#মহুয়া পর্ব ২৪
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
তিথি রকিবকে নিয়ে রুমে ঢুকতেই রকিব রুমের দরজা বন্ধ করে তিথিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ইস কতদিন পর তোমায় জড়িয়ে ধরলাম।”
” এমনভাবে বলছো যেনো কত বছর পর জড়িয়ে ধরলে। অথচ গত পরশুও কলেজে গিয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করে জড়িয়ে ধরেছিলে।”
” গত পরশু থেকে আজ পর্যন্ত কতটা সময় জানো?”
” হিসাব করতে হবে।”
” দরকার নেই। এখনও নিজের বউকে ঠিকভাবে কাছেই পেলাম না, হিসাব করে কী হবে?”
” তোমার মা মানে শাশুড়ি আম্মা আমাকে সবসময়ের জন্য তোমাদের বাড়ি নিয়ে গেলেই তো পারেন, তাহলেই কাছে পাবে।”
” তোমার পরীক্ষা শেষ না হলে তো সেটা পারছি না।”
” পরীক্ষার তো বেশি দিন বাকি নেই। পরীক্ষার দিনগুলো সহ মাস দুই এর মতো আছে।”
” দুই মাস তোমার কাছে কম মনে হয়?”
” হাসল তিথি।”
” আচ্ছা তিথি তুমি তো এবার এইচএসসি দিবে।”
“হুঁ।”
“তাহলে তোমার বয়স বড়জোর সতেরো কী আঠেরো হতে পারে, ঊনিশ কেন?”
“ছোটবেলা একটু দেরীতে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। কেন? হঠাৎ আমার বয়স নিয়ে পড়লে?”
” না মানে প্রথমে ভেবেছিলাম আমি আন্ডার এইটিন মেয়েকে বিয়ে করেছি। আইনের লোক হয়ে বেয়াইনি কাজ কারবার করব, বুঝতেই পারছ।”
” হুঁ বুঝলাম।”
২৭!!
প্রিয়তি সৌরভের সাথে ফোনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। একটু দূরে বস কান খাড়া করে সব শুনছে রিদু। প্রিয়তির কথা শুনছে আর মনে মনে অট্টহাসি হাসছে। রিদু জানে প্রিয়তি বর্তমানে হৃদিতার কাছে থাকা নতুন সিমে কথা বলছে। কথাগুলো এমনভাবে বলছে যেনো শুনে মনে হয় ওর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলছে। রিদু কথা ধরনে প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল এটা সৌরভ নয় অন্য কেউ। সে কারণে প্রিয়তি যখন ঘুমে ছিলো তখন খুব সাবধানে, লুকিয়ে ওর ফোন সৌরভ নাম দিয়ে সেইভ করা ফোন নাম্বারটা নিয়ে নেয়। তারপর ভাবল কল করে জানবে কার সাথে কথা বলছে? তখন ভাবল যদি পরিচিত কেউ হয় তবে ওর নাম্বার বা কন্ঠ চিনে ফেলতে পারে। সে কারণে বুদ্ধি করে নিজের নাম্বার দিয়ে কল না করে ওর বন্ধুর নাম্বার থেকে কল করল। আর সাথে নিজের মুখে রুমাল চেপে নিল। যাতে করে ওর কন্ঠ চিনতে না পারে। কিন্তু প্রথম কয়েক সেকেন্ড কথা বলেই ও বুঝতে পারল ওটা হৃদি। আর হৃদিরও সন্দেহ হল না কারণ রিদু এমনভাবে কথা বলেছে যেনো শুনে মনে হয় ও ভুল নাম্বারে কল করেছে। সৌরভ মানে হৃদিতার সাথে হাসতে হাসতে কথা বলছে প্রিয়তি। তা দেখে রিদু মনে মনে বলল,
” আহা বেচারি কত চেষ্টা করছে আমাকে জেলাস ফিল করানোর। আচ্ছা আমিও এ নাটকের অবসান আজ রাতে করব। তবে তোমাকে হাতে নাতে ধরে নয় বরং ভালোবেসে। তোমাকে হাতে নাতে ধরলে তুমি অনেক লজ্জা পাবে, অস্বস্তিতে পড়বে তা আমি চাই না।”
রাত দশটার দিকে প্রবল বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধ্যা থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়লেও রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিটাও বেড়েছে। রিদু ভাবল, আজ প্রিয়তির পছন্দের একটা গান গাইবে। গিটারটা নিয়ে বারান্দায় বসে গান ধরল,
এই চলোনা বৃষ্টি তে ভিজি
চলোনা কণ্যা যায় ছাদে
আজ আমরা বৃষ্টি বন্ধী
ভালবাসার অপরাধে
মনে কর তুমি জলের রাণী
আমি বৃষ্টির রাজপুত্র
বাকিটুকো গাইবার আগেই প্রিয়তি বলল,
” বৃষ্টির এমন মনোমুগ্ধকর শব্দ শুনোর পর, আমার কাছে তোমার কন্ঠ কাকের মত লাগছে। বৃষ্টি কোকিল আর তুমি কাক, এহ নিজেকে আবার বৃষ্টির রাজপুত্র বলে। যেই না চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা।”
বেচারা রিদু লজ্জা পেয়ে গান থামিয়ে বলল,
” তাহলে আগে যে বলতে আমার গান তোমার কাছে ভালো লাগে।”
” মনের ভুলে বলেছিলাম হয়তো। গান তো গায় সৌরভ! উফ! কী গানের গলা ওর দূর্দান্ত! একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে লাগে।”
এবার রিদু প্রিয়তির কাছে গিয়ে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে ওর কানে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে বলল,
” তোমার সৌরভকে আমি কচকচ করে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলব।”
” হাত তো দিয়ে দেখো। আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব।”
” নাও খাও। আমি তোমার ভোজন হবার জন্য অধির আগ্রহে বসে আছি।”
রিদুর কথা শুনে প্রিয়তির বেশ হাসি পেলো। প্রিয়তি মুখ টিপে হেসে বলল,
” আমি সেকেন্ড হ্যান্ড মাল খাই না।”
” আমি মাল? যাক ভালো। তবে ম্যাডাম ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমাকে আপনি বহুবার খেয়েছেন। খেয়ে আমাকে পুরা শুকনা ঝিঙের খোসা জালি বানাই দিছেন। যা এখন কোনো কাজে লাগে না।”
প্রিয়তির এবারও বেশ হাসি পেলো। তাও মুখ টিপে বলল,
” প্রথমে তো আর আমি খাইনি। ভ্রমর হয়ে তখন আপনি অন্য ফুলের মধু খেয়ে নিজেকে বিলিয়ে বেড়িয়েছিলেন।”
রিদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” প্রিয়তি আর কত? এখন সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রিয় তুমি নিজেও ভালো করে জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। হয়ত আমি অতীতে বড় একটা ভুল করেছি, তবে আমার সে অতীত আমার সুন্দর বর্তমানকে নষ্ট করছে আর তুমি যেমন করছো তাতে তো আমাদের ভবিষ্যৎও খারাপ হয়ে যাবে। অতীত নিয়ে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নষ্ট করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়!”
” এ জন্যই গুনীজনরা কোনো কাজ করার আগে ভেবে করতে বলেন।”
” কিন্তু সে গুনীজনরাই আবার বলেন মানুষ মাত্রই ভুল।”
প্রিয়তি কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর একটু ভেবে বলল,
” ঠিক আছে আজ তোমাকে ক্ষমা করব, যদি পাঁচ সেকেন্ড সময় এর মধ্যে একটা বাংলা বাক্যের ইংরেজী ট্রানসেলেশন বলতে পারো তবে।”
” কি বাক্য?”
” মানুষ মাত্রই ভুল এটার ট্রানসেলেশন করো।”
রিদু কিছু না ভেবেই হুট করে বলে ফেলল,
” ম্যান ইজ মট্রাল।”
প্রিয়তি শব্দ করে হেসে বলল,
” বাহ! বাহ! এই তোমার এম বি এ করার নমুনা?”
রিদু পরোক্ষনে জিবে কামড় দিয়ে বলল,
” না মানে বাক্যটা হবে, পিপল আর জাস্ট রং।”
” পাঁচ সেকেন্ড অনেক আগেই শেষ।”
” আসলে বন্ধুদের সাথে এটা নিয়ে বহু দুষ্টুমি করার ফলে এমন হয়েছে।”
” সেটা আমার জানার বিষয় না। তুমি ফেল করছো। মাফি ক্যান্সেল।”
রিদু প্রিয়তিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” প্লিজ প্রিয় অনেক হয়েছে এবার প্লিজ এসব বন্ধ করো। আই লাভ ইউ।”
প্রিয়তি রিদুকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। তা দেখে রিদু প্রিয়তিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুলে নাক ঘসল। এবার প্রিয়তি খানিক সন্নিধ্য পেলে রিদুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রিদুর হাত ধরে বলল,
” রিদু একটা কথা বলি। জাস্ট ইমাজিন করবে তুমি বিষয়টা।”
” হুঁ বলো।”
প্রিয়তি রিদুর কপালে চুমো আঁকল। তারপর ওকে বিছানায় বসিয়ে ওর চুলে হাত বুলোতে বুলাতে বলল,
” আমাকে এভাবে বসে জড়িয়ে ধরো রিদু। যতক্ষণ না আমি ছাড়তে বলবো ততক্ষণ ছাড়বে না প্লিজ। বলো প্রমিজ”
রিদু মনে মনে ভাবল হয়ত প্রিয়তি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তাই বসা অবস্থায় প্রিয়তির কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কোমরে চুমোও আঁকল কয়েকটা। তারপর আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
” প্রমিজ ছাড়ব না। এখন বলো?”
প্রিয়তি রিদুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” জাস্ট চিন্তা করো আমার বিয়ের আগে আমার একটা ফ্রেন্ড ছিলো যার নাম সৌরভ। তার সাথে আমার গভীর অন্তঃরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো। আমরা একে অপরের সাথে বহুবার শারীরিক সম্পর্ক করেছি। সৌরভের বাচ্চা আমার পেটে আসল। তারপর আমি সে বাচ্চা এবরশন করে ফেললাম। আমাদের বিয়ের পর তোমাকে সবটা বললাম। তখন তুমি কী সহজে ক্ষমা করতে আমায়?”
রিদুর হাত অলরেডি ঢিলা হয়ে গিয়েছে। প্রিয়তি আবার বলল,
” একবার ভাবো আমার শরীরের গোপন প্রাইভেট পার্টগুলো যেখানে কেবল তুমি স্পর্শ করেছো, কিন্তু এখন জানতে পারলে সেসব স্থানে তোমার পূর্বেও কারো ছোঁয়া আছে। কেউ দিনের পর দিন সেসব স্থান স্পর্শ করেছে। যেসব গোপন কাজ মানে ফিজিক্যাল রিলেশন আমি তোমার সাথে করেছি, তোমার পূর্বেও সেসব কাজ আমি অন্য কারো সাথে করেছি। যে গর্ভে তোমার ভ্রুন ছিল, সেখানে পূর্বেও কারো ভ্রুন স্থান পেয়েছিলো। এসব শোনার পর আমার প্রতি তোমার ঠিক কী রিয়াকশন হতো? খুব সহজে ক্ষমা করতে পারতে আমাকে? যদিও সৌরভ নামের কেউ নেই আমার জীবনে। তাকে নিয়ে এতদিন যা বলেছি সব মিথ্যা। ফোনে সৌরভ নামে যে নাম্বার সেইভ করা সেটা আসলে হৃদির। এখন বলো, নিজেকে আমার জায়গায় রেখে ভাবো, পারতে কী এত সহজে ক্ষমা করতে?”
রিদুর হাত সেই কখনই প্রিয়তিকে ছেড়ে দিয়েছে। ওর চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল ঝরছে। প্রিয়তি রিদুর কপালে চুমো খেয়ে বলল,
” থাক তোমার কিছু বলতে হবে না। তোমার অনুশোচনাময় চোখদুটো আমাকে সব বলে দিয়েছে। যাও ক্ষমা করে দিলাম তোমাকে।”
তারপর প্রিয়তি যেতে নিলে রিদু প্রিয়তির হাত ধরে বলল,
” না প্রিয়তি তুমি আমাকে এত সহজে ক্ষমা করো না। আমি সত্যি ক্ষমা পাবার যোগ্য নই।”
প্রিয়তি কিছুই বলল না শুধু রিদুকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকের মাঝে। আর রিদু কান্নায় ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তির জামা ওড়না।”
প্রিয়তি রিদুর মাথা তুলে ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
” অনুশোচনার থেকে বড় কোনো শাস্তি নেই রিদু। আমি চাই তুমি বুঝতে পারো তুমি যেটা করেছো সেটা কত বড় অন্যায়!”
” সেটা আমি বহুদিন আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ভেতরে ভেতরে অনুশোচনার আগুনে জ্বলছিলাম। কিন্তু আজ তুমি যেভাবে বললে সেভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। সত্যি আজ তোমার বলার পর বুঝলাম আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তুমি আমাকে একদম ক্ষমা করো না প্রিয়তি, একদম না। আমাকে শাস্তি দাও যতদিন না পর্যন্ত তোমার মন শান্ত হয় ততদিন পর্যন্ত শাস্তি দাও। আমার শাস্তি হওয়া দরকার, খুব দরকার। আমার স্থানে তুমি হলে হয়ত আমি তোমাকে সহজে ক্ষমা করতে পারতাম না। তবে তুুমি কেন সহজে ক্ষমা করবে।”
প্রিয়তি রিদুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আজ অনুশোচনার আগুনে পুড়ে রিদু তার ভালোবাসাকে জয় করে নিয়েছে। রিদু তুমি নিজেও জানো না কতটা ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে আমি কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তোমার ভিতরের অনুশোচনাটা আমি ঠিকভাবে দেখতে চাইতাম তাই এতদিন এতদূরে থাকা।”
রিদু কিছু বলছেই না। লজ্জায়, নিজের প্রতি ঘৃণায় মাথা প্রিয়তির বুকেই লুকিয়ে রেখেছে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে ওর।
রাত গভীর তখন।
রিদু প্রিয়তিকে যতটা পারা যায় ততটা গভীরভাবে নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। প্রিয়তির কপালে ভালোবাসার গভীর পরশ দিয়ে মনে মনে বলল,
” আর তোমার সাথে কোনো রকম ধোঁকা করব না। মিথ্যা বলব না তোমার সাথে। আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি প্রিয়তি।”
২৮!!
নিজের প্রেগনেন্সি টেস্ট কিটে ফলাফল পজেটিভ দেখে থ মেরে বসে পড়ল তিথি। বিড়বিড় করে বলল,
” হয়ত আমার সব স্বপ্ন শেষ। ডাক্তার হওয়া বুঝি আমার কপালে নেই।”
চলবে______
আগামী কাল গল্পের নতুন পর্বের পর থাকছে ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ। দোয়া করবেন।
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/1272922316180443/posts/2163885693750763/