#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১২,১৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১২
একই সাথে রোদ এবং শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। আকাশ বৈরী। দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। ইফরান তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো। আজকে অনেকদিন বাদে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেরোচ্ছে।
ইদানীং আড্ডা দিতে গেলে বন্ধুরা ইফরানকে নিয়ে ভীষণ বেশ হাসাহাসি করে। ইফরান নাকি দিনদিন ভেজা বেড়াল হয়ে যাচ্ছে বিনির ভয়ে। কদিন বাদে নাকি বউয়ের আঁচল চেপে ম্যাঁও!ম্যাঁও করবে। এসব শুনলে রাগে গা জ্বলে উঠে ইফরানের। সেই সঙ্গে বিনির ওপর রাগও হয়। স্বৈরিণী মেয়েটা দিনদিন ভয়ংকর হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় ইফরানকে খোঁচা দেয়। চাপার জোরে কিছুতেই তাঁর সঙ্গে পেরে উঠে না ইফরান।
ভেবেছিলো তাঁর আশিকের হাতে তুলে দিতে পারলে মুক্তি পাবে। কিন্তু সেগুড়ে বালি। বিনি তাঁর সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে।
গতকাল রাতে ইফরান তাঁর প্রেমিকের প্রসঙ্গ তুলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলো বিনি! ইফরানকে যা নয় তা শুনিয়ে দিয়েছে। রণচণ্ডী মুখ করে বলেছে,ইফরানের নিজের চরিত্রে দোষ আছে বলেই সে বিনিকে এমন কথা ভাবতে পেরেছে নইলে নিজের বউকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার মত জঘন্য কথা সে কিছুতেই বলতে পারতো না। ইফরান কাণ্ডজ্ঞানহীন
অসভ্য, বর্বর। এরকম হাজারো ধরণের ভর্ৎসনা আর বিদ্রুপে ইফরানের কান ঝালাপালা করে দিয়েছে।
ইফরান বাড়াবাড়ি করে নি। চুপচাপ বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ফিরেছে একেবারে মধ্যরাতে। বিনি ঘুমিয়ে পড়ার পর।
★
রাতে ঘুম কম হওয়ায় দেরীতে উঠেছে ইফরান। সকালে নাশতা শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু গেটের কাছাকাছি এসে মনে পড়লো গাড়ির চাবি আনে নি। গটগট পা ফেলে পুনরায় বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। তাড়াহুড়ো করে চাবি নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বারান্দার দিকে একঝলক নজর পড়লো। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
দরজার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে বারান্দায় বসে চুলে তেল দিচ্ছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমণী।
তাঁর তেল দেওয়ার ধরণটা বেশ আকর্ষণীয়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, কোন স্নেহময়ী মাতা পরম যত্নে, স্বীয় হস্তে সন্তানদের পানি পান করাচ্ছে। পরম যত্নে একটু একটু করে তেল মালিশ করছে।
ঘনকালো কেশরাশি একপাশে সরিয়ে রাখায় রমণীটির পৃষ্ঠদেশ সম্পূর্ণ অনাবৃত। এর আগে কখনো তাঁকে এমন অসংবৃত অবস্থায় দেখে নি ইফরান। শীতল বাতাসে শাড়ির আঁচল হাওয়ায় লুটোপুটি খাচ্ছে। মোহনীয় দেহাবয়ব ইফরানের নজর থমকে দিয়েছে। হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো। আবছা আলোতে নজর আটকে গেলো।
দ্রুত পায়ে রমণীটির কাছে এগিয়ে গেলো সে। মাটি থেকে শাঁড়ির আঁচল উঠিয়ে তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,
—‘মনে হচ্ছে আঁচল দিয়ে নিশান বানানো হয়েছে। রাস্তা থেকে লোকে দেখে বুঝবে এই বাড়িতে যুবতী মেয়েমানুষ আছে।’
আচমকা ইফরানের কন্ঠস্বর শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো বিনি। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—‘তুমি এখনো যাও নি?’
ইফরান থমথমে মুখ করে বারান্দার রেলিং চেপে দাঁড়ালো। এদিকে ওদিক তাকিয়ে বললো,
—‘নিশান দেখে ফিরে এসেছি।’
বিনি লজ্জা পেলো। ইফরানের সামনে এমন অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়বে ভাবতে পারে নি।
ইফরান তাঁর লাজুক মুখের দিকে লক্ষ্য করে খানিকটা শাসনের সুরে বললো,
—‘বসার কি আর জায়গা ছিলো না? চাকরবাকরেরা সারাক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাটি করে। তাঁরা এই অবস্থায় দেখলে মানসম্মান কিছু থাকবে?’
—‘তাঁরা তো কেউ নেই!’
—‘নেই মানে?’
—‘সবাই ছুটিতে গেছে। হালিম চাচার ছেলের বিয়ে। ওখানে দাওয়াতে গেছে।’
ইফরান শুধু সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো,’ও!’
তারপর আর দাঁড়ালো না। খোলাচুলে বিনিকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে। এই প্রথম বিনিকে এমন অসংবৃত অবস্থায় দেখছে সে। নইলে বিনি এসব ব্যাপারে খুবই সচেতন। রাতে ঘুমানোর সময়ও পরিপাটি হয়ে থাকে।
ইফরান বেরিয়ে গেলে বিনি লজ্জায়, অস্বস্তিতে থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। হাতখোঁপা করে লম্বা চুলগুলো বেধে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—‘দেখলাম বেরিয়ে গেলো। আবার কখন ফিরে এলো? মানুষ না ভূতপ্রেত!’
★
রাহেলা মির্জা এখনো ফেরেন নি। বিয়ের দাওয়াতে তিনিও গেছে । হালিম মিয়া বারবার করে বলে গেছে। গরিব মানুষ। না গেলে মনে দুঃখ পাবে। তাই রাহেলা মির্জা উপহার নিয়ে বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে গেছেন।
সারাদিন বাড়িতে মানুষ বলতে শুধু মিনু আর বিনি ছিলো। বিকেলে ইফরান ফিরেছে। সঙ্গে বন্ধুবান্ধব নিয়ে।
ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বাবার বৈঠকখানায় বন্ধুদের সঙ্গে সুরা পান করছে সে। তাসের আড্ডা সেই সাথে মিউজিক প্লেয়ারে হিন্দি গান। একেবারে জমজমাট রঙ্গতামাশা চলছে।
উপরতলা থেকে বিনি দুবার খবর পাঠিয়েছে। যাওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। তাস খেলার সময় অনর্থক জ্বালাতন তাঁর পছন্দ নয়।
বাধ্য হয়ে বিনি নিচে নেমে এলো। পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগলো। ভেতরে দেশি বিদেশী শরাবের বোতল। ঢালছে আর গিলছে অসভ্য বর্বর গুলো। গলা চড়িয়ে ডাক দিলো সে,
—‘একবার এদিকে এসো তো। কথা আছে তোমার সঙ্গে!’
মিউজিক প্লেয়ারের উচ্চশব্দে তাঁর গলার আওয়াজ ইফরানের কর্ণকুহর অব্দি পোঁছালো না। অগত্যা ভেতরে ঢুকে পড়লো বিনি। তাঁকে দেখে ইফরানের বন্ধুরা সকলেই হতবম্ভ! মোহপূর্ণ, বিস্ফোরিত নেত্রে অপলক চেয়ে রইলো সবাই।
হলুদ বালুচরি গায়ে জড়ানো সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমার ন্যায় দেহাবয়ব, পূর্নিমার চন্দ্রের ন্যায় শ্বেতশুভ্র মুখমন্ডল, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় খ্যাপা নেত্রযুগল সবমিলিয়ে ইন্দ্রপুরীর ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে আছে যেন!
বুকের রক্ত নিমিষেই ছলকে উঠলো! ইফরান বন্ধুদের চাহনি অনুসরণ করে সম্মুখপানে চাইলো। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বিরক্তস্বরে বললো,
—‘কি চাই?’
—‘একবার উপরে যেতে হবে।’
—‘এখন পারবো না।’
—‘এক্ষুনি যেতে হবে। আমার তাড়া আছে।’
—‘বললাম তো পারবো না। কেন বিরক্ত করছো?’
—‘বেশ তবে আমি এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি!’
ইফরান আড়চোখে একবার বন্ধুদের দিকে চেয়ে চোখ রাঙালো। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। বিনি নড়লো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াতে হলো ইফরান। বিনির পেছন পেছন এগোতে শুরু করলো।
বন্ধুদের লালসাপূর্ণ দৃষ্টি এতক্ষণ বিনির দেহের বাঁক পরিমাপে ব্যস্ত ছিলো ! ইফরানকে উঠতে দেখে অশ্লীল হাসি ফুটে উঠলো মুখে। ফিসফিস করে বললো,’দোস্ত! মালটা কিন্তু সেই!’
ইফরান ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। স্বীয় সহধর্মিণী সম্পর্কে বন্ধুদের এহেন অরুচিকর মন্তব্য তাকে কতখানি আঘাত করলো সেটা বুঝে উঠার আগেই বিনি প্রতিউত্তর করে বসলো। বক্তাকে উদ্দেশ্য করে স্মিত হেসে বললো,
—‘তাই নাকি? শুধু দেখেই বুঝে গেলে? ঘরে নিশ্চয়ই এমন মাল আছে?’
প্রতিউত্তরে বন্ধুটির জবাব না পেয়ে এবারে ইফরানকে আক্রমণ করলো। জলন্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থেকে হীমশীতল গলায় বললো,’কি তোমার বন্ধুর ঘরে আছে এমন দুচারখানা মাল? নাকি শুধু বন্ধুর মাল দেখেই হাপিত্যেস করে? থাকার তো কথা। তাঁর না হলেও তাঁর বাপের নিশ্চয়ই আছে?’
বিনির কন্ঠে রাগ, তিরস্কার, নিষ্ঠুরতার সংমিশ্রণ। মাথা হেঁট হয়ে গেলো সবার। লজ্জায় মস্তক অবনত হয়ে এলো। ইফরান জবাব দেওয়ার পরিবর্তে বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে মুখটিপে হাসলো। সবকটার চেহারা দেখার মতন। মেনি বিড়ালের মতন চুপ্সে যাওয়া মুখ! যদিও বিনিকে সে বিশেষ পছন্দ করে না তবে আজকে খুশি হলো। ইতোপূর্বে বন্ধুমহলে বিনির প্রসঙ্গে বহু বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে তাঁকে। আড়ালে ভেড়ার ডাক নকল করে পরিহাস করেছে বন্ধুরা! এবার বুঝবে এই মেয়ের চোপার জোর কেমন! কেন ইফরান এর সঙ্গে মুখ লাগায় না। সরস্বতী রূপে সাক্ষাৎ দেবী ভবতারিণী এই মেয়ে!
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১৩
হালিম মিয়া গেটে বসে পাহারা দিচ্ছে। ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে সাতদিনের ছুটি কাটিয়ে গতকালই কাজে যোগদান করেছে। তাই আজকে সকাল থেকে বেশ খাটুনি হচ্ছে। সকালে রাহেলা মির্জার সঙ্গে ব্যাংকে গিয়েছিলো সেখান থেকে ফিরে রতনের সঙ্গে বাজার গিয়েছে তারপর বাগান পরিষ্কার করেছে। এখন আবার দারোয়ানের ডিউটি করছে।
এই বাড়িতে হালিম মিয়া সহ মোট দুজন দারোয়ান। পালা ডিউটি পালন করে তাঁরা। হালিম মিয়া একসপ্তাহ ছুটিতে থাকায় অপরজনকে টানা কাজ করতে হয়েছে। এবার হালিম মিয়া চলে এসেছে তাই আগামী দুই দিনের জন্য তাঁর মুক্তি।
গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে টুলের ওপর বসলো হালিম মিয়া। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তবুও ঘামছে সে।
লতিফ গালে হাত দিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ালো। আজও ইফরানের হাতে চড় খেয়েছে সে। পাঁচ আঙুলের দাগ একেবারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কান গরম হয়ে উত্তাপ বেরোচ্ছে।
বৃষ্টির মধ্যে সুইমিংপুলে দাপাদাপি করছিলো ইফরান। রাহেলা মির্জা ঘরের জানালা দিয়ে সেটা দেখতে পেয়ে লতিফকে পাঠিয়েছিলেন ডেকে আনতে। বিনি তখন দুপুরের রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলো বিধায় তাঁকে জানায় নি।
কিন্তু লতিফ গিয়ে ডাক দিতেই ঠাস করে তাঁর গালে চড় বসিয়ে দিয়েছে ইফরান।
চড় খেয়ে লতিফ ছিঁটকে দুহাত পেছনে গিয়ে পড়েছে। অসহায়ের মত মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও যখন ইফরানের কাছ থেকে সহানুভূতি পেলো না তখন মুখ কালো করে পুনরায় ফিরে এলো।
ফেরার পথে অবশ্য ইফরানকে মনে মনে হারামজাদা, জালিম, জুলুমবাজ ইত্যাদি যাবতীয় গালি দিয়ে মনের অপ্রতিরোধ্য উত্তাপ দমন করেছে।
রাগের পর্ব শেষ হতেই হালিম মিয়ার কাছে এসেছে সহানুভূতি আদায়ের জন্য। হালিম তাঁর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে ‘চুকচুক’ জাতীয় শব্দ করে উঠলেন। কন্ঠে আফসোস প্রকাশ করে বললেন,
—‘মারছে?’
লতিফ মৌন মুখে উপরের নিচে মাথা দোলালো। বাম হাতটা আবার গালের ওপর নিয়ে গেলো সে।
—‘মারছে কেন?’
—‘হ্যারে ডাকতে গেছিলাম। বিষ্টিতে ভিজলে শরিল খারাপ হইবে। এইজন্য বড়মা তারে ডাইকা আনতে পাঠাইছিলো। আমার গিয়া সে কথা বলতেই সে আমার গালে চড় বসায় দিলো। এবার আপনি বলেন হালিম ভাই? আমি কি দোষ করেছি?’
লতিফের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। হালিম মিয়া সত্যি সত্যি দুঃখিত বোধ করলেন। বিনাদোষে এই পর্যন্ত ইফরানের হাতে অনেক মার খেয়েছে বেচারা। তবুও কেন যে ঘুরেফিরে তাঁর কাছে যায় আল্লাহ মালুম। আর রাহেলা মির্জাকেও বলিহারি! ছেলের স্বভাব জানার পরেও চাকরবাকরদের তাঁর কাছে মার খেতে পাঠায়। কেন নিজে গিয়ে ডেকে আনলে কি হতো?
★
বিনির রান্না শেষ। এক এক করে তরকারির পাতিলগুলো সব গুছিয়ে শেলফে রাখছিলো সে। লতিফ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। কাচুমাচু মুখ করে ডাক দিলো,
—‘মা!’
বিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো। শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—‘কিছু বলবে লতিফ মিয়া?’
প্রতিউত্তরে লতিফ মাথা নিচু করে ফেললো। চোখেমুখে অসহায় ভাব। তাঁর ধারণা এভাবে দাঁড়য়ে থাকলে বিনি আপনাআপনি বুঝে যাবে। মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না।
গালে হাত দেওয়া লতিফের করুণ চাহনি দেখে বিনি সত্যিই বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—‘কোথায় এখন সে?’
—‘ঘরে গিয়েছে!’
নিঃস্পৃহ কন্ঠস্বর লতিফের। চোখে পানি টলমল। এর আগে অনেকবার ইফরানের হাতে মার খেয়েছে সে কিন্তু কখনো অভিযোগ নিয়ে আসে নি। ইফরান বদ অভ্যাস ভেবে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। বিনির আসার পর থেকে ইফরানের স্বভাব পরিবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে ভৃত্যরা সবাই।
বলা বাহুল্য, এই বাড়িতে ভৃত্যরা সবাই বিনির কাছে একটু বেশিই প্রশ্রয় পায়। যাবতীয় অভিযোগ, অনুযোগ তাঁর কাছেই পেশ হয়। বিনিও সাধ্যমত তাঁদের সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করে। কাউকে অবহেলা করে না।
লতিফ মিয়াও সেই উদ্দেশ্য এসেছিলো। কিন্তু বিনির দুঃখিত চেহারা দেখে মুখ কালো করে বললো,
—‘আমি যাই মা।’
বিনি লতিফ মিয়ার মলিন মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এই অসহায় লোকগুলোর বদদোয়া আর কত নেবে ইফরান! একটুও কি নিজের কথা ভাববে না সে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—‘দাঁড়াও।
অতঃপর শাড়ির আঁচল থেকে একহাজার টাকার চকচকে দুখানা নোট বের করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—‘তোমার ছোটহুজুরকে বদদোয়া দিও না লতিফ মিয়া। সে আমার স্বামী। তাঁর কষ্ট হলে আমি সইতে পারবো না।’
বিনির কন্ঠে একরাশ বিষন্নতা! চোখের ভাষা ক্লান্তিজড়ানো। লতিফ মিয়া মুগ্ধ, বিমোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সামনের দন্ডায়মান অপূর্ব সুন্দরী নারী মূর্তিটির দিকে।
বয়সে তাঁর ছোট হবে রমণীটি। কিন্তু মনের দিক থেকে সমুদ্রের চাইতেও বিশাল। এমন দয়ালু, নিরহংকারী, অসাধারণ মাতৃরূপী স্নেহপরায়ণ গৃহকর্ত্রীর ক্ষতি কোনদিন চাইতে পারে না লতিফ মিয়া। টাকাটা জোরহস্তে ফিরিয়ে দিতে চাইলো সে। কিন্তু বিনি নিলো না। মুচকি হেসে বললো,
—‘এটা তোমাকে এমনিই দিয়েছি। বখশিশ হিসেবে। রাখো।’
লতিফ স্নেহার্দ্র, অশ্রুসজল ভেজা কন্ঠে বললো,
—‘আমার সকল ভালো আপনার হোক মা। ছোটহুজুর সবসময় ভালো থাকুক। আপনি চিরসুখী হন।’ এই বলে বেরিয়ে গেলো সে। বিনি অবসন্ন চোখে ফের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
★
রান্নাঘরের কাজ শেষ করে মাত্রই ঘরে এসেছে বিনি। ইফরানও গোসল সেরে বেরিয়েছে। পরণে কালো ঢিলাঢালা গেঞ্জি আর ছাই রঙা ট্রাউজার। মাথাভর্তি ঘনকালো চুল কপালে, ঘাড়ে লেপ্টে আছে। হাত দিয়ে একটুপর পর ভেজা চুল ঝাঁকাচ্ছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল পুরোপুরি শুকায় নি। পানি পড়ছে।
বিনি ওয়াশরুম ঢুকে তাঁর গেঞ্জি আর প্যান্ট ধুয়ে বেরিয়ে এলো। সেগুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে পুনরায় ওয়াশরুমে ঢোকার সময় একঝলক নজর গেলো ইফরানের দিকে।
ইফরান টাওয়েল হাতে নিয়ে ফোন স্ক্রল করছে। মাথা মোছার নামগন্ধও নেই।
একে তো ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজেছে তার ওপর এখন আবার ভেজা মাথা নিয়ে বসে আছে। বিনি মনে মনে বিরক্ত হলো।
শাড়ির আঁচলে হাতমুছে এগিয়ে গেলো ইফরানের কাছে। টাওয়েলটা নিয়ে খানিকটা রাগত মুখে তাঁর মাথা মুছে দিতে শুরু করে দিলো।
ইফরানের প্রথমে অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো বিনির দিকে। একই সঙ্গে রাগ এবং অধিকারবোধ দেখানো কেবল বিনির পক্ষেই সম্ভব। ভীষণ অদ্ভুত এই মেয়ে!
বিনি এদিক ওদিক টাওয়েল ঝাঁকিয়ে তাঁর চুল শুকানোর চেষ্টা করছে। ইফরান হাতের হেয়ার ড্রায়ারটা আস্তে করে একপাশে সরিয়ে রাখলো। যেন বিনির নজরে না পড়ে। তারপর বাধ্য ছেলের মত বিনির মাথা মোছা পর্যবেক্ষণ করে গেলো। আপাত দৃষ্টতে রাগী এবং গম্ভীর প্রকৃতির এই নারীটির মাঝে যে অন্যরকম এক স্নেহময়ী সত্তা বিরাজমান তাঁর আভাস সে একটু একটু করে পাচ্ছে।
বিনির গায়ের মিষ্টি একটা সুবাস নাকে এসে লাগছে ইফরানের। সম্ভবত চুলে শ্যাম্পু লাগিয়ে বেরিয়েছে সে। গোসলের সময় চুল ভেজাবে হয়ত। গন্ধটা নেশার মত টানছে ইফরানকে। চোখ বন্ধ করে মৃদু শ্বাস নিলো সে।
এদিকে মাথা মুছতে গিয়ে বারবার হাত উচুঁ করতে হচ্ছে বিনিকে। যার ফলে শাড়ি ভাঁজ হয়ে পেটের একাংশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই আপমনে হেসে ফেললো ইফরান। এমনিতে বিনি সারাক্ষণ সতর্ক। ভুলেও কখনো গায়ের কাপড় এলোমেলো হয় না। এমনকি ঘুমানোর সময়ও না।
অথচ এখন ইফরানের সামনে একেবারে উন্মুক্ত। তাঁর পেটের লালচে দাগটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইফরান।
আলগোছে শাড়ি টেনে ঢেকে দিলো ইফরান। বিনি টের পেলো না। তাঁকে হাসতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
—‘কি হয়েছে? হাসছো কেন?’
ইফরান দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—‘কিছু না। সৃষ্টি প্রকৃতি দেখছিলাম।’
বিনি তাঁর কথার মানে বুঝতে পারলো না। কিংবা খেয়াল করে নি। বললো,
—‘টেবিলে খাবার দিয়েছি। খাবে এসো।’
ইফরান উঠে দাঁড়ালো। গায়ের গেঞ্জিটা টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—‘কি রান্না হয়েছে?’
—‘সজনে ডাঁটা, করলা ভাজি, পটল, শুঁটকিমাছ আর ঢেঁকিশাক।’
ইফরান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। এজন্যই বাড়িতে খেতে চায় না সে। যতসব অখাদ্য কুখাদ্য গেলানো হয়। সজনে ডাঁটা, করলা ভাজি এগুলো কোন খাওয়ার জিনিস!
★
কিন্তু ডাইনিংরুমে গিয়ে বেশ চমকিত হতে হলো ইফরানকে। গরুমাংস ভুনা, হাঁসের মাংস, ইলিশ মাছ ভাজি, লাউচিংড়ি, রুই মাছের কালিয়া, বেগুন ভর্তা দিয়ে টেবিল সাজানো।
রাহেলা মির্জা টেবিলে এসে বসেছেন। যত কাজই থাকুক না কেন ছেলের খাবারের সময়টাতে তিনি ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত থাকেন। আজকে তাঁর শরীর ভালো ছিলো না। তবুও ক্লান্তদেহ নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন শুধুমাত্র ছেলেকে খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য। বিনি তাঁর পেছন পেছন এসেছিলো। তিনি জোর করে গোসলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইফরানকে খাবার বেড়ে দিয়ে তাঁর পাশে চুপচাপ বসে রইলেন।
ইফরান তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। রাহেলা মির্জা ছেলের প্রসন্ন মুখে পানে চেয়ে মনে মনে হাসলেন। তাঁর ছেলেটা জানেও না আজকে সারা সকাল কত যত্ন নিয়ে তাঁর জন্য এই খাবার তৈরী করেছে বিনি। সে ঝাল খেতে পারে না বিধায় তরকারীতে একচিমটি মরিচ পর্যন্ত ছোঁয়ায় নি। অথচ তারকারিতে ঝাল না হলে বিনি যে খেতে পারে না সেকথা একদিন কারোই অজানা নেই।
ছেলের পাতে মাছের টুকরো তুলে দিতে দিতে স্নেহের সহিত প্রশ্ন করলেন,
—‘রান্না কেমন হয়েছে?’
—‘ভালো হয়েছে মা। তোমার লক্ষ্মীমন্ত বউমার রান্নার হাত ভালোই বলতে হয়।’
রাহেলা মির্জা একই সঙ্গে অবাক এবং আনন্দিত হলেন। আনন্দিত হয়েছেন এই কারণে যে ইফরান বিনির রান্নার প্রশংসা করেছে। কিন্তু সে বুঝলো কি করে এই রান্না বিনি করেছে এটা ভেবেই তিনি অবাক হলেন। ইফরানও তো রান্নাঘরের ধারেকাছেও পা রাখে না। তবে বুঝলো কি করে?