মালা_করনু_তারে_দান,পর্বঃ২২,২৩

0
472

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্বঃ২২,২৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২

সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা।
রেডি হয়ে অফিসের জন্য বেরোচ্ছিলো ইফরান। রতন তখন বালতিতে পানি নিয়ে ছাদে উঠছিলো গাছে পানি দেওয়ার জন্য। তাড়াহুড়োতে ধাক্কা খেলো ইফরানের সঙ্গে। বালতি থেকে পানি ছিঁটকে ইফরানের প্যান্টে, জুতোয় পড়ে ভিজিয়ে দিলো।
মেজাজ চরমে উঠে গেলো ইফরানের।
মানুষ চাইলেই সহজে অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে না। দাঁতমুখ খিঁচে রতনকে চড় মারতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো বসার ঘরে বিনিকে দেখে। বিনি বুক শেল্ফে বই গুছাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত নামিয়ে নিলো ইফরান। নিজেকে শান্ত করে ফেললো।
ঠান্ডা গলায় রতনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘তোদের খামোখা বেতন দিয়ে রেখেছি। একটা কাজও ঠিকমত করতে পারিস না। যা সর সামনে থেকে।’

রাহেলা মির্জা বিনির সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইফরানকে হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে দেখে ফিসফিস করে বললেন,
—‘দেখছিস? তোকে দেখে কেমন মেজাজ শান্ত করে নিলো? জানে তুই কাজের লোকদের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করিস না। তাই। নইলে রতনের আজকে খবর ছিলো। ‘

রাহেলা মির্জা যত যাই বলুক মনে মনে তিনি ছেলের পক্ষে। একথা তিনি মুখ ফুটে বলেন না। কিন্তু নানা বাহানায় ইফরানের কথা বলে বিনির মন নরম করতে চাইছেন।

বিনি জবাব দিলো না। রাহেলা মির্জা পুনরায় ফিসফিস করে বললেন,
—‘ভালো না বাসলে কিন্তু পরোয়া করতো না।’

বিনি এবারেও নিরুত্তর রইলো। রাহেলা মির্জা রতনকে নিয়ে উপরে চলে গেলেন। ইফরান সিঁড়ি থেকে নেমে বিনির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৌনমুখে বিনিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘এখন তো আমি কাজের লোকদের গায়েও হাত তুলি না। আর কত রাগ করে থাকবে আমার সঙ্গে?’

বিনি বুক শেল্ফে ধুলো ঝাড়ার ভান করে অন্যপাশে সরে গেলো। ইফরানকে অধৈর্য দেখালো। অস্থির হয়ে বললো,
—‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি। মদ সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’

বিনি শুধু একবার তাকিয়ে আবার নিরবে চোখ সরিয়ে নিলো। কিন্তু ইফরান হাল ছাড়লো না। পুনরায় ডাক দিলো,
—‘রাগ পুষে রাখার চাইতে দেখিয়ে ফেলো না।’
—‘তোমার ওপর আমার কোন রাগ নেই। টেবিলে নাশতা দেওয়া হয়েছে। খেতে যাও।’
—‘রাগ না থাকলে কথা বলো না কেন আমার সঙ্গে?’
বিনিকে এবার সিরিয়াস দেখালো। গম্ভীর মুখে জবাব দিলো সে,
—‘কথা বলি না তার কারণ তোমার ওপর থেকে অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছি আমি।’

ইফরান চেয়ারের হাতল চেপে ধরলো। বিনির এত কঠিন জবাব সে সহ্য করতে পারছে না। চোখে পানি চলে আসছে। লজ্জা লাগছে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
—‘আমি তোমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করছি। তোমাকে অপমান করেছি। তাই তুমি আমাকে উপেক্ষা করছো, শাস্তি দিচ্ছো। কিন্তু তোমাকে যে ভালোবেসেছি তারজন্য বুঝি কিছুই পাওয়ার নেই?’

বিনি থমকে গেলো! কয়েক মুহূর্ত নিরবে ইফরানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। ইফরান চট করে তাঁর হাত ধরে ফেললো। আকুতিভরা কন্ঠে বললো,
—‘আমার সঙ্গে কথা না বলো ঠিক আছে কিন্তু আমাকে নিয়ে ভাবো না, আশা রাখো না, এগুলো বলো না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারবো না।’
বিনি ঠোঁট কামড়ালো। নিজেকে দুর্বল হতে দিতে চায় না সে। দুর্বল মানুষ ঠকে বেশি। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
—‘অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। টেবিলে যাও।’
ইফরান শুনলো না। না খেয়েই বেরিয়ে গেলো। বিনি তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।


তোফায়েল সিনহা ছেলেকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এর আগে ইফরানকে অনেক বুঝিয়েছেন নতুন প্রজেক্টের কাজ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু ইফরান শোনে নি। তাই আজকে আবার দেখা করতে এসেছেন। আরো ক্লিয়ারলি যদি বলা হয় তবে হুমকি ধামকি দিতে এসেছেন।

ইফরান অফিসেও আসে নি। বিনি চিন্তায় পড়ে গেলো। রাগ করে কোথায় বেরিয়ে গেছে সে? আবার যদি বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দেয়? এদিকে তাঁর দেখা না পেয়ে বিনির সঙ্গে আলাপ চলে এলেন তোফায়েল সিনহা।

বিনি ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বোধ করলেও ধৈর্য সহকারে তোফায়েল সিনহার কথা শুনলো। কিন্তু তোফায়েল সিনহা ধৈর্য রাখতে পারলেন না। কথাবার্তার একপর্যায় অধৈর্য হয়ে বললেন,
—‘ইফরান মির্জা ব্যবসা করতে নেমেছে মাত্র কয়েকমাস। আর আমি আজকে ত্রিশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। তাঁকে আটকাতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আমার ছেলে চাইলেই মামলা ঠুকে দিতে পারবে। তবুও আমি সোজাভাবে তাঁকে বোঝাতে চাইছি।’

বিনির সংযমের মাত্র অকল্পনীয়। এমন পরিস্থিতিতেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে ভুললো না। যদিও হাসিটা বিদ্রুপের। সামনের পানির গ্লাসটা তোফায়েল সিনহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—‘আপনি শুধুশুধু উত্তেজিত হচ্ছেন মি.সিনহা। সরকারি নির্দেশ মোতাবেক কাজ শুরু করা হয়েছে। বেআইনি কিছু হচ্ছে না। খামোখা এসব হুমকি ধামকি দিয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করছেন। তার চেয়ে বরং ব্যবসায় মনোযোগ দিন।’

বিনির বেপরোয়া জবাব শুনে এবার তারেক সিনহা মুখ খুললো। বাবার কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
—‘আমরা মোটেও ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি না মিসেস মির্জা। আপনার হাজবেন্ডের যেই চরিত্র তাতে করে তাঁর নামে যেকোনো ধরণের মামলা ঠুকে দেওয়া খুবই সহজ।’

বিনি ভ্রু কুঁচকালো। মুখের ভাব কঠোর হয়ে গেলো তাঁর। তারেক সিনহাকে কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে মন দিতে চাইলো। তারেক সিনহা সেটা লক্ষ্য করে বললো,
—‘রিলেক্স মিসেস মির্জা। আমরা এমন কিছুই করছি না। আপনি শুধু ডিলটা আমাদের কম্পানীকে ছেড়ে দিন। ব্যস! তাহলেই ঝামেলা মিটে যাবে। শুধুশুধু মির্জা ফ্যামিলির সঙ্গে ঝামেলা করার ইচ্ছে আমাদেরও নেই।’
—‘কিন্তু তারপরেও তো করছেন?’
—‘আমি তো আপনাকে বলেছিই ডিলটা আমাদের হাতে ছেড়ে দিলে আর কোন ঝামেলা হবে না। আমি আব্বাকে আর কোন ঝামেলা করতে দেবো না। ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। আপনি চোখ বন্ধ করে আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আমার কথার বরখেলাপ করবো না।’

বিনি সামনে রাখা পেপার ওয়েটে হালকা টোকা দিলো। মুচকি হেসে তোফায়েল সিনহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘আপনার ছেলে তো বেশ ইন্টারেস্টিং! কি সুন্দর আমাকে উপায় বাতলে দিলো। মানতেই হবে সে চোর হলেও ইমানদারি আছে। ভালো। খুব ভালো।’

বাপ ছেলের মুখ হঠাৎ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। তোফায়েল সিনহা হাল ছাড়লেন। বিনি স্পষ্টত, হাসিমুখে অপমান করেছে। এই মেয়েটার ভীষণ ধারালো। শান্তভাবে অপমান করে দিতে পারে। নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন,
—‘তারমানে আপনারা কাজ বন্ধ করবেন না তাইতো?’
—‘প্রশ্নই উঠে না। কাজ আগের মতই চলবে। এবার আপনারা আসুন। আমি বেরোবো।’

তোফায়েল সিনহা ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বিনির দিকে অত্যন্ত ক্রুর কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেলেন। তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না পথের কাঁটাটা আসলে কে? ইফরান নাকি বিনি?
ম্যানেজারের কাছে শুনেছিলেন স্বামীস্ত্রীর মধ্যে তেমন বনিবনা নেই! সেই সুযোগ নিয়ে বিনিকে অনেকবার ভড়কাতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। বিনি সহজে হাতে আসার মত মেয়ে নয়। সেই সুযোগই দেন নি তোফায়েন সিনহাকে। উপরন্তু বিনির সঙ্গে কথা বলে বারবার এটাই মনে হয়েছে ইফরানকে গভীরভাবে ভালোবাসে সে। নইলে এতকিছুর পরেও ইফরানের সবকিছু আগলে রাখার এত প্রয়াস তাঁর মাঝে থাকবে কেন?

তাঁরা বেরিয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো বিনি। সকালের কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে এলো। ইফরানকে একটু বেশিই বলে ফেলেছিলো সে। নইলে এতদিনে একবারও অফিস মিস দেয় নি ইফরান। আজকে তাঁর ওপর রাগ করে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করলো সে। ইফরানের খবর জানতে চাইলো।

ইফরান ফেরে নি শুনে বিনি চিন্তা বেড়ে গেলো। নিচের ঠোঁট কামড়ালো। চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে তারপর হালিম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘সে তো অফিসেও আসে নি চাচা। কোথায় গেছে আপনি একটু খোঁজ নিন। খোঁজ নিয়ে আমাকে জানান।’

হালিম মিয়া সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। তৎক্ষণাৎ লতিফ মিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইফরানকে খবর জানতে। বিনি ফোন রেখে থম মেরে বসে রইলো। টেনশনে মাথা ব্যথাটা আবার ঝাঁকিয়ে আসছে।


ইফরান বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে ফিরেছে সে। এসেই মদ নিয়ে বসেছে। বিনি মিনুকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছিলো। খায় নি। বসে বসে মদ খাচ্ছে।

রাহেলা মির্জা নিজের ঘরে বসে কাঁদছেন। ছেলের হয়ে জোর গলায় বিনিকে কিছু বলতেও পারছেন না। আবার ছেলের দুরবস্থাও সহ্য করতে পারছেন না।

কিন্তু ভৃত্যরা সবাই বিনির পক্ষে। সবাই বিরক্ত ইফরানের ওপর। সারাদিন কত খাটাখাটুনি করে অফিস থেকে ফেরে বিনি। ঘরসংসার সামলায়। অথচ ইফরান নির্লজ্জের মত আবার মদ নিয়ে বসেছে। একটু যদি শিক্ষা হতো। ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিনিকে কিছু জানালো না কেউ।
বিনি নিচতলায় বসার ঘরে অফিসের কাজ করছিলো। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ হঠাৎ গম্ভীর থমথমে দেখে মিনুকে ডাক দিলো। নিতান্ত কৌতূহল বশতই প্রশ্ন বললো,
—‘কি হয়েছে মিনু? সবাই কোথায়? বাড়ি এত নিশ্চুপ কেন?’
মিনু প্রথমে বলতে চাইলো না। বিনি ফের জিজ্ঞাসাতে কাচুমাচু করে বললো,
—‘ভাইজান ঘরে মদ খায়। আম্মা কানতাছে। হালিম চাচা আর লতিফ মিয়া বাইরে।’

বিনি অবাক হলো। ইফরান আবার মদ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে?
—‘আমাকে জানাও নি কেন?’
—‘আপনি কাজ করতাছেন তাই বিরক্ত করি নাই।’

বিনি ফাইল পত্র রেখে উঠে দাঁড়ালো। মিনুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘আমার সঙ্গে এসো।’

ঘরে ঢুকতেই মদের বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এলো। সোফায় বসে মদ খাচ্ছে ইফরান। বিনি মদের বোতলগুলোর দিকে ইশারা করে মিনুকে বললো,
—‘এগুলো নিচে নিয়ে যাও মিনু খালি করে ডাস্টবিনে ফেলে দাও।’

মিনু তাঁর কথামত বোতল নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ইফরান প্রতিবাদ করতে নিলে কড়াচোখে তাঁর দিকে তাকালো বিনি। সঙ্গে সঙ্গেই চুপ হয়ে গেলো ইফরান।
টেবিলে খাবার পড়ে আছে। বিনি সেদিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,
—‘মদ কেন খেয়েছো?’

ইফরান চোখ পিটপিট করলো। ঘামে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেছে তাঁর পরনের শার্ট। মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। বিনির প্রশ্নের জবাবে এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে দেখে বললো,
—‘নিচে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। আমাকে দেখে আফসোস করে বললেন,”বৎস তোমার কঠিন হৃদয়া, পাথরবৎ সহধর্মিণী তোমাকে কোনদিনও ক্ষমা করিবে না। অতএব ভালো হইয়া কাজ নাই। তারচেয়ে বরং মদ খাও। মদ খাইয়া নিজের জ্বালা মেটাও। ইহাতে আত্মতৃপ্তি মিলিবে।”

বসার ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটার কথাই নেশার ঘোরে বলছে ইফরান। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে অল্পতেই নেশা ধরে গেছে। বিনি রাগতে গিয়েও পারলো না। চুপচাপ ইফরানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মায়াময়, নিষ্পাপ লাগছে ইফরানকে। যেন দুনিয়াদারি কোন খোঁজখবর নেই। বোঝাই যাচ্ছে না এই ছেলেটাই একসময় আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে দিয়েছিলো তাঁকে। ক্রমাগত অত্যাচারে দুর্ব্যবহারে বাড়ির ভৃত্যদের জীবন যাপন অতিষ্ঠ করে দিয়েছিলো।

ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে পানি এনে ইফরানের মাথা ধুয়ে দিলো সে। চোখেমুখে পানি ঢাললো। গায়ের ভেজা শার্টটা খুলে দিয়ে গা মুছে দিলো। তারপর একটা পাতলা গেঞ্জি পরিয়ে দিয়ে চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—‘রবীন্দ্রনাথ তোমাকে মদ খেতে বলেছে?’

ইফরান যেন কোনভাবেই স্বীকার করতে রাজি নয় সে নিজের ইচ্ছেতে মদ খেয়েছে। জোর গলায় বললো,
—‘বলেছেই তো! নইলে আমি খেলাম কেন?’

মিনুকে দিয়ে লেবু শরবত আনিয়ে বিনি। সেটা খাইয়ে দিয়ে মৃদু শাসনের সুরে বলল,
—‘আমি না আসা পর্যন্ত এখান থেকে নড়বে না। চুপচাপ বসে থাকবে। আমি এক্ষুনি আসছি।’


রান্নাঘর থেকে ফ্রেশ খাবার নিয়ে ফিরে এলো বিনি। ইফরান তার কথামত চুপচাপ বসে আছে। এক ধ্যানে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।

বিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তাঁর অযত্ন, অবহেলায় বেশ শুকিয়ে গেছে ইফরান। খাবার দাবার নিয়েও অনিয়ম করছে। রাহেলা মির্জা রোজ বকাবকি করেন কিন্তু ইফরান শোনে না। মাকে ঠিক কিছু একটা বলে বুঝ দিয়ে দেয়।

বিনি খাবার মেখে ইফরানের সামনে বাড়িয়ে দিলো। টেবিলে হালকা আওয়াজ করে বললো,
—‘এই যে মায়ের আদরের বাঁদর। দেখি হাঁ করো।’

ইফরানের ধ্যাণ ভঙ্গ হলো। সচেতন হয়ে বিনির দিকে চাইলো সে। দৃষ্টি সরু করে বললো,
—‘কি এটা?’
—‘ভাত। রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়েছেন তোমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।’
—‘খাবো না।’

ছোট বাচ্চাদের মতন গাল ফোলালো ইফরান। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিনির মুখের ভাব কঠোর। কিন্তু চোখে হাসি। ফের শাসনের সুরে বললো,
—‘না খেলে আমি এক্ষুনি হালিম চাচাকে গাড়ি বের করতে বলছি। বড়চাচার বাসায় চলে যাবো।’

ইফরান করুণ মুখ করে তাকালো। হাঁ করে লোকমাটা মুখে নিয়ে বললো,
—‘আমার সঙ্গে কথা বলবে তো?’
—‘মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিচ্ছি। আবার জিজ্ঞেস করছে কথা বলবো কি না। নির্বোধ আর কাকে বলে! দেখি বড় করে হাঁ করো।’

ইফরান হাঁ করলো। শান্ত ছেলের মত চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো।
বিনি এঁটো বাসন পত্র নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো কিন্তু পেছন থেকে তাঁর হাত চেপে ধরলো ইফরান। সরল, নিষ্পাপ অভিযোগ জানিয়ে বললো,
—‘আজকে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি বিনি। তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছো। কেন বললে আমাকে নিয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছো? আমি বুঝি ভালো হওয়ার চেষ্টা করছি না?’

বিনি বেশ বুঝতে পারছে তাঁর ভেতরটা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইফরানকে আর কষ্ট দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না।

ইফরান উত্তরের অপেক্ষায় তাঁর দিকে চেয়ে রইলো। বিনি সামান্য হেসে বললো,
—‘ঠিক আছে। আর বলবো না। তুমি ভালো ছেলে। এবার ছাড়ো। এগুলো রেখে আসি।’

ইফরান যেন একটা ঘোরের মধ্যে আটকে গেছে। ছাড়লো না সে। বিনির কোমর জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ছেড়ে দিলেই যদি বিনি আবার আগের মতন কঠোর হয়ে যায়।
নেশার ঘোরে বিনিকে বোঝার মতন শক্তি তাঁর মস্তিষ্কে জোগাড় করতে পারছে না। নইলে আর কিছু নাহোক অন্তত বিনির গায়ের উত্তাপ টুকু বুঝতে পারতো সে। একশো তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপাত দৃষ্টিতে কঠিন বলে মনে হওয়া এই মহৎ হৃদয়ের অসাধারণ মেয়েটি। নিজের দিকে খেয়াল রাখার মতন হুঁশ তাঁর নেই। সে ব্যস্ত অফিসের কাজ আর ইফরানকে সামলাতে। সন্ধ্যার দিকে নিতান্তই মাথা ব্যথাটা সহ্য করতে পারছিলো না বিধায় একটা প্যারাসিটেমল খেয়ে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার গুরুদায়িত্বটা ঘাড় থেকে নামিয়েছে সে।

ইফরান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে বিনিকে। তাঁর অবস্থা দেখে বিনির দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। স্নেহজড়িত শাসনের সুরে বললো,
—‘আর কখনো মদ খাবে না। মা কষ্ট পান।’
—‘খাবো না।’
—‘ঠিক আছে। এবার ছাড়ো।’
ইফরান ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিলো। বিনি বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে অনুরোধ জানিয়ে বললো,
—‘তাড়াতাড়ি এসো। তুমি না এলে কিন্তু আমি ঘুমাবো না।’

মাঝরাতের বাতাসের শো শো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইফরানের। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে ঝড়ো বাতাস। বাতাসে জানালার পাট্টা বারবার বাড়ি খাচ্ছে।
ইফরান উঠে বসলো। ঘুমঘুম চোখে আশেপাশে চাইলো। তাঁর পাশেই আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছে বিনি। আবছা আলোতে মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মায়াবী, মোহনীয় লাগছে দেখতে। বেশকিছুক্ষন চেয়ে থেকে উঠে দাড়ালো ইফরান।

ধীরে পায়ে হেঁটে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। ফিরে এসে বিনিকে ঠিক করে শুইয়ে দিতে গেলে তাঁর গায়ে হাত লাগলো। অবাক হলো ইফরান। বিনির গায়ে জ্বর। কপালে হাত দিয়ে ভালোভাবে চেক করলো সে। একশো চার ডিগ্রীর কম হবে না!

বিস্মিত, হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে বিনির মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে মরে যেতে মন চাইছে তাঁর। এত জ্বর নিয়ে তাঁর পাশে বসে ছিলো বিনি। অথচ সে টেরই পেলো না। নিশ্চিন্তে আরাম করে ঘুমিয়েছে! দ্রুত বিনিকে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাঁর গায়ের ওপর কাঁথা টেনে দিলো। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে অনুতপ্ত, অশ্রুসজল কন্ঠে বললো,
—‘আমি সবসময় কেন তোমাকে কষ্ট দেই বলোতো? যখন খারাপ ছিলাম তখনও কষ্ট দিয়েছি। এখন ভালো হওয়ার পরেও কষ্ট দিচ্ছি। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? আমি সত্যিই একটা ইউজলেস। নইলে তোমাকে সুখি করতে পারি না কেন?’

সারারাত বিনির পাশে জেগে বসে রইলো ইফরান।
কপালে জলপট্টি দিয়ে একটু পরপর টেম্পারেচার চেক করলো। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত বিনির হাত চেপে ধরে নিজের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো নির্দ্বিধায় তাঁর কাছে প্রকাশ করে দিলো। পূর্বের করা ভুলের জন্য শত সহস্রবার ক্ষমা চাইলো বিনির কাছে। কিন্তু অন্তরের জ্বালা কিছুতেই কমাতে পারলো না।

#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩

“ব্রাইবারি অফার করার অপরাধে ব্যবসায়িক সমিতি থেকে ভাবির সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে। ভাবিকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।”

গম্ভীর মুখে ইফরানকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন মির্জা পরিবারের ব্যক্তিগত পরামর্শক জামিউল খন্দকার। পেশায় একজন উকিল তিনি। তাঁর বাবা আতাউল খন্দকার ছিলেন আবু আলী মির্জা সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুত্র ধরেই মির্জা পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা জামিউলের।

ইফরানেএ রক্তলাল চোখজোড়া মেঝেতে নিবদ্ধ। তাঁর ধারণা কেউ একজন জেনেবুঝে বিনিকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। হতে পারে অফিসের কেউ। বাইরেরও হতে পারে। ইফরান সঠিক জানে না।
তবে বিনি যতদিন ম্যানেজিং ডিরেক্টের চেয়ারে ছিলো ততদিন তাঁর ভয়ে কম্পমান ছিলো গোটা অফিস। রাহেলা মির্জার বার্ধক্যের সুযোগ নিয়ে গোপনে যেসব টাকাপয়সা লুটপাট চলছিলো সেগুলো আর হচ্ছিলো না। তাই গোপনে অনেকেই বিনির পেছনে লেগে গিয়েছিলো। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
ইফরানকে সামনে রেখে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে আছে মুখোশধারী শয়তানেরা। তাদের ধারাণা তাঁরা যাই করুক না কেন দোষ ইফরানের ঘাড়েই পড়বে! কারণ অফিসের সবাই জানে ইফরানের সঙ্গে মনোমালিন্য চলছে বিনির।

জামিউল ইফরানের হাতে উকিল নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ইফরান জলন্ত দৃষ্টিতে হাতের কাগজখানার দিকে চাইলো। ক্রমশই মেজাজ খারাপ হয়ে আসছে তাঁর।বেল বাজিয়ে অফিসের সমস্ত কর্মচারীকে তাঁর রুমে জড়ো করলো। বজ্রকন্ঠে হুংকার দিয়ে বললো,’এই কাজ কে করেছে?’

কেউ স্বীকার করলো না। তৌহিদা আগেই নোটিশ পড়েছে। তাই সে জানে এই কাজ কার। ভীত কন্ঠে বললো,
—‘এলিগেশন আপনার নামে ছিলো স্যার। তোফায়েল সিনহা বাদী হয়ে কম্পানীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু ম্যাম কৌশলে কেইস ঘুরিয়ে দিয়েছেন।’
—‘মানে?
ইফরান হাতের কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করলো। তৌহিদা সবটা ক্লিয়ার করে দিয়ে বললো,
—‘মানে এখন সত্যতা যাচাই হওয়ার আগ পর্যন্ত কম্পানীর নামে কেউ কিছু বলতে পারবে না। দোষ যা হবে সব ম্যামের ঘাড়ে পড়বে। এতে করে কম্পানী ফেইস লস হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।’

ইফরান তেতে উঠলো। বিনাকারণে বিনিকে জেলে নেওয়া হয়েছে ভাবতেই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে পড়লো। খামোখাই তৌহিদাকে ধমক দিয়ে বললো,
—‘শাট আপ। আপনার কি হয় আমার স্ত্রীর সম্মানের চাইতে বেশি কম্পানীর ফেইসলসের গুরুত্ব আমার কাছে বেশি? হাউ ক্যান ইউ বি সো ইরেস্পনিসবল?’

ধমক খেয়ে তৌহিদা চুপ হয়ে গেলো। ইফরান আঙুল দিয়ে কপালের শিরা চেপে ধরলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
—‘ড্রাইভারকে বলুন গাড়ি রেডি করতে আমি থানায় যাবো।’


লকাপের বাইরে মুখোমুখি বসে আছে ইফরান এবং বিনি। ইফরানের দৃষ্টি উত্তপ্ত। বিনি শান্ত। আকাশ পাতাল কি যেন ভাবছে। ইফরান রাগে ফুঁসে উঠে বললো,
—‘মিথ্যে বলে নিজের নামে বদনাম নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো?’

বিনির ভাবনায় ছেদ কাটলো। সামান্য হেসে বললো,
—‘প্রয়োজন ছিলো বলেই তো নিয়েছি। মিছেমিছি তো আর কারো জেলে আসার শখ হয় না।’

ইফরান হাত দিয়ে বিনির কপালে জ্বর চেক করলো। । জ্বর নেই আশ্বস্ত হতেই হাত সরিয়ে নিলো। গম্ভীর, থমথমে গলায় বললো,
—‘প্রয়োজনটা কি সেটাই জানতে চাইছি।’
—‘প্রয়োজনটা হচ্ছে তুমি জেলে আসা মানে পুরো কম্পানীর বিরুদ্ধে আনা এলিগেশন সত্য প্রমাণিত হয়ে যাওয়া। মানে বুঝতে পারছো? এরপরে যদি তোফায়েল সিনহার আনা এলিগেশনগুলো মিথ্যেও প্রমাণিত হয় কম্পানীর ওপর থেকে ব্যাড ইমপ্রেশন হঁটানো যাবে? শোনো আমি বোকা, নির্বোধ নই। নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার ঠেকা পড়ে নি আমার যে সেধে সেধে জেলে যেতে চাইবো। প্রয়োজন ছিলো বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কম্পানীর প্রয়োজনে যদি আমার পরিবর্তে তোমাকে জেলে যেতে হতো তবে আমি তোমাকেই পাঠাতাম।’

কম্পানী! কম্পানী! কম্পানী! রাগে অসহ্য হয়ে গেলো ইফরান। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
—‘কম্পানী ক্ষতি হলে হতো। তুমি এর মাঝে ঢুকলে কেন?’
বিনি শক্ত কন্ঠে বললো,
—‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যা ফ্যাক্ট। অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নেই। আই ক্যান টেইক কেয়ার অফ মাইফেল্ফ। আমি নিজের ভালো বুঝি। তুমি মামলা কীভাবে হ্যান্ডেল করবে সেটা নিয়ে ভাবো।’

বিনির অবজ্ঞামিশ্রিত কন্ঠস্বর সূক্ষ্মভাবে অন্তরে গিয়ে বিঁধল ইফরানের। নিষ্ঠুর বাক্যবাণে ইফরানের অক্ষমতা তুলে ধরেছে বিনি। এটাই বোঝাতে চাইছে তাঁকে নিয়ে চিন্তা করার মত যোগ্যতা ইফরানের নেই।’

ইফরান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কোনপ্রকার তর্কে গেলো না বিনির সঙ্গে। মৌনমুখে বললো,
—‘তোমার মত ব্যবিসায়িক বুদ্ধি আমার নেই। আমি মানছি। কিন্তু এইটুকু বোঝার মতন বুদ্ধি আমার হয়েছে তুমি জেলে গেলে আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে। মা কষ্ট পাবে।’
তারপর না থেমেই বললো,’সবসময় তো শুধু ব্যবসার কথা ভাবলে চলে না বাড়ির সম্মানের কথাও ভাবতে হবে।’

বিনি অবাক হয়ে গেলো ইফরানের জবাব শুনে। এত গভীরভাবে কবে থেকে ভাবতে শিখে গেছে ইফরান? এই বুঝি দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে সে?
হাসি ফুটে উঠলো তাঁর ক্লান্ত চোখজোড়ায়। অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করলো বুকের ভেতর। অনেকটা ইফরানের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার মতন করেই বললো,
—‘তাহলে কি করতে চাও এখন?’
ইফরান তখনো মাথা নিচু করে বসে ছিলো। শান্তস্বরে বললো,
—‘যা করার তা তো তুমি করেই দিয়েছো। মামলা কোর্টে উঠবে। আপাতত তোমার বেইল করাতে চাই।’

বিনি হাসলো। এবার আর জেলে যেতেও আপত্তি নেই তাঁর। ইফরান দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। লোহারে গ্রিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো,
—‘যা করার সাবধানে করো। তোফায়েল সিনহা বড় ধুরন্ধর। সে তোমাকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।’


বিনিকে জামিনে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে ইফরান। তারপর থেকে তাঁর দেখা পাওয়া দুষ্কর। মামলা নিয়ে দিনরাত ছুটোছুটি করছে। বিনির সঙ্গে নিরিবিলিতে দুদন্ড কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না।

মামলার হিয়ারিং শীঘ্রই শুরু হবে। সন্ধ্যার দিকে পড়ার টেবিলে বসে অফিসের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি করছিলো ইফরান। বিনি কফি বানিয়ে ন তাঁর পাশে এনে রাখলো। হোলদোল হলো না ইফরানের। মনোযোগের সহিজ কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত। বিনি সেটা লক্ষ্য করে তাঁর পিঠের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সামান্য ঝুঁকে কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
—‘কি নিয়ে এত পেরেশানিতে আছো? মামলার রায় নিয়ে? ‘

তাকে এত কাছে পেয়ে ফাইল থেকে মনোযোগ হটে গেলো ইফরানের। সচেতন অবস্থায় বিনি কখনোই তার এত কাছে আসে নি। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা ব্যাঙের মতন লাফিয়ে উঠলো! মেরুদণ্ড শীতল হয়ে এলো।মাতাল, মোহনীয় এক সুবাস এসে লাগলো নাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে এলোমেলোভাবে কফিতে চুমুক দিলো। বললো,
—‘না। এমনিই কাগজপত্র দেখছিলাম।’
—‘এমনি?’
ফাইল দেখার নাম করে আরেকটু ঝুঁকে দাঁড়ালো বিনি। একেবারে ইফরানের বুকের কাছাকাছি। ইফরান বিষম খেলো। কাশতে কাশতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বিনি চট করে তাঁর বুকে মালিশ করে দেওয়ার ভান করে বুকে হাত রেখে বললো,
—‘কি হয়েছে? হঠাৎ কাশি উঠলো কেন? পানি খাবে?’

সে বুকে হাত রাখতেই ইফরান চোখ বড়বড় করে ফেললো। দুজনের মধ্যকার এতদিনের আড়ষ্টতা এখনো ঠিকভাবে কাটে নি। এরই মাঝে বিনির এমন অদ্ভুত আচরণ ঠিক হজম করে উঠতে পারছে না সে। বিনিকে এত কাছে পেয়ে মন মস্তিষ্ক তালগোলে লাগছে। বিনি মুখ টিপে হাসি গোপন করলো। ইফরান বিনির হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ইতস্তত করে বললো,
—‘ইয়ে মানে। আমি একটু বাইরে যাবো বিনি…’

বলেই বিনির হাত ছাড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো সে। বিনিকে কোনরূপ প্রতিবাদ করার সময় পর্যন্ত দিলো না। তার অবস্থা দেখে সমগ্র ঘর জুড়ে হাসির লহর বইয়ে দিলো বিনি। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো তাঁর। অনেকদিন বাদে ইফরানকে নাজেহাল করতে পেরে বেশ আনন্দ লাগছে। ভাবতেই অবাক লাগছে এই ভীতুরামের ভয়ে নাকি এতদিন সবাই কম্পমান ছিলো।

এদিকে ইফরান ভাবছে অন্য কথা। তাঁর ধারণা ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে জব্দ করার জন্য এমন নাটক করছে বিনি। যেই ইফরান কাছে যাবে তখনি সুযোগ বুঝে চরিত্র নিয়ে একগাদা কথা শুনিয়ে দেবে ইফরানকে। বিনিকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না! ভয়ে আর উপরে গেলো না। টিভি দেখার ভান করে নিচের ঘরে বসে রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here