#সুখের_নেশায় পর্ব ৪৬
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
বাহিরে আঁধার নেমে এসেছে। সেই অন্ধকার,অমানিশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্বেই টুপটুপ করে জ্বলে উঠল ময়ূখ। তাদের দীপ্ততা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল পুরো ঘরময়। সাফারাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেজাজ চরম তপ্ত হয়ে আছে তার। মাথা,ঘাড় ব্যাথায় টনটন করছে। বিকেল হতে এই কক্ষে আসে নি চৈত্রিকা। তাকে দেখার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হয়ে সাফারাত বেজায় বিরক্ত, রাগান্বিত। সুঠাম, তাগড়া,বলিষ্ঠ পুরুষালি শরীর টায় এখনও আগের ন্যায় ফিরে আসে নি শক্তি। ডাক্তারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা শরীরে যেন জোর না দেয়। মস্তিষ্কের মতোন ক্ষত হাত-পাও। হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। দাঁড়ানো টা-ই কষ্টকর হয়ে যায়। পায়ের প্লাস্টার টা গতকাল খোলা হয়েছে। সাফারাতের এসব বিষয়ে তোয়াক্কা নেই। তার ফর্সা মুখটা রক্তিম রঙে রাঙানো। ভিতরে ভিতরে ক্রোধ। দরজা পর্যন্ত হেঁটে এসে গলা উঁচিয়ে প্যাসেজওয়ে ধরে টইটই করে চলন্ত মিনাকে ডাকল। স্থির হলো মিনা। উল্টো ঘুরে এক প্রকার দৌড়ে ছুটে এলো। অবাক স্বরে তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ কিছু কইবেন স্যার? আপনে উঠছেন ক্যান?কিছু লাগলে আমারে কন। ‘
সাফারাত চোখ রাঙিয়ে তাকালো। রোষপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ চৈত্র কোথায়?’
‘ ভাবী?ভাবীরে তো কতক্ষণ আগে ছাঁদে যাইতে দেখলাম। আইচ্ছা আমি এহনই ডাকতে যাইতাছি। ‘
‘ তোমার যেতে হবে না৷ আমি যাবো। নিচে যাও তুমি। ‘
‘ আচ্ছা স্যার। ‘
মিনা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে চলে গেল নিচে। সাফারাত আস্তেধীরে হেঁটে ছাদের সিঁড়ি অভিমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। অসুস্থ পা দুটো নিয়ে কিভাবে ভাঙ্গবে এতগুলো সিঁড়ি? ভেবেই গরম মেজাজ টা বেশ চটে গেল। সকল অসুস্থতা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে। সময় লাগল,একটু আকটু কষ্ট হলো কিন্তু রাগ কমলো না। এত খামখেয়ালিপনা পছন্দ না তার। রাতের বেলা ছাদে তা-ও প্রেগন্যান্সি অবস্থায়। চৈত্রিকা কি বুঝতে পারলো না তাকে না দেখে কি হাল হবে তার প্রাণপুরুষের?ছাদের দরজা পার করে ঢুকতেই ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে গেল সাফারাতের। পুরো ছাদের মেঝেময় ছোট ছোট প্রদীপ বাতি জ্বলছে। সকল বাতি ডিঙিয়ে ছাদের অন্যপাশে যেতেই চক্ষে বিঁধল একটা মেয়ের শাড়ির আঁচল মেঝেতে পড়ে আছে। আঁচল টা লাল বর্ণের। টুকটুকে লাল একটা শাড়ি। শাড়ি টা চিনতে সময় লাগল না। এটা তার জীবনের প্রথম নারীর,তার মায়ের।
এক গাছি চুল আঁচলের পাশাপাশি মেঝে স্পর্শ করছে। ঝুঁকে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত মেয়েটা। চিকন ঠোঁটের কার্নিশে বহমান স্মিত হাসি। সাফারাত থমকে গেল। থমকালো তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। দৃষ্টি স্থির,অনঢ়।
মেয়েটা কানে গুঁজে রাখা একটা লাল রঙা জারবেরা। কারো উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে চট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো সে। এক জোড়া মন্ত্রমুগ্ধ মিশ্রিত নেত্রের চাহনি দেখে ভড়কে গেল। দ্রুত গতিতে দাঁড়িয়ে ছুটে এসে উদ্বেল মাখা,উদভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ একা একা এসেছেন?আপনার তো পায়ে ব্যাথা। আমিই নিয়ে আসতাম। একা আসতে গেলেন কেন?কষ্ট হয় নি?’
ওষ্ঠদ্বয়ে একটা আঙুল ঠেকতেই কন্ঠনালিতে আটকা পড়ল চৈত্রিকার সকল প্রশ্ন। তিরতির করে কেঁপে উঠল ওর দু ঠোঁট। সাফারাত অধর প্রসারিত করলো ক্ষীণ। ঠোঁটে আঙ্গুল টা দিয়ে আরেকটু চাপ দিল। তাতে যেন আরো প্রবলভাবে কাঁপল দু’ঠোঁট। সাফারাত টের পেল তা। চৈত্রিকার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল তৎক্ষনাৎ। গভীর চোখের চাউনিতে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে যাচ্ছে সে। সাফারাত চারদিকে চোখ বুলিয়ে কানের কাছে মুখ এগিয়ে আনল। বাড়িয়ে দিল চৈত্রিকার বক্ষস্পন্দন। ফিচেল স্বরে বলে উঠল,
‘ বিকেল হতে ছাদে বাসরঘর সাজাচ্ছিলেন?একবারও ভাবলেন না আপনার স্বামীর মুড আছে কি-না বাসর করার। ‘
চৈত্রিকার বুকে উত্তাল পাতাল ঢেউ গর্জে উঠতে শুরু করলো নিমিষেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। ফাঁকা ঢোক গিলল সে। চক্ষুদ্বয় পিটপিট করে বললো,
‘ শুভ জন্মদিন। ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশ হলো। একটু বড় হলেন,একটু বুড়ো হলেন। ‘
সাফারাত এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,
‘ সারাদিন উইশ করলেন না। এখন করলেন। জন্মদিন যখন শেষ হওয়ার পথে। ‘
‘ শেষ হয় নি। রাত বারোটা অব্দি সময় থাকে। ‘
‘ আপনি এত বছরেও আমার জন্ম তারিখ টা ভুলেন নি। কিন্তু আপনার জন্মদিন টা যে কবে?’
আকাশে চন্দ্রিমা উপস্থিত হয়েছে নিজের অপার সৌন্দর্য নিয়ে। তাহার রুপে আলোকিত পুরো ছাদ। প্রদীপের আলোয় জ্বলজ্বল ছাদে চৈত্রিকার পুরো মুখশ্রী হলদে দেখাচ্ছে। ঢের অভিমান চেহারায়। সাফারাত ভুলে গেল ওর জন্ম তারিখ? এই ভালোবাসা? কয়েক বছরের দূরত্বে,বিচ্ছেদে ভুলে গেল?বয়স ছাব্বিশ হোক!মনটা প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সেই কিশোরী জীবনের মতো হয়ে গেল।অভিমানহত হয়ে সাফারাতের কাছ থেকে সরে যেতে নিলে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সাফারাত। শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত পেটে হাত রেখে নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনি সুন্দর চৈত্র মাস। ভীষণ সুন্দর। আম্মু আজ আপনাকে তার শাড়িতে দেখলে বিস্মিত হত। বলত,এই মেয়েটা তো অপ্সরী। কে বলবে এই মেয়েটা শুধু আমার ত্রিশ দিনের ছোট?আপনি তো সদ্য ফোঁটা পদ্ম। ‘
সাফারাতের ঘোর লাগা কন্ঠস্বর মোলায়েম সারা গা,দেহপিঞ্জর কাঁপিয়ে তুলল। শ্বাস ভারী হয়ে এলো চৈত্রিকার। চুলগুলো একপাশে রেখে সাফারাত কানের পিঠে উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে নিল নিজের অভ্যন্তরে। প্রশ্ন করল,
‘ জারবেরা কোথায় পেলেন?’
চৈত্রিকা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না। রয়ে সয়ে বললো,
‘ আনিয়েছি বাজার থেকে। আপনি বিয়ের পর থেকে আমায় দিচ্ছেন না। ‘
সাফারাত সুপ্ত হেসে বলে উঠল,
‘ চালাক হয়ে গেলেন চৈত্র। অবশ্য আপনি চালাক। তবে বোকা শুধু আমার কাছেই। ‘
কথাটা বলেই সাফারাত পাঁজা কোলা করে চৈত্রিকাকে নিয়ে দোলনায় বসে পড়ল। ফর্সা ঘাড়ে থুতুনি ঠেকিয়ে বলে উঠল,
‘ জারবেরার মাধ্যমে ভালোবাসা টা মিস করছেন?’
চৈত্রিকা নিমিষেই উত্তর দিল,
‘ খুব। ‘
‘ এত প্রিয় হয়ে গেল ফুলগুলো? ‘
‘ উঁহু। শুধু মাত্র ভালোবাসার মাধ্যম টা। ‘
সাফারাত ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতেই চৈত্রিকা তার পেটে চাপ প্রয়োগ করা হাত দুটো খামচে ধরে। শ্রবণ হয় গাঢ় স্বরের একটা অদ্ভুত,ভয়ংকর একটা প্রশ্ন।
‘ আপনার প্রথম ভালো লাগা কে চৈত্র? ‘
প্রথম ভালো লাগা?জীবনের প্রথম ভালো লাগা ক’জন মনে রাখে?বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভালো লাগা,পছন্দের পরিবর্তন ঘটে,বদল হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চৈত্রিকার এটা হলেও একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। সাবলীল কন্ঠে প্রতুত্তর করে,
‘ আমার প্রথম ভালো লাগা, প্রথম ভালোবাসা আপনি সাফারাত। ভালোবাসি আমি আপনাকে। খুব ভালোবাসি। কিশোরী জীবনের সেই প্রথম দেখায় আপনাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। শুধু দেরি হয়ে যায় ভালোবাসা টা বুঝতে, অনুভব করতে। ‘
অকপটে স্বীকার করে চৈত্রিকা নিজেই হতভম্ব। আজ সে লজ্জা পেল না। সাফারাতের লহু স্বর শুনতে পায়। হৃদয় নিংড়ানো স্বর।
‘ কয়েক মাস আগে যখন জার্মানি থেকে ফিরে আপনার খুঁজে সিলেট গিয়ে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ঢাকাতে চলে আসি তারপর একদিন জ্যামে আটকা পড়ি। গাড়িতে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম। তখনই চোখে পড়ে একটা সুতি থ্রি পিস পরিহিতা মেয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছে। চৈত্র মাসের গরমে অবস্থা নাজেহাল মেয়েটার। কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। ছোট্ট একটা ফুল বিক্রেতা শিশু এক বালতি জারবেরা নিয়ে মেয়েটার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। মেয়েটা হাসিমুখে একটা জারবেরা হাতে তুলে নেয়। সাথে সাথে একটা ছবি তুলে রাখি আমি মেয়েটার। কারণ আট বছর আগের যেই কিশোরী চৈত্র কে খুঁজতে আমি সিলেট গিয়েছিলাম সে আমার চোখের সামনে,যাকে চিনতে আমার এক মুহুর্তও লাগল না। পার্থক্য সময়ের সাথে মেয়েটার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে একটুখানি। আগের চেয়েও দ্বিগুণ মায়াবিনী,সুন্দর হয়ে উঠেছে। কিছু সেকেন্ড পর সুন্দর সেই চৈত্র নামের মেয়েটা ছোট শিশু টার বালতি তে ফুল টা রেখে গালে হাত বুলিয়ে চলে যায়। সেদিন হতে জারবেরা আমার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিল। হয়ে উঠল আমার প্রেম নিবেদনের মাধ্যম। ‘
চৈত্রিকা চমকিত নয়নে তাকালো সাফারাতের মুখের দিক। সাফারাত তখন মাদকতাময় দৃষ্টি মেলে চিকন অধরের দিকে চেয়ে বললো,
‘ আপনি আমাকে জন্মদিনের গিফট দিবেন না চৈত্র? আমি কিন্তু অগ্রীম গিফট দিয়েছি আপনাকে। যেটা এই মুহুর্তে আপনার পেটে অবস্থান করছে। আর আট মাস পরেই এক ফালি সুখ নিয়ে হাজির হবে। বন্ধুত্বের কোনো সুবিধা পেলাম না। সব নিজেই জোর করে আদায় করতে হয়। অস্থির আমাকেই হতে হয়। ‘
চৈত্রিকা লজ্জা পেল। দখিনা শীতল হাওয়ায় নিভে গেল সবকটা বাতি,শুধু ছাদের মাঝে থাকা একটা প্রদীপ বাদে। তা-ও বাতিটার আগুন নিভু নিভু। চাঁদ মুখ লুকিয়েছে। জোৎস্না বিলীন করছে না আর। সাফারাতের চোখে হাত চেপে ধরল চৈত্রিকা। সাফারাত বাঁধা দিল না। কোমর জরিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল,
‘ রেডি ম্যাম। ‘
চৈত্রিকা নিজের ওষ্ঠযুগল এগিয়ে আনল সমুখের মানুষটার ঠোঁটের কাছাকাছি, অতি নিকটস্থে। বুক টা দুরুদুরু করছে। অস্বাভাবিক শরীরের কার্যকলাপ। শিরায় উপশিরায়,রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো তে নিজের ওষ্ঠাধর আলতো ছোঁয়াতেই সারা দেহ,কায়া বজ্রপাতের ন্যায় কেঁপে উঠল। চোখ বুঁজে মিশিয়ে দিল দু’ অধর। সাফারাত তা সাদরে আঁকড়ে ধরল। পরম সুখের নেশায় মত্ত, মাতাল হলো যেন দু’জনে,দু’টো হৃদপিণ্ড।
____________
চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা চৈত্রিকা বেলকনির রেলিংয়ে এক হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির বড়সড় রাজকীয় গেট দিয়ে প্রবেশ করছে লাশবাহী গাড়িটা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাড়িতে একজন সদস্যের লাশ আসছে অথচ কান্নার রোল পড়ে নি। কারো ক্রন্দন চিৎকার আসছে না চৈত্রিকার কর্ণধারে। চৈত্রিকা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। বিদায়ের সব আয়োজন হয়ে গেছে। কাফনের কাপড়ও রেডি। মৌসুমির চোখ দুটো ফোলা। চৈত্রিকা কে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদল সে। আবেগে নাকি ভুলে বস্তির মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল?চৈত্রিকার হাসি পাচ্ছে। ভীষণ। মৃ’ত্যু মানুষ টার শা*স্তির অবসান ঘটিয়ে দিল। শা*স্তি টা আরেকটু দীর্ঘ হতে পারল না?
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)