#সুখের_নেশায় পর্ব১২

0
792

#সুখের_নেশায় পর্ব ১২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা

ক্লান্ত দুপুর। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ নিয়ে মিম হেলেদুলে হেঁটে চলেছে। কলেজের জন্য নির্ধারিত সাদা ইউনিফর্ম টা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে দেহে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বড্ড অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। হাঁটছে আর কিছু সময় পর পর টিস্যু দিয়ে ব্যস্ত হাতে ঘাম মুছে চলেছে। কিছু দূর হতে একটা ভারি কন্ঠ শোনা গেল।
‘ এই মেয়ে!’
পা দুটো থেমে গেল মিমের। কিন্তু পিছনে তাকালো না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে রাস্তায় অনেক মানুষের চলাচল। এই মেয়ে বলে কে ডাকল বা কাকে সম্বোধন করল কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই না দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। নয়ত রোদে পুড়ে শুঁটকি হতে সময় নিবে না সমস্ত শরীর। পূর্বের ন্যায় আবারও কানে ভেসে আসে।
‘ এই মেয়ে!’
তবে এবারের ডাকটা আগের থেকে জোরে ছিল। কন্ঠে ছিল তেজ। মিম পিছনে ফিরে তাকালো। দেখল দিহান গাড়ির পাশে দাড়িয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে এই মেয়ে বলে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। দিহান যে তাকে এমন করে ডাকছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দিহান এগিয়ে আসছে না। অলসের মতো দাড়িয়ে চেয়ে আছে। বাধ্য হয়ে মিম হেঁটে এল কিছুটা কাছাকাছি। অবিশ্রান্ত নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে? এভাবে ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করছেন কেন?’
দিহান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ কি আমি ছাগলের মতো ডাকি?’
‘ অবশ্যই। ছাগলের ডাকও আপনার ডাক থেকে সুন্দর। ‘
‘ যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। দেখতে পিচ্চি অথচ বেয়াদবি তে সেরা।’
মনে চেপে রাখা রাগ তড়তড় করে বেড়ে উঠল মিমের। চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘আমি বেয়াদব?আর আপনি ভালো? আপনার মা ভালো তাই না?ভালো মানুষ যে অন্যদের আঘাত করে কথা বলে তা তো জানতাম না। আর আমি পিচ্চি অথবা এই মেয়ে না। আমার নাম মিম। কল মি মিম।’
মিমের কথার ধাঁচে যে তীব্র রাগ সেদিনের জন্য, তার মায়ের চৈত্রিকা কে অপমান করার জন্য তা অনায়সে ধরে ফেলল দিহান। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘ তো তোমার নাম মিম,ডিম। রাইট?’
‘ ডিম???হু ইজ ডিম?আপনাদের বাসায় ডিমের অভাব পড়েছে। রাস্তাঘাটে ডিম খুঁজতে বের হয়েছেন। তাই তো আমার নাম কে ডিমের সাথে গুলিয়ে ফেললেন। এটা শহর। গ্রাম নয় যে পুকুর পাড়ে অথবা ঝোপঝাড়ে হাঁস-মুরগি ডিম পাড়বে।’
মিমের রোষপূর্ণ কন্ঠের উপহাসে দিহান মনে মনে বললো,
‘ ধানিলংকা। আম্মুর এই মেয়েকেই পছন্দ করতে হলো?জীবন ছাড়খাড় করে দিবে একদম। ‘
মিম দিহানের কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তেতে উঠে বললো,
‘ কিসের জন্য ডেকেছেন?আবার এই রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে মাথা গরম করে দিচ্ছেন। অসহ্য তো আপনি!’
‘ অসহ্য কেই সহ্য করতে হবে তোমার।’
‘ কি?’
‘ কিছু না। গাড়িতে উঠো। বাসায় পৌঁছে দিব।’
‘ নো নিড। আমার দু’টো পা আছে। ‘
‘ দু’টো পা আছে তা আমিও দেখতে পাচ্ছি। আমারও দু’টো হাত আছে। যেতে না চাইলে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে উঠাবো নয়ত কোলে তুলে।’
দিহানের কথা কর্ণপাত হতেই মিমের চক্ষুজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। নাক ফুলিয়ে বললো,
‘ অসভ্য লোক।’
‘ আই নো। চলো এখন। নয়ত রোদে কালো হয়ে যাবো। পড়ে তো কালো বলে রিজেক্ট করে দিবা।’
দিহানের অকপটে সগতোক্তি তে মিমের রাগের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ। এই সুদর্শন ছেলেটা কে তার একটুও ভালো লাগে না। দেখলেই মস্তিষ্কে রাগ চাপে। দিহান কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাঁটতে শুরু করল। দিহান উঁচু আওয়াজে বলে উঠল,
‘ থামো বলছি। কিছু রাস্তা গিয়ে তো বেহুঁশ হয়ে যাবে। শরীরের যা অবস্থা। মনে হয় না খাবার খাও। পরে কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না। তাই ভালো ভালোই বলছি ফিরে এসে গাড়িতে বসো। সবে তো কলেজ থেকে বের হলে। আরো এক ঘন্টার রাস্তা তোমার বাসায় যেতে। নয়ত কোলে নেওয়ার জন্য আমি একদম প্রস্তুত।’
মিম পা দু’টো থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ ভালো হয়ে যান। এতে রাস্তা ঘাটে জুতা পে/টা খাও/য়ার হাত থেকে বেঁচে যাবেন।’
‘ কেউ জিজ্ঞেস করল বলব পিচ্চি টা আমার বউ হতে চায়। জোর করে আমার কোলে উঠেছে। তখন লোকে জুতা পে/টা নয়।বরং লাজুক লাজুক হাসি হাসবে।’
মিথ্যে মিথ্যে অপবাদ শুনে হতবুদ্ধি মিম। শরীর টা বড্ড ক্লান্তিতে ভরপুর। মাথা ব্যাথা করছে। গাড়ি করে যাওয়ার জন্য চৈত্রিকা ভাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা বাচিয়ে হেঁটে বাসায় যায় আজকাল মিম। সে চায় না আরাম আয়েশে বোনের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকা নষ্ট হোক। মন তো বলছে দিহানের কাছ থেকে লিফট নিয়ে নিতে। কিন্তু রাগ টা যে কমছে না। দিহান বড় বড় পা ফেলে কাছে এলো। গলার স্বর নরম করে বললো,
‘ চলো। তর্ক অন্যদিন করো। আজ তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। ‘

সত্যিই শরীর টা খারাপ লাগছে। কথা না বাড়িয়ে মিম গাড়িতে গিয়ে বসল। দিহান কে কেন যে ভালো মনে হলো এক মুহুর্তের জন্য। পরমুহূর্তেই ওর মায়ের কথা মনে বিষ ঢেলে দিল। মিমের কাছে দিহান অপছন্দের মানুষ কেবলই তার মায়ের চৈত্রিকা কে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে। ড্রাইভিং সিটে বসে দিহান একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয়। মিম এক পলক তাকিয়ে বিনা বাক্যে বোতল টা হাতে নিয়ে নিল। কয়েক ঢোক পান করে রেখে দিল গাড়িতে। কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন ছুড়ল দিহানের দিক।
‘ আপনি তো মনে হয় সামনে কোথাও যাচ্ছিলেন। আবার আমার জন্য উল্টো যাচ্ছেন কেন?’
‘ অফিসে যাচ্ছিলাম। কলেজ গেইটের দিকে নজর পড়তেই দেখলাম তুমি হেঁটে যাচ্ছো। কিছুটা সিক মনে হচ্ছিল। ভাবলাম বাসায় পৌঁছে দেই।’

মিম আর কোনো কথা বলল না। চুপ করে মাথা হেলিয়ে দিল সিটে। দৃষ্টি বাহিরের দিকে। ইট পাথর কোলাহলের ভিড় চারপাশে। সবুজ গাছপালার দুস্থিতি পড়েছে যেন। মাঝে মাঝে এক দু’টো দেখা যায়। মিমের ভালো লাগে না এই শহর৷ এই শহরের এতো কোলাহল।

চৈত্রিকা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিষন্ন মন নিয়ে। ভিতর জুড়ে প্রলয় হচ্ছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। বাবা-মার মুখের দিকে চেয়ে বুকে পাথর তো চেপেছে কিন্তু এখন কোনো রকমেই শান্তি পাচ্ছে না। শেষ কবে শান্তি অনুভব করেছিল মনে আছে চৈত্রিকার। ওই গভীর রাতে রিকশায় পাশাপাশি বসে সাফারাতের সাথে কাটানো সময়টা ছিল সুখের,শান্তির।
চৈত্রিকা বাড়িওয়ালার জন্য অপেক্ষা করেছিল এতক্ষণ গেইটের কাছে। তিনি রেগুলার একবার আসেন এ বাড়িতে। একটু আগেও এসেছিলেন। চৈত্রিকা ভেবেছিল আজ হয়ত ওদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু তার চিন্তা নিঃশেষ করে দিয়ে বাড়ির মালিক জানান-তার যখন মন চায় ভাড়া দিলে হবে। নিস্তব্ধ হয়ে যায় চৈত্রিকা এ কথা শুনে। যেই লোক গতকাল অব্দি থ্রে/ট দিয়েছে ভাড়া না পেলে ধা/ক্কা দিয়ে বের করে দিবে,সেই লোকই বলছে যখন ইচ্ছে দিলেই হবে। কথাটা ঠিক হজম করতে পারে নি চৈত্রিকা। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বাড়িওয়ালা তাড়া দেখিয়ে প্রস্থান করে। তখন থেকেই ঠাঁই দাড়িয়ে আছে সে। টিউশনির সময়ও হয়ে এসেছে। গেইটের সামনে একটা গাড়ি থামতেই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিম। তা দেখে চৈত্রিকার অবাকতা যেন আকাশচুম্বী। অপরপাশ হতে দিহানও বেরিয়ে এসেছে। আচমকা বোন কে দেখে মিম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভাব ঠিক চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার অবস্থা। চৈত্রিকা স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ দিহান ভাইয়ার সাথে আসলি যে?তোকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। ‘
‘ তার জন্যই তো তোমার বোন কে জোর করে নিয়ে এলাম। আমার গাড়ি করে আসতে রাজি হচ্ছিল না।’
সহজ গলায় বললো দিহান। চৈত্রিকা ঠোঁট ছড়িয়ে প্রতুত্তর করে,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। মিম বাসায় যা।’

মিম মাথা দুলিয়ে চলে গেল। দিহান সেদিক থেকে নজর সরিয়ে চৈত্রিকার দিকে চেয়ে বললো,
‘ স্যরি চৈত্রিকা। আমার মায়ের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত আমি।’
চৈত্রিকা অস্বস্তিতে পড়ে গেল তৎক্ষনাৎ। দিহান হুট করে এমন বলে বসবে ভাবে নি সে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
‘ স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। আমার আন্টির প্রতি কোনো রাগ নেই। ‘
এতটুকু বলে ক্ষীণ শ্বাস ফেলল। থেমে থেকে দ্বিধান্বিত চাহনি নিয়ে বললো,
‘ সাফারাত সন্ধ্যায় বাসায় থাকে ভাইয়া?’
‘ থাকে। তোমার জন্য চব্বিশ ঘণ্টাই ফ্রী।’
‘ জ্বি?’
‘ কিছু না। চলে যেও। আসি আমি।’
কথাটা বলে দিহান গাড়িতে উঠে পড়ল। চৈত্রিকা ডুবে গেল ভাবনায়। সাফারাতের বাসায় দ্বিতীয় বার পা রাখবে কি-না তা ভেবে।
_________________

একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে। দারোয়ান তাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সন্ধ্যে বেলার আবছা রক্তিম আলোয় পিছন দিকটা অস্পষ্ট। চৈত্রিকা থম মেরে রইল। মেয়েটাকে ঢুকতে দিচ্ছে না তাকে দিবে তো!নাকি আবার অপমান করবে?কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল মেয়েটা দারোয়ান কে থ্রে/ট দিচ্ছে। চাকরি খে/য়ে দিবে বলে রাগ দেখাচ্ছে। কন্ঠে তেজ,অহংকার। দারোয়ান বলছে– সাফারাত স্যার আপনারে ঢুকতে দিতে নিষেধ করছে ম্যাম। আপনে চইলা যান। মেয়েটা ত্যাড়ামি করে পাল্টা বলে উঠল-
‘আমার মামার বাড়ি আমাকে ঢুকতে দিবি না। দেখে নিব তোদের। সাফারাত নিজেই আমাকে নিবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’

মেয়েটা সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গাড়িতে উঠে চলে গেল। এবার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেল চৈত্রিকা। এটা তো তাকে থাপ্পড় দেওয়া সেই মেয়েটা। এ বাড়ির সদস্যই তো মনে হয়েছিল। কিন্তু তাকে ঢুকতে দিতে নিষেধ কেন করল সাফারাত!অবাক ব্যাপার। চৈত্রিকা মাথা না ঘামিয়ে গেইটের কাছে যেতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিল। জিজ্ঞেস অবধি করল না কিছু। এটাই চৈত্রিকাকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। চমকপ্রদ দৃষ্টিতে গুটি গুটি পায়ে ভিতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা গম্ভীর স্বর কর্ণগোচর হতেই মৃদু কেঁপে উঠল পুরো দেহ।
‘ ভিতরে ঢুকে সোজা সিঁড়ি বেয়ে বাম দিকের প্যাসেজওয়ে ধরে কর্ণারের রুমে চলে আসবেন । আপনাকে কেউ আটকাবে না।’

চৈত্রিকা চোখ তুলে তাকাল উপরের দিকে। সাফারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কানে মোবাইল। বুঝতে পারছে না তাকে বললো নাকি অন্য কাউকে। সাফারাত যেন তার দ্বিধান্বিত চাহনি বুঝে গেল। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে চৈত্রিকার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ আপনাকেই বলছি চৈত্র। ‘

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here