বিয়েতে বেশি কাউকে বলা হয় নি কাছে আত্মীয় ছাড়া। জিমি বিদায়ের সময় নিজেকে খুব শক্ত রাখার চেষ্টা করেও নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে বাচ্চাদের মতো মা’কে কেঁদে দিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের মতো করে বলেছিল মা’কে ছাড়া কোথাও যাবে না সে। পলাশ জিমিকে বুঝিয়ে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল।
_______________
জিমি বাসর ঘরে বসে ফুপিয়ে কেঁদে চলছে। মা আর দাদিকে ছাড়া জিমি কখনো কোথাও থাকে নি। মিলি, লিমন মামা বাড়িতে বেড়াতে গেলোও জিমি কখনো মা’কে ছাড়া থাকে নি। জিমি মা’র বকাগুলোও আজ প্রচন্ড মিস করছে। সেগুলো তখন বিরক্ত লাগলেও এখন যেনো সেগুলো মধুর লাগছে। সামির যে জিমির সাথে গালে হাত দিয়ে বসে জিমির দিকে তাকিয়ে আছে জিমির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে-তো নিজের মতো করে কেঁদে যাচ্ছে। সামি জিমির দিকে ওভাবে তাকিয়ে থেকে বলল
-‘ আমি এতো দিন জানতাম আমি একটা ম্যাচুয়েড মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছি কিন্তু এখন জানলাম একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছি। যে কি না এখন বাচ্চাদের মতো করে কান্না করছে’
জিমি ফুপাতে ফুপাতে বলল
-‘ আপনার কি আপনি চুপ করে বসে থাকুন আপনারই তো সব দোষ কে বলেছিলো আমাকে বিয়ে করতে? না আপনি আমাকে বিয়ে করতেন না আমি আম্মুকে ছেড়ে এতো দূর থাকতাম। সব আপনার জন্য হলো’
সামি বোকার মতো কিছুক্ষণ জিমির দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত কন্ঠে বলল
-‘ যাও ফ্রেশ হয়ে আসো’
জিমি মাথা হেলিয়ে সমতি জানিয়ে জামা নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো। সামি জিমির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বেলকনিতে চলে গেলো। আজ রাতের আকাশে চাঁদ তারার মেলা বসেছে সবাই মিটমিট করে জ্বলছে। সামি তাকিয়ে রইলো সেদিক পানে। পায়ের শব্দ পেতে পিছনে ফিরে জিমিকে দেখলো জিমিকে আজ অন্য অন্য রুপে দেখছে সামি। কখনো শাড়ি তো এখন আবার থ্রি পিচ সামি জিমিকে কখনো থ্রি পিচ কিংবা শাড়িতে দেখেনি সবসময় ঢিলাঢালা শার্ট কিংবা টি-শার্টে দেখেছে। জিমির নতুন নতুন রূপ দেখে সামি যেনো নতুন করে জিমির প্রেমে পড়ছে। জিমি একটা লাল রংয়ের থ্রি পিচ পড়ে আছে চুলগুলা ছাড়া। নিজের কাছেই তার কেমন কেমন জানি লাগছে। জিমি অস্তি নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামি চোখ ফিরিয়ে নিলো বহু কষ্টে শুকনো ঢোক গিলে বলল
-‘ দাঁড়িয়ে আছো কেনো যাও ঘুমিয়ে পড় সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার’
জিমি চোখ তুলে সামির দিকে তাকালো সামির পিছনটা দেখা যাচ্ছে বলল
-‘ আর আপনি ঘুমাবেন না?’
-‘ হ্যাঁ তুমি ঘুমিয়ে পড় আমার দেরি হবে’
জিমি কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলল না পিছনে ফিরে রুমের দিকে পা বারাতেই সামি বলে উঠলো
-‘ জিমি’
জিমি চলন্ত পা থামিয়ে পিছনে ফিরে বলল
-‘ হুমম’
-‘ তুমি কি কষ্ট পেয়েছ?’
জিমি বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে বলল
-‘ মানে? কিসের জন্য?’
-‘ ঔ যে নিচে তখন খালামনির কথায়’
জিমি মনে পড়লো ভ্রু কুচকানো মিলিয়ে গেলো।
ফ্ল্যাসব্যাক–
বিয়ে করে আনার পর যখন জিমিকে বাসায় এনে সোফায় বসানো হয় তখন জিমি মিলিকে আস্তে করে বলল
-‘ আপু আমি ওয়াসরুমে যাবো চোখমুখ জ্বালা করছে নিয়ে চল’
আস্তে বললেও পাশে বসে থাকা খালাশাশুড়ি শুনতে পেয়ে খ্যাক করে উঠে বলল
-‘ এই নতুন বউ তুমি বড় বউকে তুই তোকারি করছো কেনো? মানলাম ও তোমার বড় বোন কিন্তু এখন তো জা ও হয় সম্মান দিয়ে কথা বলবে’
জিমি মাথা নিচু করে নিলো। সবাই তাকিয়ে আছে জিমির দিকে মিলি বলে উঠলো
-‘ সে যাহোক খালামনি সে আমার আগেও বোন ছিলো এখনো বোন আছে তার সাথে জা এড হয়েছে কিন্তু ও আমার বোন আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি থাকবে আর এটা আমাদের দুজনের ব্যাপার আপনারা এর মধ্যে কথা না বললে খুশি হবো’
-‘ হ্যাঁ দেখবো তোমাদের ভাব কতদিন থাকে।’
বর্তমান–
জিমিকে কিছু বলতে না দেখে সামি বলল
-‘ দেখো ওনার কথায় কিছু মনে করো না উনি একটু ওমন-ই’
জিমি সামির দিকে তাকিয়ে বলল
-‘ আমি জানি সমাজে এবং পরিবারে এমন কিছু মানুষ থাকে তারা শুধু অন্যর ত্রুটি ধরে প্রশংসা করে না উনিও তাদের মধ্যে-ই পড়েন আমি এগুলোতে কিছু মনে করলেও আপুর কথায় সেকথা আর গায়ে লাগে নি বরং আপুর প্রতি ভালোবাসা আর সম্মানটা বেড়ে গেছে’
সামি বলতে চাইলো ‘আর আমার প্রতি কি তোমার কোনো ফিলিং কাজ করে না? এতোদিনেও কি আমি কি তোমার মনে জায়গা করে নিতে পারলাম না?’ কিন্তু সেগুলো আর মুখ দিয়ে বের করা হলো না। শুধু মুখে বলল
-‘ থ্যাংস বোঝার জন্য’
জিমি মাথা ঝাকিয়ে ধীর পায়ে রুমে গিয়ে বেডের এক পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। জিমির মনের মধ্যে অজানা অচেনা অনুভূতি গুলো উঁকি দিচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ক্রমাগত। জিমি এপাশ ওপাশ করলো অনেকক্ষণ বারান্দার দরজার দিকে তাকালো বার বার সামির অপেক্ষায় রাত ২টা বেজে গেলো তবুও সামি এলো না। জিমি নিজের মধ্য অস্থিরতা খুব করে অনুভব করলো। জিমিকে ক্লান্তিও জেনো আজ জিমিকে কাবু করতে পারছে না। জিমি শোয়া থেকে উঠে ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো। গিয়ে দেখলো সামি আগের মতো এখনো গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। জিমিও সামির পাশে গিয়ে দাড়ালো। সামি টের পাই নি জিমি এসেছে তা। চারিদিকে নিস্তব্ধ চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। তার সাথে বেলিফুলের ঘ্রাণ। নিস্তব্ধতা ভেঙে জিমির মৃদু সুরেলা কণ্ঠে সামির দিকে তাকিয়ে বলল
-‘ কি ভাবছেন?’
সামি অদ্ভুত ভাবে চমকে জিমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
-‘ তুমি এখানে কি করছো?’
-‘ ঘুম আসছিলো না’
-‘ ওহ’।
আবারও মিনিট পাঁচেক নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। হুট করে কোনো কথা ছাড়া সামি সরাসরি প্রশ্ন করলো
-‘ এখনো কি তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো নি?’
জিমি মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল
-‘ যদি বলি না’
সামি হতাশ নিশ্বাস ছাড়লো। জিমি আবারও বলল
-‘ এতোদিন আমার পিছে পিছে ঘুরে এখনো আমার মন বুঝতে পারেন নি?’
-‘ তোমার মনে হয় আমি তোমার মন বুঝি না? অবশ্যই বুঝি আর এটাও বুঝি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো শুধু প্রকাশ করতে চাও না’
-‘ বুঝেন তাহলে প্রশ্নটা করলেন কেনো?’
-‘ মন চাইলো। যানতাম আজও উত্তর পাবো না তাও করলাম’
-‘ আপনার কি মনে হয় আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ কিছু করাতে পারে? তাহলে ভাবলেন কেমন করে বিয়েটা আমাকে দিয়ে জোর করে করানো হয়েছে? আপনার এইটুকু বোঝা উচিত ছিল আমার মতে বিয়েটা হচ্ছে কেউ জোর করে করাই নি তাহলে কেনো আপনি আপুর কাছে শুনতে গেলেন?’
সামি জিমির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল
-‘ তাহলে শিকার করছো তুমি আমাকে ভালোবাসো?’
জিমি সামির চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে উত্তর দিলো
-‘ হ্যাঁ আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। প্রতিদিন আমাকে বিরক্ত করে আমার সাথে যেচে ঝগড়া বাঁধিয়ে আমাকে বাধ্য করেছেন। আপনার চোখের চাহনি আমাকে ক্রমশ দূর্বল করে দিয়েছে। প্রতিদিন আপনার এতো ব্যস্ততা থাকার সত্ত্বেও আপনি আমাকে ৫ মিনিটের জন্য হলেও সময় দিয়েছে। আমার ভালো, খারাপ, পছন্দ, অপছন্দের খবর নিয়েছেন আপুর কাছ থেকে।এতো কিছু পরেও আমার মনে হয় একটা পাথরও গলে যাবে আর আমি তো সেখানে মানুষ মাত্র’
সামির মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
-‘ তাহলে পারলাম আমার প্রেমপ্রলয়ে তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে’
জিমি সামির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশে দৃষ্টি স্থির করে হেসে বলল
-‘ ভাসিয়ে নিয়ে জাননি ডুবিয়ে দিয়েছেন’
সামি হুট করে জিমির পায়ের কাছে বসে। পা কলে নিলো জিমি চমকে বলল
-‘ কি করছেন কি? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?’
সামি একটা সুন্দর পায়েল পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
-‘ আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম যেদিন তুমি আমার প্রতি তোমার অনুভূতি প্রকাশ করবে তোমাকে এটা দিবো’
কথাটা বলে জিমি পায়ে ঠোঁট ছোয়ালো। জিমি কেঁপে উঠলো। সামির বাহু খামছে ধরলো।
সমাপ্ত