মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১৮,১৯

0
396

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১৮,১৯
অরিত্রিকা আহানা

বেলা বারোটার দিকে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ধীর পায়ে অফিসে ঢুকলো বিনি। তাঁর শরীরের সব শক্তি যেন ক্ষয় হয়ে গেছে। পা দুটো টলছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে দেহ।
সারাজীবন ধরে নিজের চারপাশে যেই আত্মসম্মান আর অপরাজেয়তার বলয় সে তৈরী করেছিলো সেটা আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ইফরান ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে!

এলোমেলো পায়ে হেঁটে রুমের দরজা খুললো। ক্লান্ত দেহটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোঁটা নোনা জল। বুকের ভেতর খাঁখাঁ করছে। অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। হতাশা আর নিরব হাহাকার চারদিক অন্ধকার করে দিচ্ছে। আজকের এই অপমান বিনি কোনদিন ভুলতে পারবে না। এত লজ্জা! এত গ্লানি!
ইফরান তাঁকে শেষ করে দিয়েছে!

বিনি চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো এমন সময় দরজায় নক! ব্যক্তিগত সহকারী তৌহিদা এসে জানালো সাড়ে বারোটায় মিটিং আছে। বায়াররা মিটিংরুমে অপেক্ষা করছে বিনির জন্য। বিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখেমুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তৌহিদাকে উদ্দেশ্য করে ক্লান্ত গলায় বললো,
—‘উনাদেরকে বসতে বলুন আমি আসছি।’

ইতোপূর্বে রাহেলা মির্জার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলো তৌহিদা। সেই সুবাদে মাঝেমধ্যে কিছু ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাও তাঁর সঙ্গে শেয়ার করতেন রাহেলা মির্জা। বিনির সম্পর্কেও অনেক কথা হয়েছে। পুত্রবধু হিসেবে অসাধারণ এই মেয়েটির অনেক প্রশংসা শুনেছে তৌহিদা। রাহেলা মির্জা পুত্রবধুর প্রশংসা করার সময় বারবার বিমোহিত হয়ে পড়তেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুত্রবধুর খেতাবটা তিনি নির্দ্বিধায় বিনিকে দিতেন।

বিনির প্রশংসা শুনে তৌহিদা মুখটিপে হাসতো। মাঝেমাঝে বাড়াবাড়ি মনে হতো তাঁর। সামান্য ঘরই তো সামলায়। এই নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে!অবশ্য রাহেলা মির্জার সামনে কখনো মুখ ফুটে বলার সাহস হয় নি। পাছে তিনি রেগে যান এই ভয়টাই বলা থেকে বিরত রেখেছে!

তবে অফিসে আসার পর বিনির কর্মদক্ষতা এবং বিচক্ষণতা দেখে তৌহিদার ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেছে। বিনিকে সে যতটা হালকাভাবে নিয়েছিলো বিনি তাঁর চাইতে অনেক অনেক বেশি প্রশংসার দাবিদার।
সে যেভাবে ব্যবিসায়িক ঝক্কিঝামেলা সামালাচ্ছে তাতে করে যে কেউ নিঃসন্দেহে বলতে পারবে যে কম্পানীর দায়িত্ব যোগ্য হাতেই পড়েছে।

বর্তমানে বিনির পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত আছে তৌহিদা। এতগুলো দিন যাবত বিনিকে কখনো অন্যমনস্ক, আত্মবিস্মৃত দেখে নি সে। আজকে বিনি অন্যরকম লাগছে। কি যেন একটা ভাবছে সে। চোখ মুখ ফোলা। রোগা, অসুস্থ দেখাচ্ছে।
তৌহিদা দ্বিধান্বিত চেহারা নিয়ে বিনয়ী, আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করলো,
—‘কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি ম্যাম?’

বিনি ভ্রজোড়া কুঞ্চিত হলো। ধ্যান ভাঙলো তাঁর। তৌহিদার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো। সাড়ে বারোটায় মিটিং! তৌহিদা কথা বলে সময় কেন নষ্ট করছে?

তাঁকে বিরক্ত হতে দেখে তৌহিদা ইতস্তত করে বললো,
—‘না মানে। আপনাকে আজকে অন্যরকম লাগছে ম্যাম। ইট সিমস লাইক ইউ ক্রাইড। ইজ ইভ্রিথিং ওকে?’

বিনি মৃদু মোলায়েম হাসার চেষ্টা করলো। সামান্য মাথা নাড়িয়ে বললো,
—‘থ্যাংকস ফর ইউর কমসার্ন। আই অ্যাম ওকে।’

জবাব শুনে তৌহিদা সন্তুষ্ট হলো। হাসিমুখে বেরিয়ে গেলো। বিনি তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে টেবিলে মাথা এলিয়ে দিলো। রোজ এইভাবে নিজের সঙ্গে, আশেপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করে সে। ভালো থাকার ভান কর থাকে। নিজের ভেতরের ক্লান্তি, অবসাদ, একাকিত্ব কাউকে বুঝতে দেয় না।
দুহাতে চোখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। তারপর ধীরেসুস্থে মিটিং অ্যাটেন্ড করার জন্য বেরিয়ে পড়লো।


ইফরান রাগে ফুঁসছে। নিজেকে সে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছে না। বিনির সকালের কথাগুলো মনে পড়তেই মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। গোটা বাড়ি তছনছ করে ফেলতে মন চাইছে।

দুপুরে খাবারের জন্য ডাকতে আসায় খামোখা রতনকে মেরেছে সে। তবুও মেজাজ শান্ত হচ্ছে না। বিনি তাঁকে ধোঁকা দিয়েছে! সম্পত্তির জন্য ইফরানকে সে ধোঁকা দিয়েছে!
নাহ! এই সম্পত্তি কিছুতেই তাঁর হতে দেবে না ইফরান। যে করেই হোক উদ্ধার করবে। দরকার পড়লে জোর করে কেড়ে নেবে। তবুও বিনিকে ভোগ করতে দেবে না। একটা লোভী মেয়েটাকে সে কিছুতেই জিততে দেবে না।

রাত্রীবেলা আরেকদফা বিনির সঙ্গে তোলপাড় হলো তাঁর। বিনি তাতে বিন্দুমাত্রেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। না রাগলো, না প্রতিউত্তর করলো। চুপচাপ নিজের কাজে মনযোগ দিলো।

তাতে করে ইফরান আরো খেপে গেলো। বিনির উপেক্ষা সে ঠিক হজম করে উঠতে পারলো না। হ্যাঁচকা টানে বিনিকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
—‘কি ভেবেছো চুপ করে থাকলে পার পেয়ে যাবে? এত সহজে আমি সবকিছু ছেড়ে দেবো?’
বিনি শান্ত! অবিচল! হীমশীতল কন্ঠে বললো,
—‘কিচ্ছু করার ক্ষমতা তোমার নেই। তুমি শুধু বউয়ের সঙ্গে গায়ের জোর দেখাতেই পারো। এছাড়া আর কিচ্ছু পারো না। নাথিং! অ্যাবসলিউটলি নাথিং!’

বিনির চোখে ঘৃণা, অবজ্ঞা, বিদ্রুপ। ইফরান থমকে গেলো! এই চাহনি তাঁর সম্পুর্ণ অচেনা। মূহূর্তেই যেন এক অপ্রতিরোধ্য তাণ্ডব ঘটে গেলো হৃদয় জুড়ে। নিজের কাছে নিজেই পরাস্ত হলো সে।
ইফরান নিজেও জানে না সে কি চায়! সত্যিই কি সম্পত্তির প্রতি তাঁর কোন মোহ আছে? নাকি এতদিনের চিরপরিচিত,স্নেহময়ী বিনির শূন্যতা অনুভব করছে সে?
উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারার মত উত্তর খুঁজে বেড়ালো ইফরান।

বিনি সেই একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ইফরান আর সইতে না পেরে রাগে টেবিলের ওপর রাখা ফুলের টবটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো! নিজের উন্মাদ উত্তপ্ত হৃদয়ের জ্বালা বিনিকে আঘাতের মাধ্যমে মেটাতে চাইলো। হুংকার দিয়ে বললো,
—‘যেই সম্পত্তির জন্য তুমি আমাকে, আমার মাকে ঠকিয়েছো সেই সম্পত্তি আমি কিছুতেই তোমাকে ভোগ করতে দেবো না। আই প্রমিস ইউ দ্যাট!’

বিনি এবারেও নির্লিপ্ত। জবাব দিলো না। চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে বসার ঘরে চলে গেলো। সেখানে গিয়েই অফিসের বাকি কাজ সমাধান করলো। ইফরান রাগে হতাশায় দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে পড়লো।


দুদিন পরের কথা,
অফিসরুমে বসে আঙুল দিয়ে কপালের শিরা চেপে ধরে আছে বিনি। তীব্র যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কপালের শিরা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসার উপক্রম! দাঁত কামড়ে যন্ত্রণা চাপার চেষ্টা করলো।
একটু আগে মিটিং ছিলো। কিসের উপর দিয়ে মিটিং শেষ এসেছে সে নিজেও জানে না। আজকেও সকালেও ইফরানের সঙ্গে একচোট হয়েছে।
বিনি যদিও তেমন কিছু বলে নি, ইফরান চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে। চাকরবাকরদের যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই মেরেছে। বিনি সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারপর থেকেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা। কিছুতেই কমছে না।

দরজায় নকের আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসলো! সহকারী তৌহিদা। রুমের দরজা সামান্য ফাঁক করে বিনীত গলায় ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো।
বিনি কপাল থেকে হাত সরিয়ে ইশারায় ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিলো।
—‘আসুন।’
—‘মি.সিনহা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ম্যাম।’

ব্যবসায়িক মহলে বন্ধুত্বের চাইতে রেষারেষি চলে বেশি। প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে তাঁর আর গোপন শত্রুর অভাব হয় না। সেই সকল শত্রুরা কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই ছোঁবল মারতে দেরী হয় না। তেমন শত্রুর অভাব রাহেলা মির্জারও নেই।
অবশ্য তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন ধারেকাছে ঘেঁষারও সুযোগ দেন নি কাউকে। বলা চলে দাপটের সঙ্গেই অফিস পরিচালনা করেছেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তিনি অফিসে আসা বন্ধ করে দেওয়ার পর। বিনির জন্য অফিসের দিনগুলি আর সহজতর রইলো না।
সবাই যেন সুযোগ পেয়ে গেলো। চারদিক থেকে মুখোশধারী শয়তানেরা পেছনে লেগে গেলো।

তোফায়েল সিনহা তাদেরই একজন। নামটা শুনতে যদিও ভদ্র, মার্জিত মনে হয় স্বভাবের দিক থেকেই ঠিক ততটাই অভদ্র এই মিষ্টভাষী অসৎ ব্যবসায়িটি। বিগত কয়েক মাস যাবত রাহেলা মির্জার সঙ্গে ব্যবিসায়িক কোন্দল চলছে তাঁর। সেটা আরো দৃঢ়তর হয়েছে বিনি আসার পর।
বিনিকে ভুলভাল বুঝিয়ে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার একটা সরকারী ডিল হাতিয়ে নিতে চাইছে।

বিনি বিচক্ষণ! সে সবাইকেই কথা বলার সুযোগ দেয়। সবার পরামর্শই গ্রহণ করে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয় নিজের মর্জি মত। আর ঠিক সেইজন্যই তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং দূরদর্শিতাকে ইতোমধ্যে ভয় পেতে শুরু করেছে অনেকে।
গম্ভীরমুখে তৌহিদাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘উনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’


তোফায়েল সিনহা ভ্যাঁসভ্যাঁস করে পান চিবুচ্ছে আর বিনাকারণেই অভদ্রদের মত হাসছে। বিনি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও সংযত রইলো। সামান্য হেসে বিনয়ী গলায় বলল,
—‘কি খবর মি.সিনহা? আপনার শরীর ভালো?’

সিনহা সামনে রাখা অ্যাসট্রেতে শব্দ করে পানের পিক ফেললো। আলতো করে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,
—‘আছি আপনাদের দোয়ায় কোনরকম। খবর শুনেছেন নিশ্চয়ই?
—‘নাতো। কিসের খবর?’

তোফায়েল সিনহা নড়েচড়ে বসলো। বেশ উচ্ছ্বাসিত মনে হলো তাঁকে। বিনি ভ্রু কুঁচকালো। সরু চোখে চেয়ে রইলো। তোফায়েল সিনহা গর্বিত কন্ঠে বললো,
—‘আমার ছোটপুত্র তারেক। ব্যারিস্টারি পাশ করে গতকাল দেশে ফিরেছে। ব্যবিসায়িক সমতি থেকে আমার পার্টনাররা সবাই ওকে সংবর্ধনা জানিয়েছে। এবার কোর্টে ওকালতি করবে।’

বিনি স্মিত হাসলো। এই লোকটা ভীষণ চালাক। ধুরন্ধর। গোটা পরিবারে এই একটি মাত্র ছেলেকেই পড়াশোনা করিয়েছে। বাকি সবাই মূর্খ, বকলম। বলা চলে টাকা রোজগারের মেশিন। তবুও সুযোগ পেলেই বিনির সামনে ছোট ছেলের গুনগান করবে আর ইফরানকে নিয়ে বাজে কথা বলার প্র‍য়াস চালাবে। আপাত দৃষ্টিতে তাঁর এই উচ্ছ্বাস নেহায়েত পুত্রস্নেহ মনে হলেও আসল উদ্দেশ্য ইফরানকে ছোট করা। বিনিকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেওয়া। যেই কাজটা তিনি ইতোপূর্বে রাহেলা মির্জার সঙ্গেও করেছেন। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হলো না। গলায় একরাশ আফসোস ঢেলে বললেন,
—‘আমার ভাগ্য খারাপ! নইলে আর একটা বছর আগে কেন আপনার সঙ্গে দেখা হলো না। আপনার মত সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিতে পারতাম।’

বিনি বিব্রত হলেও মুখে স্বাভাবিক হাসি বজার রাখলো। কাজের প্রসঙ্গ টেনে বললো,
—‘সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের কম্পানীর আগামী মাস থেকে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু শুনলাম আপনি নাকি কাজ স্থগিত করার জন্য আবেদন করেছেন?’
—‘সেতো অনেক আগেই করেছি। কেন আপনি জানতেন না? অবশ্য না জানাটাই স্বাভাবিক। মহিলা মানুষ। ঘরে বাইরে কতদিক সামলাবেন? স্বামীটা তো কোনো কাজের না। এতদিন মাকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। এবার বউকে জ্বালাচ্ছে। সবদিক তো আপনাকেই সামলাতে হচ্ছে।’

বিনি চুপ করে রইলো। তোফায়েল সিনহা থামলেন না। অনবরত নিজের উস্কানিমূলক কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন,
—‘আপনার শ্বাশুড়ি বুঝি তাকে কিছু বলেন না? যত যাই হোক। পুরুষ মানুষ এমন অকর্মা হলে চলে? মহিলা দিয়ে আর কত? ব্যবসা বানিজ্য কি মেয়ে মানুষের কাজ? আপনার শ্বাশুড়ির নাহয় স্বামী ছিলেন না। তাই তিনি ব্যবসার কাজে নেমেছেন। কিন্তু তাঁর ছেলে তো বেঁচে আছে। সে কেন ঘরের বউকে বাইরে চরিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেই তো অফিসে বসতে পারে?’

বিনি ধীরস্থির! মুখের হাসি অক্ষুণ্ণ আছে। ভাবখানা এমন যেন রসিকতা করছে। বললো,
—‘সেইজন্যই বোধহয় আপনাদের ভাগ্যটা ভালো। সে অফিসে বসলে তো আর আপনাদের পায়ের তলার মাটি থাকবে না।’

তোফায়েল সিনহার মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। বিস্মিত চেহারা নিয়ে বললেন,
—‘মানে? কি বলতে চাইছেন কি আপনি?’

তোফায়েল সিনহা দ্বিধাগ্রস্ত। বিনির সুক্ষ্ম তিরস্কার,বিদ্রুপ ধরতে পারছেন আবার পারছেন না।চুপ করে বিনি মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বিনি পুর্বের হাসি বজায় রেখে বললো,
—‘আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি, সে রাহেলা মির্জার সন্তান! ব্যবসা তাঁর মগজে নয়, রক্তে মিশে আছে! বাকিটা আমি না বললেও আপনি বুঝবেন।এবার আপনি আসুন।’

এতকিছুর পরেও বিনি যার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে এতটা তৎপর সেই পাপী, বর্বর একটু যদি বিনিকে বুঝতো? তাহলে সে ঠিক বুঝতে পারতো কত যত্ন পেলে বিনির মতন রত্ন মেলে! যত্ন ছাড়া রত্ন মেলেও না, টেকেও না। অবশ্য সেটুকু বোঝার ক্ষমতা যদি তাঁর সত্যিই থাকতো তবে আর লেখিকার এত সংগ্রামের প্রয়োজন পড়তো না।
অথচ আফসোস! মূঢ়চিত্ত, নির্বোধ এই মানবমূর্তিটির বিনিকে বোঝার চাইতে নিজের সর্বনাশ করাতেই বেশি আগ্রহ। বিনিকে অপদস্থ করার নেশায় বারবার সে নিজেও যে বিপর্যস্ত হচ্ছে এই কথা যেন বুঝেও বুঝতে চায় না।

তোফায়েল সিনহা চুনকালি চেহারা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ইতোপূর্বে তিনি যে বিনিকে ঠিক কতটা ভুল চিনেছেন সেটা বোধহয় আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন রইলো না।

#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১৯

মাসখানেক পরের ঘটনা,
অফিসে পা রাখতেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে বিনির কানে খবর এলো ইফরান অফিসে এসেছে। বিনির জন্য অপেক্ষা করছে।

বিনির কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। অফিসে হঠাৎ ইফরানের উপস্থিতি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। ইফরান বাড়িতে বিনির সঙ্গে রোজ চিৎকার চেঁচামেচি করে, জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। বিনি প্রতিউত্তর করে না। পারতপক্ষে সে কথা বলে না ইফরানের সঙ্গে। নিজের মত করে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

কিন্তু ইফরানের অফিসে আসার কারণটা যদি বিনির সঙ্গে ঝামেলা করার অভিপ্রায় হয় তাহলে তো মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ঘরের কথা বাইরে বেরোলে মানসম্মান আর কিছু থাকবে না। বিনি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বড় বড় দম দিলো। তারপর ঠান্ডা মাথায় ইফরানের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো।

ভেতরে ঢুকে দেখলো ইফরান টেবিলের ওপর পা তুলে চুপচাপ ফোন স্ক্রল করছে।
সঙ্গে হালিম মিয়াও আছে। এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বিনি ইফরানের বিপরীতে চেয়ার টেনে বসলো। বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অফিসের ফাইলগুলো ঘাটাঘাটি করলো। ইফরান টেবিলের ওপর তুলে রাখা পাদুটো নাচাচ্ছে আর মৃদু শীষ দিচ্ছে। বিনি নিজেকে শান্ত করে নিয়ে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বললো,
—‘লেট’স টক?’

ইফরান ফোন একপাশে সরিয়ে বিনির দিকে চাইলো। তিরস্কারে ঠোঁট উল্টালো। তাঁর চোখেমুখে রহস্যজনক হাসি। টেবিল থেকে পা নামিয়ে গাছাড়া ভাবে বললো,
—‘নট আস। ইট’স জাস্ট মি। অনলি আই উইল টক। ইউর ওয়ার্ক ইজ টু লিসেন।’

বিনির ধৈর্য যে কতখানি প্রশংসার দাবিদার সেটা আজকে আবারো প্রমাণিত হলো। ইফরানের দাম্ভিক,অহংকারী আদেশপূর্ণ কথাবার্তার শোনার পরেও পূর্বের ন্যায় শান্ত রইলো সে। অবিচল, স্থির গলায় বললো,
—‘ঠিক আছে বলো, কি বলবে?’

ইফরান কুটিল হাসলো। টেবিলে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
—‘রাহেলা মির্জা তোমার নামে কোন সম্পত্তি লিখে দেন নি। তুমি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছ থেকে পাওয়ার অফ অ্যাটোর্নি আদায় করেছো। সেই সাথে সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে আমাদের কাছে তথ্য গোপন করেছো।’

এইটুকু বলে সকৌতুকে বিনির মুখের দিকে চাইলো ইফরান। যেন শিকার জালে আটকা পড়েছে। বিনি হতাশ হলেও তাঁর কথার মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটালো না। চুপচাপ শুনে গেলো। ইফরান তাঁর দিকে একটা সিগনেচার পেন এগিয়ে দিয়ে বললো,
—‘এবার ভালোয় ভালোয় পেপারে সাইন করে দাও, নইলে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। উপযুক্ত সাক্ষী আছে আমার কাছে।’

বিনির চোখে ভয় নেই। তাঁর মন জানে, মস্তিষ্ক জানে, অন্তরাত্মা জানে সে কোন অন্যায় করে নি। তবে কিসের ভয়? নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
—‘সাক্ষি? কে সে?’
—‘হালিম চাচা।’

এবার বিনি স্তম্ভিত! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বিস্মিত চেহারা নিয়ে হালিমের চেয়ে রইলো। হালিম মস্তক অবনত করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জা বিনির মুখের দিকে তাকাতে পারছে না।
ইফরানকে সে নিজের ছেলের মতন স্নেহ করে। তাঁর অনুরোধ ফেলতে পারে নি। বিনি বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে বললো,
—‘হালিম চাচা?’

হালিম যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিইয়ে গেলো। সজল হয়ে উঠলো অসহায় করুণ চোখজোড়া। এতবড় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সৃষ্টিকর্তা কোনদিন তাঁকে মাফ করবে কিনা সে জানে না। ইফরানের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তাঁর। এই অসাধারণ, অসম্ভব সুন্দর মেয়েটিকে কষ্ট দেওয়ার ফল একদিন সে পাবে!

বিনি মূর্তির মতন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইফরান অবজ্ঞাভরে হেসে উঠে বললো,
—‘কি হলো? এত চমকাচ্ছো কেন? বলেছিলাম না? এই সম্পত্তি তোমাকে আমি ভোগ করতে দেবো না? সবে তো শুরু। এবার যদি তোমাকে রাস্তায় এনে দাঁড় না করিয়েছি তবে আমার নামও ইফরান মির্জা নয়।’

বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ইফরানের কোন কালেই মাথাব্যথা ছিলো না। সে বরাবরই এসবের ব্যাপারে উদাসীন। নিজের হাত খরচের টাকাপয়সা ছাড়া অন্য কোনকিছুর প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো না।
তবে আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, বিনির অবহেলা, উপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে সে বাধ্য হয়েছে এসবের সঙ্গে জড়াতে। ভেতরে জেদ চেপে গেছে।
বিগত একমাস যাবত দলিলদস্তাবেজ নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছে। তারপর বুদ্ধি করে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনাটা বের করেছে। রাহেলা মির্জার মেডিকেল রিপোর্ট আর হালিমের সাক্ষ্যপ্রমাণ কোর্টে পেশ করতে পারলেই বিনির আর কিছু করার থাকবে না।

এতকিছুর পরেও বিনি শান্ত! মুখফুটে একটা কথাও বললো না। চুপচাপ পেপারে সাইন করে দিলো।

সাইন করার সময় ইফরান ফিসফিস করে বললো,’এখনো সময় আছে। একবার বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। সব ছেড়ে দেবো!’

আহা! বিনির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বুঝি এই নির্বোধ, বোকা ছেলেটা করেই ফেললো!
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন ‘দুরত্ব জানে শুধু কতটা নিকটে ছিলে।’
ইফরানের মনের অবস্থাও ঠিক তেমন। এখন সে বুঝতে পারছে বিনি তাঁর কতটা কাছের ছিলো, হৃদয়ের কতটা গহীনে বিনির অনুপ্রবেশ ছিলো। রোজ রোজ বিনির শূন্যতা সে আর নিতে পারছে না। বুকের খাঁচায় বন্দি যন্ত্রটা চিরপরিচিত, স্নেহময়ী বিনির আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে মরছে।

জবাবের অপেক্ষায় বিনির মুখে দিকে চেয়ে রইলো সে। বিনি নির্লিপ্ত! দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সাইনকরা পেপারগুলো ইফরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—‘ধরো।’

ইফরান হাত বাড়িয়ে নিতে পারলো না। সে পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো বিনির নিটোল মায়াবী মুখখানার দিকে। কি অপূর্ব অথচ কি কঠিন।
এই বিনি তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত!
ভেতরটা আঘাতপ্রাপ্ত হলো! এতদিনের স্নেহ, যত্ন,ভালোবাসা পেয়ে আসা চোখজোড়া হঠাৎ এই উপেক্ষা আর নিতে পারছে না। দাঁত নিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। একটানা, পলকহীনভাবে বিনির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। উদ্দেশ্য বিনির দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

বিনি ভ্রুক্ষেপ করলো না। টেবিলের ওপর পেপার গুলো রেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ইফরান এবারে পুরোপুরি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত!


মাগরিবের নামাজের আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ হয়েছে। রাহেলা মির্জা নামাজ আদায় করে সবে সালাম ফিরিয়েছেন এমন সময় বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত চেহারা নিয়ে ইফরান ভেতরে ঢুকলো।
খাটের ওপর বসে মায়ের মোনাজাত শেষ হওয়ায় পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। রাহেলা মির্জা মোনাজাত শেষ করে তাঁর দিকে ফিরলেন। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,
—‘কিছু বলবে?’
—‘বিনি এমন কেন করলো মা? আমাদের কেন ঠকালো?’

ইফরানের কন্ঠে বিষাদ! রাহেলা মির্জা মনে মনে বিরক্ত হলেন। তিনি নিজ ইচ্ছায় বিনিকে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন এই কথাটা বিনি মত তিনিও ইফরানের কাছে বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। কি লাভ বলে? ইফরান কোনদিন তাঁর কোনো কথা শুনেছে যে আজ শুনবে?
তাঁর দৃঢ় ধারণা রাহেলা মির্জা বিনির প্রতি স্নেহান্ধ। তাই বিনির কুটিলতা,চালাকি বুঝতে পারেন না।
গম্ভীর গলায় ছেলে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—‘কেন তুমি যা বলেছে তাই তো সত্যি হলো? তাহলে সমস্যা কোথায়? এতদিন যাবত তো এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলে?’

ইফরান অন্তর্যন্ত্রণায় কাহিল! বুকের ভেতর বেদনা হচ্ছে। সবার কাছে রাগী, বদমেজাজি খেতাবপ্রাপ্ত ছেলেটা হাটুমুড়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়লো। চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে অশ্রুসজল কন্ঠে বললো,
—‘আমি সত্যিটা জানতে চাই মা!’

সে যে বিনিকে ভালোবেসে ফেলেছে এই কথা বোধহয় রাহেলা মির্জাকে আর বলে দিতে হলো না। ছেলের বিষণ্ণ, অশ্রুভেজা মুখ দেখে তিনি সব বুঝে গেলেন। অকস্মাৎ রাগ পড়ে গেলো। পরম মমতায় ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—‘সত্যিটা তোমার অন্তর জানে! তুমি যা বিশ্বাস করো তাই সত্যি।’
—‘আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না মা।’
—‘পারছো। সেইজন্যই এতো উতলা হয়ে আছো।’
ইফরান যেন নিজেকেই শোনালো,
—‘বিনি কোন অন্যায় করে নি!
—‘না করে নি।’
—‘তুমি আমাকে এতদিন কেন বললে না মা?’
—‘তুমি কবে শুনেছো আমার কথা? বিনিকে তুমি বরাবরই ছোট করেছো।’

ইফরান ঘাড় উঁচু করে মায়ের মুখের দিকে চাইলো। রাহেলা মির্জার হাতদুটো নিয়ে বাচ্চা ছেলেটির মতন নিজের গালে চেপে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো,
—‘আমি এত খারাপ কবে থেকে হয়ে গেলাম মা? তোমাদের সবাইকে আমি শুধু কষ্ট দিয়ে গেছি।’

টলমল করা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। ইফরান মাথা নিচু করে অপরাধির মত মায়ের পায়ের কাছে বসে রইলো। রাহেলা মির্জা আঁচল দিয়ে ছেলের চোখের পানি মুছে দিলেন। সামান্য ঝুঁকে ছেলের কপালে চুমু খেলেন। এই ছেলেটা তাঁর প্রাণ। তাঁর কলিজার টুকরো। তাঁর সাত রাজার ধন। স্নেহের সহিত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—‘মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে বাবা। তুমি এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শুধরে ফেলো। নতুন করে আবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here