#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১৮
শ্রাবণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সে সাগরিকার কাছ থেকে অনেক বড়ো কথা লুকাচ্ছে। সে বলে দিতে চায়। কিন্তু ভয় হয় তার। যদি সাগরিকা তাকে ছেড়ে চলে যায় বা নিজের ক্ষতি করে। এই কথা তো সারাজীবন লুকিয়ে রাখতে পারবে না সে। এক না একদিন সে জেনেই যাবে। শ্রাবণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেল ভাবনার জগতে।
———–
আজ শ্রাবণ খুব খুশি। সে যে কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল সেটা পূরণ করতে সাকসেস হয়েছে। যদিও এটার ক্রেডিট তার অফিসে চাকরি করা কর্মীদের যায় কিন্তু শ্রাবণ পুরো ক্রেডিট নিজে চায়। হাজার হলেও সে বস৷ কোম্পানি তার। কেন কর্মীদের ক্রেডিট দেবে? তারা কাজ করার বিনিময়ে টাকা নেয়। শ্রাবণ ইজি চেয়ারে বসে ভাবছে তার এই বড়ো অর্জনের খুশিতে একটা পার্টি দেয়া যাক। আর এই পার্টিতে আজমাইনকে বলবে সাগরিকাকে নিয়ে আসতে। একবার দেখাতেই মেয়েটা তার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। শ্রাবণ চোখ বন্ধ করলো। এই মেয়েকে না পেলে যে সে পাগল হয়ে যাবে। শ্রাবণ উঠে দাঁড়াল। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“এক্সকিউজ মি লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান।”
সবাই দাঁড়াল শ্রাবণের কথা শুনে। শ্রাবণ হাসিমুখে বলল,
“আপনাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনারা পরিশ্রম করেছেন বলে আজ আমরা এত কিছু অর্জন করতে পেরেছি। আমি আপনাদের সবার নামে একটা পার্টি দিতে চাই। আশা করছি আপনারা সবাই আসবেন।”
সবাই ধন্যবাদ জানাল শ্রাবণকে। শ্রাবণ আবার বলল,
“আমি চাই আপনারা আপনাদের পরিবারের মানুষদেরও নিয়ে আসেন। আপনাদের সাকসেসের অংশ উনারাও হয়।”
সবাই ভীষণ খুশি হলো শ্রাবণের কথা শুনে। শ্রাবণ আজমাইনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর একটা কথা বলতে চাই। আপনারা জানেন আজমাইন খুব বিয়ে করতে যাচ্ছে।”
আজমাইন অবাক হয়ে এদিক সেদিক দেখলো। সবাই আজমাইনকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। শ্রাবণ আবার বলল,
“তাই আমি চাচ্ছি৷ শ্রাবণ তার হবু স্ত্রীকে নিয়ে আসুক। হতে পারে এটা তার বিয়ের আগের শেষ পার্টি হবে। কে জানে বিয়ের পর যদি আমাদের ভাবি তাকে কোনো পার্টিতে আসতে না দেয় আর বলে ‘না ওখানে অন্যান্য মেয়েরা আছে তুমি যাবে না’। সবাই হাসলো শ্রাবণের কথা শুনে। আজমাইন হেসে বলল,
“না স্যার ও অনেক ভালো। কিন্তু আপনি যেহেতু বলেছেন আমি পার্টিতে ওকে নিয়ে আসবো।”
শ্রাবণ খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করলো না। সে সবাইকে যার যার কাজ করতে বলে কেবিনে ফিরে আসলো।
.
.
পার্টি শ্রাবণের বাড়ির ইয়ার্ডেই অর্গানাইজ করা হয়েছে। এখানে অগণিত মানুষের জায়গা হবে। শ্রাবণ একপাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে ওয়েলকাম করছে। সে অপেক্ষা করছে সাগরিকার। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। সাগরিকা আর আজমাইন এগিয়ে আসছে কথা বলতে বলতে। শ্রাবণের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সাগরিকা কালো রং এর ফুল হাতা ওয়ালা থ্রি পিস পড়েছে। তার ফর্সা গায়ে কালো জামা বেশ মানিয়েছে। চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। শ্রাবণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। যেভাবেই হোক এই মেয়েকে সে তার ভাগ্যে নিয়েই আসবে। আজমাইন আর সাগরিকা এগিয়ে আসলো শ্রাবণের সামনে। শ্রাবণ সাগরিকাকে আরো কাছাকাছি দেখে ঢোক গিলল। আজমাইন সালাম দিতেই শ্রাবণের ধ্যান ভাঙলো। সালামের জবাব নিয়ে হাত মেলালো। সাগরিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“হ্যালো বিউটিফুল লেডি।”
সাগরিকা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আজমাইন এত লেইট করলে কেন?”
“ওর জন্য স্যার। বলছিল আসবে না। আমি বললাম স্যার আমাদের দুজনকেই ডেকেছে। অনেক জোর করার পর রাজি হলো।”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেনো ম্যাম? এই গরীবের ছোট্ট পার্টি আপনার ভালো লাগে নি।”
সাগরিকা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“এমন কিছু না। আমার এক্স্যাম সামনে তাই আসতে চাই নি। আর প্লিজ আমি এখন মজা করার মুডে নেই।”
আজমাইন ধমকের স্বরে বলল,
“সাগরিকা চুপ থাকো।”
শ্রাবণ হেসে বলল,
“আরে আজমাইন উনাকে কিছু বলো না। এমন মানুষ খুব ভালো লাগে যারা মুখের উপর নিজের মনের কথা বলে দিতে জানে।”
সাগরিকা বিরক্ত হওয়ার শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আজমাইনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি বলেছিলে আধাঘন্টার বেশি থাকবে না। দ্রুত সবার সাথে দেখা করে নাও।”
আজমাইন লম্বা নিশ্বাস ফেলল। শ্রাবণ তাদের দুজনকে বলল ভেতরে যেতে। আজমাইন সাগরিকাকে নিয়ে ভেতরে গেল। সাগরিকার গোমড়া মুখ দেখে আজমাইন বলল,
“তুমি কেন এমন করছো বলো তো। স্যার কত ভালোবেসে আমাদের ইনভাইট করেছে।”
“তোমাকে আমি বলেছিলাম তোমার স্যারকে আমার অসহ্য লাগে।”
“কিন্তু কেন? উনি অনেক ভালো সাগরিকা।”
“হ্যাঁ ভালো, তাই তো মনে হয় চোখ দিয়েই গিলে খাবে।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ, ছি এমন কেন তোমার ভাবনা চিন্তা?”
সাগরিকা কিছু বলার আগেই শ্রাবণ পাশ দিয়ে এসে বলল,
“হয়তো সাগরিকা আমাকে পছন্দ করে নি।”
আজমাইন চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বলল,
“না..না স্যার আসলে..আসলে..”
সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“কি আসলে আসলে করছো?” সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে পছন্দ করার বিষয় কোথা থেকে আসলো? হ্যাঁ আপনাকে আমার ভালো লাগে না।”
শ্রাবণ হেসে বলল,
“আমি কি জানতে পারি আমি কি করেছি?”
সাগরিকা শ্রাবণের চোখে চোখ রেখে বলল,
“এখন কি মুখে বলতে হবে আপনি কি করেছেন? আপনি ভালো মতো জানেন আপনি কি করেছেন।”
আজমাইন ধমকের স্বরে বলল,
“স্টপ ইট সাগরিকা। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছো।”
শ্রাবণ আজমাইনের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“খবরদার, ও তোমার হবু স্ত্রী হয়। আর তুমি ওকে বকাঝকা করছো?”
সাগরিকা শ্রাবণের মুখে এই কথা শুনে রাগে হনহন করে চলে গেল। আজমাইন মাথা নিচু করে বলল,
“স্যার আমি খুব লজ্জিত। ওর তরফ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”
শ্রাবণ আজমাইনের পিঠে হাত রেখে বলল,
“কাম অন আজমাইন। তুমি আমার ভাইয়ের মতো। ক্ষমা চাইতে হবে না। এক কাজ করো তুমি সাগরিকাকে নিয়ে চলে যাও। ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসো দেখবে রাগ কমে যাবে।”
“ওকে স্যার”
আজমাইন সেদিন সাগরিকাকে নিয়ে চলে গেল। শ্রাবণ সারারাত সাগরিকার কথা ভেবেছে। সে ভেবেছিল সাগরিকা হয়তো এত বড়ো পার্টি দেখে ইমপ্রেস হবে। কিন্তু ইমপ্রেস হওয়ার বদলে শ্রাবণকে আরো অপমান করে গেল। শ্রাবণের গা জ্বলছে রাগে। শ্রাবণ এক প্যাকেট সিগারেট পুরো শেষ করলো। সারারাত জেগে ভেবেছে কি করা যায়।
পরেরদিন, শ্রাবণ সাগরিকার ডিটেইলস বের করিয়েছে। ডিটেইলস দেখে যেন তার লটারি লেগে গিয়েছে। সাগরিকা বাবা এক নাম্বারের নে*শা*খোর। আর লোভীও ভীষণ। সাগরিকাকে পেতে হলে তার বাবাকে হাত করতে হবে। শ্রাবণ তাই করলো। সাগরিকার বাবা সেইদিন রাতে রাস্তায় বসে ম*দ খাচ্ছিল। শ্রাবণ গিয়ে তার সাথে আলাপ করলো। ম*দ খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিলো। নে*শাখোর মানুষদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো তারা নে*শা*গ্রস্ত অবস্থায় যাকে তাকে বিশ্বাস করে ফেলে। সাগরিকার বাবাও তাই করলো। সেদিন থেকে শুরু হয় শ্রাবণের প্ল্যান। সে প্রতিদিন সাগরিকার বাবার সাথে দেখা করতো। তাকে টাকা দিতো। আবার তাকে সুস্থ সবল বাসার নিচে দিয়ে চলে যেত। সাগরিকার বাবা বাসায় গিয়ে শ্রাবণের খুব প্রশংসা করতো। শ্রাবণ নিজের নাম বলেনি তাই সাগরিকা আর সূর্য মানুষটার নাম জানতো না।
প্রায় ৩ মাস পর, শ্রাবণ সাগরিকার বাবাকে হাত করে ফেলেছে। তার বাবা এখন প্রতিদিন শ্রাবণের অপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সাগরিকার পরীক্ষাও শেষ। আজমাইনের কাছ থেকে শ্রাণ শুনেছে সে খুব তাড়াতাড়ি সাগরিকার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। শ্রাবণের যেভাবেই হোক কিছু একটা করতে হবে। অফিস শেষে শ্রাবণ আবার গেল সাগরিকার বাবার কাছে। সাগরিকার বাবা ম*দ খেতে খেতে হেটে যাচ্ছে। পাশাপাশি শ্রাবণ রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ বলল,
“আংকেল একটা কথা বলি?”
সাগরিকার বাবা থেমে গেল। হেলেদুলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সব দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বলো বাপজান বলো”
“আপনি বলেছিলেন আপনার একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আছে।”
“হ্যাঁ”
“আমি যদি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই আপনি কি রাজি হবেন?”
সাগরিকার বাবা থমকে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাগী কন্ঠে বলল,
“ওই ছেলেটা তো আমার মেয়ের পেছনে পড়ে আছে।”
শ্রাবণ বুঝতে পারলো সাগরিকার বাবা আজমাইনের কথা বলছে। এর মানে সাগরিকার বাবা আজমাইনকে অপছন্দ করে। শ্রাবণ আরো খুশি হলো। তার ভাগ্য এত ভালো সে আগে বুঝতে পারে নি। শ্রাবণ হেসে সাগরিকার বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সেই ছেলের চিন্তা আপনার করতে হবে না। আপনি শুধু বলুন আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন কি-না?”
“কিন্তু আমার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর যদি তুমি আমাকে টাকা না দাও?”
“আপনি আমার উপর বিশ্বাস করেন না? আমি ওয়াদা করছি আমি প্রতিদিন আপনাকে টাকা দেবো। যত চাইবেন তত দেবো। তো আংকেল বলুন, আপনি কি সাগরিকাকে আমার স্ত্রী হওয়ার অনুমতি দিবেন?”
সাগরিকা বাবা হেসে মাথা নাড়িয়ে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরলো। তার শরীরের গন্ধে শ্রাবণ নিজের নাক চেপে ধরলো। কোনো মতো নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
“তাহলে বলুন আমি কবে আসবো বরযাত্রা নিয়ে?”
“আজই আসো”
“আরে আজ কিভাবে সম্ভব? আপনার আগে সাগরিকাকে মানাতে হবে।”
“ও মানবে না। ওই ছেলেটা ওর মাথা খারাপ করে রেখেছে।”
“ঠিক আছে, আপনি তাহলে সাগরিকাকে এখন কিছু বলবেন না। আমি আগে আজমাইনের ব্যবস্থা করে নিই।”
সাগরিকার বাবা মাথা নাড়াল।
.
.
কিছুদিন পর….
সাগরিকা ঘরে বসে বই পড়ছিল তখনই বাহির থেকে বাবার কথা বলার শব্দ আসলো। উনি কাকে যেন ওয়েলকাম করছেন। সাগরিকা বই রেখে বাহিরে গেল। প্রায় ৭/৮ জন পুরুষ মানুষ ভেতরে প্রবেশ করছে। সবার হাতে ৬/৭ টা করে শপিং ব্যাগ। সাগরিকা ভ্রু কুঁচকালো সবাইকে দেখে। বাবা সাগরিকাকে দেখে বলল,
“মা, যা জামাইর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আয়।”
সাগরিকার চোখ কপালে উঠে গেল। জামাই মানে? বাবা আবার বলল,
“কি হলো? যা তারাতাড়ি।”
“আব্বু, কি বলছো তুমি এসব? আর কার কথা বলছো?”
তখনই দরজা দিয়ে শ্রাবণ প্রবেশ করে বলল,
“আব্বু আমার কথা বলছে।”
অবাক হওয়ার শেষ সীমানা পাড় করে ফেলল সাগরিকা। তার মাথা যেন ঝিমঝিম করছে। বাবা হেসে শ্রাবণের পিঠে হাত রেখে তাকে বসতে বলল। শ্রাবণ মুচকি হেসে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো। সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“কি হচ্ছে এসব? আর আপনি এখানে কি করছেন?”
“আমার হবু বউ কোন বাসায় থাকে। বাসার পরিস্থিতি কেমন সেটা দেখতে আসছি।”
“হোয়াট ননসেন্স! আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে?”
“হুম, তোমাকে যেদিন প্রথমবার দেখেছি ঠিক সেদিন থেকেই মাথা খারাপ হয়ে আছে। তুমি আমার জীবনে আসলে ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবো।”
“বন্ধ করুন বাজে কথা। আপনি জানেন না আমার বিয়ে ঠিক?”
শ্রাবণ সাগরিকার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আংকেল আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন?”
সাগরিকার বাবা বলল,
“না না বাবা ও মিথ্যে বলছে। তোমাকে বলেছি না একটা ছেলে ওর মাথা খারাপ করে রেখেছে। আমি তো ওই ছেলেটাকে একদমই পছন্দ করি না। রাস্তার ভিখারি একটা।”
সাগরিকা রাগে চিৎকার করে বলল,
“খবরদার আব্বু, আজমাইনের সম্পর্কে আর একটা উল্টা পাল্টা কথা বললে আমি ভুলে যাব তুমি কে।”
সাগরিকার বাবা তেড়ে এসে সাগরিকার গালে চড় মেরে বলল,
“এত বড়ো সাহস তোর? নিজের বাবার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলবি?”
শ্রাবণ দাঁড়িয়ে বলল,
“আংকেল প্লিজ ওকে মারবেন না। আমি যাই তাহলে। ভেবেছিলাম আমার মতো অনাথের মাথার উপর আপনি বাবা হয়ে ছায়া দিবেন। সমস্যা নেই, সাগরিকার বিয়ে আপনি আজমাইনের সাথেই দিন।”
সাগরিকার বাবা এই কথা শুনে দ্রুত শ্রাবণের দিকে হেটে এসে বলল,
“না বাবা, তুমিই হবে সাগরিকার স্বামী। তুমি আমাকে বাবা ডেকেছো আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো না।”
শ্রাবণ মনে মনে হাসলো। সাগরিকা বলল,
“তুমি কেমন বাবা? আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিতে চাচ্ছো কেন?”
“চুপ থাক তুই। তুই জানিস শ্রাবণ কে? কত বড়োলোক সে? তোকে রানী করে রাখবে সে।”
“আমি কারোর রানী হতে চাই না। এখনই বের হয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।”
“চুপ থাক সাগরিকা। তোর বিয়ে শ্রাবণের সাথেই হবে। আর কালই হবে।”
সাগরিকার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো। শ্রাবণ সাগরিকার বাবাকে বলল,
“ঠিক আছে আংকেল। আমি তাহলে কালই আসছি বিয়ের জন্য। বিয়ের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিলাম আপনাদের জন্য। আজ আসি তাহলে।”
“ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে”
শ্রাবণ এক নজর সাগরিকাকে দেখে মুচকি হেসে চলে গেল। সাগরিকা ঠাই দাঁড়িয়ে আছে।
আজমাইন গোসল করে বের হলো। খাটের উপর মোবাইল বাজছে। হাতে নিয়ে দেখে সাগরিকার কল। মুচকি হেসে রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে সাগরিকার কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পরলো। নিজের কানে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার স্যার কিভাবে এটা করতে পারে? সাগরিকা এখনই তাকে দেখা করতে বলেছে। আজমাইন দ্রুত বাসা থেকে বের হলো।
সাগরিকা তার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সন্ধ্যা, রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু সাগরিকার সেদিকে খেয়াল নেই। সে কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছে। সে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল তার বাবা এমন কিছু বলেছে যেটা শোনার পর থেকে তার মাথা কাজ করছে না।
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“তোমাকে কেন বলবো?”
“তুই যদি ওই ছেলের কাছে যাস ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
“তোমার হুমকিকে ভয় পাই না আমি। আমি চলে যাচ্ছি আজমাইনের কাছে।”
“ভেবে নে যদি তুই যাস শ্রাবণ আহমের আমাদের সবাইকে মে*রে ফেলবে। তুই ও জানিস শ্রাবণ কেমন।”
সাগরিকা চমকে উঠে বাবার দিকে তাকাল। বাবা আবার বলল,
“আমার কথা ভাবতে হবে না। নিজের ছোটো ভাইয়ের কথা ভাব। সে ঠিক মতো এখনো দুনিয়াও দেখেনি। তার লা*শ দেখতে পারবি নিজের চোখে?”
সাগরিকা কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে তো নিজের জীবন এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারবে না। দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো। সাগরিকা বের হতেই বাবা শ্রাবণকে কল করলো।
“হ্যালো শ্রাবণ, সাগরিকা বেরিয়ে পরলো। তুমি যা শিখিয়ে দিয়েছিলে তা বলেছি ওকে। ভাইয়ের মৃ*ত্যুর কথা শুনেও ও থামলো না।”
“চিন্তা করছেন কেন? সাগরিকার পেছনে আমি লোক লাগিয়েছি৷ সে কোথাও যাবে না।”
কারো ছোঁয়া পেয়ে সাগরিকার হুঁশ ফিরলো। আজমাইন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সাগরিকা কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে জাপ্টে ধরলো আজমাইনকে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আজমাইন তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। সাগরিকা শ্বাস উপরে উঠে গিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। আজমাইন সাগরিকাকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“এত কান্না করার কি আছে এতে? চলো আমরা এখনই বিয়ে করে ফেলি। শ্রাবণ স্যার কিছু করতে পারবে না আমাদের।”
সাগরিকা এক ঝটকায় আজমাইনকে দূর ঠেলে বলল,
“এখনো তোমার মুখে স্যার শব্দ কিভাবে বের হচ্ছে? ওই লোকটা আমাদের জীবন ধ্বংস করতে চাচ্ছে বুঝতে পারছো তুমি?”
“শান্ত হও সাগরিকা। আমি থাকতে তুমি কেন ভয় পাচ্ছো?”
“শ্রাবণ আহমেদ আমাদের মে*রে টুকরো করে ফেলবে। তুমি আন্দাজ করতে পারছো সে কতটা ভয়ংকর মানুষ?”
“হ্যাঁ ঠিক বললে। সে মানুষ। আমরা যেমন ব্যাথা পাই সেও ব্যাথা পায়। তোমার কি মনে হয় আমি চুপচাপ সহ্য করবো এসব? আমি এখনই গিয়ে ওর খবর নিয়ে আসছি।”
“হিরোগিরি পেয়েছো? ওর সাথে বডিগার্ড আছে। তোমার কি মনে হয় তুমি জীবিত ফিরতে পারবে ওর বাসা থেকে?”
আজমাইন সাগরিকার গালে হাত রেখে বলল,
“তোমাকে ছাড়া আমি এমনিতেও ম*রে যাব সাগরিকা।”
সাগরিকা আজমাইনের বুকে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আজমাইনেরও বুক ছিঁড়ে কান্না আসছে। কিন্তু তার এই পরিস্থিতিকে সামলাতেই হবে। সাগরিকা নাক টানতে টানতে বলল,
“আমি একটা কথা ভেবেছি।”
“কি ভেবেছো?”
সাগরিকা মাথা তুলে আজমাইনের দিকে তাকাল। আজমাইনের চেহারা দেখে তার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। এই প্রিয় মুখটা না থেকে থাকবে কিভাবে? আজমাইন সাগরিকার গালে হাত রেখে বলল,
“কি ভেবেছো বলো”
“ভুলে যাও আমাকে।”
“তুমি কি বলছো এসব?”
আজমাইন যেন আকাশ থেকে পরলো। সাগরিকাকে ছেড়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“মাথা ঠিক আছে তোমার? তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো?”
“এ ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো রাস্তা নেই।”
“রাস্তা নেই মানে? তুমি এসব বলে আমাকে কি ভীতু প্রমাণ করতে চাচ্ছো?”
“আমি এটা কখন বললাম আজমাইন? তুমি জানো না শ্রাবণ আহমেদ কতটা পাওয়ারফুল? আমি তোমাকে বলেছিলাম মানুষটা ভালো না। সে একজন গু*ন্ডা। কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করো নি। আর এখন দেখো, আমাদের জীবন এখন ওর হাতে। আমি ওকে বিয়ে না করলে ও আমার বাবা ভাইকে মেরে ফেলবে।”
আজমাইন স্তব্ধ হয়ে গেল। সাগরিকা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আজমাইন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“চলে যেতে চাও আমাকে ছেড়ে?”
“তো কি করবো? তোমার কারণে আজ এসব হয়েছে শুধুমাত্র তোমার কারণে। কতবার বুঝিয়েছি বুঝো নি। এখন আমরা ওর বিরুদ্ধে গেলেই আমাদের পরিবারের ক্ষতি করবে ও। সবার ক্ষতি হতে দেই কিভাবে বলো। এরচেয়ে ভালো ও করতে চাচ্ছে করতে দিই।”
“তুমি ওকে বিয়ে করবে? ধ্বংস হয়ে যাবে তোমার জীবন।”
“এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সবার মৃ*ত্যু হওয়ার চেয়ে ভালো। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাক।”
আজমাইন তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে।সে একা হলে ভয় পেত না। শ্রাবণ তার পরিবার এর মাঝে নিয়ে আসবে সে জানে। সাগরিকা চোখের পানি মুছে বলল,
“আমাকে অনুমতি দাও আজমাইন।”
“চলে যাবে?”
সাগরিকা নিঃশব্দে কাঁদছে। আজমাইন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কেন যাবে তুমি আমাকে ছেড়ে? কেন তুমি স্বার্থপর হচ্ছো?”
সাগরিকা চিৎকার করে বলল,
“কারণ আমি তোমার ক্ষতি হতে দেখতে পারবো না। আমাদের ক্ষমতা নেই শ্রাবণকে থামানোর।”
চারপাশ নিরবতায় ঢেকে গেল। সাগরিকা দ্রুত চোখ মুছে বলল,
“চলে যাচ্ছি আমি। আর খবরদার, তুমি নিজের ও আন্টির ক্ষতি হতে দেবে না। তোমাকে আমার কসম।”
“চলে যাচ্ছো যাও। তোমাকে থামানোর ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু মনে রেখো, যেদিন ক্ষমতায় আসবো তোমাকে ওর চোখের সামনে থেকে নিয়ে আসবো সে কিছু করতে পারবে না।”
সাগরিকা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। প্রিয় মানুষটার মুখ মন ভরে দেখে নেয়ার জন্য তাকিয়ে রইল। কিন্তু মন ভরছে না। এক সময় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। তাকিয়ে থাকলে তো যেতে ইচ্ছে করবে না। আজমাইন দাঁড়িয়ে রইল। সাগরিকা কাঁপা কাঁপা কদম ফেলে চলে যাচ্ছে। আজমাইন এক সময় তাকে ডাকলো। কিন্তু সাগরিকা শোনেও না শোনার ভান ধরে চলে গেল।
তাদের থেকে অনেকটা দূর দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। সাগরিকার চলে যাওয়া দেখে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। ভীষণ শান্তি লাগছে তার। তার পাশের লোকটা বলল,
“স্যার, এখন আমি কি করবো?”
“এই ছেলের উপর নজর রাখো। কাল যখন আমি বিয়ে করতে যাব তুমি বাকিদের নিয়ে বাড়ির নিচে পাহারা দেবে। যদি এই ছেলে আসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে। আর তত পর্যন্ত তার গায়ে হাত তুলবে না যত পর্যন্ত আমি না আসবো।”
“ওকে স্যার”
শ্রাবণ সিগারেটে আর একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বাঁকা হাসি দিলো।
চলবে……..