#মহুয়া পর্ব ১৬
#শারমিন_আক্তার_সাথী
রিদু প্রিয়তির নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু প্রিয়তি সারা শব্দ করছে না। রিদু প্রিয়তির নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলো নিশ্বাস চলছে, তবে শরীর বেশ ঠান্ডা। রিদু প্রিয়তির গায়ে হাত দিয়ে আলতো করে কয়েকবার নাড়া দিলো। আর ডাকল,
” জান! জান! প্রিয়তি!”
প্রিয়তি পিট পিট করে চোখ মেলল। দেখে মনে হয় চোখ মেলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল কিন্তু শব্দ হলো না। রিদু জোরে জোরে ওর মাকে ডাকল। দিলারা বেগম রুমে এসে বলল,
” কী হলো চিল্লাচ্ছিস কেন?”
রিদু থমথমে গলায় বলল,
” মা দেখো না প্রিয়তি কেমন করছে? ওর শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে। কথা বলছে না। শুধু চোখ পিট পিট করছে।”
দিলারা দ্রুত প্রিয়তি গায়ে হাত রাখলো। বেশ কয়েকবার প্রিয়তিকে ডাকলেন কিন্তু প্রিয়তি চোখ পিট পিট করে তাকানো ছাড়া কোনো উত্তর দিতে পারল না। দিলারা বলল,
” হৃদয় তুই ওকে নিয়ে সামনে আয়। আমি তোর বাবাকে বলছি দ্রুত গাড়ির ব্যবস্থা করতে। হসপিটালে নিতে হবে দ্রুত। আর তোর খালাকে বলছি হসপিটালে আসতে।”
রিদু বলল,
” মা খালাকে বিরক্ত করো না। এমনি কাল রকিবের আকদ। এখন তাকে আমাদের ঝামেলায় না জড়াই।”
” তা অবশ্য ঠিক বলছিস।”
হসপিটালে নিয়ে আসার পর ডাক্তার ভালো করে দেখে বললেন,
” আসলে ভয়ের কিছু নেই। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। প্রেসার ভয়ানক মাত্রায় লো হয়ে গেছে। শরীরে স্যালাইন দিয়েছি একটা। বাকি বার বার খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজ খাওয়াবেন । শরীরে স্যালাইন শেষ হলে পুষ্টিকর এবং পানিজাতীয় খাবার খাওয়াবেন। প্রেসার অতিমাত্রায় লো হয়ে যাবার কারণে শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। আর এই দুর্বলতার কারণে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলো। উনি কী ঠিকমত খায় না?”
দিলারা বলল,
” হ্যাঁ ঠিকমতই তো খায়। তাছাড়া মাস দুই আড়াই আগে ওর একসিডেন্ট হয়েছিলো, তখন মিসক্যারেজও হয়েছিলো, তখন প্রচুর ব্লাড লস হয়েছিলো। কিন্তু কাল তো একদম সুস্থ ছিলো।”
ডাক্তার বলল,
” সে ধাক্কার কারণে শরীর এখনো খুব দুর্বল আর মনে হয় কোনো বিষয় নিয়ে খুব টেনশন করেছেন। যার কারণে হঠাৎ প্রেসার এত লো হয়েছে। কয়েকদিন টানা বিশ্রাম নিলে আর খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ওনার তেমন কোনো মেডিসিনের প্রয়োজন নেই। বিকালের দিকে স্যালাইন শেষ হলে বাসায় নিয়ে যাবেন।”
রিদু বুঝতে পারলো প্রিয়তি কিসের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে রিদুসহ বাকি সবাই যেনো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ডাক্তার চলে যেতেই রিদুর বাবা হারুণ সাহেব বললেন,
” কেমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলাম? রোজ রোজ তাকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াতে হয়। ডাক্তার আর ঔষধের পিছনে কারি কারি টাকা ঢালতে হচ্ছে। রিদু ওর বাবার দিকে চোখ বড় করে তাকাতেই তিনি বললেন, এমন চোখে আমার দিকে তাকাবি না। তোর চোখ রাঙানীকে আমি ভয় পাই না। ভুল তো কিছু বলিনি! আড়াইমাস আগে ওর বোনের কারণে আঘাত পেলো, অসুস্থ হলো। অথচ ওর পরিবার একটা টাকা খরচ করেছে? উল্টা আরো কত কত কথা শোনালো। মেয়ের পিছনে একটা টাকা খরচ করেছে? বরং আমার বংশধর আসতে গিয়েও তাদের কারণে আগমনের আগেই বিদায় নিলো। তখন ওর পিছনে পানির মতো টাকা গেছে।
তারপর ওর নাকি মন ভালো না সে কারণে ঘুরতে গিয়ে কারি কারি টাকা ভেঙে আসলি। তখন অসুস্থতায় অনেকদিন অফিসে যাসনি, ঘুরতে যাবার বাহানায় বন্ধ দিলি, এখন আবার আজ থেকে বন্ধ দিলি। মানে আয়ের কিছু হচ্ছে না শুধু ব্যয় আর ধারদেনা বাড়ছে। এই যে টাকা গুলো খরচ করেছিস তার তো বেশিভাগই তোর ধার করা। বিয়ের সময় কত টাকা দেনা হলো, আর তোদের বিয়ের পর একটার পর একটা ঝামেলার কারণে পানির মত টাকা যাচ্ছে আর আজ এখন আবার। এত টাকা তো গাছে ফলে না। লোকের ঘরে বউ আসে, লক্ষ্মী আসে, ঘরে আয় বাড়ে কিন্তু আমার ঘরে উল্টো আসার পর থেকে খরচ বেড়েই যাচ্ছে, ধারদেনা, অশান্তি বেড়েই যাচ্ছে। ওকে একবারও বলেছিস তুই কত টাকা দেনা আছিস? স্ত্রীর কর্তব্য শুধু স্বামীর টাকায় ঘোরাঘুরি করা আর শপিং করা না, তার ভিতরের খবরটাও রাখা।”
রিদু বেশ রাগ করেই বলল,
” বাবা প্লিজ চুপ করো। ও শুনতে পেলে কী ভাববে? এমন সময় কেউ এসব কথা বলে? তাছাড়া দেখতে গেলে ওর জীবনের সব বিপদের জন্য দায়ী আমিই। কেন? কী কারণ তা নাহয় পরে বলবো? এখন প্লিজ তোমরা এসব টাকা টাকা করা বন্ধ করো। আর বাবা বিয়ের পর স্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব তার স্বামীর, তবে ওর পরিবার কেন ওর চিকিৎসার টাকা দিতে যাবে? আর আমরাইবা তা নিব কেন? আমরা কী এতটা ছোটলোক?”
হারুণ সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। ওখান থেকে চলে গেলেন। ঘরের মধ্যে দিন দিন এতো ঝামেলা তার ভালো লাগছে না। প্রিয়তি নামের মেয়েটা তার ঘরে প্রবেশ করার পর থেকে শনির দশা লাগছে তার ঘরে। যেমন সম্মান হানি হয়েছে, তেমন টাকা পয়সা যাচ্ছে। নেহাৎ মেয়েটাকে দেখলে তার মায়া লাগে। মেয়েটা শ্যামলা বরন মুখে প্রচুর মায়া। মুখের আদল অনেকটা তার মায়ের মতোন। সে কারণে কিছু বলে না। নয়তো এসব কথা মুখের উপর বলে দিতো অনেক আগে।
২২!!
প্রিয়তিকে বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। প্রিয়তিকে রুমে শুইয়ে দিয়ে রিদু কাউকে ফোন দিলো। কথা বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলো। প্রিয়তি রিদুর দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার পাশ ফিরে টেবিল ল্যাম্পটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইল।
রিদু ওর অফিসের বসের সাথে কথা বলছে। তিনি প্রচন্ড রেগে আছে। অবশ্য তার রাগের যথেষ্ট কারণ আছে। নেহাৎ রিদু খুব দক্ষ মেধাবী দেখে এখনো ওকে চাকরি থেকে বাতিল করেনি। নয়তো এতক্ষণে রিদুর চাকরি চলে যেতো। রিদু তাকে বোঝানোর খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু রিদুকে কথা শোনাতে তিনি বিন্দু মাত্র ছাড় দিচ্ছেন না। রিদুর অনেক বোঝানোর পর অবশেষে তিনি এই শর্তে মানলেন ছুটির দিনগুলোতে রিদুকে অফিসের পেনডিং কাজগুলো করতে হবে। রিদু শর্ত মেনে নিলো। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না রিদুর। কারণ এ মুহূর্তে ওর চাকরি যাওয়া মানে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়া। ধার দেনায় ডুবে আছে। সেসব শোধ করতে হবে। তাছাড়া সংসারের খরচ তো আছেই।
বসের সাথে কথা বলে রিদু প্রিয়তির পাশে বসলো। গতকাল রাতের পর প্রিয়তির সাথে কোনো কথা হয়নি ওর। প্রিয়তির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” জান!”
” প্রিয়তি নিশ্চুপ।”
” তুমি এমন চুপ থাকলে আমার কেমন লাগে তা কী তুমি বোঝো না?”
” প্রিয়তি নিশ্চুপ।”
” এতটা টেনশন নিলে যে নিজেকে অসুস্থ করে ফেললে? আমাকে শাস্তি দেয়ার পথ হিসাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?”
” প্রিয়তি নিশ্চুপ।”
” প্রিয়তি আমায় শাস্তি দাও তবুও এমন নিশ্চুপ থেকে নিজেকে কষ্ট দিও না।”
” প্রিয়তি নিশ্চুপ।”
রিদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে কিছু কথা বলবো। তারপর সিদ্ধান্ত তুমি নিও।”
রিদু ওয়াশরুমে চলে যেতেই প্রিয়তির চোখের কোন বেঁয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশেই হারিয়ে গেলো। লোকে সত্যি বলে, মানুষের কষ্টের, গুমরে কাঁদার সবচেয়ে বড় সাক্ষী বিছনার বালিশগুলো। কত মানুষের চোখের জল, বুকের কষ্ট যে বালিশের বুকে সমাহিত তা কেবল বালিশগুলো জানে। মানুষের মত বালিশগুলোতে যদি প্রাণ থাকতো, তবে তারা মানুষের কষ্টের গোপন সাক্ষী হতে গিয়ে নিজেরাই কষ্টে মরে যেতো। তারা যদি বলতে পারতো, তবে হয়তো তারা প্রতিটা মানুষের কষ্টের বর্ণনা সুনিপূণ এবং পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতো। বালিশ প্রাণহীন বলেই কষ্টগুলো খুব যত্নে নিজের মাঝে নিয়ে নিতে পারে।
প্রিয়তি বালিশের পাশে থাকা নিজের ফোনটা হাতে নিলো। কাউকে কল করবে ভাবছিলো। কল করতে নিয়ে দেখল ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে। হয়তো চার্জ নেই। কিন্তু প্রিয়তির এখন বিছানা থেকে উঠে ফোনে চার্জ দিতে ইচ্ছা করছে না। তাই ফোনটাকে পাশে রেখেই চোখ বন্ধ করলো। রিদু ফ্রেশ হয়ে এসে আবার প্রিয়তির পাশে বসে বলল,
” একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে। ভালো লাগত। সারাদিন একই কাপড়ে আছো। জামটা পাল্টে হাত মুখে ধুয়ে মাথায় একটু পানি দাও। দেখবে শরীর হালকা লাগবে।”
প্রিয়তি উঠতে নিলে রিদু ধরলো ওকে। উঠে বসার পর রিদু বলল,
” তোমার ওয়াশরুমে যেতে হবে না। বালতিতে পানি এনে আমি তোমার মাথায় পানি দিয়ে, কাপড় পাল্টে দিচ্ছি।”
প্রিয়তি রিদুর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে উঠে নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। রিদু চুপ করে বসে রইল।
প্রিয়তির শরীর এখনো কাঁপছে। শরীর যে প্রচন্ড দুর্বল তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা জেদের বশে নিজের কাজ নিজে করছে। রিদু দরজার সামনে গিয়ে বলল,
” প্রিয়তি তুমি কাপড় পাল্টে বের হও। আমি ড্রেস ধুঁয়ে দিব।”
কিছুক্ষণ পর প্রিয়তি বের হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে নিজের ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিলো। রিদু তখনই প্রিয়তিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ও জান তুমি এত রাগ করে আছো? হয় ক্ষমা করো নাহয় শাস্তি দাও। তাও এ নীরবতার দেয়াল ভাঙো।”
প্রিয়তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। সে শক্তি ওর নেই। রিদু জড়িয়ে ধরেই বলল,
” সৃষ্টিকর্তা তো বোধ হয় অলরেডি শাস্তি দিয়েছেন এবার তুমি দাও। তাও এমন চুপ থেকে কষ্ট দিও না।”
প্রিয়তি এবার হালকা গলায় বলল,
” সৃষ্টিকর্তা কী শাস্তি দিয়েছেন?”
চলবে_____
আজ লিখতে গিয়ে যা প্যারা সহ্য করছি। কমপক্ষে দশ বার উঠতে হয়েছে। মেজাজ গরম হয়ে ভেবেছিলাম লিখবোই না। কিন্তু আপনাদের কথা দিয়েছি আজ গল্প পোস্ট করবো সে কারণেই লিখলাম।
”কিছু সাদা টিউলিপ” উপন্যাস অর্ডার করেছেন কী? না করলে আমাকে নক করুন।
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/1272922316180443/posts/1964407563698578/