#সুখের_নেশায় পর্ব৫৪

0
662

#সুখের_নেশায় পর্ব৫৪
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

পেটে উষ্ম ছোঁয়া পেয়ে চৈত্রিকা চোখ মেলে তাকালো। দেখল আয়মান ছোট, চিকনচাকন ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে ওর পেটে চুমু আঁকছে। নিমিষেই অনেকখানি প্রশস্ত হাসি ওর ঠোঁটের জায়গা দখল করে নেয়। প্রশান্তির নির্মল সমীরণ বয়ে যায় হৃদয়স্থল জুড়ে। হাত বাড়িয়ে আয়মানকে কাছে টানল ও। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আয়মানের গালে চুমু দিল। অতিশয় আদর মেশানো স্পর্শ। মলিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ সুখ কে মিস করছিলে?’
‘ তুমি আমার সুখ কে নিয়ে চলে এলে কেন মামি মণি?’
আয়মানের গম্ভীর কন্ঠের প্রশ্নে চৈত্রিকা আলতো হাসল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে বলে উঠল,
‘ কার সাথে এসেছো?’
‘ দাদুর সাথে। ‘
চৈত্রিকা চমকে উঠল। দ্রুতপদে বললো,
‘ খালা মণির সঙ্গে? ‘
‘ ইয়েস। ‘
‘ কোথায় উনি?’
‘ ড্রইং রুমে। মামার সাথে কথা বলছেন। ‘
সাফারাতের সাথে কথা বলছেন?মনে মনে প্রশ্নটা আওড়ালো চৈত্রিকা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ল। হুট করেই অসুস্থ শরীরে শক্তি অনুভব করলো সে। সাফারাত আবার না আলো বেগমকে কিছু বলে বসে!টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা আয়মানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ তুমি এখানে বসে গেমস খেলো বাবা। আমি আসছি। ‘
আয়মান কপাল কুঁচকে একবার চাইল। পরমুহূর্তেই মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে পড়ল বিছানায়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চৈত্রিকা দরজা পর্যন্ত গিয়ে পুনর্বার ফিরে আসে। বেডসাইডের সেন্টার টেবিলের ড্রয়ার হতে একটা কিটকিট এর প্যাকেট ওর হাতে ধরিয়ে দিল। গতকাল এনেছে সাফারাত চকলেটগুলো। প্র্যাগনেন্সিতে বারংবার চকলেট খাওয়ার ইচ্ছে জাগে চৈত্রিকার। সেই কারণেই ড্রয়ার ভর্তি চকলেট।

বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম নজর নিক্ষেপ করলো দরজার দিকে। মেঝেতে পড়ে থাকা আলো বেগমকে দেখে চৈত্রিকার বুক টা ধ্বক করে উঠল। এক প্রকার দৌড়ে এসে টেনে দাঁড় করালো আলো বেগমকে। সাফারাতের দিকে চেয়ে বিস্ময়মাখা স্বরে বলে উঠল,
‘ খালা মণি এভাবে পড়েছিল, আপনি কি দেখছেন না সাফারাত?’

তাৎক্ষণিক চৈত্রিকার সারা দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল
সাফারাতের অগ্নি দৃষ্টি চক্ষে বিঁধতেই। পাশের টেবিল থেকে ফুলদানি সজোড়ে আছড়ে ফেললো সে। আলো বেগমসহ ভড়কে গেলেন। চৈত্রিকা ওনাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সাহস জোগাড় করতে সক্ষম হলো না, আর না পারল সাফারাতের সান্নিধ্যে যেতে। সাফারাত নিজেই এগিয়ে এলো। চৈত্রিকার দিকে চেয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ প্রকাশ করে বসল,
‘ হাউ ডেয়ার ইউ?সাহস কি করে হলো আপনার চৈত্র, আমার মায়ের খু*নের পরিকল্পনাকারীকে আমার বাসায় ঢোকানোর? ‘

দুই কর্ণ ঝা ঝা করে উঠল চৈত্রিকার। সমগ্র কায়ায় তরঙ্গ খেলে গেল। সেকেন্ডের ব্যবধানেই স্থির, স্তব্ধ হয়ে পড়ল চৈত্রিকা। নেত্র গহ্বর জলে টইটুম্বুর হলো কিন্তু এক ফোঁটাও অশ্রু গড়ালো না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না সংবরণ করলো,কন্ঠনালিতে আটকা পড়া কান্না গিলে ফেলল তৎক্ষনাৎ। মানসপটে উদয় হলো একটা শব্দ। কেবলমাত্র একটা শব্দ। এবং তা হলো-‘ প্রতা’রক। ‘

বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো ও আলো বেগমের মুখশ্রী পানে। এত বড় একটা সত্য উন্মোচন হলো তবুও তাহার চেহারা জুড়ে অশ্রু মাখামাখি। কিসের জল এগুলো?কি কারণসরূপ বিসর্জন দিচ্ছেন তিনি?ছলনা নাকি সত্য? একটা মানুষের এত রূপ কেমন করে থাকতে পারে!চৈত্রিকার বিশ্বাস হচ্ছে না। হজম করতে পারছে না ও সাফারাতের রাগান্বিত কন্ঠে উচ্চারিত সেই বাক্য খানা। ওনি তো মা!সিয়ার পর সাফারাতের দ্বিতীয় মা। কি করে সম্ভব! চৈত্রিকার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোনো রকমে সোফায় বসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি?আপনি সিয়া মা’র হ’ত্যার পরিকল্পনাকারী?মা’র দ্বিতীয় খু*নি?’
আলো বেগমের নিরবতা দেখে সাফারাত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতে লাগল,
‘ চোর কি কখনও বলে আমি চোর?সুফিয়া এহমাদ মৃ’ত্যু’র পূর্বে বলে না গেলে জানতেই পারতাম না কেউ আমার অজান্তেই আমার কলিজার এক অংশ কেটে নিয়েছে বহু আগেই। যার কাছে কঠোর,শক্ত,নির্ভয় হতে শিখলাম সেই কি-না আমাকে বছরখানেক আগে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া আসল মানুষ টা। আপনার মনে আছে চৈত্র সুফিয়া এহমাদের মৃ’ত্যু’র কয়েকদিন আগে থেকে আমি ঘনঘন ওনার রুমে যেতাম?’

চৈত্রিকা ঠান্ডা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সাফারাতের দিকে। কন্ঠনালি গলিয়ে বেরিয়ে এলো — ‘ হু!’
সাফারাত অধর কোণ বাঁকিয়ে আলো বেগমের মুখোমুখি বসল। সোফায় বসে বৃদ্ধাঙ্গুল ঘষলো ললাটের এক অংশে। বললো,

‘ মিসেস আলো আনিয়া আপনি যার সঙ্গে মিলেঝিলে আমার মা’য়ের মৃ’ত্যুর প্ল্যান করলেন সেই সুফিয়া এহমাদ বলে গিয়েছেন আপনিই সর্বপ্রথম আমার মা’কে মা’রার বুদ্ধি টা দিয়েছিলেন। ওনার রুমে যেতাম শরীরের পচন ধরবার ইনজেকশন দেওয়ার জন্য। কথা তো বলতেন তিনি একটু আকটু। আমি স্রেফ ওনাকে ও মিনার মা’কে খু’নী হিসেবে জানতাম। কিন্তু একদিন ওনাকে ইনজেকশন দিতে গিয়ে দেখলাম ওনি খুব অস্থির আচরণ করছেন। বার কতক কাছে ঢাকলেন চোখের ইশারায়, মিহি স্বরে। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কান পাতি ওনার মুখের কাছে। তখনই তিনি আপনার নাম টা নিলেন। ফারুক এহমাদকে আম্মুকে অত্যা/চার করার কারণে এতকাল খু’নি মেনে আসতাম। কিন্তু ওনার আম্মুর উপর এত অত্যা/চারের কারণ যে আপনি ছিলেন তা সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম আমি। ঠিক আট বছর আগে আপনার কাছে আমার মা নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেয়ার করেন। ভরসা করে, আপনভেবে কষ্টগুলো মেলে ধরেন আপনার নিকটে। আপনি সেই সুযোগে প্রথমত আমার মা’র মানসিকভাবে আত্মার মৃ’ত্যু ঘটালেন, তারপর আগুনে জ্বালিয়ে দিলেন দেহটা। যেদিনই জানতে পারলেন আম্মু গর্ভবতী ও তার স্বামী নামক নর*পশু তার সাথে এসব নিয়ে মন মানা মানি, বাক-বিতণ্ডা চালাচ্ছেন ঠিক সেই সুযোগ টা লুফে নিলেন আপনি। জার্মানি থেকে সুফিয়া এহমাদের নাম্বার কালেক্ট করে যোগাযোগ করলেন। ওনার সাথে হাত মিলিয়ে শিখিয়ে দিলেন ঠিক কেমন করে,কিভাবে আমার মা’কে আঘা*ত করতে হবে। আপনার কথা মতোই সুফিয়া এহমাদ কান ভরতেন ফারুক এহমাদের। এমনকি তিনি যখন বললেন,এতকিছুর পরও আম্মু হার মানছে না,কিভাবে আম্মুকে সরানো যাবে তখন আপনি এক বাক্যে বলে দেন মে’রে ফেলতে। সেই রাতেই চট করে ঘন্টা দুয়েক ভেবে আপনি খুবই চমৎকার এক প্ল্যান করেন। সুফিয়া এহমাদ কে বলেন মিথ্যে হার্ট অ্যাটাকের বাহানা ধরে হসপিটালে ভর্তি হয়ে যেতে। সেই সময়টাতে চাচা-চাচীর কয়েকদিনের জন্য ওনার বাবার বাড়ির যাওয়ার কথাটাও আপনাকে জানান সেই বৃদ্ধ মহিলা। তা মাথায় রেখেই আপনি সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যেন কারো কাছে ভুলেও মনে হয় না এটা কোনো হত্যা/কান্ড নই বরং অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। এম আই রাইট মিসেস আলো আনিয়া?’

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থেকেও চৈত্রিকার সারা দেহ ঘেমে চুপেচুপে হয়ে গেল। চুলের গোড়া পর্যন্ত ঘেমে উঠেছে। হৃদস্পন্দন স্পন্দিত হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। শ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। আলো বেগমের কাছ থেকে ছিটকে সরে গেল ও। সোফার হাতল আঁকড়ে ধরে ঘৃ’ণার চক্ষে তাকালো ওনার দিকে। কে এই নারী?কে এই অর্ধবয়স্ক মহিলা? কেউ এমন মুখোশ পড়ে থাকতে পারে?কই সুফিয়া বেগমের শয়*তানী চেহারা দেখে তো আসল রূপ ধরতে বেশিসময় নষ্ট হয় নি চৈত্রিকার!কেমন ঝটপট বুঝে গেল। অথচ কেন এই মহিলার মুগ্ধ চেহারার আড়ালে এত বড় একজন প্রতা/রক লুকিয়ে আছে বুঝতে পারল না ও?নিমিষেই চৈত্রিকার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। জ্বলে উঠল দু’চোখ। কঠোর,কম্পনহীন কন্ঠে চিল্লিয়ে উঠল মেয়েটা,

‘ আপনি এত বড় পিশা’চ?আপনি আমার সাফারাতের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছিলেন?ওনার মা’কে মে’রে ফেলেছেন। কি করে পারলেন আপনি?আপনার বোন ছিল না?মা’য়ের পেটের না হোক রক্তের তো ছিল। মানুষ এতটা জা’লিম কি করে হতে পারে?সবাই কি আপনার মতো শয়*তান হয়? এমন করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকে?কি সুন্দর করে আপনি আমার স্বামীর সব সুখ কেড়ে নিয়ে আদর,মায়া-মমতা দেখাচ্ছিলেন!পারতপক্ষে আপনিই তো সাফারাতের সুখের হত্যা’কারী। নিকৃ/ষ্ট মহিলা আপনি। আমার যদি সাধ্য থাকত আমি আপনাকে এই মুহুর্তে শ্বাস রোধ করে মে’রে ফেলতাম। ‘

চৈত্রিকার এতক্ষণ আটকে রাখা জল বাঁধ ভাঙলো। ডুকরে কেঁদে উঠল মেয়েটা। মন,দেহের দুর্বলতায় কেমন নেতিয়ে পড়ল। হুড়মুড় করে সোফা ছেড়ে তড়িৎ গতিতে ওকে জড়িয়ে ধরে সাফারাত। বুকের মধ্যখানে আগলে নেয়। বেঁধে ফেলে তাকে পেশিবহুল দু’হাতে। প্রিয় প্রাণপুরুষের স্পর্শ পেয়ে চৈত্রিকা ভাঙা গলায় বললো,

‘ প্রিয় মানুষগুলোর এত রূপ কেন থাকে সাফারাত? কেন তারা কঠিন,নিকৃ’ষ্ট,মুখোশধারী হয়?আমাদের অসুখের কারণ কেন তাদেরই হতে হয়?কি করে সহ্য করছেন আপনি?এত সহ্যশক্তি কেন আপনার?’

চৈত্রিকার ক্রমাগত ক্রন্দনমিশ্রিত প্রশ্নের প্রতি উত্তরে মুখ খুললো সাফারাত। বড্ড ভরাট শোনাল সর্বদা গম্ভীরতার চাদরে মুড়িয়ে থাকা মানুষ টার কন্ঠস্বর,

‘ কারণ মাঝে মাঝে সহ্য করে সেই মানুষগুলোক দেখিয়ে দিতে হয় সুখী হয়ে। আপনি আমার চৈত্র মাস। উত্তাপ আপনি,শীতল নই। আমার জন্য কাঁদবেন না। বিশ্বাস করুন কারো বিশ্বাসঘাত’কতা আমার হৃদয় নাড়াতে পারে নি। কারণ আমার জন্য আমার চৈত্র মাস নামক সুখ আছে। ‘

আলো বেগম চুপচাপ থাকতে পারলেন না আর। ধরা গলায় বললেন,
‘ তোর প্রতি আমার ভালোবাসা সত্য সাফারাত। তুই আমার গর্ভে না হলেও আমার ছেলে তুই। ‘
সাফারাত গর্জে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। কন্ঠে ক্রোধ,তেজ,
‘ বেরিয়ে যান আপনি। ‘

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here