#সুখের_নেশায় পর্ব ৪২

0
688

#সুখের_নেশায় পর্ব ৪২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা

মৃ’ত্যুর খবর টা সাফারাতকে দিতেই ও মাথা চেপে ফ্লোরে বসে পড়ে। বিড়বিড় করে শুধু এতটুকুই বলে–‘ বাংলাদেশের টিকেট কাটো খালা মণি।’ টিকিট পাই তা-ও শুধু একটা। তাই সাফারাতকে পাঠিয়ে দিই আমরা। সিয়ার দাফনের পর দিন ছেলেটা বাংলাদেশ পৌঁছায়। মা’য়ের মুখটা শেষ বারের মতো দেখার সৌভাগ্য তার হয় নি।

আমরা সবাই টিকেট পেয়ে যাই দু’দিন পরের৷ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এহমাদ বাড়িতে গিয়ে দেখি ঝড় বৃষ্টিতে আমার ছেলেটা গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে। গেইটের ধারে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে ওকে ভিজতে দেখে আমরা সকলে হতভম্ব হয়ে পড়ি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আয়ান, তোমার খালু টেনেও ওকে এক চুল নড়াতে পারছিল না।

অকস্মাৎ এসবের কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। বাংলাদেশ আসার পর সাফারাত কেন আমার ফোন ধরে নি,সে কেন নিজের বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না আমার। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল ছেলেটাকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে। দারোয়ান কে বলি আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিতে। সাথে সাথেই মুখের উপর না করে দেয় দারোয়ান। আমি যেন কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। সাফারাতকে নিয়ে এই বাসায় আসতেই আব্বা কে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? আমার ছেলের এ অবস্থা কেন?তখন আব্বা -আম্মা দু’জনেই জীবিত ছিলেন। আব্বা এক এক করে সব খুলে বলে আমাকে। সিয়ার মৃ’ত্যু হয় আগুনে পুড়ে। কিচেনে রান্না করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যায় ও। সেদিন বাসায় কেউ ছিল না। সুফিয়া বেগম হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। কারণ আগের দিন রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উনার। ফারুক নাকি অফিসে ছিল। ওকে দারোয়ান ফোন করে জানায় সিয়া আগুনে পুড়ে গেছে,ওরা হসপিটালে নিয়ে এসেছে ওকে। ফারুক তখন ওদের মুখের উপর বলে দেয় ” মরলে যেন ফোন করে জানায়। তার আগে একটা ফোনও যেন না করে। ”

সিয়ার দাফনের কাজটা পর্যন্ত সে করে নি। সাফারাতের চাচা হামিদ করে। কিন্তু ওরা’ও নিজেদের নিকৃষ্ট রূপ দেখিয়েছে। বাংলাদেশে এসেই যখন সাফারাত এই বাড়ির গেট পেরোয় দারোয়ানের মাধ্যমে সাফারাত কে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তারা। সাফারাত যে ওদের কিছু হয় সম্পর্কে তা নিমিষেই অস্বীকার করে বলে, এই বাড়িতে সাফারাতের কোনো জায়গা নেই। বাড়িটা এখন ওদের। সুফিয়া বেগমের আহাজারিতে’ও ওরা সাফারাতকে ঢুকতে দেয় নি। ছেলেটা তখন পাথর হয়ে যায়। নিজের বাবার সাথে দেখা করতে চায়। ফারুক তার মুখের উপর বলে দেয়,” মায়ের সাথে সাথে তুমি ম’রে গেলেই পারতে সাফারাত। তাহলে কোনো পিছুটান থাকত না আমার। ”

একটা সন্তান যখন বাবার মুখে এমন বাক্য শুনে সে কি তখনই অর্ধ ম’রে যায় না?আত্মার মৃ’ত্যু হয় না? আমার ছেলেটা’ও শেষ হয়ে গিয়েছিল। আপন মানুষদের প্রতারণায় ওর অনুভূতিরা মৃত্যুবরণ করেছিল।

সিয়ার মৃত্যুর সাতদিন পরেই ফারুক সেই ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করে কানাডা পাড়ি জমায়। বছরের পর বছর অফিস থেকে মোটা অংকের টাকা নিজের একাউন্টে ট্রান্সফার করে সে। তা দিয়ে বউ নিয়ে কানাডায় নিজের সংসার সাজায়,বিলাসিতা করে। আর সাফারাত প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে মরছিল মা’য়ের উপর হওয়া এক একটা অত্যাচারের কথা জানতে পেরে,বাবার নিকৃষ্ট রূপ টা জানতে পেরে,চাচা-চাচীর প্রতারণা সহ্য করে। আমি ওকে এভাবে দেখতে পারছিলাম না। আমাদের লয়ার দ্বারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বাড়িসহ সব সম্পত্তি সিয়া সাফারাতের নামে লিখে দিয়েছে ওর মৃ’ত্যুর কয়েকদিন পূর্বেই। আমি সাফারাতকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। সব জেনে ওর চাচা-চাচী চুপসে যায় নিমিষেই। মা’য়ের রুমে গিয়ে সিয়ার ডায়েরি টা খুঁজে বের করে সাফারাত। সিয়া ডায়েরি লিখতে পছন্দ করত। তাতে লিখে যায় ওর জীবনের প্রত্যেক টা মুহুর্ত। ফারুকের করা অত্যাচার, পরকীয়া সবকিছুই উল্লেখ থাকে। অত্যাধিক দরদী সিয়া নিজের ডায়েরি তে এটাও লিখে যায় এ পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষকে যেন সাফারাত আগলে রাখে। মা’য়ের কথার খেলাপ করতে পারল না ও। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও চাচা-চাচী কে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিল। দাদির সাথে একটা দিন কাটিয়ে পরের দিন-ই আমাদের নিয়ে পাড়ি দিল সে জার্মানিতে। সেদিন থেকেই সাফারাত চুপ হয়ে যায়। গম্ভীর খোলসে আবৃত করে নেয় নিজেকে। আমার কাছ থেকে সাজেশন চাইত জীবনে কি করলে এতটাই শক্ত হওয়া যাবে যাতে কেউ ভাঙার সুযোগ না পায়। আমি ওকে বলতাম মোটিভেশনাল বই পড়তে। বিভিন্ন বক্তার কাছে নিয়ে যেতাম। কম বয়সেই শিখালাম বিজনেস হ্যান্ডেল করতে। কারণ তখন ওদের বিজনেস নিভু নিভু ছিল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমরা সবাই এমন এক সাফারাতকে আবিষ্কার করি যাকে অতিশয় কষ্টও ছুঁতে পারে না। আজকের এই গম্ভীর, গাম্ভীর্য ভরা সাফারাত হওয়ার পেছনে রয়েছে ওর অপ্রকাশিত কষ্ট, কান্না। ছেলেটা কাঁদে নি,মা’য়ের মৃত্যুতে’ও না।

চৈত্রিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। এত অবিচার? এত কষ্ট?বাবা না-কি অমানুষ ছিল ফারুক?যেই লোক স্ত্রীর একটু বয়স করে বাচ্চা নেওয়ায় স্ত্রীকে অমানবিক, নিষ্ঠুরভাবে অবহেলা,অত্যাচার করেছে তারই আজ বুড়ো বয়সে সন্তান রয়েছে। আচ্ছা দোষটা কি সাফারাতের মায়ের ছিল?সন্তানটা তো লোকটারই অংশ ছিল। চৈত্রিকা কি-না সেই জা’নোয়ারের সাথে মিলিয়ে দিত চেয়েছিল সাফারাত কে?হ্যাঁ! জা’নোয়ার। এসব মানুষকে কখনও বাবা বলা যায় না। চৈত্রিকার ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে অপরাধবোধে,নিজের করা চেষ্টায়। আলো বেগমের দু’হাত জড়িয়ে ধরল ও। ডুকরে কেঁদে উঠে ভাঙা গলায় বললো,

‘ আমি,,,,আমি ওই খারাপ মানুষটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম খালা মণি। সাফারাতের সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম উনাকে। ‘

আলো বেগম থমকে গেলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন -‘ মানে?’
চৈত্রিকা সব খুলে বলল। আলো বেগম ওর হাত ধরে বললেন,
‘ এই মেয়ে সাফারাত যদি জানে ওই লোকের সাথে দেখা করার জন্য তুমি শপিংমলে গিয়েছিলে,ওর সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছ তাহলে ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। তুমি ওর অন্যতম দুর্বলতা। ও নিজেকে যতই শক্ত জাহির করুক আমি তো জানি ওর সবটা জুড়ে তুমি। বর্তমান সময়ে ওর একমাত্র ভরসা,বিশ্বাসের স্থান তুমি। ‘

‘ আমি এই কারণে সবটা জানতে চেয়েছি খালা মণি। তবুও আমি ভুল করে ফেলেছি উনাকে লুকিয়ে। অজান্তেই উনার বিশ্বাসে আ’ঘাত করেছি। উনি জানলে হয়ত আমায় কখনও ক্ষমা করবেন না। ‘
‘ ঠিক আছে। ও জানে না তো। তুমি,,’

বলতে গিয়ে আলো বেগম থেমে গেলেন। চৈত্রিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে উনার দিকে চেয়ে দেখল উনার দৃষ্টি ভয়ার্ত এবং দরজার দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো চৈত্রিকা। মুহুর্তেই থমকে গেল হৃদস্পন্দন, তার পুরো দুনিয়া। সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে হাত মুঠো করে। রক্তবর্ণ দু চক্ষু। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। তার মুখভঙ্গি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সব শুনে ফেলেছে সে। চৈত্রিকা উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে তার কাছে পৌঁছানোর আগেই দূরে সরে গিয়ে লিফটে উঠে গেল সাফারাত। স্পর্শ করতে পারল না চৈত্রিকা তাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে উদ্যত হলেই আলো হাত টেনে ধরে বলল,
‘ ভিতর থেকে ফোন টা নিয়ে আসো। আমি ফোন দেই ওকে। তুমি চিন্তা করো না। আমি বুঝিয়ে বলব। ভুল বুঝে নি তোমাকে। ‘

চৈত্রিকা ছুটে গিয়ে ফোন আনল। আলো বেগম চিন্তিত হয়ে অনবরত কল দিতে লাগল সাফারাতের নাম্বারে। পাঁচ বারের বেলায় কল টা রিসিভ হল। লাউড স্পিকারে থাকায় কর্ণে ভেসে এল সাফারাতের ধীর কন্ঠস্বর। চৈত্রিকা ফুপিয়ে উঠল। কান্নার দরুন কথা বলতে পারল না মেয়েটা। কান্না গুলো গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তা-ও পারছে না। আলো বেগম ওকে বুকে জড়িয়ে বলে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?গাড়ির আওয়াজ কেন?কোথায় তুই সাফারাত। মেয়েটা কাঁদছে। জলদি ফিরে আয়। ওকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দে। ‘

‘ চৈত্র কোনো ভুল করে নি খালা মণি। উনি শুধু আমার বিশ্বাসে আ’ঘাত করেছেন আমার কাছ থেকে সবটা লুকিয়ে। ভুল টা আমার। যার হাতে নিজের আত্মা সঁপে দিলাম সেই মেয়েটা আমার আত্মার বিনাশ করল। উনাকে কাঁদতে বারণ করো খালা মণি। আমি ফিরে আসব কি-না জানিনা তবে আমার সুখ কে তোমরা আমার মতো করেই আগলে রেখো। কাঁদতে বারণ করো। হয়ত ফিরে আসব কষ্ট টা লাঘব হলেই।’
এতটুকু বলে স্তব্ধ হয়ে গেল সাফারাত। আলো বেগম ডেকে উঠতেই মলিন স্বরে বললো,
‘ আমার সন্তান কষ্ট পাবে কাঁদলে। চৈত্র প্রেগন্যান্ট খালা মণি। ‘

খুশির সংবাদ পেয়ে খুশি হবে না-কি সাফারাতের কথা শুনে কাঁদবে চৈত্রিকা?ওর যে পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে পড়েছে। হাতড়ে’ও ছুঁতে পারছে না ও সাফারাতকে। ঢোক গিলে উত্তেজিত, অস্থির কন্ঠে ডেকে উঠল সে,
‘ সাফারাত!’
সাফারাত শুনল। তবে কিছুই বলল না। চৈত্রিকা জোর গলায় আবারও ডেকে উঠল,

‘ এই সাফারাত? ফিরে আসুন প্লিজ। কোথায় যাচ্ছেন আপনি?বিশ্বাস করুন আমি ভালো থাকব না। শেষ হয়ে যাবে আপনার চৈত্র মাস। আপনাকে ছাড়া,,’

বাকি কথাগুলো থেকে গেল কন্ঠনালিতে। সাফারাত ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। কান থেকে ব্লুটুথ টা একটানে খুলে সাফারাত গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। দুর্বোধ্য হেসে সমাপ্ত করল চৈত্রিকার অসমাপ্ত কথাটা, বাক্যটা,

‘ আমিও আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না চৈত্র। কিন্তু একি করলেন আপনি? কেন তাজা করলেন আমার পুরোনো ক্ষত?’

সাফারাত গালে তরল কিছু অনুভব করল। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে গেল কি?চোখ বুঁজে ফেলল সে। ভেসে উঠল মা’য়ের সেই সুন্দর চাঁদ মুখখানা।

#চলবে,,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here